“সমুদ্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়, নীরবতাও কখনো কখনো আর্তনাদ হতে পারে।” বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন আজ এমনই এক নীরব আর্তনাদের কেন্দ্র— যেখানে জীবন টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত।
বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিণতম প্রান্তে, বঙ্গোপসাগরের গভীর নীলজলে ভেসে থাকা এক টুকরো স্বপ্নের নাম এই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। নারিকেল গাছঘেরা এই ক্ষুদ্র দ্বীপটির আয়তন মাত্র আট বর্গকিলোমিটার, অথচ এর স্বচ্ছ জল, প্রবালবেষ্টিত সৈকত আর নির্জনতার মোহে বন্দি হয়েছে অগণিত মানুষের হৃদয়। একসময় যা ছিল আনন্দভ্রমণের স্বর্গ, আজ সেখানে ছড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গতা, উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার ছায়া— যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যের ভেতর লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৃদু, তবু গভীর ক্রন্দন।
দ্বীপবাসীর মুখে হাসি এনে দিত পর্যটন। প্রতি মৌসুমে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমাতো স্বচ্ছ জল, প্রবাল সৈকত আর শান্ত প্রকৃতির টানে। স্থানীয়দের অধিকাংশই জীবিকা নির্বাহ করতেন সেই পর্যটকদের হাত ধরে— কেউ নৌকা চালাতেন, কেউ হোটেল ও রিসোর্টে কাজ করতেন, কেউবা বিক্রি করতেন নারিকেল পানি, শামুকের অলংকার কিংবা সামুদ্রিক মাছ। কিন্তু সময় বদলেছে। সরকারি বিধিনিষেধ, নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন দ্বীপটি যেন ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
দুই বছর আগেও টেকনাফ থেকে ছাড়তো সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজ। পথে সময় লাগত অল্প, খরচও কম। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র তৎপরতার কারণে সেই নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন জাহাজ ছাড়ে কক্সবাজার থেকে। সকাল ৯টার দিকে যাত্রা শুরু করে বিকেল তিন-চারটার দিকে পৌঁছায় দ্বীপে। অথচ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নভেম্বর মাসে সেখানে দিনে দিনে ফিরে আসতে হবে— অর্থাৎ বিকেল পাঁচটার মধ্যেই জাহাজ ফিরতে হবে কক্সবাজারে। ফলে পর্যটকরা দ্বীপে থাকতে পারেন সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা।
এই দুই ঘণ্টা নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সেন্ট মার্টিন হোসেন জহুরা ফাউন্ডেশনের সভাপতি আব্দুর রহিম জিহাদী। তাঁর ভাষায়, “এখন তো জেটি ভাঙা। জাহাজ থেকে নেমেই এক ঘণ্টা চলে যায়। হাতে থাকে মাত্র আরেক ঘণ্টা— তাহলে কে আসবে ১৪-১৫ ঘণ্টা জার্নি করে এই দ্বীপে?” ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রাত্রিযাপনের অনুমতি থাকলেও, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও রমজানের কারণে পর্যটক কম আসবে বলেই আশঙ্কা স্থানীয়দের। অথচ এই এক-দুই মাসের আয় দিয়েই চলতো দ্বীপবাসীর বাকি ১১ মাসের সংসার। হিসাবটা সত্যিই ভয়ানক কঠিন।
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ এখন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১২টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর মাসে পর্যটকরা শুধুমাত্র দিনের বেলা দ্বীপে থাকতে পারবেন, রাতে থাকা নিষিদ্ধ। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে সীমিত রাত্রিযাপনের অনুমতি থাকবে, আর ফেব্রুয়ারিতে পুরো দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না।
এছাড়া নতুন নিয়মে বিআইডব্লিউটিএ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কোনো নৌযানকে দ্বীপগামী অনুমতি দিতে পারবে না। পর্যটকদের অনলাইনেই বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের অনুমোদিত ওয়েব পোর্টাল থেকে টিকিট কিনতে হবে, যেখানে প্রতিটি টিকিটে থাকবে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড। এই কিউআর কোডবিহীন টিকিটকে নকল হিসেবে গণ্য করা হবে।
দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় রাতের সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ করা বা বারবিকিউ পার্টি আয়োজনও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ, সামুদ্রিক প্রাণী যেমন প্রবাল, রাজকাকরা, ঝিনুক, কচ্ছপ বা পাখির ক্ষতি করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। সৈকতে মোটরচালিত যান চলবে না, পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বহনেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এমনকি পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে— যেন প্লাস্টিক বোতলের বর্জ্য না জমে।
এই নির্দেশনাগুলোর পেছনে যুক্তি স্পষ্ট— সেন্ট মার্টিনের প্রবাল ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র আজ বিপন্ন। অতিরিক্ত পর্যটন, বর্জ্য ও অযত্নে দ্বীপের বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতার অন্য পিঠে আছে মানবজীবনের প্রশ্ন। দ্বীপের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পর্যটনের উপর নির্ভরশীল, বাকিরা মৎস্যজীবী। দুই পেশার মানুষই এখন অনিশ্চয়তায়।
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সৈয়েদ আলম বলেন, “গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয় হঠাৎ করে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দ্বীপের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। তখন থেকেই অনেকে জীবিকার তাগিদে দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে। এখন পর্যন্ত ২০০টিরও বেশি পরিবার দ্বীপ ছেড়েছে।”
প্রতিবছর অক্টোবরে শুরু হতো মৌসুমের প্রস্তুতি। হোটেল ও রিসোর্টগুলোতে সংস্কার, রং করা, নতুন করে সাজসজ্জা— সব মিলিয়ে ছিল উৎসবের আমেজ। এখন সেই ব্যস্ততা নেই। বরং কেউ কেউ রিসোর্ট বিক্রি করে দিতে চাইছেন। দ্বীপে একমাত্র জেটির সংস্কার কাজ দীর্ঘায়িত হয়ে পড়েছে, ফলে যোগাযোগও অনিশ্চিত। সাবেক ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, “জেটির কাজ ঢিলেঢালা ভাবে চলছে। মৌসুম শুরু হবার আগেই যদি কাজ শেষ না হয়, পরে শেষ করে লাভ কী?”
এমন সংকটে শুধু অর্থনীতি নয়, মানুষের মনও শুকিয়ে যাচ্ছে। যাদের জীবন একসময় সমুদ্রের ঢেউ আর পর্যটকের কোলাহলে ভরা ছিল, এখন তারা শুনছে শুধু বাতাসের হাহাকার। রাতে যখন চাঁদের আলো ঝরে পড়ে সৈকতের বালিতে, তখন দ্বীপটা যেন আরও একা হয়ে যায়— যেমন একা হয়ে গেছে এর মানুষগুলো।
তবু ইতিহাস বলে, সেন্ট মার্টিন সবসময়ই ছিল বেঁচে থাকার দ্বীপ। স্থানীয় নাম নারিকেল জিঞ্জিরা— নারিকেল গাছে ঘেরা সেই মাটির সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুক্ত মানুষের জীবন। একসময় মৎসজীবী পরিবারগুলো এখানে আশ্রয় নিয়েছিল, মাছ ধরা, নারিকেল চাষ ও ক্ষুদ্র কৃষিতেই চলতো তাদের জীবন। পরে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭০-এর দশকে এই দ্বীপ পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
প্রবালপ্রাচুর্য, স্বচ্ছ জল আর শান্ত সৈকত— সেন্ট মার্টিন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের রোমান্টিক স্বপ্নের গন্তব্য। নববিবাহিত দম্পতিরা, একাকী প্রকৃতিপ্রেমী, কিংবা ফটোগ্রাফার— সবাই মুগ্ধ হতো এই ছোট্ট দ্বীপে এসে। কিন্তু অযত্ন, অতিরিক্ত জনসমাগম আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সেই সৌন্দর্যের অনেকটাই আজ বিলীন।
গত কয়েক বছরে সাগরের জোয়ারের পানি ঢুকেছে দ্বীপের ভেতরে, ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক ভূমি। তাই দ্বীপবাসীর একটাই দাবি— চারদিকে টেকসই বেরিবাঁধ নির্মাণ। তারা জানে, প্রকৃতি রক্ষা মানেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
দ্বীপের ইতিহাসও বহন করে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উত্তরাধিকার। বলা হয়, উপনিবেশিক যুগে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মার্টিন দ্বীপটি পরিদর্শন করেছিলেন, তাঁর নামেই নামকরণ হয় “সেন্ট মার্টিন”। কিন্তু স্থানীয় মানুষের কাছে এই নামের কোনো অর্থ নেই— তারা একে এখনো স্নেহভরে ডাকে নারিকেল জিঞ্জিরা বলে।
আজ এই নারিকেল জিঞ্জিরা নিঃসঙ্গ। পর্যটকের হাসি-খুশির বদলে শোনা যায় ঢেউয়ের একটানা গর্জন। তবু প্রকৃতি এখনো সেখানে আশ্চর্য শান্ত। সকালের সূর্য যখন নীল জলে লাল রেখা ফেলে, তখন মনে হয় পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন এক মুহূর্তের জন্য সেখানে এসে থেমে গেছে।
কিন্তু সেই সৌন্দর্যের মাঝেও বাজছে এক নিঃশব্দ প্রশ্ন— বেঁচে থাকা মানুষের কী হবে? যারা জীবনের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়ে নিয়েছিল, তারা কি এখন হারিয়ে যাবে এই প্রবাল দ্বীপের মতোই?
সেন্ট মার্টিন আজ এক প্রতীক— প্রকৃতি সংরক্ষণ ও মানুষের বেঁচে থাকার দ্বন্দ্বের প্রতীক। পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু সেই রক্ষার নামে যদি মানুষই হারিয়ে যায়, তবে প্রকৃতির সৌন্দর্যই বা কার জন্য?
বঙ্গোপসাগরের নীল ঢেউয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ছোট্ট দ্বীপ যেন এখন বাংলাদেশের পরিবেশচেতনার এক পরীক্ষা ক্ষেত্র। একদিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়াস, অন্যদিকে জীবিকার সংগ্রাম।
তবু আশা রয়ে যায়— জোয়ার-ভাটার মতোই হয়তো আবার ফিরবে জীবন। আবার হয়তো সকালবেলার সমুদ্রে দেখা যাবে ছোট নৌকা, কাঁধে মাছের ঝুড়ি নিয়ে ফিরবে জেলে, হোটেলের সামনে বসবে পর্যটক, আর শিশুদের হাসিতে মুখরিত হবে এই প্রবাল দ্বীপ। ততদিন পর্যন্ত সেন্ট মার্টিন থাকবে এক স্বপ্নের নাম, এক নিঃসঙ্গ সৌন্দর্যের প্রতীক— যেখানে প্রকৃতি এখনো নিঃশব্দে বলে চলে, “মানুষ চলে যায়, কিন্তু সমুদ্র থেকে যায়।”




