Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    কোহলির ‘বিরাট অধ্যায়’

    সাফল্যের আলো দিয়ে অন্ধকার মোছার চেষ্টা একরকমের দুর্ভাগ্যই। দীর্ঘ দিনের জমে ওঠা অন্ধকার অনেক ক্ষেত্রে যেন আলো দিয়েও আর দুর করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। বর্তমান সময়ে আমরা যেন এক চরকিপাকে ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছি, সেখানে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন আর আদর্শ। রাজনীতির হাঁ-মুখের সামনে আমাদের আত্মসমর্পণ দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলাফল— এখন আমাদের হাতে আছে শুধুই শূন্য। এই শূন্য যোগের গণিত যখন আমাদের সবঅর্থেই ক্লান্ত করছে তখন সবুজ মাঠের কোলাহল আমাদের খানিকটা উত্তেজিত করে সত্যি। আর আমাদের সবুজ মাঠের রাজত্ব ক্রিকেটের কাছে।

    ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ক্রিকেট-পাগল। আর ভারতীয়রা একটু বেশীই পাগল। ক্রিকেট ইন্ডিয়ানদের কাছে ধর্মের মত। ক্রিকেট বিশ্বকাপ বা আইপিএল-এর মৌসুমে ভারতে সবচেয়ে বেশি সিক-লিভ এবং আর্ন-লিভ নেওয়া হয়। প্রায় ১৪২ কোটি জনসংখ্যার বিশাল বাজারের কারণে ভারত ক্রিকেটকে নিজেদের করে নিয়েছে বলে মনে করেন এই খেলার অনেক সমর্থক। বাস্তব ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিসিআই-এর অনেক অন্যায় আবদার আসিসি বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল’কে মেনে নিতে দেখা যায়। বিশ্লেষকদের মতে, ক্রিকেটের গ্লোবালাইজেশনের পথে বড় বাধা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। তারা মনে করেন, যেখানে ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা বাড়াচ্ছে; সেখানে ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা না বেড়ে উল্টো কমছে—শুধুমাত্র বিসিসিআই’র চাওয়াতেই এমনটা হচ্ছে।

    এই মতামতে বিশ্বাস করে উপমহাদেশে একটা ইন্ডিয়া-বিরোধী মনোভাবের একটা বলয় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এর বাহিরে নয়। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তানের বাহিরে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচও সমান উত্তেজনা ছড়ায়। এই রাইভালরির পরেও অনেক ভারতীয় ক্রিকেটার আছেন যারা তাদের ক্রিকেটিয় দক্ষতায় এদেশের মানুষের কাছেও হয়ে আছেন রোল মডেল। মো. আজহারউদ্দিন, রাহুল দ্রাবির, গাভাস্কার, গাঙ্গুলী, সচিনের পর হালের বিরাট কোহলির নাম উঠেছে সেই তালিকায়।

    ‘আমি কোহলি হতে চাই’- এদেশের অনেক উঠতি ক্রিকেটারের প্রতিদিনের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে এই বাক্য। কোহলি তাই শুধু একজন ক্রিকেটারের নাম নয়, কোহলি আসলে এক স্বপ্নের নাম। একজন উঠতি ক্রিকেটারের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার নেপথ্য়ে থাকে দীর্ঘদিনের তপস্যা। নিরলস পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, অদম্য় জেদ আর প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে সব প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর এক সংগ্রামী কাহিনি। কোহলিও আগামীর অনুপ্রেরণা হতে নিজের ভালোবাসা ক্রিকেটের প্রতি সব উজাড় করে দিয়েছেন।

    ‘আমি কোহলি হতে চাই’- এদেশের অনেক উঠতি ক্রিকেটারের প্রতিদিনের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে এই বাক্য। কোহলি তাই শুধু একজন ক্রিকেটারের নাম নয়, কোহলি আসলে এক স্বপ্নের নাম। একজন উঠতি ক্রিকেটারের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার নেপথ্য়ে থাকে দীর্ঘদিনের তপস্যা

    একদিনের ক্রিকেটে দ্রুততম ৮ হাজার, ৯ হাজার, ১০ হাজার, ১১ হাজার, ১২ হাজার, ১৩ হাজার রান করা প্লেয়ারটির নাম বিরাট কোহলি। ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি ৮ বার ফুটবলের সর্বোচ্চ খেতাব ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। আর আইসিসির বর্ষসেরা পুরস্কার নয়বার জিতেছেন কোহলি। বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ তার আশেপাশেও নেই। তালিকার দুই নম্বরে আছেন এম এস ধোনি এবং সাঙ্গাকারা—যারা চারবার করে আইসিসির বর্ষসেরা পুরস্কার পেয়েছিলেন। নয়বার আইসিসির বর্ষসেরা খেলোয়াড় পুরস্কার জেতার পাশাপাশি অর্জুন অ্যাওয়ার্ড, পদ্মশ্রী অ্যাওয়ার্ড, রাজীব গান্ধী খেলরত্ন অ্যাওয়ার্ড-ও উঠেছে কোহলির হাতে।

    ২০০৮ সালে ভারতের জার্সিতে অভিষেক। তাঁর সমসাময়িকরা এসেছেন। আবার চলেও গিয়েছেন। নিজেও খারাপ সময় কম দেখেননি বিরাট। ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২-এর প্রথম ৮ মাসে ৭২টা ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলেও কোনও শতরান পাননি তিনি। নিখুঁত যন্ত্রের মতো রান করে যাওয়া কিং কোহলির ব্যাট জাদু হারিয়েছে। পাশ থেকে সরে যাচ্ছে জনতার ভিড়। টের পাচ্ছিলেন বিরাট। কেড়ে নেওয়া হল অধিনায়কত্ব। এই পরিস্থিতিতে কামব্যাক করা তো পরের কথা, ফিরে আসার তাগিদটাই আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় অনেকের। কিন্তু তিনি তো বিরাট। ভিড়ের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তাঁর বরাবরের স্বভাব। তাই বিরাট ফিরলেন, রাজার মতোই। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের ১১ ম্যাচে ৯৫ গড়ে ৭৯৫ রান করে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। যেখানে ৩টা শতকের সাথে আছে ৬টা অর্ধশতক। এই রান তুলেই তিনি ছাপিয়ে গেলেন শচীন তেন্ডুলকরের রেকর্ড। আইসিসি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রানের মালিক এখন তিনিই।

    বিরাট কোহলি মানে শুধু ক্রিকেটার নয়। তাই শুধু ক্রিকেট দিয়ে সত্যিই বোধহয় বিরাট কোহলিকে বোঝা যাবে না। তিনি বিপণন দুনিয়ার পোস্টারবয়, ফোর্বস ইন্ডিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা, তিনি বলিউডি নায়িকার সঙ্গে প্রেমের রূপকথা লেখেন — কিন্তু তিনি নিখুঁত নন। এমন অনেক কথা বলে বসেন, যা ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’-এর ধার ধারে না। ছেলেটি মেজাজি, খেয়ালি। কেউ কেউ বলে থাকেন, ছেলেটি খানিক উদ্ধতও। মাঠে, মাঠের বাইরেও। ছেলেটি আগ্রাসি মেজাজমর্জি কোনোদিন লুকিয়ে রাখতে শেখেনি। ফলত প্রবল সমালোচিত। ছেলেটি তার আবেগের সামনে বাঁধ দেয়নি কোনোদিন। ফলত ছেলেটি বেশ ‘আনপ্রেডিক্টবল’।

    তিন-চার বছর আগের স্মৃতি স্মরণ করতে পারেন। মাঠে কোহলির শরীরী ভাষা ছিল ভীষণ আক্রমণাত্মক। ব্যাটিংয়ে, ফিল্ডিংয়ে এমনকি উদ্‌যাপনেও তীব্র আক্রমণাত্মক মানসিকতা দেখাতেন। ইতিহাস ঘাঁটলে কোহলির অনেক বিতর্কিত উদ্‌যাপনই সামনে চলে আসবে। তবে এসব বিতর্কের অন্য পিঠে আরেকটি কথাও ছড়িয়েছে—কোহলি খেলাটা প্রচণ্ড ভালোবাসেন বলেই মাঠে সব সময় আক্রমণাত্মক মেজাজে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সেই কোহলিকে কি মাঠে দেখা যাচ্ছে? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আরও শান্ত হয়। কোহলির ক্ষেত্রেও বয়সের প্রভাব হয়তো পড়েছে, তবে রূপান্তরের কাজটা তো নিজেকেই করতে হয়েছে! আইসিসির সঙ্গে আলাপচারিতায় সে কথাই বলেছেন কোহলি, ‘গত আড়াই বছরে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সেই রাগী উদ্‌যাপনগুলো এখন অতীত।’

    শুধু ক্রিকেট দিয়ে সত্যিই বোধহয় বিরাট কোহলিকে বোঝা যাবে না। তিনি বিপণন দুনিয়ার পোস্টারবয়, ফোর্বস ইন্ডিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা, তিনি বলিউডি নায়িকার সঙ্গে প্রেমের রূপকথা লেখেন — কিন্তু তিনি নিখুঁত নন। এমন অনেক কথা বলে বসেন, যা ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’-এর ধার ধারে না

    এই তো গত মাসেই বিশ্বকাপে ওয়ানডে শতকের অর্ধশতক করলেন। ওয়ানডেতে শচীন টেন্ডুলকারের ৪৯ শতকের যে রেকর্ডকে অবিনশ্বর বলে ভাবা হতো, সেটা ভেঙেছেন। তা–ও নিজের আদর্শ টেন্ডুলকারকে গ্যালারিতে সাক্ষী বানিয়ে! পশ্চিম দিল্লির এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বিরাট কোহলির জন্ম ১৯৮৮ সালের ৫ নভেম্বর। তাঁর বাবা প্রেম কোহলি পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী এবং মা সারোজ কোহলি একজন গৃহিণী। সচিন তেন্ডুলকর পরবর্তী জমানার অন্যতম সেরা ব্যাটার। সচিন ১০০টি সেঞ্চুরির মালিক। দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছেন কিং কোহলি। টেস্টে ভারতের পঞ্চম সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী বিরাট। বিশ্বের তালিকায় তিনি রয়েছেন ২৩ নম্বর স্থানে। তিন সংস্করণ মিলিয়ে শতকের সংখ্যা এখন ৮০। ৩৫ বছর বয়সী কোহলি কি আরও ২০টি শতক করতে পারবেন? শচীন টেন্ডুলকারের ১০০ শতকের রেকর্ড গড়তে সময় লেগেছে ২৪ বছর ও ৬৬৪ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। কোহলি ৮০ শতক করে ফেলেছেন ১৫ বছরে, তিন সংস্করণ মিলিয়ে তাঁর ম্যাচ সংখ্যা ৫১৭। সময় যে কোহলির পক্ষে আছে, তা বলাই যায়। বিশ্ব ক্রিকেট তাঁকে ডাকে ‘মর্ডান ডে গ্রেট’ নামে৷

    সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুসরণকারীর সংখ্যায় সারা পৃথিবীতে ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি প্রথম তিনের মধ্যে থাকেন। তাঁর আগে (খানিকটা বেশিই আগে) কারা? ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং লিয়োনেল মেসি। মনে রাখতে হবে যে, কোহলি খেলেন এমন একটা খেলা, যা এই গ্রহে মেরেকেটে আট থেকে ১২টা দেশ খেলে। অর্থাৎ, তাঁর ক্যানভাস রোনাল্ডো-মেসির তুলনায় অনেক সঙ্কুচিত। তা সত্ত্বেও এই তীব্র অভিঘাত তাঁর সামাজিক উপস্থিতির। ২৬২ মিলিয়ন ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ারের কোহলিকে একটি মাত্র পোষ্টের জন্য ১৪ কোটি ভারতীয় রুপি দিতে হয়।

    সুনীল গাভাস্কার একবার বলেছিলেন, তুমি যদি ভালো হতে চাও তবে তোমার ট্যালেন্ট থাকতে হবে, যদি তুমি গ্রেট হতে চাও তবে তোমাকে অনুসিলন করতে হবে, আর যদি তুমি সবার চেয়ে সেরা হতে চাও তবে বিরাট কোহলির মতো অ্যাটিটিউড তোমার থাকতে হবে। কোহলির দৈনিক খাবারের মধ্যে ৯০ শতাংশ সেদ্ধ বা ‘স্টিমড’। তাঁর জীবনে কোনও ‘চিট ডে’ (কড়া ডায়েটে থাকাকালীন সপ্তাহের একটা দিন নিজেকে লাই দেওয়া। যা খুশি খেয়ে প্রশ্রয় দেওয়া) নেই। শরীরে ভিটামিন, প্রোটিন এবং জলের পরিমাণ ঠিকঠাক রাখা তাঁর রোজের রুটিনের মধ্যে পড়ে।

    একবার তার এক সাক্ষাৎকারে কোহলিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার কাছে সেরা সাল কোনটা— তখন বিরাট বলেছিলেন প্রতিটা লিপ ইয়ারের বছর তার কাছে সেরা; কারণ সেই বছর একদিন বেশি প্র্যাকটিস করা যায়। বিরাট কোহলি যদি তাঁর কেরিয়ারে আর একটি রানও না-করেন, তা-ও তাঁর সংকল্প, পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ইতিহাস আমাদের যুগে যুগে তাড়িয়ে যাবে। বলবে, প্রতিভার প্রয়োজন নেই। শ্রমিক হও। কারণ বিরাট কোহলি প্রতিভা নন। বিরাট কোহলি জিনিয়াস নন। বিরাট কোহলি পরিশ্রমী। প্রতিভা বীর তৈরি করে না। বীর তৈরি করে পরিশ্রম, সংকল্প, শৃঙ্খলা, অধ্যবসায়, অনুশীলন আর সাফল্যের জন্য গনগনে খিদে। কোহলি শুধু একজন ক্রিকেটার নয়, বরং হার-না-মানা লড়াইয়েরই নাম।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.