Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    আলোনসো: আ ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াস

    সভ্যতার সংকট তার রূপ বদলায়। বদলায় না প্রবণতাগুলো। তাই তো বর্তমানের শূন্য সংস্কৃতির আগ্রাসনের জেরে ভুল বানানে শহরের মুখ ঢেকে গেলে অভিযোগের তীর ছোটে তরুনদের দিকে। এসবের মধ্যেও যেসব প্রো-অ্যাক্টিভ তরুনরা জীবনের কাছাকাছি থাকতে চায় তারা জানে কি চলছে ইউরোপের মাঠে। ‘পিপল’স চয়েস’ হোক কিংবা ‘ক্রিটিক্স্‌ শো’! তেইশের ফুটবল বন্দনার পুরোটা জুরেই আছে জাভি আর লেভারকুজেন। এমনটা হওয়া একদিক থেকে খুব স্বাভাবিকই। আবার অস্বাভাবিকও বটে।

    সাবেক লিভারপুল, রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ প্লেয়ার জাভি আলোনসোর সম্ভাবনাময় কোচিং ক্যারিয়ারের কারণে লোকে তাকে প্রফেসর নামে ডাকা শুরু করেছে। এটা শুধুমাত্র লেভারকুজেনকে বুন্দেজলিগার পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার কারণে নয়। বরং লেভারকুজেন যে ব্যান্ডের ফুটবলটা খেলছে সেটা অনেক বেশি বিনোদনমূলক। প্রতি খেলায় গড়ে চার গোল করা কতটা বিনোদনমূলক হতে পারে ফুটবল সমর্থক মাত্রই বুঝতে পারেন। জাভির এই সাফল্য এমন জল্পনা তৈরি করেছে যে— সে হতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ অথবা লিভারপুলের ভবিষ্যৎ ম্যানেজার! কিভাবে এত অল্প সময়ে মাস্টার ট্যাকটিশিয়ান জাভি নিজেকে এই পর্যায় নিয়ে আসলেন—‌ আজকে সেটাই জানব।

    জাভি তার জেনারেশনের সবচেয়ে ভালো মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত। অসাধারণ পাসিং অ্যাবিলিটি, ভীষণ এবং ফুটবল জ্ঞানের কারণে এই স্পেনীয়ার্ডের ছিল একটি অসাধারণ ফুটবল ক্যারিয়ার। সে ছিল স্পেনের সোনালী প্রজন্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ নায়ক; যে অবদান রেখেছিল স্পেনের ফুটবল বিশ্বকাপ এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে। সেই সাথে ইউরোপের তিনটি প্রধান ক্লাবের হয়ে ১৪ টি বড় শিরোপা জয় তার ক্যারিয়ারকে গৌরবান্বিত করেছে।

    ২০০২-০৩ সালে রিয়াল সোসিয়াদাদ শেষ বিশ বছরের মধ্যে অন্যতম সেরা মৌসুম কাটিয়ে ছিল। এবং লা-লিগা জয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিল সোসিয়াদাদ। আর ২১ বছর বয়সি জাভি ছিলেন সেই দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অন্যদিকে লিভারপুলে হ্যাভিয়ের মাসচেরানোর পাশাপাশি থেকে জাভি খেলেছেন ডিপলাইন প্লে-মেকিং রোলে। রিয়াল মাদ্রিদে গিয়ে আরেকটু অ্যাডভান্স রোলে খেললেন মরিনহোর অধিনে। আর খেলোয়ারি জীবনের শেষ সময়ে চলে এলেন পেপ গার্দিওলার সেসময়কার দল বায়ার্ন মিউনিখে। জাভি মনে করেন সেটা ছিল তার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। জাভি মরিয়া ছিলেন পেপ গার্ডিওয়ালার দর্ষণটা নিজের করে নেয়ার জন্য। ৩৫ বছর বয়সে তখনও জাভি ওয়ার্ল্ড ক্লাস প্লেয়ার, হঠাৎ-ই সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের বুট জোড়া তুলে রাখার।

    জাভি তার জেনারেশনের সবচেয়ে ভালো মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত। অসাধারণ পাসিং অ্যাবিলিটি, ভীষণ এবং ফুটবল জ্ঞানের কারণে এই স্পেনীয়ার্ডের ছিল একটি অসাধারণ ফুটবল ক্যারিয়ার। সে ছিল স্পেনের সোনালী প্রজন্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ নায়ক; যে অবদান রেখেছিল স্পেনের ফুটবল বিশ্বকাপ এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে

    জাভি আলোনসো সবসময় ফুটবলের সাথেই ছিলেন। কারণ, তার বাবা পেরিকো আলোনসোও ছিলেন একজন প্রফেশনাল ফুটবল প্লেয়ার। তার ভাই মিকেল আলোনসোও ছিলেন একজন ফুটবলার। তাই তো ২০১৭ সালে খেলা থেকে অবসর নিলেও তার মতো এক ফুটবল জিনিয়াসের এই খেলা থেকে দুরে থাকা সম্ভব হয়নি। উইয়েফা প্রো-লাইসেন্স কোর্স সম্পন্ন করে নাম লেখালেন প্রফেশনাল কোচের খাতায়। রিয়াল মাদ্রিদ অনূর্ধ্ব-১৩ দলের হয়ে জাভি প্রথম কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেখানে তার সাফল্য ছিল অবাক করার মত। ২৩ ম্যাচের মধ্যে ২২টা জয় এবং একটা ড্র; যেখানে ১৪২ গোলের বিপরীতে মাত্র বারোটা গোল খেয়েছিল তার দল। পরের সিজনে জাভি ফিরে গেলেন সেখানে, যেখান থেকে তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল— সেই রিয়াল সোসিয়েদাদে। সেসময় সোসিয়েদাদ-বি ছিল থার্ড টিয়ারের টিম। সেই সিজনে অসাধারণ খেলে তারা ১৯৬২ সালের পর দ্বিতীয় টিয়ারে ফিরে আসে। পরের সীজনে জাভি সোসিয়েদাদ ছেড়ে পাড়ি দেন নতুন গন্তব্যে।

    ১৯৯৩ সালে ডিএফবি পোকাল জয়ের পর আজ পর্যন্ত কোনো শিরোপা জিততে পারেনি লেভারকুজেন। পরপর তিনবার টাইটেল জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও রানার-আপ থেকে যাওয়ার কারনে সমর্থকরা লেভারকুজেন না বলে নেভার-কুজেন ডাকা শুরু করে। বাকি দুনিয়া লেভারকুজেনকে কমফোর্ট জোন মনে করা শুরু দিয়েছিল। কারন এখানে এসে তারা খুব সহজেই জিতে যেত। লেভারকুজেন তাদেরকে কোনো চ্যালেঞ্জই জানাতে পারত না। সেই লেভারকুজেন এখন ইউরোপজুড়ে যে ভয়ঙ্কর ফুটবলটা খেলছে, তার চিত্রনাট্যটা লিখছেন সান সেবাস্তিয়ানের ফুটবল গরনা থেকে উঠে আসা জাবি আলোনসো।

    জোসে মরিনহোর বর্তমান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও তার ফুটবল জ্ঞান নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। মরিনহো ফুটবল নিয়ে বিভিন্ন সময় যেসব ভবিষ্যৎবাণী করেছেন তা প্রায়ই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। একসময় তিনি জাভি আলোনসেকে নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, তার ভেতরে আদর্শ ম্যানেজার হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সে কোচিং পেয়েছে জোজে মরিনহো, গার্দিওলা, আনচেলত্তি, রাফায়েল বেনিতেজ এর মত বিখ্যাত কোচদের কাছে। জাভি আলোনসো বায়ার লেভারকুজেনকে নিয়ে যেটা করে চলছেন সেটা শুধু ইউরোপে নয়—পুরো ফুটবল বিশ্বে হইচইয়ের জন্ম দিয়েছে।

    জাভির মতে— ‘চ্যালেঞ্জ সব সময় আনন্দের, আমি অনুভব করি প্রতিদিনই আমার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আমি এর মধ্যে যা করে ফেলেছি তার জন্য মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেটা আমি চাইনা— আমি বর্তমানে যা করছি সেটার জন্য স্মরণীয় হতে চাই’

    ইয়ুর্গেন ক্লপের— গেগেনপ্রেসিং (এমন একটি প্রেসিং ট্যাক্টিক্স, যেখানে কোন টিম বল পজেশন লস করার পর ডিফেন্সে ড্রপব্যাক করে অর্গানাইজড হওয়ার পরিবর্তে ইমিডিয়েটলি বল পজেশন নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য এটেম্পট নেয়), পেপ গার্দিওলার— পজিশনাল প্লে এবং ফার্নান্দো দিনিজের— রিলেশনিজমকে জাভি আলোনসোকে একত্রিত করেছেন নিজের কোচিং দর্শণে। সেইসাথে মর্ডান ফুটবলের দর্শনের মধ্যকার গ্যাপগুলোকে দুর করে নির্মাণ করেছেন ফুটবলের নতুন ধারা। বিল্ড-আপ থেকে কাউন্টার অ্যাটাক, কাউন্টারপ্রেস— সবভাবেই অবিশ্বাস্যরকম গোল করে যাচ্ছে বায়ার লেভারকুজেন। আর জাভি তার নিজস্ব স্টাইল দিয়ে ফুটবল বিশ্বের মনজোগ আকর্ষণ করে যাচ্ছেন। তার হাত ধরেই লেভারকুজেন ইউরোপের সবচেয়ে বিনোদন দানকারী দলে পরিনত হচ্ছে।

    আলোনসো যখন ২০২২ সালের অক্টোবরে বায়ার লেভারকুজেনের দ্বায়িত্ব নেয়, তখন লেভারকুজেন রেলিগেশন জোনের নিচের দিকে থেকে ধুঁকতে ছিল। পয়েন্ট টেবিলের ১৭-তে থাকা দলটিকে দেখে বিধ্বস্ত লাগছিল। কিন্তু আলোনসো তার তীব্র আক্রমন আর জমাট রক্ষণের দর্শনে মাত্র এক বছরের মধ্যে সেই দলটির পরিচয় বদলে দিল। আর এই সীজনে লেভারকুজেন বুন্দেস লিগার পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ দল। তাদের খেলার ধরণের একটি নির্দিষ্ট নাম দেওয়া অনেক কঠিন, কারণ— তারা নির্দিষ্ট কোনো স্টাইলে বেশি দিন খেলে না। তাদের খেলাকে বুঝতে হলে পরিসংখ্যানে চোখ বুলাতে হবে। এখন পর্যন্ত এই সীজনে সবচেয়ে বেশি পাস খেলা দল তারা। এখন পর্যন্ত লিগের ১৬ ম্যাচে ৪৬ গোলের বিপরীতে গোল হজম করেছে মাত্র ১২ টি।

    লেভারকুজেন প্রতিটা ম্যাচ শুরু করে ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে; তবে শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে যায় ৪-২-৩-১। যেখানে চারজন ডিফেন্ডারের সাথে দুইজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার, দুইজন ইনসাইড ফরওয়ার্ডের সাথে দুই উইংব্যাক আর সামনে স্টাইকার। কিন্তু খেলোয়ারদের কেউই নিজের অবস্থানে ফিক্সড না থেকে প্রতিমুহূর্তে পরস্পরের সাথে অবস্থান পরিবর্তন করে খালি জায়গা খুঁজতে থাকে। এটা কার্যকরভাবে প্রতিমুহূর্তে বিপক্ষ দলের অর্ধে চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং দলের জন্য অনেক ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে। জিকজ্যাক প্যাটার্ন হোক কিংবা ওয়াইড ডায়মন্ড হোক— জাভির ট্যাকটিস লেভারকুজেনকে ইউরোপের ভয়ঙ্কর টিকিটাকায় পরিণত করেছে। জাভি তার দলের পাঁচজনকে ডিফেন্সের দায়িত্ব দিয়েছেন আর বাকি পাঁচজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন গোল করার।

    বাবার ক্লাব সোসিয়েদাদের হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করা জাভি এখন ডাগআউটের মাস্টারমাইন্ড। এই সাফল্যে মজে না থেকে জাভি অনেক দূর এগিয়ে নিতে চান নিজেকে, ফুটবলকে। জাভির মতে— ‘চ্যালেঞ্জ সব সময় আনন্দের, আমি অনুভব করি প্রতিদিনই আমার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আমি এর মধ্যে যা করে ফেলেছি তার জন্য মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেটা আমি চাইনা— আমি বর্তমানে যা করছি সেটার জন্য স্মরণীয় হতে চাই।’

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.