Saturday, September 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    লুব্ধক মাহবুব’র কবিতার মায়াময় জগৎ ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’

    পাঠকের মনে কবি লুব্ধক মাহবুব’র কবিতা পাঠ মাত্রই মনোময় জ্যোৎস্নার রহস্যের আলো ছড়িয়ে দিয়ে যাবে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’ হাতে নিলে গ্রন্থের নামকরণ এই বিশ্বাসের জন্ম দেবে। পাতা খুললে প্রবাসী এই কবির নিজেরই ‘কিছু কথা’য় পাওয়া যেতে পারে সেই রহস্য, জ্যোৎস্না অরণ্য জুড়ে যার অধিবাস, কাছে টানে কিন্তু জড়িয়ে ধরে না। মুগ্ধ করে, মন ঘরে ফিরে যেতে চায় না। তার নিজের ভাষায়, সে হচ্ছে, আকাশের উজ্জ্বলতম যুগ্মতারা লুব্ধকের ঐন্দ্রজালিক মোহময়তা। যার আলোর প্রতিচ্ছায়াতে এই কবির নিজের জগৎ, সেখানেই তাঁর আনন্দ কবিতার উৎস।

    ‘অস্পৃশ্য অনুভূতি’ ও ‘বসন্ত বেলা’ নামে লুব্ধক মাহবুব’র আরও দুটি কবিতার বই এর আগে প্রকাশিত হয়েছে। তার থেকে বর্তমান গ্রন্থে তিনি আরও পরিণত। ঋদ্ধ এবং জ্যোৎস্না অরণ্যের রহস্যময়তায় স্মিতহাস্যে অধরা শব্দের বুননে ঐন্দ্রজালিক। তাঁকে ঘিরে আছে সেই আলো, যে আলোতে কবি নিত্য নিজের মুখোমুখি হয়। প্রকৃতই বলা হয়েছে, লুব্ধক মাহবুব সহজিয়া অনুভবের কবি। তিনি কবিতা নির্মাণ করেন না, সৃষ্টি করেন। সেই সৃষ্টিতে যত্ন আছে, মন আছে, আছে আবেগ। জানার অহমিকা নেই, গরিমা আছে শব্দ-দানার এবং তার সৌন্দর্য পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায়। কবি লুব্ধক মাহবুবের জানার জগৎ. বলার ভঙ্গী, দেখার চোখ আলাদা। তিনি কবিতার শব্দ-মালা গাঁথেন বকুলের মালা গাঁথার মতো আদরে, সৌন্দর্য ও রঙের বিভায়। মনে হয়, চোখের সামনে কোন এক আকাশ-ভাঙা জ্যোৎস্নার ভিতর থেকে সে আসে। এভাবে ডাকে,

    নিঃশব্দে এলো ডাক, কোন পদক্ষেপ নেই কানে,/হাত ধরে নিলো আমার, থেমে গেল সময়ের ধারা।/ এ পথে শুধু আমি আর সে, অজানা অদৃশ্যের দিকে, /সঙ্গী শুধু নিঃশ্বাসের তাল, হৃদয়ের স্পন্দন মৃদু, অস্পষ্ট। (নিঃশব্দে ডাক, পৃষ্ঠা :১০২)

    এই কবির সব কবিতা জুড়ে আছে সতেজ, জীবন্ত উপমা ও চিত্রকল্প। সহজ বচনে আছে হৃদয়ের গভীরে ছায়া হয়ে থাকা মুক্ত জীবনদর্শন। মনে হয়, ‘সে আমার বন্ধু, কোথাও হারিয়ে গেছে, জীবনের রাস্তায় পথ চলছে একা একা। সে ফিরে আসবে।’

    দ্বিভাষিক (বাংলা, ইংরেজি) কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’তে মোট কবিতার সংখ্যা ৮০টি। সুখপাঠ্য ছোট-বড় কবিতার সমাহারে সমৃদ্ধ কবিভাষ্য পাঠককে জানিয়ে দেয়, তার বুকের ভিতরে টানাপোড়েন আছে প্রেমের, বিরহের। কখনো দেশে-বিদেশের, কখনো প্রেমে-অপ্রেমে, কখনো আকাশ ও মৃত্তিকার, নিজের উঠোনের ছায়া থেকে চিরজীবনের বিচ্ছেদের। নিজের মাটি ও মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকেন বটে, তবে ভুলে যায় না মন, দেশের এ প্রান্তের চিত্রকল্প—

    ‘অনন্ত পায়ের তলায়/ হীরের শিকল ছটফট করে/ ঝকঝকে বাতাসে/ সাদা ধোঁয়া উড়ছে/ শনির আখড়ার ইটখোলার/ লম্বা সারির মতো ধোঁয়া’র-’ কথা। আর অপর প্রান্তে তখন-

    আর উত্তর গোলার্ধের/ মাথার উপর তুষার ঢাকা/ আকাশের সাদা ট্রেপেজিয়াম। (জ্যোৎস্না অরণ্য, পৃ.৯-১০)

    ‘জ্যোৎস্না অরণ্য’ কাব্যগ্রন্থে পাঠক যত গভীরে যাবে ততই নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবে। আধুনিক এই কবি’র চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠে ‘সেকাল’ আর ‘একাল’র ফাগুনের পার্থক্য। পরিবর্তনের ক্রমবিবর্তন। কবিতায় অনুভব করা যায়, তিনি বহুবছর ধরে বাস করছেন বিদেশে, কিন্তু তার মন-প্রাণ সবসময় পরে থাকে বাংলাদেশের সরল সবুজে, ফাগুনের রঙে। তার চোখে ‘সেকাল’এর বাংলাদেশ—

    ‘আকাশে রঙের খেলা,/ মাঠে উড়ছে ঘুড়ি/ হাতে রঙের আবির / গানে মুখরিত বাড়ি।/ ধুলোয় মাখামাখি / হাসি ঠাট্টার লীলা বন্ধুদের সাথে,/ ফাগুনের মেলা।’

    আর একাল হলো,

    ‘ফোনে আবিরের ছোঁয়া,/ ভার্চুয়াল আড্ডা,/ ভিডিও কলে গান,/ ভালোবাসার বর্তা।/ শহুরে জীবনে,/ ফাগুনের আবেগ ফিকে,/ প্রকৃতির স্পর্শে,/ হারিয়ে গেছে মিশে।’

    জ্যোৎস্না অরণ্য (Frost-Kissed Wilderness) । লুব্ধক মাহবুব কবিতা । প্রকাশক: সৃজন । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৫ । মুদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017 রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— rokomari.com/book/454772/jyotsna-aronno কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

    সমাজ সচেতন এই কবি মনে করেন, তবুও কিছু রীতিনীতি, কিছু ঐতিহ্য, ভালোবাসার বন্ধন গৃহস্থালিতে এখনো রয়েছে অপরিবর্তিত। যুগ বদলেছে, প্রযুক্তি আমাদের খোল-নলচে পাল্টে দিয়েছে বটে, কিন্তু ফাগুনের মনের রঙ পাল্টায়নি। প্রকৃতপক্ষে, এদেশের মাটির গন্ধ একজন প্রবাসী যত দূরেই থাকুক না কেন, তার শরীর থেকে, মন থেকে মুছে ফেলা সহজ নয়। সে যতবার দেশের বাইরে যায়, ফিরে আসবে বলেই যায় যদি সেই কবি হয় বাঙালি।

    লক্ষ করি, এই কবির সব কবিতা জুড়ে আছে সতেজ, জীবন্ত উপমা ও চিত্রকল্প। সহজ বচনে আছে হৃদয়ের গভীরে ছায়া হয়ে থাকা মুক্ত জীবনদর্শন। মনে হয়, ‘সে আমার বন্ধু, কোথাও হারিয়ে গেছে, জীবনের রাস্তায় পথ চলছে একা একা। সে ফিরে আসবে।’ আর এভাবেই মানুষ বাঁচে। প্রবাসী কবি বাঁচে। ভবিষ্যতের স্বপ্নে। স্মৃতিতে। কেননা, ‘আমার জন্য এক ভালোবাসা রাখা আছে/ যা প্রাচীন প্রার্থনায় মোড়া-’ (প্রত্যাবর্তন)

    এই কবিও চিরকালের প্রেমিক। চাওয়া-পাওয়ায় সরল, সহজ। যার স্বীকারোক্তি এমন-

    ‘তোমাকে বুঝতে বুঝতে/ ভালোবাসতে বাসতে ক্লান্ত আমি-’ (নটরাজ) প্রেমিক হলে এমনই হয়। বলা বাহুল্য, আজ পৃথিবীর বয়স হয়েছে অনেক। বহু পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মানুষের। প্রেমিকের। তবুও ভালোবাসা আছে। ভালোবাসা থেকে গেছে অধরা। যুদ্ধাক্রান্ত আজকের পৃথিবী সাক্ষ্য দেয়, মানুষ মানুষকে ভালোবাসে না। ভালোবাসা চায়। পায় না। তথাপি মৃতের মিছিলে কবি জাগে। ভালোবাসা মাগে। কেননা, কবি চিরকালের মানবতাবাদী। প্রেমিক। পৃথিবী, মাটি ও মানুষ তার আরাধ্য। সেজন্যে বয়ান করেন কষ্টের অনুভূতি,

    কবে আমি সেইসব/ দিনগুলোকে ফিরে পাব,/ সেইসব হিজল, আর আগাছা গাছ,/ বাড়ি প্রজাপতি, মরালেরা…/ সরে গেছে দূরে…কোথাও…(ছেঁড়া স্মৃতি)

    তবুও মনে আছে। মনে পড়ে। যেকারণে কবি ফিরে ফিরে আসে নিজগৃহে, মাটির কাছে, মায়ের কাছে। আসতেই হবে কবিকে। লুব্ধক মাহবুব, কবি, বেঁচে থাকুন কবিতায়। নিত্য অবগাহন করুন কবিতায়। নিত্য পান করুন ‘অরণ্যে জ্যোৎস্না’র শ্যাম্পেন। শুভকামনা সবসময়।

    চমৎকার বাঁধাই ও আঙ্গিকের গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে সৃজন। প্রথম প্রকাশ: মাঘ ১৪৩১, ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বইমেলা। প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু। মূল্য:৪০০ টাকা। সবশেষে আমরা এই কবির উত্তরোত্তর সৃজন সাফল্য কামনা করি।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.