Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    সাহিত্য পুরস্কার

    বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও করপোরেট হাউজগুলোর আলাদা বা যৌথভাবে সাহিত্যের নামে পুরস্কার দেয়ার হিড়িক পড়েছে। এত ঢাকঢোল বাজিয়ে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেন সাহিত্যের নামে পুরস্কার দিচ্ছে, ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো। প্রথমে ব্যাংকের কথাই ভাবি, ব্যাংকের কাজ সম্পর্কে মোটামুটি সবাই জ্ঞাত। এটা এমন এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যার সবই সুদের ফাটকা ব্যবসা। ব্যাংক সঞ্চয়মুখী জনগণের কাছ থেকে সাধারণ সঞ্চয়সহ বিভিন্ন স্কিমে জামানত হিসেবে টাকা সংগ্রহ করে আর চালু ব্যবসায়ীদের সেই টাকা ঋণ দেয়। যাদের কাছ থেকে ব্যাংক নিজে জামানত নেয়, তাদের সুদ দেয় কম, আবার যাদেরকে তারা সেই টাকা ঋণ দেয়, তাদের কাছ থেকে চড়া সুদ নেয়। ব্যাংকের এই ফাটকা ব্যবসা দেখে খুব দ্রুত ক্ষমতাবানরা ব্যক্তিগতভাবে দেশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেয়। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে যত্রতত্র বেশকিছু ব্যাংক গড়ে তোলে। আর আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি, বিভিন্নভাবে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সরকারি অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে তারা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। অথচ এই দেশটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে এরাই। এরাই আবার দেশের সম্পদ দেশের বাইরে পাচার করছে। যেন এদেশটার পতন হলে তারা বিদেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। এরাই গণশত্রু, এদেরকেই আমাদের রক্ষক ভেবে আমরা দিনগুজার করছি।

    বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে চালু ব্যবসা কী? মোটা দাগে গার্মেন্টস সেক্টর, ওষুধ সেক্টর, প্লট বা ফ্ল্যাট ব্যবসা, খাদ্য ব্যবসা ইত্যাদি। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসা থাকলেও বৃহৎ পুঁজি খাটে উল্লেখিত ব্যবসায়। আবার এই ব্যাংকও বহুজাতিক ব্যবসা চক্রের অংশ। একেকটা বহুজাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এখন সব ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ থাকে। এরা এমন ব্যবসাচক্রের প্রসার করছে একই কোম্পানির বস্ত্রব্যবসা, ওষুধ ব্যবসা, খাদ্য ব্যবসা, শিক্ষা ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, চিকিৎসা ব্যবসা, মিডিয়া ব্যবসা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসা করে থাকে। এ রকমও হতে পারে যে, এক কোম্পানির টিভি বা পত্রিকায় চমৎকার বিজ্ঞাপন দেখে ভালো প্যাকেটে খারাপ খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলেন, ভর্তি হলেন এই একই কোম্পানির হাসপাতালে, চমৎকার সাজসজ্জার হাসপাতালে গলাকাটা দামে চিকিৎসা করলেন, খেলেন এই একই কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ তা-ও চড়াদামে। চিকিৎসার অবহেলায় আপনার মৃত্যু হলে মিডিয়া তা চেপে যাবে, কারণ মিডিয়াও এই একই কোম্পানির। মোট কথা আপনি এসব বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। এই বহুজাতিক কোম্পানি টিকিয়ে রাখতে গেলে তার একটা রাজনৈতিক রূপরেখা দরকার। ফলে রাজনীতিও পক্ষান্তরে ক্ষমতাটাও এদের হাতে। মনে রাখতে হবে বুর্জোয়াদের প্রথম টার্গেট ব্যবসা বা মুনাফা। মুনাফা করতে সহজ বলেই তারা ক্ষমতাটাও হাতিয়ে নেয়। বুর্জোয়া ব্র্রিটিশরা সামন্তীয় ভারতে এসেছিল ব্যবসা করতে মানে মুনাফা করতে। কিন্তু অচিরেই তারা দেখল তাদের সামনে জগদ্দল পাথরের মতো পথ আটকে বসে আছে সামন্তীয় সমাজ। তাই ভারতীয় সামন্তীয় সমাজের হাত থেকে তারা ক্ষমতাটা ছিনিয়ে নেয় এরপর তারা একচ্ছত্র ব্যবসা করে এবং ব্যাপক মুনাফা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের পুঁজি তৈরি করে। ব্রিটিশরা চলে গেছে কিন্তু ব্রিটিশ বুর্জোয়াদের জায়গায় আজ ভারতবর্ষজুড়ে দেশিয় বুর্জোয়াদের রাজত্ব। মনে রাখতে হবে বুর্জোয়াদের কোনো নীতি বা নৈতিকতা নাই আছে শুধু মুনাফার লোভ। যে কোনো প্রকারে মুনাফা করাই তাদের লক্ষ্য।

     তথাকথিত এই সাহিত্য পুরস্কার এরই অংশ। তাই দেখা যাবে অমুক ব্যাংক-তমুক পত্রিকা সাহিত্য পুরস্কার। অমুক বহুজাতিক-তমুক পত্রিকা সাহিত্য পুরস্কার

    এখন বিচ্ছিন্ন করে এই ব্যবসাগুলো দেখা যাক। গার্মেন্টের ব্যবসা সম্পর্কে এদেশের সচেতন মানুষ খোঁজখবর রাখেন। রানা প্লাজা, তাজরীন, স্পেকট্রাম, স্মার্টের দুর্ঘটনার পর গার্মেন্টসের অনেক খবরাখবর জনগণ পাচ্ছেন। এটা সম্পূর্ণ লুটপাটের জায়গা, শ্রমিকদের রক্তে পুঁজি বানানোর অমানবিক এক হাবিয়া দোজখ। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে এই সেক্টরে। মাসে ৩০০০ টাকা বেতন দিয়ে যাদেরকে কমপক্ষে ১৫০০০ টাকার পরিশ্রম করিয়ে নেয়া হয়। বাকি ১২ হাজার টাকাই মালিকের লাভ। দিনের পর দিন এই একই শোষণ প্রক্রিয়া, অমানবিক দাসত্বের পরিবেশে তাদের বেঁচে থাকার সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়ে গুটিকয় মানুষের পুঁজি তৈরির কারখানা এসব। এ খাতে ব্যাংকগুলোর রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ, হয়তো বাংলাদেশে সবচোয়ে বেশি ঋণ দেয়া হয় এই সেক্টরে।
    চিকিৎসাসেবা মানুষের নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার হলেও ওষুধপথ্য বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে জল্লাদ ব্যবসা হচ্ছে চিকিৎসাব্যবসা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর ওষুধ খেতে গিয়ে জীবনের সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে অনেক মানুষের। সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে যে ওষুধগুলো বিভিন্ন পাবলিক হাসপাতালে পাঠায়, সেসব ওষুধ সেসব পাবলিক হাসপাতালের দায়িত্বরত ডাক্তার, নার্স, কর্মচারীচক্র নিজেদের আমানত ভেবে নিজেরাই মেরে দেয়। হরদম পত্রিকায় দেখা যায় হাসপাতালের এসব ওষুধ তারা এমনকি মাটির তলায়ও পুঁতে রেখে দেয়। যা-ই হোক, এই যে ওষুধ বানানোর শ্রমিক, তা বিক্রির শ্রমিক তাদেরও অবিকল একই কায়দায় তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়। ঠিক এভাবেই বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার এখন এদেশে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এটা মূলত ক্যাপিটালিজমেরই গুপ্ত চেহারা। সবকিছু থেকেই নিংড়ে মুনাফা বের করা।

    এই প্রত্যেক ব্যবসায়ের টার্গেট বা ভোক্তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে অতিদামে নিম্নমানের চিকিৎসা দিয়ে, সাধারণ মানুষের রক্ত ও ঘাম থেকে শ্রমঘণ্টা মেরে দিয়ে, সাধারণ মানুষকে পুষ্টি কম দিয়ে অর্থাৎ তাকে দুনিয়ায় তার মানবিক ও সাংবিধানিক অধিকারকে তারই কাছে বিক্রি করে তার ভেতর থেকে গুটিকয় মানুষকে মুনাফা তথা পুঁজিপতি বানানো এবং তার ঋণের চড়া সুদে নিজের দেহ আরো প্রসারিত ও নিজের ফাটকা ব্যবসার আরো বিস্তার ব্যাংকের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

    সেই লাভেরই এক ক্ষুদ্র অংশ সে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো জনমত গড়ে না ওঠে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তো তাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে তাদের নিজস্ব পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখন সিংহভাগ পত্রিকাই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দখলে। সাংবাদিকতা এখন একটা পেশা ছাড়া আর কিছু নয়। গার্মেন্টস কর্মীরা সেলাই মেশিন চালায় আর সাংবাদিকরা কলম মেশিন চালায়। উভয় উৎপাদনই করপোরেট হাউজগুলোর পক্ষে। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা এখন কল্পনা মাত্র। নিজেদের কুকর্ম ঢাকতেই বহুজাতিক সারা দুনিয়ায় সংবাদ মাধ্যমগুলো দখলে নিয়েছে। তাই সামাজিক সুনাম যেসব বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, সেখানে সে সামান্য বিনিয়োগ করে তার সুনাম বাড়িয়ে তোলার জন্য। মোট কথা কালো টাকা সাদা করা, তথাকথিত এই সাহিত্য পুরস্কার এরই অংশ। তাই দেখা যাবে অমুক ব্যাংক-তমুক পত্রিকা সাহিত্য পুরস্কার। অমুক বহুজাতিক-তমুক পত্রিকা সাহিত্য পুরস্কার।

    সাহিত্যকে বলা হয় হিতের চেতনা। সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা অনেকাংশে একটা জাতির চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মতোই

    আর অন্যদিকে সাহিত্যের কাজ প্রায় সম্পূর্ণই এর বিরোধী। সাহিত্যকে বলা হয় হিতের চেতনা। সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা অনেকাংশে একটা জাতির চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মতোই। আমরা দেখেছি জারের আমলে রাশিয়ার সব সাহিত্যই সেন্সর করা হতো। যে কোনো লেখা বা বই প্রকাশিত হওয়ার আগে সরকারি সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে হতো। এমনকি তলস্তয়ের অনেক বই আটকে দিয়েছিল সেন্সর বোর্ড। ফরাসি দেশে ভলতেয়ারকে ছদ্মনামে লিখতে হতো প্রায় লেখা। তবু ধরে ফেলত রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্র জানত এ রকম লেখা একমাত্র ভলতেয়ারের কলম দিয়েই বেরোনো সম্ভব। তাকে জীবনের সিংহভাগই দেশের বাইরে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে। দুনিয়াতে অনেক লেখককেই তার নিজের দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয়েছে অন্য কোনো দেশে। পূর্ব ইউরোপের অনেক লেখকই ইউরোপ বা আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সেন্সরে পড়ে। চেশোয়াভ মিউশের মতো কবি লিখেছেন, কোনো দেশকে বিশ্বাস নেই, কারণ ক্ষণে ক্ষণে সে মানচিত্র বদলায়। ব্রিটিশ আমলে কবি নজরুলের অনেক লেখাই নিষিদ্ধ হয়েছিল।

    জগতে যাদের লেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেসব লেখা অমূল্য হিসেবে টিকে আছে এখন। কারণ সাহিত্যের জন্য সঠিক কাজই তারা করে গেছেন। বুর্জোয়া রাষ্ট্র বা শোষক প্রতিষ্ঠানের সব অপকর্মের বিরুদ্ধে অতি গোপনে জেগে থাকে মৌলিক লেখকের গোপন চোখ ও কলম। কারণ লেখকের স্বার্থ চেতনার স্বার্থ সিংহভাগ নিরীহের স্বার্থ। তাই সে লেখার ভেতর দিয়ে একটা অলিখিত দায়িত্ব পালন করে চলে। যেখানে যেকোনো পুরস্কার তার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়। বলা যায় একসময় লেখক কবিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সামন্তীয় রাজাগণ। তখন কবি-সাহিত্যিকরাও সামন্তীয়দের গুণগান গেয়ে তাদের সৃজনশীল লেখার পাশাপাশি মহাকাব্য রচনা করতেন। অলংকৃত করতেন সামন্তীয় রাজাদের দরবার। কিন্তু বুর্জোয়া সভ্যতা বা ক্যাপিটালিজম তাদের সে সম্মানজনক স্থান কেড়ে নিয়ে তাদেরও প্রতিযোগিতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাদের বলেছে, যদি তোমাদের কবিতা সাহিত্য বিক্রিযোগ্য না হয়, তাহলে সেসব বাতিল। বলা যায় সব সম্মানজনক পেশাকেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে নিজেদের মুখোমুখি। তাই যে কোনো সৎ লেখকেরই প্রতিপক্ষ ক্যাপিটালিজম। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম একটা অবস্থায় একজন প্রকৃত লেখকের দায়িত্ব কী?

    বলা যায় সব সম্মানজনক পেশাকেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে নিজেদের মুখোমুখি। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম একটা অবস্থায় একজন প্রকৃত লেখকের দায়িত্ব কী?

    আমরা দেখেছি পৃথিবীর অনেক লেখকই অনেক পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। জাঁ পল সার্ত্রে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, আলফ্রেন্ড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। সেই ডিনামাইট আজকে ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে। যে কোনো বোমা তৈরিতে, বারুদ তৈরিতে ডিনামাইট ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই ডিনামাইটের দামও আকাশচুম্বী। আলফ্রেড নোবেল বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি হয়তো পাহাড় উড়িয়ে দেয়ার জন্য বা অন্য কোনো মানবহিতৈষী কাজের জন্য আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই দেখতে পান ডিনামাইটের অধিকার নিয়েছে বুর্জোয়ারা আর তা ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত, যে কোনো কিছু বুর্জোয়ারা বিক্রি করবে। এ কারণেই নোবেল পুরস্কার নীতিগতভাবে পরিত্যাগ করেন তিনি। আমার মনে হয়, এটাই একজন লেখকের যথাযথ দাঁড়ানোর জায়গা। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জায়গা। ১৯৬৪ সালে নোবেল কমিটি তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করলেও তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেননি। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ না করার পক্ষে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই অফিশিয়াল সম্মাননা এড়িয়ে চলেছি। লেখকের উচিত নয় নিজেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে আমার লেখকের চেষ্টা-সম্পর্কিত ধারণা। যে লেখক রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা বিশেষ সাহিত্যিক অবস্থানে থাকেন তিনি নিশ্চয়ই তাঁর নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী চলবেন, মানে তিনি নিজে যা লেখেন সে অনুযায়ী।’ নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন ভিয়েতনামের লে ডাক থো (Le Duc Tho). ১৯৭৪ সালে আমেরিকান কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে যৌথভাবে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর দেশে শান্তি ফিরে না আসায় তিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
    তবে জগতের অনেক শিক্ষিত বুর্জোয়াই সাহিত্যের উন্নয়ন সাধনে ভূমিকা রেখেছে। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে তারা মূলত ম্যানার শেখানোটাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, নিঃসঙ্গতার অনুভব, খাওয়া, দেখা, প্রেম ইত্যাদিও আলাদা অর্থ তৈরি করার ব্যাপারে সেসব সাহিত্যে গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে।

    প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচুর ঋণ দিতে পারত।  বিক্রয়ের জন্য গোটা দেশে একটা চমৎকার নেটওয়ার্ক তৈরি করে গণচেতনার সৃষ্টি করতে পারত

    ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর যদি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে এতই দায়িত্ববোধ থাকত তাহলে তারা প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচুর ঋণ দিতে পারত। বইয়ের গুণগত মান বাড়িয়ে, লেখককে তাদের রয়্যালটি নিশ্চিত করে, বই উৎপাদন ও তা বিক্রয়ের জন্য গোটা দেশে একটা চমৎকার নেটওয়ার্ক তৈরি করে গণচেতনার সৃষ্টি করতে পারত। বাংলাদেশে ১৬ কোটি, পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে গোটা দুনিয়া প্রায় আরো ১০ কোটি বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলে, পড়ালেখা করে। ১০ থেকে ১২ কোটি ভাষাভাষী ফ্রান্স, রুশ ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যবাজারটা বাংলার চেয়ে অনেক বড়। ২৬ কোটি বাংলাভাষীর মধ্যে এক কোলকাতার সাহিত্যবাজার ছাড়া বাংলাদেশের বাংলাসাহিত্যের বাজার নেই বললেই চলে। তার ওপর ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরের বড় বইয়ের দোকানগুলোও কলকাতার বইয়ের দোকান। আর মফস্বলে মকছুদুল মোমেনিন বা হাশরের পর জাতীয় বই ছাড়া ভালোমানের কোনো সাহিত্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। ভেতরে এ রকম নানা জটিলতা রেখে কয়েকজনকে সাহিত্যের নামে এত বাজনা বাজিয়ে পুরস্কার দেয়াটা অনেকটা পোকায় খাওয়া গর্ত ঢাকা দেয়ার জন্য কার্পেট বিছানোর মতো নয় কি!

    অথচ ব্যাংক ও বহুজাতিক বেনিয়ারা যা করে তা হচ্ছে- গুটিকয় ব্যাংক মালিকের বা লিয়াজোঁকারীর আত্মীয়-স্বজনকে লেখক নাম দিয়ে পুরস্কার দিয়ে সাহিত্য জগতে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। সাহিত্যের মানে তাদের কিছু আসে যায় না। দেখা যাবে যে ক’জনকে পুরস্কার দেয়া হয় অল্প টাকা। তার অনেকগুণ বেশি খরচ করা হবে প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, অতিথি আপ্যায়নে, অডিটোরিয়ামের সাজসজ্জায়। উপস্থিত করবে ক্ষমতাধর কোনো মন্ত্রী, যার আবার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। পুরস্কার প্রদানের পর আবার বিজ্ঞাপন, আবার প্রচারণা। মূলত এই প্রচারণাই তাদের লাভ। একাধিকবার এভাবে লাগাতার পুরস্কার প্রদানের প্রভাব জনমনে স্থায়ী হয়। এটা সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে ওঠে। যেহেতু সাহিত্য পঠন-পাঠনেরই বিষয়। সাহিত্যের কথা উঠলেই সঙ্গে ভেসে উঠবে সেসব ব্যাংকের নাম, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নাম, যা সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেছে। তখন সমাজ ব্যাংককে বা বহুজাতিক কোম্পানির সব শোষণ ভুলে সেসবকে হিতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করবে। না হলে সাহিত্যের মতো একটা অলাভজনক কিন্তু প্রচারবহুল জায়গায় ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কী কাজ?

    ২৬ কোটি বাংলাভাষীর মধ্যে এক কোলকাতার সাহিত্যবাজার ছাড়া বাংলাদেশের বাংলাসাহিত্যের বাজার নেই বললেই চলে

    প্রশ্ন উঠতে পারে কাদের দেয়া হবে সেসব পুরস্কার? ব্যাংকের টার্গেট থাকবে কোনো সিরিয়াস লেখককে সেই পুরস্কার দিতে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একজন লেখক এই পুরস্কার গ্রহণের আগে যেহেতু পুরস্কার দাতার স্বভাব ও উদ্দেশ্যের নেতি নিয়ে প্রশ্ন করবে। এবং অবশ্যই এসব প্রতিষ্ঠান তাদের এই পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক তৈরি করবে না। তাই পুরস্কার দেয়ার আগে তারা সেই লেখকের সঙ্গে কথা বলবে। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য ব্যাংক খুঁজে বের করবে সাহিত্যিক বেশ্যাদের। যারা অনেক আগেই নিজেদের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে হাজির হয়েছে এখানে। আর রুজ লাগিয়ে অপেক্ষা করছে সড়কে পরবর্তী খদ্দেরের আশায়। এদের বাস সাহিত্যের কানাগলিতে, এরা সবখানেই আছে, এরা বহুরূপী। ব্যাংকের যেহেতু লেখার গুরুত্ব নিয়ে কাজ নেই, সেহেতু সাহিত্যের নামে যে কোনো কিছুকেই তারা পুরস্কার দিতে পারে। এরা এই আত্মাবিকৃত জীবগুলো, যারা ঘোরাফেরা করবে নিয়ত ব্যাংকের এজেন্টদের আশপাশ এবং এরাই এসব পুরস্কারের যোগ্য। সত্যিকার অর্থে দেখা যায় এ পর্যন্ত ভালো লেখককে খুব বেশি পুরস্কৃত করতে পারেনি, পারবেও না। কারণ সাহিত্য কোনো কিছুর বিনিময়ের জন্য তৈরি হয় না। এটা দায়বোধের ব্যাপার। এই পুরস্কার নেয়ার মাধ্যমে অনেক ভালো লেখকও নিজের আত্মা বিক্রির সুযোগ পায়। বিনিময়ে তাকে পণ্য করে তাঁরা, তাকে দেয়া অর্থমূল্যের বহুগুণ সুনাম বাজার থেকে তুলে নেয় ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। আমাদের জীবদ্দশাতেই এ রকম বহু লেখককে তাদের যুদ্ধংদেহী পোশাক খুলে নাচের পোশাক পরতে দেখেছি আমরা।

    তবু এখানেও ব্যাংক বা কোম্পানিগুলো ভাঁড়ামো করবে, তারা বই আহ্বান করবে, আহ লুম্পেনরা দলে দলে প্রতারিত হতে যাবে সেখানে। তারা বুঝতেও অক্ষম এই পুরস্কার অনেক আগেই দেয়া হয়ে গেছে তাদের বাছাই করা দালালদের। যতই আনুষ্ঠানিকতা ততই প্রচার এটাই তাদের লাভ। এমনিতেই গত ৪০ বছরে দায়বোধের জায়গায় এদেশের সাহিত্য প্রায় শূন্যের কোটায়(অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে), যা এখনো এদেশে সাহিত্য বলে আমরা পড়ছি, তা ৪০ বছর মানে ’৭১ সালের আগে জন্ম নেয়া।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.