মার্বেল খেলার বয়েস
এখনও মনে পড়ে—
মাটির গন্ধে ভেজা দুপুর,
খেজুরপাতার ছায়ায় আমাদের গোল হয়ে বসা,
হাতের তালুতে রঙিন কাঁচের গোলা,
যেন ছোট্ট গ্রহ— নীল, সবুজ, রোদে ঝলমলে।
তখন আমাদের পৃথিবী ছিল হাতের মুঠোয়,
এক চিলতে উঠানই ছিল মহাকাশ,
দূরের বাঁশবনে লুকিয়ে থাকত বৃষ্টির গোপন ডাক।
জিতলে বুক ফুলে উঠত,
হারলে চুপচাপ গিলে নিতাম
হতাশার কাঁচের গরম রোদ।
আজ দেখি—
ওই মার্বেলগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে,
কিন্তু চোখের ভেতর মাঝে মাঝে চকচক করে
সেই রঙিন গোলাগুলো—
যেন শৈশবের সব ঋতু
এক দানার ভেতর বাঁধা পড়ে আছে।
তবু জানি,
ফিরে যাওয়া যায় না মার্বেল খেলার বয়েসে,
শুধু মাঝে মাঝে, সন্ধ্যার হালকা বাতাসে
হাতের মুঠোয় অনাথ হয়ে পড়ে থাকে
একটা কাঁচের গোলা—
যা আমি কারও হাতে ফেরত দিতে পারিনি।
রেলস্টেশন
রেলস্টেশনে দাঁড়ালে
মনে হয়, এ জীবন এক অবিরাম বিদায়।
সিটি বাজে—
লোহার শব্দে কেঁপে ওঠে অন্ধকার,
কিন্তু মানুষের চোখে শুধু ভাসে বিচ্ছেদের জল।
এখানে ভালোবাসা আসে অল্প সময়ের জন্য,
তারপর ট্রেনের চাকার শব্দে
গলে যায়,
মিশে যায় দূরের অজানা ধুলায়।
এক তরুণী হাত নেড়ে বিদায় জানায়,
কিন্তু তার ঠোঁটে জমে থাকে
অধরা কোনো নাম।
এক বৃদ্ধ তাকিয়ে থাকে ফাঁকা আকাশে—
যেন সেখানে লেখা আছে
হারানো দিনের সব ঠিকানা।
রেলস্টেশন—
মানুষের কান্নার ঘর,
যেখানে মিলনের চেয়ে বিদায়ের ওজন
সবসময় বেশি।
আমি দাঁড়িয়ে ভাবি,
আমার ভেতরেও যেন প্রতিদিন
একটি ট্রেন ছেড়ে যায়—
ফিরে আসে না আর কোনোদিন।
একাকী
রাতের জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়াই,
তোমার চোখের মতো দূরে জ্বলছে তারা।
আমি ভাবি— এই শহর, এই অচেনা আলো,
সবই যেন ভেসে আসে এক মৃত সমুদ্র থেকে।
বন্ধুদের ভিড়ে আমি একা,
হাসির ভেতরেও শুনি ভাঙা কাচের শব্দ।
একদিন তোমার হাত ছুঁয়েছিলাম—
আজও সেই উষ্ণতা শুকনো অশ্রুর মতো লেগে আছে আঙুলে।
আমি জানি, তোমার দরজায় কোনো চিঠি পৌঁছাবে না,
রাতের ডাকবাক্স ভরে থাকবে কেবল বাতাসে।
তবু আমি লিখে যাই—
তোমার অনুপস্থিতির দীর্ঘতম কবিতা।
পাখির নামহীন ডাক
অন্ধকারের ভেতরে হঠাৎ
কোনো পাখি ডেকে ওঠে—
তার ডানার শব্দে
মহাশূন্য কেঁপে ওঠে আমার ভেতর।
শহরের বিদ্যুতের নিচে
আজকাল পাখিরা শুয়ে থাকে ক্লান্ত;
অপেক্ষা করে ভোরের,
যেখানে গাছ নেই, শুধু ইটের স্তূপ।
তবু তারা উড়ে যায়—
অতীতের নদীর দিকে,
সেই মাঠের দিকে
যেখানে একদিন বাতাসে ধানের গন্ধ ছিল।
আমি জানি না তার নাম,
সে বুলবুলি নয়, শালিক নয়, কোকিল নয়;
তবু তার ডাকে
আমার অদৃশ্য রক্তে আলো ঝরে।
অলস দুপুর
পুকুরঘাটে শাপলা-পাতা গুনছে বাতাস,
ধানক্ষেতের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর—
গ্রামের উঠোনে পোষা মুরগি ছায়া খুঁজে নেয়,
গাভী চরে ধীরে, ঢুলে পড়া চোখে।
নারীরা হাঁসফাঁস করে আঁচলে ঘাম মোছে—
তবু চুলোর আগুনে ধোঁয়া উঠে যায় আকাশে।
এমন দুপুরে সময় নিজেই থেমে যায়,
মাঠে খেলতে থাকা বালকেরাও হঠাৎ নিস্তব্ধ।
কেবল দূরে কারো বাঁশির সুর,
অতীতের মতো ভেসে আসে
এখনকার অলস দুপুরে।
ট্রেনের হুইসেল
শহরের প্রাচীন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ধূসর সকাল,
বৃষ্টির গন্ধে ভিজে আছে বিজ্ঞাপন বোর্ড,
তুমি যেন কোথাও দূরে, রেললাইনের বাঁকে,
খুব ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছো বাষ্পের কুয়াশায়।
ট্রেনের হুইসেল—
এই অদ্ভুত দীর্ঘশ্বাসে জেগে ওঠে
নদীর পারে ঘুমন্ত বাঁশঝাড়,
শুকনো পাতার ভেতর কেঁপে ওঠে
শীতের কাক।
আমি ভাবি, কতজন অচেনা মানুষ
তাদের নিজস্ব প্রস্থান নিয়ে হাঁটছে—
যেন প্রত্যেকের বুকেই লুকানো আছে একটি অপ্রকাশিত স্টেশন।
পেছনের শেষ বগি চলে গেলে
রেলের গায়ে লেগে থাকে কেবল ধাতব উষ্ণতা,
আর আমি একা দাঁড়িয়ে শুনি—
দূরের হুইসেলের ভেতর
তোমার চলে যাওয়ার শেষ প্রতিধ্বনি।