Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    শিলার-গ্যেটে পূতিগন্ধময় আপেল

    ফ্রেডরিখ শিলার ও জোহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটের বন্ধুত্ব ছিল অবিচ্ছেদ্য ও প্রগাঢ়। গ্যেটে মাত্র ২৪ বছর বয়সেই ‘দ্য সরোজ অব ইয়াং ওয়েদার’ নামে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখে জার্মান সাহিত্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তার পরও এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, আঠারো’শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান সাহিত্যাকাশে গ্যেটে যদি হয়ে থাকেন তারা, তাহলে শিলার হচ্ছেন পূর্ণচন্দ্র। সাহিত্য রচনার সূচনাপর্বের দিকটায় গ্যেটের চেয়েও শিলার ছিলেন এককাঠি সরেস। মাত্র ২২ বছর বয়সেই শিলার ‘দ্য রাবার’ নাটকটি রচনা করে চারদিকে ধুন্ধুমার হুলুস্থুল বাধিয়ে দেন। অন্যদিকে গ্যেটে তখন পর্যন্ত ম্রিয়মাণ মিটমিটে আলোর চেরাগ; তখন পর্যন্ত গ্যেটে কাব্যনাট্য ‘ফাউস্ট’ রচনা করেননি। পরবর্তী জীবনে ‘ফাউস্ট’ রচনার মধ্য দিয়ে গ্যেটে নিজেকে শেকসপিয়ার ও ভলতেয়ারের সমপর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন; যদিও ব্যক্তিগত জীবনে ভলতেয়ার সাহিত্য সম্পর্কে গ্যেটে ছিলেন নিদারুণ সন্দিহান। অন্যদিকে গ্যেটে মোহাবিষ্ট ছিলেন শেকসপিয়ারের প্রতি।

    একদিন শিলারের বাড়িতে এসেছেন গ্যেটে। দরজার কড়া নাড়তেই বন্ধুপত্নী শার্লট এসে দরজা খুললেন। পরিতাপের বিষয়, সে সময়টায় শিলার বাড়িতে নেই। বন্ধুর সঙ্গে দু’দন্ড সময় না কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে যেন মন কিছুতেই চাইছে না। কী আর করা, গ্যেটে মনে মনে ভাবলেন, কিছুটা সময় অপেক্ষা করলে এমন কোনো ক্ষতি নেই। যদি এরই মধ্যে বন্ধুটি চলে আসে, তাহলে তো ভালোই হয়। শার্লটের সাদর সম্ভাষণে শিলার যে সুদৃশ্য টেবিলটিতে নিত্যদিন লেখালেখি করেন, সেটা সংলগ্ন যে চেয়ারটা আছে, সেখানে গিয়ে বসলেন। শিলারের আসতে একটু দেরি হতে পারে, এই ভেবে গ্যেটে প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় নোট করে রাখবেন বলে যেই না তাঁর পকেট থেকে নোটখাতাটি বের করেছেন, অমনি এক উটকো বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে লাগল। এ রকম তীব্র ও ঝাঁজালো গন্ধদ্যোতক অনুভূতি সইতে না পেরে গ্যেটে দ্রুত জানালার কপাট দুটি খুলে টাটকা ও বিশুদ্ধ বাতাস নিলেন বুক ভরে। এ রকম কটু গন্ধের স্বাদ তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। বিশ্রী গন্ধটা আসলে আসছে কোত্থেকে! শিলার স্বভাবের দিক দিয়ে খুবই পরিপাটি, গোছালো ও উন্নত রুচিসম্পন্ন। আর এ জন্যই তাঁর কক্ষটি থেকে কোনো রকম বাজে গন্ধ আশা করা কল্পনাতীত। গ্যেটে ফিরে এসে বসলেন চেয়ারটিতে। গন্ধের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিশ্চিত হলেন যে আসলে গন্ধটা আসছে টেবিলটার দু-তিনটি দেরাজের কোনো একটি থেকে। অনুমান করে একটি ড্রয়ার টেনে খুলতেই বেরিয়ে এলো একস্তুপ পচা আপেল। সঙ্গে সঙ্গে শার্লটের ডাক পড়ল। গ্যেটের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে অন্দরমহল থেকে ছুটে এলেন শার্লট। বন্ধুপত্নীকে উদ্দেশ্য করে গ্যেটে বললেন, ‘দেখো তো শার্লট, কী কান্ড। টেবিলের ড্রয়ারে একগাদা পচা আপেল। শিলার বুঝি এগুলো এখান থেকে সরাতে ভুলে গেছে, তাই না? জলদি এসে এগুলো সাফসুতরা করে দাও। নইলে শিলার এগুলোর গন্ধে এখানে একদন্ডও টিকতে পারবে না, লেখালেখি তো দূরের কথা।’ গ্যেটের এমন মন্তব্যে শার্লট ঈষৎ আমতা আমতা সুরে বললেন, ‘না…মানে, দেরাজ থেকে যদি ওগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে তুমি এতক্ষণ যা বললে, ফল হবে তার উল্টো।’

    এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, আঠারো’শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান সাহিত্যাকাশে গ্যেটে যদি হয়ে থাকেন তারা, তাহলে শিলার হচ্ছেন পূর্ণচন্দ্র। সাহিত্য রচনার সূচনাপর্বের দিকটায় গ্যেটের চেয়েও শিলার ছিলেন এককাঠি সরেস। মাত্র ২২ বছর বয়সেই শিলার ‘দ্য রাবার’ নাটকটি রচনা করে চারদিকে ধুন্ধুমার হুলুস্থুল বাধিয়ে দেন। অন্যদিকে গ্যেটে তখন পর্যন্ত ম্রিয়মাণ মিটমিটে আলোর চেরাগ; তখন পর্যন্ত গ্যেটে কাব্যনাট্য ‘ফাউস্ট’ রচনা করেননি।

    শার্লটের এ রকম ধাঁধাযুক্ত কথার কোনো মানেই খুঁজে পেলেন না গ্যেটে। তাঁর মাথায় যেন এসব কিছুই ঢুকছে না, সেটা বোধ করি গ্যেটের চোখ দেখেই বুঝে নিলেন শার্লট। তাঁর বারগেন্ডি রঙের রহস্যময় চোখ দুটি গ্যেটের আশ্চর্যময় অনুভূতিপূর্ণ চোখ দুটির ওপর রেখে এর রহস্য ভেদ করতে শুরু করলেন- ‘শোনো গ্যেটে, তুমি এত দিন হয়তো খেয়াল করোনি ব্যাপারটি, যদিও তোমার অনেক আগেই টের পাওয়ার কথা ছিল, তোমার এই বন্ধুটি স্বভাবের দিক দিয়ে কেতাদুরস্ত হলেও তাঁর একটি অদ্ভুত স্বভাব হলো, পচা আপেলের ঝাঁজালো গন্ধের অনুভূতি না পেলে শিলার এক লাইনও লিখতে পারে না। আর এ জন্যই ও সব সময় দেরাজ ভর্তি করে জমিয়ে রাখে একগাদা পচা আপেল। ওই পূতিগন্ধময় আপেলগুলোই নাকি ওর লেখার অনুপ্রেরণা।’

    শার্লটের মুখে এসব কথা শুনে গ্যেটের তখন ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। একি উদ্ভট স্বভাব! এ রকম স্বভাবও কি একজন মানুষের হতে পারে? গ্যেটে মনে মনে ভাবলেন, যদিও শিলার তাঁর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু, কিন্তু স্বভাব ও আচরণের দিক দিয়ে তাঁরা দুজন দুই মেরুর। পচা আপেলের বিষয়টি তাঁর জানা না থাকলেও শিলারের আর দু-চারটি স্বভাব সম্পর্কে গ্যেটে কিন্তু সম্পূর্ণরূপে অবগত। লেখালেখি করার সময়টাতে শিলার অভ্যার্থীদের উৎপাত একদম সহ্য করতে পারেন না। এইতো কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোক এলেন শিলারের সঙ্গে দেখা করতে। সাক্ষাৎপ্রার্থী সেই লোকটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন শিলার। গ্যেটে এটাও খেয়াল করে দেখেছেন যে এ ব্যাপারগুলোতে তাঁর কোনো রাখঢাক নেই। যা মনে আসে, তা-ই তিনি বলে দিচ্ছেন তাঁর যেকোনো দর্শনপ্রার্থীকে। আর এ জন্যই শিলার রাত জেগে লিখতে পছন্দ করেন; বিশেষ করে রাতে যখন তাঁকে জ্বালানোর মতো কেউ জেগে থাকে না, তখন। হাতে থাকে কড়া ধাঁচের এক পেয়ালা কফি।

    ১৭৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ফ্রান্সের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে জোহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২) ও ফ্রেডরিখ শিলার (১৭৫৯-১৮০৫)। ছবি : রজার ভায়োলেট

    এর পরও কখনোসখনো তিনি বেশ ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। তার পরও অদম্য শিলারকে লেখা চালিয়ে যেতেই হয়, আর এ জন্য তিনি আরো একটি অদ্ভুদ কাজ করেন। গামলা ভর্তি কনকনে ঠান্ডা জল এনে রাখেন তাঁর টেবিলটির নিচে, তারপর পায়ের পাতা দুটি ডুবিয়ে দেন সেই গামলায়। শরীরে প্রবেশ করে প্রবল ঠান্ডা এক অনুভূতি আর তাতে উবে যায় তাঁর ক্লান্তি ও ঘুম। ঘুম তাড়ানোর এ রকম অভিনব পন্থা জীবনে আগে কখনো দেখেছেন কি না কিছুতেই মনে করতে পারলেন না গ্যেটে। দিনের বেলাও যে শিলার লেখালেখি করেন না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু দিনের বেলা লেখালেখি করার জন্যও একটি ভিন্ন পরিবেশ প্রয়োজন হয় তাঁর। কড়া লাল রঙের জানালার পর্দাটি একটু ফাঁক করে সামান্যতম আলো প্রবেশ করতে দেন। সেই আধো আলো-অন্ধকারের মধ্যে বসে লেখেন তিনি। হাতে এক কাপ ধারালো কফি এবং টেবিলের দেরাজে রাখা ঝাঁজালো গন্ধযুক্ত পচা আপেল।

    এসব ভাবতে ভাবতেই শিলার এসে উপস্থিত হলেন গৃহে। গ্যেটেকে উদ্দেশ করে বললেন- ‘তুমি কখন এলে? দুজন চুটিয়ে গল্প করছিলে বুঝি।’ প্রত্যুত্তরে গ্যেটে জানালেন, বেশ কিছু সময় ধরে তিনি অপেক্ষা করছেন শিলারের জন্য। শিলার বললেন- ‘আমি দুঃখিত বন্ধু, তোমাকে দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য। আসলে গিয়েছিলাম একটু লাইব্রেরিতে, দু-চারটি প্রয়োজনীয় বই তুলে আনার প্রয়োজন ছিল। লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে বাজারের সামনে দিয়েই আসছিলাম। মনে হলো, কত দিন যে স্মোক করা স্যামন মাছ খাই না মনে নেই। তাই দু-চারটি ভালো জাতের স্যামন মাছ তুলে নিলাম মেছুনির দোকান থেকে। দেখো না, মাছগুলো টাটকা ও সজীব কি না দেখতে গিয়ে মাছ ধোয়া জল লেগে গেল আমার কোটের এই ডান আস্তিনে। উফ্, কেমন আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে রে বাবা!’ সঙ্গে সঙ্গে শিলার তাঁর শরীর থেকে কোটটি খুলে তুলে দিলেন শার্লটের হাতে- ‘এক্ষুনি ধুয়ে দাও তো কোটটা।’ গ্যেটে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর আধো চেনা আধো অচেনা বন্ধুটির দিকে। পচা আপেলের ঝাঁজালো গন্ধ ছাড়া যিনি লিখতে পারেন না, মাছ ধোয়া জলের আঁশটে গন্ধ তাঁকে আজ পীড়িত করছে! গ্যেটের মনে হলো, শিলার যেন সত্যি সত্যিই বৈপরীত্যের এক বরপুত্র।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.