Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকাঃ আফ্রিকান বিশ্বাসের খন্ডাংশ

    প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ ()

     

    ১৮৪০ সালের দিকে আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব দিক থেকে আরব বণিকরা উগান্ডায় আসতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সোনা আর দাস সংগ্রহ। বিনিময়ে তারা দিয়েছিল নিন্ম মানের আগ্নেয়াস্ত্র আর নানারকম উপহার সামগ্রী। তারা তৎকালীন ভয়ংকর শাসক কাবাকা সুন্নাহ’র মন জয় করে নিয়েছিল আয়না উপহার দিয়ে। কাবাকা সুন্নাহ প্রথমবারের মত নিজের মুখ দেখতে পেয়ে ভীষণ পুলকিত হয়ে উঠেন। সম্ভবত সেই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি আরবদের বিশ্বাস এবং বিশেষত মৃত্যু পরবর্তী যে বেহেশতের কথা বলে থাকে বিশ্বাসীরা তাতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। আরবদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা ইসলাম ধর্ম এখন উগান্ডায় প্রতিষ্ঠিত। তবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও এখানকার মুসলমানরা এখন নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পৃথক পৃথক মসজিদ কাম্পালার পাহাড়ের চূড়ায় শোভা পাওয়ার মধ্যে দিয়ে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং বিভক্তি উভয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠে। আমাদের উগান্ডা উপস্থিতির সময় উগান্ডার বড় ভাই হিসেবে পরিচিত লিবিয়ার নেতা কর্ণেল গাদ্দাফি এসেছিলেন একটি মসজিদ উদ্বোধনের জন্য। বিপুল সম্পদের অধিকারি কর্ণেল গাদ্দাফির সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছিলেন আফ্রিকা মহাদেশের আরও চার-পাঁচজন রাষ্ট্রপ্রধান।
    হাবীব নামের একজন উগান্ডার ধনকুবের মুসলমান ব্যবসায়ীর সূত্রে লিবিয়ার সাথে উগান্ডার সম্পর্কের বিশেষ উন্নতি ঘটেছে। হাবীব উগান্ডার সবচেয়ে প্রাচীন মুসলমান পরিবারগুলোর একটির সদস্য। হাবীবের পিতামহ ১৮৪৮ সালে আরবদের দ্বারা ধর্মান্তরিত হন। এবং ১৮৮০’র দশকের শেষ দিকে মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে যে যুদ্ধ বিরাজমান ছিল তার মধ্যেও টিকে ছিলেন। সেই যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হয় এবং তাদেরকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শাসকরা পশ্চিমের বনালে তাড়িয়ে দেয়।
    কিন্তু হাবীবের পিতামহ তার বিশ্বাস থেকে সরে যাননি। তিনি একজন ধর্ম প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১০৪ বছর বেঁচে থেকে তিনি পায়ে হেঁটে ধর্ম প্রচারের কাজটি চালিয়ে যান। হাঁটতে হাঁটতে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি বহুদূরের রুয়ান্ডা পর্যন্ত গমন করেন। সেখানে তিনি তিনটি বিয়ে করেন। তার সেই স্ত্রীদের মধ্যে একজন ছিল হুতু উপজাতীর এবং দু’জন টুটসি উপজাতীর। এভাবে তিনি একুশ সন্তানের পিতা হয়ে উঠেন।

    ভি এস নাইপল ও ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’

    হাবীবের পিতার জীবনের শুরুটা ছিল দারিদ্রপীড়িত। তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন না। তিনি পশুপালন করতেন। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরবর্তী স্থানে তার গরুর খামার অবস্থিত ছিল। পাশাপাশি তিনি সাইকেল এবং মোটর সাইকেলের টায়ার মেরামত করতেন। কিন্তু ঐসব কাজ থেকে যথেষ্ট আয় করতে না পেরে অন্যদের মত তিনিও সীমানা অতিক্রম করে কংগো চলে যান। সেখানে স্বর্ণখনিতে কাজ শুরু করেন এবং সেই সোনার ব্যবসার সুবাদে তিনি ধীরে ধীরে ধনী হয়ে উঠেন।
    হাবীব জানান, ‘আমরা এক ধরনের যুথবদ্ধ জীবন যাপন করতাম। আমাদের একসাথে আহার করতে হতো। প্রত্যেক স্ত্রীর আলাদা নিজস্ব সবজি বাগান থাকত এবং প্রত্যেক স্ত্রীকে মাসের একটি সপ্তাহ রান্না করতে হতো। পুরো পরিবারের সবার জন্য রান্নার ব্যবস্থা করার কাজে পরিবারের অন্য রমনীরা তাকে সাহায্য করতো। প্রত্যেক বেলার আহারে প্রায় ত্রিশজন অংশগ্রহন করতো। সকাল দশটার দিকে যার রান্নার দায়িত্ব থাকত তার বাগানে অন্য স্ত্রীরা তাদের কন্যা সমেত উপস্থিত হতো। তারা সেখানে যদি কাঁচা কলার খোসা ছাড়াত তবে সেই কলা বা অন্য সবজি রান্না ঘরে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বালক বা পুরুষদের ডাকা হতো। তাছাড়া কূয়া থেকে জল তোলা, লাকড়ি বা কফি সংগ্রহের মত কাজগুলো পুরুষদেরই করতে হতো। নারীদের ঐ ধরনের কাজ করা নিষিদ্ধ ছিল।’
    তারা এখন তাদের গ্রামের ধনী পরিবার। তাদের গাড়ি আছে এবং কাচের জানালা সমৃদ্ধ পাকা দালানটি ঐ গ্রামের মধ্যে একমাত্রও বটে। গ্রামের অন্য অধিবাসীরা কাঁদামাটি আর পাতা দিয়ে তৈরি কুঁড়ে ঘরে বাস করে। হাবীবদের পরিবারের বাড়ির বাইরে স্যানিটারি লেট্রিন থাকলেও প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য ব্যক্তিগত গোসলখানা বিদ্যমান।
    ১৯৭৯ সালে ইদি আমিনের পতনের পর তাদের গ্রামের লোকেরা মুসলমানদের হত্যা করা শুরু করে। কিন্তু হাবীবদের পরিবার অক্ষত থাকে। কারণ তারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বিশেষত বিয়েতে কনে আনার সময় প্রতিবেশিদের গাড়ি দিয়ে সাহায্য করতো। ফলে গ্রামবাসীরা তাদের বিশেষ সম্মান করতো। সেই সুবাদে তারা রক্ষা পেয়ে যায়।

    বাবা তাকে বুগান্ডায় নিয়ে যায় যাতে সে আরবীর পাশাপাশি ইংরেজিও শিখতে পারে। এবং ১৯৭১ সালে, যখন হাবীবের বয়স আঠার তখন যে বত্রিশজন ছাত্রকে স্কলারশীপের জন্য নির্বাচিত করা হয়, হাবীব ছিল তাদের মধ্যে একজন। সে স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে লিবিয়ায় গেল এবং সেখানে শরীয়া এবং মুসলিম আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করল। লিবিয়ায় অবস্থানের কারণে সে অনর্গল আরবী বলার সক্ষমতা অর্জন করল। এবং এই আরবী বলতে পারাটা তার জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দিল। সে লিাবয়ায় অবস্থিত উগান্ডার দূতাবাসে দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করে। কারণ একই সাথে অফ্রিকান এবং আরব ভাষা জানা লোক তখন খুব কমই ছিল

    হাবীব পড়াশোনায় ভাল ছিল। তার বাবা তাকে বুগান্ডায় নিয়ে যায় যাতে সে আরবীর পাশাপাশি ইংরেজিও শিখতে পারে। এবং ১৯৭১ সালে, যখন হাবীবের বয়স আঠার তখন যে বত্রিশজন ছাত্রকে স্কলারশীপের জন্য নির্বাচিত করা হয়, হাবীব ছিল তাদের মধ্যে একজন। সে স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে লিবিয়ায় গেল এবং সেখানে শরীয়া এবং মুসলিম আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করল। লিবিয়ায় অবস্থানের কারণে সে অনর্গল আরবী বলার সক্ষমতা অর্জন করল। এবং এই আরবী বলতে পারাটা তার জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দিল। সে লিাবয়ায় অবস্থিত উগান্ডার দূতাবাসে দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করে। কারণ একই সাথে অফ্রিকান এবং আরব ভাষা জানা লোক তখন খুব কমই ছিল। সেই সময়ের শাসক ইদি আমিন তার সেই দক্ষতায় খুব খুশি হয়। ইদি আমিনের পর তিনি কর্ণেল গাদ্দাফিরও নজর কাড়েন। সেই নজরকাড়া ছিল তার লিবিয়ার সাথে যোগাযোগের শুরু, যা পরবর্তী সময় নানাভাবে তার কাছে হিসেবে সাফল্য ধরা দিতে শুরু করে।
    হাবীব নিজেকে কি ভাবে? লিবিয়ান নাকি উগান্ডিয়ান? নাকি মুসলমান বা আফ্রিকান?
    হাবীব বলেন, ‘আমি নিজেকে মুসলমান বিবেচনা করি। আমার পিতামহ ঘাস দ্বারা খৎনা করে মুসলমান হন। আমার এবং আমার পিতার খৎনা হয় জিলেট ব্লেড দিয়ে। আমি সেই দিনের কথা এখনও মনে করতে পারি, যেদিন খৎনাকারি এলো আমাদের বাড়ি। সেদিন সব বালকদের আলাদা করে পর্দার আড়ালে নেয়া হয়। আমার তখন বয়স ছিল পাঁচ। খুব কৌতুহলি ছিলাম কি হয় দেখার জন্য। এই কৌতুহলই বিপদ ডেকে আনলো; তারা আমাকে হঠাৎ ধরে ফেলল। এবং আমারও খৎনা সম্পন্ন করে দিল। ঐ ঘটনা এখনও আমার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে।’
    একজন শিশু হিসেবে হাবীবকে শেখানো হয়েছে ঐ আফ্রিকান ধর্ম অর্থহীন। তার মতে ‘আমরা এমন একটি বিশ্বাসের মধ্য বড় হয়েছি যেখানে আফ্রিকান ধর্মকে পৌত্তলিকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা সেই ধর্মকে অবজ্ঞা করতে শিখেছি। আমিও আমার সন্তানদের ঐ ধর্মের কাছ ঘেষতে দিই না।’
    একইরকম কন্ঠে, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে হাবীব বলে যান,‘আমার বড় হওয়ার সাথে এবং পৃথিবীকে জানার পর আমি বুঝি আফ্রিকানদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার এটা একটা কৌশল ছিল। যেটা সাম্রাজ্যবাদিরা সর্বত্রই করে থাকে।’
    আমি তার কাছ থেকে এমন একটা বক্তব্য আশা করিনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম সে যা বলেছে তা-কি সে বিশ্বাস করে এবং সাম্রাজ্যবাদিদের মধ্যে ইসলামকেও অন্তর্ভুক্ত করে কি না? সে আমাকে বিস্মিত করে ইতিবাচক উত্তর দেয়। আমি তার কাছ থেকে আরও কিছু শুনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার কিছু ব্যবসায়িক বন্ধু যারা গাদ্দাফির সফরের পর থেকে হোটেল রুমে জড়ো হয়েছিল তারা তাকে নিয়ে যায়। যদিও সে ফিরে আসবে বলে কথা দিয়েছিল কিন্তু সে আর ফিরে আসতে পারেনি। এবং পরের দিন সে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়।

    [অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.