Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    হাঁটার দর্শন ও বরেণ্যদের হাঁটাহাঁটি

    মানুষ দু’পায়ে হাঁটা প্রাণী। জন্মের প্রথম বছর হাঁটতে পারে না। মানুষের বাচ্চা হাঁটা শুরু করতে এক বছরের বেশি গড়ায়। যদিও অনেক প্রাণীর বাচ্চারা জন্মের পরেই হাঁটতে পারে। মানুষ প্রাণীর বাচ্চারা জন্মের ছয় মাস পরে হামাগুড়ি দিতে শুরু করে। এরপর হাঁটতে শুরু করে এক থেকে দেড় বছর সময়ের মধ্যে।

    মানুষ হাঁটে। মানুষকে হাঁটতে হয়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। হাঁটা মানুষের অস্তিত্বের ভুবনে একটি অভিজ্ঞতা। বলা যায় একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। অস্তিত্ব এবং প্রয়োজনে এটি এতটাই জাগতিক যে— অনেক ক্ষেত্রে এটির গভীরতা উপলব্ধি তো দূরের কথা, বরং উপেক্ষা করা হয় বেশিরভাগ সময়।

    ইতিহাস জুড়ে অনেক বরেণ্য এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা প্রচুর হাঁটতেন। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে হাঁটা একটি পছন্দের অভ্যাস ছিল। কখনো স্বাস্থ্যের কারণে, কখনো তাদের চিন্তার উৎস হিসেবে হাঁটার পথ চলাকে ব্যবহার করতেন। ওইসব মহান মন তাদের চিন্তা, কাজ এবং বিশ্বাসের অনুপ্রেরণা হিসেবে হাঁটতেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তার তৈরি করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাইসিয়ামে হেঁটে হেঁটে ছাত্রদের সাথে কথা বলতেন এবং শেখাতেন। বিখ্যাত আমেরিকান লেখক হেনরি ডেভিড থোরো হাঁটার মধ্যে খুঁজে পেতেন আধ্যাত্মিক এক চেতনা। হাঁটা নিয়ে তিনি বলেছেন, “যে মুহূর্ত থেকে আমি হাঁটা শুরু করি, সেই মুহূর্ত থেকে আমার চিন্তার প্রবাহ শুরু হয়।” লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ তার লেখালেখির খসড়ার জন্যে হাঁটাকে ব্যবহার করতেন। জগত বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনার সময় দীর্ঘ একটি পথে হাঁটতেন। দৈনন্দিন অভ্যাসে তার এই হাঁটার অভ্যাসের কথা অনেকের কাছেই সুপরিচিত ছিল।

    হাঁটাকে আমরা অনেকক্ষেত্রে মনে করি পরিবহনের উপায়। শরীরকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার যানবাহন। প্রাকৃতিক বাহক। হাঁটা কেবল শরীরের বাহন নয়, এটি চারপাশের সাথে সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অনুঘটক। অনেক সৃজনশীল ক্ষমতা ও কল্পনার উৎস এবং চিন্তার সঙ্গী আসে হাঁটায়। হাঁটার ছন্দময় ধাপ আমাদের মাঝে এনে দেয় দার্শনিক গভীরতার অনেক সন্ধান। ভাবনায় আনে পুষ্টিকর প্রভাব। শরীর এবং মনের মধ্যে পায়ের ছাপগুলো যেন রেখে যায় নান্দনিক ধ্যানের এক অন্তর মিশেল।

    ইতিহাস জুড়ে অনেক বরেণ্য এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা প্রচুর হাঁটতেন। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে হাঁটা একটি পছন্দের অভ্যাস ছিল। কখনো স্বাস্থ্যের কারণে, কখনো তাদের চিন্তার উৎস হিসেবে হাঁটার পথ চলাকে ব্যবহার করতেন। ওইসব মহান মন তাদের চিন্তা, কাজ এবং বিশ্বাসের অনুপ্রেরণা হিসেবে হাঁটতেন

    ইংরেজি লেখক চার্লস ডিকেন্স অনেক হাঁটতেন। তিনি প্রায়ই সময় প্রতিদিন ২০ মাইল হাঁটতেন। বিশেষ করে রাত্রি বেলায় লন্ডনের একটি নির্দিষ্ট পথে তিনি এই হাঁটা হাঁটতেন। অনেক সময় এরকম চার-পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হাঁটতে ভোর হয়ে যেত। মধ্যরাতের পরে নিশাচর প্রাণীর মতো লন্ডনের পথে উনি বের হতে। ভোরে ফিরে এসে লিখতে বসতেন। চার্লস ডিকেন্স বলেছেন— এই হাঁটা তাকে তার চিন্তাকে উন্নত করতো, যেটা ভাবতে চাইতেন পরিষ্কার করে ভাবতে পারতেন। তার উপন্যাসের অনেক উপাদান, প্লট এবং উৎসাহ তিনি এই হাঁটতে হাঁটতেই নিজের ভিতরে আবিষ্কার করেছেন, খুঁজে পেয়েছেন এবং নিয়েছেন।

     

    হাঁটার দর্শন

    হাঁটারও একটি দর্শন আছে। চিন্তাবিদ ফ্রেডেরিক গ্রোসের মতে হাঁটা হল স্বাধীনতার আরেকটি রূপ। নিজেদের বৃত্তে আবদ্ধ থাকা জীবনের যে রূপ, পরিচয়ের এই সীমাবদ্ধতা থেকে বের করে আনে হাঁটার দর্শন। সমাজবদ্ধ থেকেও এমন করে আমরা আমাদের একটা স্পেস তৈরি করে বাঁচি। বিশ্বের সাথে, আমাদের চারপাশের সাথে নিজেদের একাকীত্ব এবং ব্যস্ততার একটি মিশ্রণের সুযোগ দেয় হাঁটার প্রতিটি পদক্ষেপ। যখন আমরা হেঁটে হেঁটে নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলি, নিজের সাথে কথা বলি, নিজেদের চিন্তার প্রতিফলন দেখতে চাওয়ার একটা স্থান করে দেয় হাঁটার অনুভূতি। গতি এবং স্থিরতার মাঝে সমন্বয় করে হাঁটা আমাদের চেতনায় আনে অনুভূতি আশ্রিত এক চিন্তার জগত।

    অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস তার হাঁটার জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি অনেক হাঁটতেন, তরুণ বয়স থেকেই হাঁটতেন, এবং খালি পায়ে হাঁটতেন।  তিনি বিশ্বাস করতেন যে— হাঁটা তার মনকে মুক্ত করত। তার অনেক সৃজনশীল চিন্তাভাবনার উৎস ছিল এই হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতেই তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল অ্যাপলের অনেক উদ্ভাবনী আইডিয়া।

     

    হাঁটার উপকারিতা

    হাঁটা অনেকভাবে উপকারী। যেমন মনের জন্যে, তেমনি শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্যে হাঁটা উপকারী এবং দরকারি। হাঁটাকে অনেক চিকিৎসক বলে থাকেন খাদ্যের পর শরীরের দ্বিতীয় পাওয়ার হাউজ। কারণ, হাঁটা শরীরের অনেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে ঠিক রাখে। হাঁটার প্রতিটি ধাপে শরীরের ২০০ এর বেশি মাসল বা পেশী একটিভ হয়ে ওঠে। মানব শরীরে ৬০০ র মতো পেশী আছে। হাঁটলে পা, কোমর, পেছন, পেট, বুক, এমনকি হাতের পেশীও একটিভ হয়ে ওঠে। পেশীগুলোর সহনশীলতা, ক্ষিপ্ততা, দক্ষতা এবং শক্তি বাড়ে। বিশেষ করে হার্ট শক্তিশালী হয় হাঁটলে, হাড় মজবুত হতে ওঠে, কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস বাড়ে, শরীরের চর্বি কমে। নিয়মিত হাঁটা রক্তচাপ কমায়, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, স্ট্রোকের আশঙ্কা দূর করে।

    বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার লুডউইগ ভ্যান বিথোভেন ভিয়েনার জঙ্গলে দীর্ঘ পথে অনেক হাঁটতেন। নির্জনে হাঁটাহাঁটি ছিল তার প্রিয় একটি কাজ। হাঁটতে হাঁটতে অনেক সময় একটি পেন্সিল এবং মিউজিক পেপারের শীট পকেটে রাখতেন । হাঁটার এই সময় সংগীতের কোন সুর তার মনে তৈরি হলে লিখে রাখতেন। তার অনেক বিখ্যাত সঙ্গীতের জন্ম এই হাঁটতে হাঁটতে ।

     

    হাঁটার মন

    হাঁটা মনকে ভালো রাখে । মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে হাঁটার জুড়ি নেই । হাঁটা মেজাজের ভারসাম্য তৈরি করতে সাহায্য করে, মুড নিয়ন্ত্রণ করে । বলা হয় এটা হল চিন্তার সৃজনশীলতা এবং মনের একাগ্রতা বাড়ানোর এক্সারসাইজ । হাঁটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক স্ট্রেস কমিয়ে দেয়, দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়লে তার রেশ টেনে ধরতে সাহায্য করে । হাঁটা হলো সবচেয়ে উন্নত মানসিক ব্যায়াম । শুধু মনের নয়, হাঁটা আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে অনেক ভাবে প্রভাবিত করে । বিশেষ করে মস্তিষ্কের কগনিটিভ ফাংশনকে শাণিত করতে হাঁটা যেন ভাবনার দ্বার খুলে দেয় ।

    ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কিয়েরকেগার্ড একবার  লিখেছিলেন যে – তার জীবনের সেরা চিন্তাগুলো হাঁটতে হাঁটতেই তার ভিতরে তৈরি হয়েছিল । অনেক দার্শনিক চিন্তার অস্পষ্টতা হাঁটতে হাঁটতেই তার ভিতরে স্পষ্ট হতো ।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.