Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    ভাষাভিত্তিক স্বাধীনতার স্বরূপ

    স্বাধীনতা কতটা এসেছে, এবং কী পরিমাণে তাৎপর্য হয়েছে তা নির্ণয় করবার অনেকগুলো নিরিখ আছে। প্রধান নিরিখ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। আরেকটি জরুরি নিরিখ হচ্ছে মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার। প্রশ্নটা প্রতি বছরেই নতুন করে ওঠে, এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বরঞ্চ আগের চেয়ে বেশি করেই উঠেছে- সেটা হলো এতসব সংগ্রাম ও অগ্রগতির পরেও জীবনের সর্বস্তরে ও পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রচলনটা কেন ঘটছে না। প্রশ্নটি এবারে আরো বেশি করে শোনা যাবার কারণ হতে পারে দু’টি। এক. স্বাধীনতার পর ঊনপঞ্চাশ বছর চলে যাচ্ছে, তবুও বাংলাভাষার প্রচলন নেই- উচ্চ আদালতে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ, উচ্চশিক্ষায় সে অব্যবহৃত, উচ্চ প্রশাসনে উপেক্ষিত, উচ্চ শ্রেণিতে অসম্মানিত। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, সংবাদপত্র ও আকাশমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, তাদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা জনগ্রাহ্য প্রসঙ্গগুলোকে সামনে আনার ব্যাপারে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার প্রশ্নের চাইতে অধিকতর জনগ্রাহ্য প্রসঙ্গ আর কী-ই বা হতে পারে?

    কিন্তু প্রচলনটা ঘটছে না কেন? ঘটাই তো স্বাভাবিক। বাংলা এখন আমাদের রাষ্ট্রভাষা, বাংলা যাদের মাতৃভাষা পৃথিবীতে আজ তাদের সংখ্যা ২৫-২৬ কোটি, সেই হিসাবে বাংলা এখন চতুর্থ স্থানে। বাংলায় রয়েছে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। অন্তরায়টা কোথায়? বলা হবে অভাব আছে সদিচ্ছার। কিন্তু কার ইচ্ছার কথা বলা হচ্ছে? ব্যক্তির, নাকি প্রতিষ্ঠানের? ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের সদিচ্ছা কিন্তু অনেক আগেও দেখা গেছে, এখনো যে দেখা যায় না তা নয়, তবে তাতে কাজ হয় নি, বাংলা চলে নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলা প্রচলনের আগ্রহের ব্যাপারে খবর পাওয়া যায়; রাজনারায়ণ বসু জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে নিয়ম চালু করা হয়েছিল যে, কথাবার্তা সব বাংলায় হবে; কেবল তাই নয়, অভ্যাসবশত কেউ যদি ইংরেজি ব্যবহার করেন তবে প্রতি বাক্যের জন্য তাঁকে এক পয়সা হারে জরিমানা দিতে হবে। বলাবাহুল্য এক পয়সা তখন অনেক পয়সা বৈকি। কিন্তু ওই প্রচেষ্টায় তেমন জোর ছিল না, কেননা এটা সীমাবদ্ধ ছিল গুটিকয়েক ভদ্রলোকদের ভেতর, যাঁরা নিজেদেরকে কেবল বাঙালি নয়, একই সঙ্গে বাঙালি ও হিন্দু মনে করতেন, কখনো কখনো হিন্দু পরিচয়টিই বরঞ্চ বড় হয়ে উঠতো। ঠিক উল্টো কাজ অবশ্য করতে আগ্রহী ছিলেন নবাব আবদুল লতিফের অনুসারীরা; তাঁরা বাংলা নয়, উর্দু চালু করতে উৎসাহী ছিলেন; তবে পরস্পরবিরোধী দুই দলের মধ্যে মানসিকতার দিক থেকে এক জায়গায় ঐক্য ছিল। সেটা হলো ‘ছোটলোকদে’র কাছ থেকে দূরে থাকা, এবং নিজেদের সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে উচ্চে তুলে ধরা।

    রাজার ভাষা আর প্রজার ভাষা যে এক হয় না তার প্রমাণ তো আমাদের ইতিহাসেই রয়ে গেছে। বাংলা চিরকালই ছিল প্রজার ভাষা, রাজার ভাষা ছিল ভিন্ন-সংস্কৃত, ফার্সি ও ইংরেজি। এখন অবশ্য রাজা নেই, কিন্তু শাসক শ্রেণি তো আছে; তারা জনগণ থেকে নিজেদেরকে আলাদা মনে করে, সেই যে তাদের দূরত্ব তার প্রকাশ নানা ভাবে ঘটে।

    কিন্তু রাজনারায়ণদের বাংলা ভাষা এবং আবদুল লতিফদের উর্দু ভাষা চালু করবার সদিচ্ছা এ দু’য়ের কোনোটাই যে সফল হয় নি তার মূল কারণ ছিল একটাই। রাষ্ট্রক্ষমতার বিরূপতা। রাষ্ট্র চায় নি স্থানীয় ভাষা চলুক, তাই প্রচলনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র তো চায় বাংলা চলুক, তাহলে চলছে না কেন? জবাবটা সোজা, রাষ্ট্র বলে বটে যে সে চায়, কিন্তু আসলে চায় না, চাইলে বাংলা চলতো। কেন চায় না? এ রাষ্ট্র তো বাঙালির রাষ্ট্র। তাহলে? জবাব হলো এই যে, এই রাষ্ট্র বাঙালিরা প্রতিষ্ঠা করেছে ঠিকই, কিন্তু এটি এখনো জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত হয় নি। রাষ্ট্র রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। এবং এই রাষ্ট্রের কর্তা যারা তারা চায় না বাংলা চলুক, যে জন্য বাংলার এমন কোণঠাসা দশা। এখানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারটা অপ্রাসঙ্গিক।

    রাজার ভাষা আর প্রজার ভাষা যে এক হয় না তার প্রমাণ তো আমাদের ইতিহাসেই রয়ে গেছে। বাংলা চিরকালই ছিল প্রজার ভাষা, রাজার ভাষা ছিল ভিন্ন-সংস্কৃত, ফার্সি ও ইংরেজি। এখন অবশ্য রাজা নেই, কিন্তু শাসক শ্রেণি তো আছে; তারা জনগণ থেকে নিজেদেরকে আলাদা মনে করে, সেই যে তাদের দূরত্ব তার প্রকাশ নানা ভাবে ঘটে। ধনসম্পদ, ক্ষমতা, শিক্ষা, পাহারাদার, পোশাক-পরিচ্ছদ আহারবিহারসহ বহু ক্ষেত্রে শাসকেরা জনগণ থেকে আলাদা, আলাদা তারা ভাষাতেও। তারা ইংরেজিই পছন্দ করে, কেননা ওই ভাষা ব্যবহার করলে তারা যে বাংলাদেশের মানুষ হয়েও সাধারণ মানুষ নয় সেটা প্রকাশ পায়। তাছাড়া বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি হচ্ছে বিশ্ব পুঁজিবাদের আজ্ঞাবহ, ওই পুঁজিবাদের রাষ্ট্র ভাষা হচ্ছে ইংরেজি; সেটা একটা বড় কারণ যে জন্য শাসক শ্রেণি ইংরেজি ভক্ত।

    মোটকথা, আমরা কিছুতেই সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে পারবো না, এগুতেও পারবো না সামনের দিকে, যদি না বাংলার প্রচলন ঘটাতে পারি। বিশ্বায়নের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াবার জায়গাটাও কিন্তু ওই মাতৃভাষার চর্চাই। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক হওয়া সম্ভব।

    ব্যাপারটা তাই স্পষ্ট। বাংলাভাষার শত্রু অন্যকেউ নয়- শত্রু হচ্ছে দেশের শাসক শ্রেণি এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভু। জনগণের ভাষা এখানে ততটাই অসহায় জনগণ নিজেরা যতটা দুর্দশার ভেতর পতিত। ভাষার লড়াইটা আসলেই একটা রাজনৈতিক লড়াই, আগেও ছিল, এখনো রয়েছে। এদেশে বাংলা তখনই সর্বস্তরে ও সর্বপর্যায়ে চালু হবে যখন এ রাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার আগে নয়। ভাষা প্রচলনের চেষ্টাকে তাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, এর বাইরের কাজগুলো হবে সংস্কারমূলক, তাতে অর্জন কিছু ঘটলেও তা বিস্তৃত হবে না, তাদেরকে ধরে রাখাও সম্ভব হবে না।

    বাংলাদেশে এখন যে ধরনের ইসলামী জঙ্গি তৎপরতা চলছে তার সঙ্গেও বাংলার অপ্রচলন সরাসরি জড়িত। জঙ্গিদের প্রায় সবাই মাদ্রাসায় শিক্ষিত, অর্থাৎ বাংলাভাষার শিক্ষা ও ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত। অপরদিকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার যে বিস্তার সেটাও কিন্তু খড়ে-ঠাসা কৃত্রিম মানুষ তৈরি করছে। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ সৃষ্টির জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই নেই।

    মোটকথা, আমরা কিছুতেই সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে পারবো না, এগুতেও পারবো না সামনের দিকে, যদি না বাংলার প্রচলন ঘটাতে পারি। বিশ্বায়নের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াবার জায়গাটাও কিন্তু ওই মাতৃভাষার চর্চাই। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক হওয়া সম্ভব। যে-বৃক্ষের শিকড় দুর্বল সে কী করে আকাশের দিকে বেড়ে উঠবে, তার পক্ষে তো টিকে থাকাটাই অসম্ভব।

    বাংলা ভাষার অবস্থা ও অবস্থানই বলে দিচ্ছে যে, স্বাধীনতা সর্বজনীন হয় নি, তার তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রকাশ লাভ করে নি। যার অর্থ হলো সংগ্রামী সংগ্রামটা চলবে। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু। তার একটি পর্যায় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। কিন্তু মুক্তির প্রশ্নটা রয়েই গেছে। সে মুক্তির জন্য সর্বস্তরে ও ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ চাই। যাতে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, এবং আরো বড় কথা সুস্থ, স্বাভাবিক এবং ঐক্যবদ্ধ হতে পারি।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.