Saturday, September 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    ছন্দের পরাগায়ন

    তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এগিয়ে চলা বিশেষ জ্ঞান কখনোই থেমে থাকে না; বরং গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তি যথার্থতা কিনা বারবার পরীক্ষা করে দেখে। কারণ চোখ বুজে সোজা পথে হাঁটা বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞানের কাজ নয়; বরং যে ধারণাটি গ্রহণ করা হয়েছে, সেটি সঠিক কিনা প্রতিবার প্রশ্ন করাই তার কাজ। যুক্তির এমন খাড়া দেয়ালের পাশেই কবিরা রচনা করেন ভাবণার মায়াকানণ। যার ভাষায় লুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত মায়া। তবে এই মায়া সর্বদা মসৃণ বা নিখুঁত নয়। সময়ে তা ভাঙাচোরা, রক্তাক্ত; কখনও আবার অপার্থিব সৌন্দর্যের ছোঁয়া। চৌধুরী রওশন ইসলামের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের ছোঁয়াকেই যেন প্রতিফলিত করে।

    বইটিতে, সৌন্দর্যের উপস্থিতি স্পষ্ট হলেও তা সবসময় সম্পূর্ণ নয়, বরং তা যেন একধরনের অসম্পূর্ণ সুখ আর আক্ষেপের প্রতিফলন। কবি সেই অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতায় রূপ দেওয়ার দায়িত্ব তার পাঠকের হাতে তুলে দিলেও বইয়ের শুরুতেই কৈফিয়তের সুরে জানিয়েছেন এই বই লেখার কারন। সেখানেই জানিয়েছেন — এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই পদ্য-ছন্দে লেখা। বস্তুত পদ্য-ছন্দেই তিনি সুখ খুঁজে পান। যদিও এ গ্রন্থের বেশ কিছু পদ্য-কবিতা পদ্য-ছন্দেরও সকল রীতিনীতি মেনে চলেনি। তবু ছন্দ-রসের ঘাটতি মনে হয়নি বলেই সেগুলোকে মলাট-বন্দি করার সাহস কিম্বা দুঃসাহস দেখিয়েছেন কবি। যদিও ইদানিং কবিদের মধ্যে গদ্য-ছন্দের প্রতি আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। কিম্বা এমনও হতে পারে, এই সময়ের পাঠকরাই গদ্য-ছন্দ পছন্দ করছেন।

    অনেকেরই ধারণা, যথেষ্ট প্রমাণও পাওয়া যায়, কবিতার পাঠক নেই বললেই চলে। নিশ্চয়ই তার যৌক্তিক কারণও রয়েছে। হয়তো দুর্বল-মানহীন কবিতার আধিক্যের কারণেই আজ কবিতা-পাঠকের সংখ্যা আঙুলে গোনা যাচ্ছে। যে অল্প কয়েকজন কবিতা-পাঠক এখন সাহিত্যের পথে-ঘাটে দেখা যায়, সে কেবল অল্প কয়েকজন সবল- মানসম্পন্ন কবিদের কৃতিত্বের কারণেই। খ্যাতি পাওয়ার লোভ সামলাতে না-পারা অথবা নিজের লেখা আদৌ মান-সম্মত হচ্ছে কি না, তা যাচায়ের জন্যই মূলতো পাঠকের সামনে আসা চৌধুরী রওশন ইসলামের।

    কবিতা যেন মানবতার এক চিরন্তন উত্তরাধিকার। প্লেটো বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের তুলনায় কবিতা জীবন্ত সত্যের কাছাকাছি।’ এমনই এক জীবন্ত সত্যের কাছাকাছি ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ কবিতার বইটি মানুষের ক্ষত ও নিরাময়ের ওষধি খুঁজতে মোট ৬৮টি কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই বইয়ের কবিতাগুলো এক সুতোয় বাঁধা, যেখানে প্রতিটি শব্দ যেন চিকিৎসক, প্রতিটি ছন্দ যেন দেখায় আরোগ্যের পথ

    দ্বিধা কবিতাটির অক্ষরবৃত্ত ছন্দ চিত্রিত করেছে চেতনাকে— ‘দ্বিধার পাথারে পড়ে থাকি আজীবন/যেদিকে তাকাই থইথই দ্বিধারাশি/কূলহারা দরিয়ায় দ্বিধার চুম্বন/কোন পার হতে কোন পারে লয় ভাসি?/কত কী দেখিতে পাই, দেখি না কতই/দেখা-না-দেখার দ্বিধা-বুদবুদ এসে/মনের অতলে ভীড় করে সে স্বতই;/কেবলি সংশয়ে দ্বিধা-স্রোতে যাই ভেসে।’ আর কখনও বলিনি‘তে তুলে ধরেছেন— ‘আমার আশার গুড়ে বালি দিলো যারা/তাদের চিনি না আমি, জানি না সে কারা/ভুল করে যদি চিনে ফেলি একবার/দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকি গোটা পরিবার/না-চেনা সহজ ভালো, চিনিলে বিপদ/মানব-মুখোশ পরা, আড়ালে শ্বাপদ।’ এমন সমৃদ্ধ কবিতা লেখার পরও বিনয়ের পাশে আবদ্ধ থাকতে গেলে প্রচন্ড মানসিক শক্তি আর সাহসের প্রয়োজন।

    প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সাহিত্য বাঙালি মননে এক বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে সাহিত্যিকরা তাদের কলমকে অস্ত্র বানিয়ে গড়ে তুলেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষ্য। তবে, বর্তমান সময়ে সেই ধারা কিছুটা ম্লান বলে মনে হয়। আধুনিক সাহিত্যিকরা হয়তো আর ততটা আন্তরিকভাবে এই বিষয়ে মনোযোগী হতে পারছেন না, কিংবা হয়তো সমসাময়িক বাস্তবতার চাপেই তাদের এই ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ছে। এখানে গায়ে গায়ে আর একটি প্রশ্নও চলে আসে যে, দৃশ্য মাধ্যমের এই আধিপত্যপূর্ণ যুগে— যেখানে অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের প্রভাব প্রায় সর্বব্যাপী, সেখানে লিখিত শব্দ কি আদৌ প্রতিবাদের কার্যকর বয়ান হয়ে উঠতে পারে? এমন প্রশ্নের মধ্যেও আমরা দেখছি চৌধুরী রওশন ইসলাম অক্লান্ত চারপাশের চলমান সমাজ ও রাজনীতির আবর্তের স্বরূপ-সন্ধানে, দূর থেকে নয়; অংশীদারের সম্প্রিক্ততায়। আর শিল্প ও জীবনের এই বহুমাত্রিকতাকেই ধরতে চেয়েছেন নিজের কবিতায়।

    ডুবতে ডুবতে ভাসি চৌধুরী রওশন ইসলাম
    কবিতা । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৫ । মুদ্রিত মূল্য: ১৮০ টাকা
    ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
    রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/445738
    কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

    আজকের পরিবর্তিত বিশ্ব-বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সাহিত্যের নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা যেনো আগের চেয়ে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এখনকার সাহিত্যের ভাষা হতে হবে এমন, যা সময়ের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং পাঠকের অন্তরে প্রতিবাদ, মানবিকতা আর ভালোবাসার নতুন উদ্যম জাগিয়ে তুলতে পারে। ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ বইয়ের দাবি কবিতা যেনো সেই উদ্যম জাগিয়ে তুলতে চায়— ‘এই যে তোর চোখের নিচে কালি, রাত্রি জেগে থাকা/মিথ্যে হাসির ঝঙ্কারে তোর ব্যথার পাহাড় ঢাকা/সব আমার চোখে পড়ে খুব অবাক হয়ে ভাবি/সেই গত জন্মে আমার কাছে কী ছিল তোর দাবি/দাবি ছিল মস্ত খোলা আকাশ; জোছনা-মাখা রাতে/আধেক ঘুমে জড়িয়ে রবি আমার বুকের সাথে/ বর্ষা এলে দাওয়ায় বসে নকশী কাঁথার ফুলে/একান্ত সব গোপন কথা রাখবি সুতোয় তুলে/দাবি ছিল খুনসুটি মন; তোর দুষ্টু দুটি হাত/ঘোর বর্ষায় দিন-দুপুরেই নামিয়ে দেবে রাত/…….তোর সেই দাবিগুলো সব দিয়েছিস বুঝি বেঁচে/দু’চোখে আজ কালি মাখাস রাতের আঁধার সেঁচে/তোর ব্যথা-ঢাকা হাসি আমি তো চিনি; আমার চোখে/তোর দাবিরা এসে বরষা নামায় নিবিড় শোকে।’

    কবিতা যেন মানবতার এক চিরন্তন উত্তরাধিকার। প্লেটো বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের তুলনায় কবিতা জীবন্ত সত্যের কাছাকাছি।’ এমনই এক জীবন্ত সত্যের কাছাকাছি ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ কবিতার বইটি মানুষের ক্ষত ও নিরাময়ের ওষধি খুঁজতে মোট ৬৮টি কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই বইয়ের কবিতাগুলো এক সুতোয় বাঁধা, যেখানে প্রতিটি শব্দ যেন চিকিৎসক, প্রতিটি ছন্দ যেন দেখায় আরোগ্যের পথ।

    ছন্দের পরাগায়নে কবিতার যে প্রতিশ্রুতি তার মলাটবদ্ধ নামই যেন চৌধুরী রওশন ইসলামের ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’। দেওয়ান আতিকুর রহমানের প্রচ্ছদ ভাবনায় প্রকাশিত হয়েছে সৃজন প্রকাশনি থেকে। চৌধুরী রওশন ইসলামের কিছু প্রকাশভঙ্গির সাথে আমি একমত না হতে পারি, কিছু ক্ষেত্রে তাঁর শব্দচয়ন আমার পছন্দ না হতে পারে; কিন্তু যে সততা ও আন্তরিকতায় তিনি এখানে সমালোচকের অনুমোদনের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের কাব্যিক ও মনুষ্য অনুভূতির বয়ান তৈরি করেছেন; সেই প্রচেষ্টাকে অভিবাদন না জানিয়ে পারা যায় না।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.