Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকাঃ আফ্রিকান বিশ্বাসের খন্ডাংশ

    প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ (৯)

    যাদুবিদ্যা উগান্ডার সমাজে এখনও এমন ভাবে টিকে আছে যে পত্রিকা খুললে প্রতি সপ্তাহে এ সংক্রান্ত দুই-তিনটি খবর নজরে পড়বেই। এইসব খবর আবার কোন সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের নয়। সারা উগান্ডা জুড়েই এই ধরনের খবরের সন্ধান মেলে।
    তেমনি এক গ্রামের কথা পত্রিকা মারফত জানতে পারি, যেখানকার মানুষ অফ্রিকার ভয়ংকর অসুখগুলোর একটি বলে বিবেচিত ম্যালেরিয়ার সাথে যাদুবিদ্যা এবং আমের সম্পর্ক স্থাপন করতে সমর্থ্য হয়েছে। বিশেষত আমের সাথে এই রোগের সম্পর্কস্থাপনের পেছনে একধরনের চিন্তাশীলতার ছাপ পাওয়া যায়। কারণ বর্ষাকালে একই সাথে বৃষ্টি এবং প্রচুর আমের ফলন হয়। যদিও বৃষ্টি হবার কারণে পানি জমে থাকে আর সেই পানিতে মশা বংশবিস্তার করে থাকে বলেই ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু তারা এর পেছনে বৃষ্টির ভূমিকার চেয়ে আমের ভূমিকাকেই বড় করে দেখে। অন্যদিকে অনেকের কাছে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের সহজ ব্যাখ্যা হলো যাদুবিদ্যা। যেমন একজন গ্রামবাসী জানায়, ‘ম্যালেরিয়া হবার কারণ যাদুবিদ্যা বা মন্দ আত্মা। সে যখন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয় তখন সে তার প্রতিবেশিকে দায়ী করেছিল এবং সেই প্রতিবেশীকে দূরে তাড়িয়ে দেয়ার পর-ই সে আরোগ্য লাভ করে।’ কারও ম্যালেরিয়া হলে সে যাদুকরের স্মরণাপন্ন হয়। সেই যাদুকর তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এর জন্য দায়ী প্রতিবেশীকে সনাক্ত করে দেন। এই সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার পরের ধাপ একটু ভীতিকর। কারণ ঐ ব্যক্তি একক ভাবে অথবা গ্রামবাসী একতাবদ্ধ হয়ে সেই প্রতিবেশীকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে।

    আর যখনই যাদুবিদ্যা আসে তখনই হিংস্রতার প্রকাশ ঘটতে সময় লাগে না। ইস্টারের সপ্তাহে, উগান্ডার দক্ষিণ-পশ্চিমের এক গ্রামে, চার ভাই তাদের খালাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারা তাদের খালার চোয়াল এবং জিহবা আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে তার অবশিষ্ট শরীর নিকটস্থ একটি কলার বাগানে লুকিয়ে রাখে। তাদের চোয়াল আর জিহবা সংগ্রহ থেকে বোঝা যায় যাদুবিদ্যার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তারা আপন খালাকে খুন করে তার চোয়াল এবং জিহবা সংগ্রহ করে। কিন্তু কলার বাগানে মৃতদেহ পুঁতে রাখলেও কুকুরদের সেই মৃতদেহের সন্ধান পেতে সমস্যা হয়নি। কুকুরের দল সেই বাগানে সমবেত হয়ে রক্তাক্ত নারীর মৃতদেহ ভক্ষণ করতে শুরু করলে গ্রামবাসীর কাছে পুরো ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়। যেহেতু ঐ নারী সবার পরিচিত ছিল এবং ঐ চার ভায়ের যাদুবিদ্যা চর্চার বিষয়ে গ্রামবাসী পূর্ব থেকেই অবগত ছিল সেহেতু ঐ চার ভাইকে স্বাভাবিকভাবেই সবাই সন্দেহ করতে শুরু করে। ঐ ঘটনায় বিক্ষিপ্ত হয়ে বিশজন গ্রামবাসী একসাথে হয়ে দল গঠন করে সেই ভাইদের সন্ধানে নেমে পড়ে এবং খুঁজে বের করে। সন্ধান পাওয়ার পর তারা হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দিয়ে তাদের প্রহার করতে শুরু করে।

    পারিবারিক বিরোধের সূত্রে সেই ছন দেয়া কুঁড়েঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেই আগুনে মারা যাওয়া দশজনের সাতজনই ছিল শিশু। কোন কোন শিশু ছিল অন্য পরিবারের। স্থানসংকুলান না হওয়ায় অন্য পরিবারের শিশুদেরও সেখানে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সংবাদের সাথে জুড়ে দেয়া ছবিতে দেখা যায় দগ্ধ শরীরগুলো এক জায়গায় জমা করা। সম্ভবত আগুনের উত্তাপ থেকে বাঁচতে তারা শেষ মুহূর্তে এক জায়গায় সমবেত হয়ে, মুখটাকে রক্ষা করার জন্য উপুড় হয়ে ছিল

    চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই পালিয়ে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে হাজির হয় আর অন্য দুই ভাই আর পালিয়ে যেতে পারেনি। গ্রামবাসী তাদের প্রহার করতে করতে পরপারে পাঠিয়ে দেয় এবং তাদের মৃতদেহ স্থানীয় একটি শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে। যারা যাদুবিদ্যার চর্চা করে তাদের পালিত পশু হত্যাও এখানকার রেওয়াজ। সেই অনুসারে ঐ ভাইদের মালিকানায় থাকা চারটি ছাগল, পাঁচটি মুরগী এবং দুটি শূকর ছানাকে জবাই করা হয়। পরে পুলিশ এসে বিশজন গ্রামবাসীর মধ্য থেকে পনেরজনকে গ্রেফতার করে এবং শৌচাগারে লুকিয়ে রাখা দুটি লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করে। এই ঘটনা একটি দেশের মানুষের বন্যতারই প্রতিচ্ছবি যেন।

    আরেকটি ঘটনার কথা জানা যায় যেখানে ঘটনাটি শুরু হয়ছিল খুব শান্তিপূর্ণভাবে। চারনভূমি ছেড়ে একটি গরু মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়ে। সেখানে একটি শার্ট রোদে শুকানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা ছিল। গরুটি সেই শার্টটি খেতে শুরু করে। ঐ শার্টটি যে ছাত্রের ছিল সে শার্টটি ফিরে পেতে গরুর পেছনে ছুটতে থাকে এবং সেই গরুকে হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল। ঘটনার কিছুদিন পর সেই বালকের পা ফুলতে শুরু করে এবং সে পঙ্গু হয়ে যায়। এবং স্বাভাবিকভাবে ঐ স্কুলের বালকরা এর মধ্যে যাদু এবং যাদুবিদ্যার প্রভাব খুঁজে পায়। এই ধরনের বিষয় মোকাবেলা করার যে একমাত্র কৌশল তাদের জানা আছে তারা সেই কৌশলই প্রয়োগ করে। এবং সম্মিলিতভাবে সেই গরু যে গ্রামের সেই গ্রাম আক্রমন করে। আটটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং গরুর মালিক যিনি (প্রায় সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধ) তাকে যাদু করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করে। তাদের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে ঐ গ্রামের একটি কুকুর, ছয়টি গরু, চৌদ্দটি ছাগল এবং এগারটি মুরগী মারা যায়। তাছাড়া চারটি শৌচাগার, আটজন গ্রামবাসীর কলা এবং কফির বাগান ধ্বংস হয়। গ্রামবাসীদের মধ্যে তিনজন আবার বর্শা এবং ছোরাসহ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঐ স্কুলে অবস্থান নিয়েছিল কিন্তু তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় আর প্রতিশোধ নেয়ার ঘটনা ঘটেনি।
    যাদুবিদ্যা আফ্রিকার মানুষদের কাছে কোন হাস্যকার বিষয় নয়। ভয় কাজ করে এমন কোন বিষয়ের দিকে তাকিয়ে হাসাও কঠিন। যেমন, গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর ছাত্ররা এক সকালে উত্তেজিত হয়ে উঠে যখন তারা দেখে তাদের স্কুল আঙ্গিনায় সদ্য কতল করা একটি ছাগলের মাথা এবং চামড়া বিছিয়ে রাখা হয়েছে, তারা এইগুলোকে যথারীতি যাদুবিদ্যার প্রতি ভক্তি থেকে বিবেচনা করতে শুরু করে। এবং এইসব ঘটনার জন্য তারা ঐ স্কুলেরই প্রধান শিক্ষককে দায়ী করেছিল। কারণ এমনিতেই খাবারের মান নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল এবং সেদিন সকালে আবাসিক ছাত্ররা ঘুম থেকে জেগে তাদের হলের কিছু জানালা ভাঙ্গা পেয়েছিল। তারা ধরে নিয়েছিল তাদেরকে প্রধান শিক্ষক অশালীন এবং নারকীয় কায়দায় হুমকী প্রদর্শন করছে। এর প্রতিবাদে তারা স্কুল পোষাক পরে সারা শহর প্রদক্ষিণ শুরু করে। এবং ধর্মঘট আহবান করে। পুলিশ যেহেতু জানে তাদের রাষ্ট্রের অবস্থা সেহেতু তারা পরে এসে একটি সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করে দেয়।

    যে পৃথিবী যাদু বিশ্বাস দিয়ে শাসিত, যে পৃথিবী অযৌক্তিক বিশ্বাসের কাছে দায়বদ্ধ সেই পৃথিবী নি:সন্দেহে এক প্রান্তিক জনপদ। খুব সতর্কতার সাথে তার দিকে নজর রাখতে হয়। আর যাদুবিশ্বাসের সাথে রাজনীতি আর ভূমি হারানোর ভীতি এরসাথে যুক্ত হয়ে গেছে দেশীয় রাজনৈতিক সমস্যা আর জমি হারানোর ভীতি তাদেরকে আরো অসহায় করে তুলেছে। যদিও দেখে মনে হবে, এখনও আফ্রিকার অনেক উন্মুক্ত আর চারপাশে অনেক ব্যবহার না করা জমি পড়ে আছে কিন্তু আপনি কিছুদূর হাঁটলেই বুঝবেন, আপনি হঠাৎ করে এমন এক জমিতে প্রবেশ করেছেন যার জলমগ্ন এলাকা ভিক্টোরিয়া হ্রদের জলকে স্বচ্ছ আর পরিষ্কার রাখার জন্য অধিগ্রহন করা হয়েছে। মাউন্ট এলগন অঞ্চল একসময় যা শিকারের জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল সেখানে এন্টিলোপ শিকার করতে গিয়ে আপনি আবিষ্কার করবেন, আপনি মূলত উগান্ডার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত সীমানায় ঢুকে পরেছেন। সেই কর্তৃপক্ষের পাহারাদারদের চোখে আপনি চোরাশিকারী। অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ানো সেই গার্ডদের কাছ ঐ চিরায়ত শিকারের অঞ্চলে প্রবেশ মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। আপনি রাখাল হলে জানতেও পারবেন না একদল গরু নিয়ে আপনি কখন চাষাবাদের জন্য সংরক্ষিত ভূমিতে প্রবেশ করেছেন। নিজের অজান্তে আপনি গবাদিপশু নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারেন তানজানিয়ার সীমান্তে। যেখানে আবার আপনার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার উগান্ডার কাউয়াঙগা প্রদেশে গাছ কেটে এমন ভাবে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছে যে মাথার ওপরে শিলাবৃষ্টি সামাল দেয়ার মত কোন বাঁধা আর অবশিষ্ট নেই। ফলে শিলাবৃষ্টির আঘাতে বাড়ি-ঘর, শষ্যাদি, গবাদিপশু সব ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন ঘুমানোর জায়গা কিংবা কোন সংগ্রহ করার মত কোন খাদ্য আর অবশিষ্ট নেই। কত সহজে সব কিছু নি:শেষ হয়ে যায় তা না-দেখলে বোঝা যায় না।

    ভি এস নাইপল ও ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’

    উত্তর থেকে আসা ‘কুঁড়েঘর পুড়ে মানুষের মৃত্যু’ জনিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের একটি ক্যাম্প ছিল সেখানে। সেই ক্যাম্পটি বলে দেয় বর্তমানে কি নিদারুন অবস্থায় তারা নিপতিত। পারিবারিক বিরোধের সূত্রে সেই ছন দেয়া কুঁড়েঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেই আগুনে মারা যাওয়া দশজনের সাতজনই ছিল শিশু। কোন কোন শিশু ছিল অন্য পরিবারের। স্থানসংকুলান না হওয়ায় অন্য পরিবারের শিশুদেরও সেখানে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সংবাদের সাথে জুড়ে দেয়া ছবিতে দেখা যায় দগ্ধ শরীরগুলো এক জায়গায় জমা করা। সম্ভবত আগুনের উত্তাপ থেকে বাঁচতে তারা শেষ মুহূর্তে এক জায়গায় সমবেত হয়ে, মুখটাকে রক্ষা করার জন্য উপুড় হয়ে ছিল।

    তেত্রিশ বছর বয়সী একজন নারী, যিনি ফুলের খামারে কাজ করেন তিনি তার আঠার মাস বয়সী সন্তানকে একটি আলুর মাঠে জীবন্ত পুঁতে ফেলেন। শিশুটি একটি ছালা দিয়ে প্যাঁচানো ছিল এবং তার পা বাঁধা ছিল। মায়ের ছবিতে তাকে অসহায় এবং নিরূপায় লাগছিল। ছালা দিয়ে শিশুটির প্যাঁচানো শরীর এবং বাঁধা পা দেখে মনে হয় এটা কোন যাদুকরের উপদেশেরই প্রতিধ্বনি। এরা প্রায়শই বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রিয় কিছু উৎসর্গ করতে বলে থাকে। সেই দরিদ্র নারী যেন সেই উৎসর্গ করার কথা শুনেই প্রিয় সন্তানকে মাটিতে জীবন্ত কবর দিয়েছে। দরিদ্ররা সর্বদাই এবং সর্বত্রই ব্যথাতুর জীবন কাটায়

    ঐ একই সংবাদপত্রে একজন রমনীর বরাতে জানানো হয়, ‘আমার স্বামীকে আমার চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়’। দুই পক্ষেরই এটা ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। ঐ লোকের প্রথম পক্ষে পনেরটি সন্তান এবং দ্বিতীয় পক্ষে ছয়টি সন্তান ছিল। তারা বাজার থেকে যখন ফিরে আসছিল তখন আচমকাই কলা বাগান থেকে ছোরা হাতে এক লোক বের হয়ে আসে। ছোরা দিয়ে খুন করার সময় আক্রমনকারি মহিলার স্বামীকে বারবার বহুগামী হিসেবে অভিহিত করেছিল। প্রথম পক্ষের পরিবারের অসন্তুষ্টির পাশাপাশি আক্রমনকারির কথা থেকে খ্রিষ্টান ধর্মীয় মূল্যবোধেরও প্রভাব দেখা যায়। স্বামীকে মারার পর আক্রমনকারি স্ত্রীর উপরও চড়াও হয়। এবং তার একটি হাত কর্তন করে ফেলে। হয়তো সে আরও ক্ষতি করতো কিন্তু হঠাৎ করে দূরে সাইকেলের হেডলাইট জ্বলে উঠলে সে পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে ঐ রমনীর আরও একটি হাত কেটে ফেলতে হয়। তিনি পত্রিকাকে জানান, ‘আমি এখন কি করে সন্তানদের স্কুলে পাঠাব এবং কি খাওয়াব তা ভেবে অন্ধকারে আছি।’

    ঐ পত্রিকার একই সংখ্যার আরও একটি সংবাদের শিরোনাম, ‘সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার অভিযোগ’। তেত্রিশ বছর বয়সী একজন নারী, যিনি ফুলের খামারে কাজ করেন তিনি তার আঠার মাস বয়সী সন্তানকে একটি আলুর মাঠে জীবন্ত পুঁতে ফেলেন। শিশুটি একটি ছালা দিয়ে প্যাঁচানো ছিল এবং তার পা বাঁধা ছিল। মায়ের ছবিতে তাকে অসহায় এবং নিরূপায় লাগছিল। ছালা দিয়ে শিশুটির প্যাঁচানো শরীর এবং বাঁধা পা দেখে মনে হয় এটা কোন যাদুকরের উপদেশেরই প্রতিধ্বনি। এরা প্রায়শই বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রিয় কিছু উৎসর্গ করতে বলে থাকে। সেই দরিদ্র নারী যেন সেই উৎসর্গ করার কথা শুনেই প্রিয় সন্তানকে মাটিতে জীবন্ত কবর দিয়েছে। দরিদ্ররা সর্বদাই এবং সর্বত্রই ব্যথাতুর জীবন কাটায়। কিন্তু উগান্ডার ধনী এমনকি রাজকীয় গোত্রের লোকদের জীবনও সমমাত্রায় দুর্বিষহ।

    ‘আমরা স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারিনি। স্বাধীনতা হারানোর পর যে দুর্গতির মধ্যে আমরা পতিত হয়েছিলাম তা আর কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ১৯৮৪ সাল থেকে শুরু হওয়া দুর্গতি এখনও চলছে। নিয়মানুয়ায়ী ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আপনারা কি এমনারারা যাচ্ছেন? গেলে সেখানে নিজের চোখে ধ্বংসাবলী দেখতে পাবেন। দেখবেন সেখানে এক সময়ের প্রাসাদে গাজার গাছ জন্মাচ্ছে। যার কারণ রাজনীতি। যখন আপনি সংস্কৃতির মূল উৎপাটন করবেন তখন আপনি দেখবেন কিভাবে বিবাদ এবং অরাজকতা বিস্তার লাভ করে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বেঁচে থাকবার জন্য যা ইচ্ছে তাই করে।’
    তার এই বক্তব্যের সাথে প্রিন্স কাসিমের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাই। ‘বেঁচে থাকার জন্য যা সম্ভব তা করার পাশাপাশি তারা পৃথিবীর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সাথেও তাল মেলাতে চায়। এই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে। আমাদের নিজস্ব ধর্ম কোন বর্বর ধর্ম ছিল না। পূর্বপুরুষদের ভক্তির উপর তা প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেমন আপনার মৃত পিতাকেও আপনি ভক্তি করেন। পানীয় পান করার আগে পূর্বপুরুষকে তর্পন করেন। ঐতিহ্যকে ধ্বংসকরন, সাংস্কৃতিক বাঁধাগুলোকে উৎপাটন করে ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের একচা জাতী হিসেবে একত্রিত করতে চেয়েছে। সংস্কৃতিকে উৎপাটন করে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করতে চাইলে বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না।

    আলোচনার মাঝখানে একজন শিক্ষিত (দরিদ্র নয় আবার রাজকীয় গোত্রের কেউ নয়, উগান্ডার একবারে ভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা, স্পষ্টত খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী কিন্তু নিজের মূলের প্রতি অনুগত একজন) নারী কথা বলা শুরু করেন। ‘আধুনিকতা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে মুছে দিতে চায় যা রাজনৈতিক আধিপত্যকামীতাকেই স্পষ্ট করে তুলে। এটা খ্রিষ্টান ধর্ম এবং চিরায়ত ধর্মের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। লাংগো ঐতিহ্যমতে যদি খরা হয় বা খরা দীর্ঘায়িত হয় তবে মুরুব্বীরা একসাথে সমবেত হয়ে কিছু উৎসর্গ করতো। আমি আমার দাদীর কাছ থেকে তা জানতে পেরেছি। আর মিশনারীরা এসে বললো এটা শয়তানের পূজা। সংস্কৃতিকে মেরে ফেলা যায় না বলেই আজ ঐ কাজটিকে বলা হচ্ছে যাদুবিদ্যা। আমার দাদীর যমজ বাচ্চা হয়ে মারা যায়। তখন সেই বাচ্চা দুটোকে একটি গভীর মাটির পাতিলে করে কবর দেয়া হয় এবং কবরের উপর তাদের রক্ষা করার জন্য একটি আচ্ছাদন দেয়া হয়েছিল।

    প্রত্যেক বছর আমার দাদী সেই কবরে যেয়ে নতুন করে আচ্ছাদন দিতেন, তাদেরকে খাবার দিতেন এবং কবরের পাশে নৃত্য-গীত করতেন। কিন্তু তিনি যখন খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষা নেন তখন তিনি তা বন্ধ করে দেন। কারণ খ্রিষ্টান ধর্মমতে তা অনুমোদিত না। তাকে সেই কবরের আচ্ছাদন সরিয়ে নিতে হয় এবং তিনি ভীত হয়ে পড়েন। তার মনে হতো কবরস্থ শিশু দুটি ফিরে এসে তার জীবিত সন্তানদের খুন করবে। আমি নিজের সাথে নিজে কথা বলেছি। আমার কাছে এটা শুধুই একটি বিশ্বাস যা আমার মধ্যে ভাল বোধের জন্ম দেয়। চিরায়ত ধর্ম শুধু অর্থ আদায়ের বিষয় ছিল না। এটা ছিল সামষ্টিক আত্মার পরিচায়ক। যেমন খরা ছিল একটি সামষ্টিক সমস্যা তা মোকাবেলা করা হতো সামষ্টিকভাবে।’
    পত্রিকার রিপোর্ট আর যোগ্য মানুষদের সাথে কথা বলার পর বুঝতে পাড়ি দরিদ্র রাষ্ট্রটি এখনও খুব অসহায়। চল্লিশ বছর দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ চলার পর এখনও তারা একটি উত্থান পর্বের জন্য প্রতীক্ষায় আছে— যে উত্থান তারা আশা করছে কার্যত সেই উত্থানের মধ্য দিয়ে কিছুই হয়তো অর্জিত হবে না।


    [অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.