Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    আধুনিক ক্রিকেটে বোলারের অবস্থান

    আধুনিক ক্রিকেট-রাজনীতিতে বল আর বোলারের অবস্থান যেনো বিরোধী শিবিরে। বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের নামে সেখানে ব্যাট হয়েছে মোটা, সীমানা হয়েছে ছোট। বোলারকে মারার জন্য ব্যাটসম্যানের হাতে দেওয়া হয়েছে জিরো জিরো সেভেন (জেমস বন্ড) এর মতো ‘লাইসেন্স টু কিল’ সার্টিফিকেট। এই চক্রে পড়ে অনেক সম্ভাবনাময় বোলারের ক্যারিয়ার চলে যায় আইসিইউ-তে! মানসিক শক্তিতে বলিয়ান কেউ কেউ সেখান থেকে ফিরে আসে সত্যি, কিন্তু কতো অজানা সংখ্যক যে আর ফিরে আসতে পারে না তার হিসেব পাওয়া যায় ক্রিকেটের ডাটাবেজে। বাণিজ্যের শেকলে আবদ্ধ হতে চাওয়া ক্রিকেটে আজ খেলার চেয়ে ধুলা বেশি। তাইতো লাস-ভেগাস বা ব্যাংককের ক্যাসিনোগুলো পেরে উঠছে না হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ক্রিকেট বেটিং সাইট বা জুয়ার অ্যাপসগুলোর সাথে। বাণিজ্যের নামে ওঠা এই ধুলার ঝড় মাঝে মাঝে মাঠের ক্রিকেটেও ফেলে তার কালো ছায়া!

    তবুও, বাণিজ্যকে বাদ দিয়ে আধুনিক ক্রিকেট আজ আর চলতে পারে না। এটা প্রায়শই বলা হয় যে, আধুনিক সীমিত ওভারের ক্রিকেট হল ব্যাট এবং বলের মধ্যে একটি অসম খেলা। আরও বিশেষভাবে বললে টোয়েন্টি-টোয়েন্টি (টি-টোয়েন্টি) ক্রিকেট, যেখানে ব্যাটকে বলের ওপর প্রবলভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ কথা বলার অনেকগুলো কারণ আছে, যেমন  টি-টোয়েন্টি ম্যাচের বেশিরভাগ পিচই ব্যাটসম্যানদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ, যাতে দর্শকদের সন্তুষ্টির জন্য অবিরাম বাউন্ডারি এবং ওভার বাউন্ডারির আগমন নিশ্চিত করা যায়। দ্বিতীয়ত: ব্যাট আজকাল মোটা হয়ে গেছে, এমনকি ছোট মাঠে ব্যাটের ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তে লাগা বলও চার বা ছক্কার জন্য ছোটে। তৃতীয়ত: পাওয়ার প্লে জোনের ভেতরে বা বাইরে আধুনিক টি-টোয়েন্টি (বা এমনকি ওডিআই) খেলায় ফিল্ডিং নিষেধাজ্ঞাগুলো ব্যাটসম্যানদের বাউন্ডারির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই দেওয়া। চতুর্থত: নো বলে ফ্রি-হিট। পঞ্চম: একজন বোলার প্রতি ওভারে শুধুমাত্র একটি বাউন্সার করতে পারে। ষষ্ঠ: লাল বলের তুলনায় টি-টোয়েন্টি বা ওডিআই ক্রিকেটে ব্যবহৃত সাদা বলটি যথেষ্ট সুইং করে না। সাত: বিশ্বের কিছু অংশে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জন্য বাউন্ডারির মাপ খুব ছোট রাখা হয়। সবশেষে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একজন বোলারকে চার বা ছক্কা দিয়ে বিবেচনা করা হয়, যেখানে একজন ব্যাটসম্যান একটি ভাল ডেলিভারির জন্য সর্বাধিক আউট হন এর বেশি কিছু না। এই সমস্ত কারণগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যাটসম্যানদের তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিমুক্ত এবং চাপমুক্ত খেলার পরিবেশ তৈরি করে খেলায় চার-ছক্কার সংখ্যা বাড়িয়ে দর্শক বৃদ্ধির পক্ষে কাজ করে।

    ফলস্বরূপ টিআরপি রেটিং বৃদ্ধি; এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট প্রতিযোগিতার সাথে জড়িত সকল স্টেকহোল্ডারদের বাণিজ্যিক লাভ। এই স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞাপনদাতা (প্রিন্ট এবং মিডিয়া উভয়), ক্রিকেট বোর্ড, খেলোয়াড়, টিম ম্যানেজমেন্ট স্টাফ, টেলিভিশন এবং স্ট্রিমিং চ্যানেল।

    বাণিজ্য-বান্ধব এবং ব্যাট-বলের অন্যায্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মাঝে, বোলারের ফিটনেস, মানসিক এবং শারীরিক উভয় উপেক্ষা করা হয়। যদিও, মানসম্পন্ন বোলারদের দীর্ঘমেয়াদী ভালো পারফরম্যান্সের স্থায়িত্বের জন্য ফিটনেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যাট এবং বলের মধ্যে অন্তর্নিহিত অন্যায়ের সাথে মিলিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বৃদ্ধি বোলারের ফিটনেসের অবহেলায় অবদান রাখছে এবং এর ফলে ক্রিকেটের দীর্ঘ সংস্করণে টেকসই মানসম্পন্ন বোলিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

    টেস্ট ক্রিকেটের টেকসই মানসম্পন্ন বোলিং সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ‘উল্লিখিত অন্যায়’ কারণগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়, বিধায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মানসম্পন্ন বোলারদের শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই অতিরিক্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বোলারের অল্প রান বা ডট বলগুলি ‘সোনার ধুলো’র মতো এবং বেশিরভাগ সময় এগুলোই ব্যাটসম্যানের ওপর বল নষ্ট না করার চাপ তৈরি করে উইকেট পাওয়ার পিছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। ওয়ানডে বা টেস্ট ক্রিকেটে এমনটা হয় না।

    বোলারকে মারার জন্য ব্যাটসম্যানের হাতে দেওয়া হয়েছে জিরো জিরো সেভেন (জেমস বন্ড) এর মতো ‘লাইসেন্স টু কিল’ সার্টিফিকেট। এই চক্রে পড়ে অনেক সম্ভাবনাময় বোলারের ক্যারিয়ার চলে যায় আইসিইউ-তে! মানসিক শক্তিতে বলিয়ান কেউ কেউ সেখান থেকে ফিরে আসে সত্যি, কিন্তু কতো অজানা সংখ্যক যে আর ফিরে আসতে পারে না তার হিসেব পাওয়া যায় ক্রিকেটের ডাটাবেজে

    বোলিংয়ের সময় বেশির ভাগ বোলার দ্রুতগতির ইয়র্কার, ধীরগতির বাউন্সার, কম ফ্লাইটেড স্পিন, নির্ভেজাল লাইন এবং লেন্থ (যা টেস্ট ক্রিকেট এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আলাদা) ঠিক রেখে তাদের বরাদ্দকৃত চার ওভারে রান প্রবাহকে সীমাবদ্ধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। যেটা পেস বোলারদের জন্য অতিরিক্ত মানসিক চাপ ছাড়াও, উরু এবং হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির ঝুঁকি বাড়ায়। দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ বোলার তাদের ইনজুরির আশঙ্কা বৃদ্ধির বিষয়ে জেনে এবং পরবর্তীতে তাদের দীর্ঘ সংস্করণে খেলার সম্ভাবনা কমে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়েও আর্থিক সমৃদ্ধির এই লিগের জন্য নিজেকে আকর্ষণীয়রুপে তুলে ধরতে তৎপর।

    দল হেরে গেলে একজন বোলার কতটা ভালো বল করেছিল তা খুব কমই মনে রাখা হয় – শুধুমাত্র একজন কতটা খারাপ বোলিং করেছে সেটা মনে রাখা হয়। তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য নেতিবাচক রানের ধারণা (রান কেটে নেওয়া) তিনটি যুগপৎ সুবিধা দিতে পারে: টি-টোয়েন্টি খেলার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি, এবং অনেক কাঙ্ক্ষিত ব্যাট-বলের ন্যায্যতা বাড়ানো (যা পরবর্তীতে বোলারদের ফিটনেসের উন্নতি ঘটাবে)। সহজ কথায়, ধারণা অনুযায়ী প্রতিটি ডট বলের জন্য (যেটি উইকেট বল নয়), ব্যাটিং দল তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্কোর থেকে এক পয়েন্ট হারাবে; অন্যকথায়, ব্যাটিং দলে একটি নেতিবাচক রান স্কোর হয়।

    টি-টোয়েন্টিতে এই স্কোরিং পদ্ধতি প্রয়োগে নিম্নলিখিত তিনটি অর্জনের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে:

    (১) রিয়েল-টাইমে পুরো খেলা জুড়ে ব্যাট এবং বলের মধ্যে স্কোর করার ন্যায্যতা বজায় রাখবে। একটি নেতিবাচক রান একদিকে ফিল্ডিং পক্ষের (এবং বোলারদের) সিংগেলস বাঁচাতে সর্বদা অনুপ্রাণিত থাকার জন্য একটি প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে। একই সাথে এটি মাঠে মাঝে মাঝে ভুলের জন্য দায়ী একজন ফিল্ডারের মানসিক অপরাধবোধ কমিয়ে দেবে, বর্তমানের ডট বলের উপর কোন নেতিবাচক রান খরচ না হওয়া পরিস্থিতির সাথে তুলনা করে। অন্যদিকে, একটি ডট বল (ঝুঁকি-প্রতিরোধী) ব্যাটিং পক্ষের উপর নেতিবাচক মানসিক প্রভাব ফেলবে যা আজকের বিচারে তুলনামূলকভাবে বেশি। রিয়েল টাইমে ব্যাটিং এবং ফিল্ডিং দলের মধ্যে মানসিক চাপের ব্যপারে আরও সমতা নিশ্চিত করবে।

    (২) প্রতি ডট বলে পয়েন্ট কেটে নেওয়া একটি বাণিজ্য-বান্ধব গেমের উত্তেজনা খেলাকে কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর করে তুলতে পারে। সরাসরি ম্যাচে টিআরপি বৃদ্ধি করা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতার কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি। স্কোরবোর্ডের চাপ দ্বারা প্ররোচিত “ম্যাচ ড্রামা” হল নেতিবাচক রান ধারণা দ্বারা প্ররোচিত আরেকটি টিআরপি বৃদ্ধির মাত্রা। বোলারদের আত্মবিশ্বাস থাকবে যে, কয়েকটি ডট বলের মধ্যেই ম্যাচের মোড় ঘুরে যেতে পারে। অন্যদিকে ব্যাটিং দলের ওপর স্কোরবোর্ডের একটি বিশাল চাপ তৈরি করতে পারে, যাদেরকে সম্ভবত “এটি খারাপ ডেলিভারির কয়েকটি ছক্কা এবং চারের ব্যাপার” এই মনোভাব থেকে দূরে থাকতে হবে, কারণ নিশ্চিতভাবে কিছু ডট ডেলিভারিও হবে। এই রিয়েল-টাইম স্কোরবোর্ডের চাপ সম্ভবত আরও বেশি (টিআরপি-বৃদ্ধি) “ম্যাচ ড্রামা”-এর দিকে নিয়ে যেতে পারে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ক্লোজ গেমের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়বে।

    (৩) বোলারের ইনজুরি কমানোর সম্ভাবনার উন্নতি – এই অভিনব স্কোরিং পদ্ধতি নিশ্চিত করবে যে, খেলার দীর্ঘ সংস্করণের জন্য উপযুক্ত মানসম্পন্ন বোলাররা (বিশেষত ফাস্ট বোলার) রান বাঁচাতে ফিল্ডিং পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সমর্থন পাবে এবং বোলাররাও তাদের বোলিংয়ের মাধ্যমে রান বাঁচাতে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হবে। এই দলগত প্রচেষ্টার ফলে মানসম্পন্ন বোলারদের তুলনামূলকভাবে কম ব্যক্তিগত শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হবে এবং তাদের কাঁধ, উরু এবং হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির সম্ভাবনা কমবে। আর এই বোলারদের সবই তাদের দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য উপযুক্ত থাকবে।

    এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত (এবং ঐতিহাসিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে) যে টেস্ট ম্যাচগুলোতে সাধারনত এমন দলগুলোই জিতে যায় যারা ধারাবাহিকভাবে ২০ উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, যেখানে টি-টোয়েন্টি এবং ওডিআই ক্রিকেটের চেয়ে ভিন্ন গতির পরিবর্তন/সৃজনশীলতা দাবি করে। অনেক বোলার টেস্ট এবং সীমিত ওভার ক্রিকেটের পরিবর্তনগুলোর সাথে সহজভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয় না বলে শেষ পর্যন্ত ইনজুরি এবং আর্থিক সমৃদ্ধির কাছে পরাজয় বরণ করে। নেতিবাচক স্কোরিং পদ্ধতির মাধ্যমে টি-টোয়েন্টি-নির্দিষ্ট বৈচিত্র্যের বোলিং করার দাবিগুলো সম্ভবত হ্রাস পাবে।

    টাইমস অব ইন্ডিয়া অনুকরনে

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.