Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    কামরুল আলম সিদ্দিকী’র একগুচ্ছ কবিতা

    সেরিব্রালে হারানপাড়া

    সেরিব্রালে হারানপাড়া, রাত জমেছে ঊষে;
    হুঁশ ফিরেছে মনের চুলোয় ধিকিধিকি তুষে!

    তুষের জ্বালে হাড়ের ব্যথায় ওঠছে কথা ভালের—
    টের পেয়েছি পিঁড়ায় তোমার নড়ছে নূপুর কালের!

    একটু ধরো, জ্বালাই কুপি— ঠুলিমুসি খুঁজি,
    ঠুলি তোমার ভাঙছে বেড়াল, মনটা খারাপ বুঝি?

    মুখটা তোল চোখটা দেখি, কোন বিড়ালী নাচে;
    কোন সরালি ডুব দিয়েছে পরের গাঙ্গের মাছে!

    একটু বসে খুলে বলো কীসের তোমার আছর—
    হারান কালের সাপলুডুতে কেমনে খেলে কামড়!

    এই দেখোনা কাঁপছে চেরাগ তোমার দীর্ঘশ্বাসে!
    তোমার মতো ফুঁপাচ্ছে শিষ হাড়ের জারের মাসে।

    একটু বলো— হারানপাড়া ভোগায় নাকি স্নায়ু?
    নাকি আজও ডাক্তার বলেন— বদলে আসুন বায়ু!

    একটু থাকো চোখটা রেখে, ঠুলির কান্দন দেখি—
    ওটার নিচে কীসের কালি? টিকটিকিটার রেকি?

    বলতে বলতে জারের বাতাস খিড়কি-কেওয়ার খুলে
    নরম হাতে নিবিয়ে দিলো চেরাগ তোমার ভুলে।

    বললে তুমি রাত হয়েছে— এবার আমি যাই গো,
    বনের ভেতর মনের পাখি হাই তুলেছে তাই গো!

    সারাংশ:

    সেরিব্রালে হারানো চাঁদ হারানপাড়ার মাথায়,
    ওমের অঙ্কে ঘুম পেরেছে কাব্যতোলা কাঁথায়।

    মাঘ আসেনি আগের মতন, ঘুমায় উতরাল বায়ু;
    শিউলি নড়ে নীরব ফোঁটায়, গণছে কেবল আয়ু!

     

    কোন বাতানের বাতাস রে তুই

    দলকলসের বাসের মগম,
    কেওয়ার খোলা আছিন?
    বসন্ত তুই একলাই এলি—
    কই ফেলেছিস সাকিন?

    দুলালপুরের দোপাটির দুল,
    কই থুইছিস পুতুল?
    বারে বারে ঢেউ তুলে যাস চোখে
    হারিয়ে আমার গোকুল!

    মায়ের কালের গন্ধ বেরোয়
    তুই এলি কেন্ হাওয়া?
    আপন সকল অপর যখন
    যায় কি জীবন বাওয়া?

    কোন বাতানের বাতাস রে তুই—
    দুলালপুরের গল্প?
    তুই এলে কেন হারান বাঁশির
    বিলাপ তোলেন কল্প!

     

    পিঠাপিঠি

    পিঠাপিঠি থাকেনা সময়— সন্ধ্যা ও বিকেল—
    রাত যদি নামে কোনো বিকেল-সন্ধ্যার দেশে;
    বিকেল কি মনে রাখে পিঠের দুপুর—
    যে কীনা বিকেল প্রসবের পর চলে গেছে
    পশ্চিমের কাছে বহুদূর! বিকেল কোলের বোন
    সন্ধ্যাকোলে তুলে দিয়ে চরাচর, গেছে কোন স্বপ্নের সুপুর!

    আমাদের ঠুকাঠুকি পিঠাপিঠি সুখে
    মা আমেনা কতোবার বুঝিয়েছে কতোসব জীবনের দুখ:
    গাঙে গাঙে হয় দেখা—
    বিয়ে হলে তবুও যেন হয়না দেখা
    সহোদর বোনে-বোনে, ভায়ে-ভায়ে মুখ!

    কোলের মেঘকে ডেকে মেঘমায়ে বলেছিলো:
    নামিও না বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর পিঠে,
    পিঠাপিঠি বৃষ্টি তবু ভাইবোন মিলেমিশে
    নামতে নামতে নীরবে নিশ্চিহ্ন এক কাঠফাটা দহপুর!

    সুখে দুখে পর হলে ভুল বোঝে পিঠাপিঠি গ্রাম—
    কত গ্রাম হয় দেখা, হয়না দেখা আর নিজ গ্রামে নাম।
    পিঠাপিঠি বন্ধু, পিঠাপিঠি গ্রাম
    পীঠাপিঠি ভাইবোন, পিঠাপিঠি ঘরদোর
    কাছাকাছি থেকে যেন আজ
    অনর্থক হয়ে ওঠে একদিন সাপে ও নেউল!
    অথচ থাকেনা কিছুই বিনাশে–
    রক্তের খুব কাছে আজ যা,
    তবু ছিঁড়ে বুকপীঠ একদা মানুষ
    ঈর্ষায় বিদ্বেষে নিজেই হারায় নামহীন বহুদূর!

     

    এরপর আর কখনও হয়নি দেখা আমাদের

    এরপর আর কখনো হয়নি দেখা আমাদের!

    দিঘির দক্ষিণ পাড়ে জোছনা আধাঁর ছায়াসহ
    ঈগলের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বুড়ো শিরিষ গাছটি
    কখন যে কাটা পরে গেছে
    আমরা কি জানি?

    এরপর আমাদের বিল বহুরঙ জল নিয়ে
    কতোবার বয়ে গেছে ভাসাইন্যা আষাঢ় শ্রাবণে,
    বৈশাখে আগুনমাঠ কতোবার কেটে নিয়ে গেছে
    তুমিহীন-আমিহীন একাকী কৃষক,
    আমাদের পায়ের তলায় শুকনো ন্যাড়া আর কোনদিন
    ফুটেনি জীবনের রক্তফুল হয়ে!

    নৌকার বিছান পাটি আমার নিরীহ ইঙ্গিতের ভাষা
    কখনো কি বুঝিয়ে দেয়নি বলো তোমাকে চর্যাপদ?
    মাঝগাঙ্গে বৈঠা ধরা আমারই শেখানো প্রয়োজন ছিলো বৈকি!
    শেখানো হয়নি ঝড়ে পূর্বরাগ কীভাবে দেখানো হয়;

    ফলে অস্তরাগে আমাদের চোখের অসহায় অব্যক্ত পানি
    শুকোতে শুকোতে আবহমান নদী ও জলাশয় আজ
    হায় হয়ে গেলো,

    জানো?
    কোটি বছরের মেঠোপথে তোমার আঙুল ধরে শেষরাতে একদিন
    একাকী জোছনায় হাঁটার খুব ইচ্ছে ছিলো,
    পথ-হৃদয়েরা এরমধ্যে পাষাণ হয়েছে কবে অগ্রসর কোলাহলে ,
    এরপর আমাদের আর কখনো হয়নি দেখা
    ফাগুন-চৈতের হৃদয় আলগা করা অনন্ত বাতাসে।
    অমাবস্যা, পূর্ণি ধানতোলা চাতালের কতটা হারিয়ে গেছে
    তোমার-আমার দিন থেকে বলো?
    লোকপলান্তির কতটা রাত আমরা হারিয়ে ফেললাম
    দূর্বিষহ জীবন নগরে।

    অসংগঠিত প্রেমিক ছিলাম বলে তোমার বাড়ির দেওদার গাছে
    লুকিয়ে লুকিয়ে কতোবার কোকিল হয়েছি বলো!
    পরদিন বৃষ্টি হতে আগরাতে চাঁদের পাশে তুমি কি মেঘের ভরণে আমাকে পাওনি?

    নিরীহ প্রেমিক কেন বাসে ভালো?
    নিরীহ নারীরও কখনই খেতে নেই ডুবে ডুবে পানি!
    এখন আগুইন্যা যুগ—
    যে ভস্ম করতে জানে সে পায় ভালোবাসা,
    প্রেম একজোড়া ঘুঘুপাখি—
    অলক্ষে হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকে বুনো হাহাকার,
    আমাদের প্রেম আজ আমাদের মানচিত্র থেকে হারানোর উপক্রমে:
    নিরীহ নদী, নারীর সম্ভ্রম, জীবন আর মানুষের গোলাঘর
    এখন যে গিলে খেতে জানে সেই হয় প্রেম ও ভালোবাসার অধীশ্বর।

    অন্ধকার বাংলার পাশে দাঁড়িয়ে আজও তোমাকে ডাকি!
    আমাদের করমাইর পাশে পূনর্বার তুমি স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী হও;
    আর আমি আরেকবার দিগন্তবিস্তারী বালুতট হই
    মারকুটে যৌবনে—

    ফেলে আসা অবিকল প্রত্ন মানচিত্রে কবিতার পাশে অনন্ত যুবক হয়ে মিশে রই!

     

    মনু মিয়ার গল্প

    আয়ছায় বরাক জারে ঝাট দিয়া উইড়া গেলা ফক্কি!
    পচমে লালি দেখলা, কালি আঞ্জাবালা আমারে দেখলা না
    ফিতলা ডুফি, এই চক্ষে ছাইয়্যা দেহ আইরা ফক্ষির
    চোক সিন্দুর মাহাইছে শোগে, মুখটা ছেওইরা আবুর!
    তুই কি রে কানা ছিলি? তুই কি দুকখুর সায়রও
    দেহছনা? তোরে যে পুষে সইপাছি বালুবাতাবালা
    তামাম আমার গাও, টিয়াফুলে হিয়াফুলে দিয়া
    নাক-কান পরাইরছি, গলায় দিছিলাম বান্নির
    ফুতি, মাতায় গেতিয়া মুরগাফুলে তরে দেখছিলাম
    ফরানে ফাতিয়া, মনে বান্দিয়া গাঙগাট বসিয়া
    এক সত্যি দুই সত্যি তিন সত্যি তুই কইয়্যাছিলি-
    আইওক তুফান কিবা আইওক জর, পুব-পচিম
    চিনবি না তুই, চিনবি রে খালি আমার বারির ফত,
    চিডিত লেকছিলে তুই- “আমার মাতার কিরা দিছি-
    তোমারে ছারিয়া জদি জাই অন্যের বেডার বারি-
    বাসর অইবার আগে কালি গাঙ ডুইব্বা যেন্ মরি”

    আরব্যা জামাই আইলো তর সোনার সন্দুক লইয়্যা-
    বাপ তরে, মাও তরে বুজাইলো সুকে তাকবি পালংকে
    দাস-দাসি লইয়্যা, মনে তুই বাইস্যা গেলি সুকসুক
    বাবে, সন্দে সন্দে মারে ফাডাইছি তর বাফের কাছে-
    একবার দুইবার তিনবার ফিরাইলো বাফে
    আমার কইলজার মারে, এরফর দিছো উরাল সোনা
    আরইব্যা সোনার গরে, এক কুড়ি বছর গোয়াইয়া
    হডাত চাতালে তরে আমি দেখলাম তর বিডাত
    বাফের, চিরকুমার অসুইক্যা দেইখ্যা পরপুরুষ
    আইছায় বরাকজারে জট কইরা উইরা গেলা ফক্কি!
    তুমি যে ডুবলা না গাঙ্গে, রাকলা না কতা চান-সুরুজ
    সাক্ষী রাইক্যা পরানের লগে, দেইক্যাও যে দেহছ না
    আইজ, গাটমুনি দিয়া রাস্তা গুইরা যাই তর বারি
    মুক দলছারা অইয়্যা, এক জলক ফাইতাম যদি
    তর দেহা, কইতাম রে কেমুন আছি আমি অমুক
    গেরামের মনু মিয়া, বাপ-মার এক ফোলা আমি-
    আমার লাইগ্যা মা কানতে কানতে গেছে আশিনে কয়বরে,
    শোগে শোগে বাপধন কবেত্তে জে বিছনায় অসুকে!

    কাজলি খাতুন তুই জাট দিয়া উইরা গেলি জারে!
    আমি গাটমুনি বারি ফিইরা যাই কালি শনিবারে!
    নারী তুই ফিতলা ডুফি দেহছ না চাইয়্যা একবার
    শোগের ফক্কির চোক, মুক তার লালিমার শোগে।

    টীকা: আয়ছা- গ্রামের বসতঘরের ঝোপঝাড়ঘেরাপেছন, কালি আঞ্জাবালা: গ্রাম্য সন্ধা ও রাতের মাঝের অন্ধকার ভয়ংকর সময়,
    কিরা: শপথ, গোয়াইয়া: শেষ কইরা, বিডাত: ভিটায়, গাটমুনি : যেই কাজের লোক সারাদিনের জন্য ভোরবেলা কোন ঘাটে পাওয়া যায়,

     

    জগদ্দল পাথরেরা সরে যাবে

    জগদ্দল পাথরেরা সরে যাবে—

    এই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে
    বারোমাসী জবা
    চামেলি নিঃশ্বাস নেবে,
    নামহীন ঝোপফুলে গন্ধ নেবে দোয়েলেরা।

    প্রাণের আকাশে
    বহুদিন গাছ হয়ে থাকা সুপুরিও এবার মানুষ হবে পৃথিবীতে,
    পাঁজর ভাঙার আগে সজোরে ধাক্কা দেবে পীপিলিকা,
    পাথর গড়িয়ে যাবে জলের স্বাধীনতায়,
    এবার পীপিলিকাও সুবোধ মানুষ হতে চায় নিজেদের পৃথিবীতে,
    রাত তুমি সরে যাও ভোরের কুসুম হয়ে,
    কতোকাল হরিণ ও নেউলেরা গর্ত হয়ে আছে
    মনসার জঙ্গলে।

    মনসা মানুষ হও তোমার বসতে,
    যে বসতে লাল-নীল-কালা ফুল ফুটবে একসাথে,
    যে বসতে বাতাসেরা হবে নিঃশ্বাসের বহমান মুক্তি,
    বসতি বিশ্বাস করবে আকাশকে,
    আকাশ কখনো ঘাতক হবেনা শ্যামল মাটির।

    জগদ্দল পাথরেরা সরে যাবে,
    জড় হয়ে থাকা প্রতিটি কয়লাও হবে
    শক্তির আগুনে মার্চ—

    তারপর ফড়িঙ বলবে কথা শিমুল-শিউলিদের সাথে
    খাঁচার পাখিটা হবে ষোল ডিসেম্বর
    প্রতিটি নদী হবে স্বাধীনতাকামী তিতুমীর,
    প্রতিটি নারীও কালো গুহা ভেঙে হবে আট মার্চ।

    জগদ্দল পাথরেরা সরে যাবে—
    চাপা মাটি ফুঁড়ে হেসে উঠবে চাপাফুল শিশু,
    আগামীর মাটি কেন এই আগুন বহন করবে তুষানল পৃথিবীর!
    আর বলবে খামাখাই— কী শীতল মরুভূমি!
    আগামীর ফুল ফুটতে দাও হে পামর পাথর;
    মানুষ কুসুম হয়ে একদিন বলে ওঠবে
    ভালোবাসি!

    জগদ্দল পাথরেরা সরে যাবে—
    সাগর মন্থন করে সমূলে মানিক খাওয়া পাথরেরা সরে যাবে,
    জল খাওয়া পাথরের বিপক্ষে দাঁড়াবে নদী ও সমুদ্র,

    পাথরেরা সরে যাবে স্বচ্ছ পানির জোয়ারে,
    ফুলের ধাক্কায়।

    পৃথিবী মানুষ হবে
    মানুষেরা বেঁচে থাকবে ফুল হয়ে পাখি হয়ে নদী হয়ে।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.