Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকাঃ আফ্রিকান বিশ্বাসের খন্ডাংশ

    প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ (৬)

    রোমান ঐতিহাসিক টেসিটাস (ইতিহাসে একাধিক টেসিটাস নামের ইতিহাসবিদ পাওয়া যায়। তবে রোমান একজনই) এর মতে, প্রাচীন জার্মানিক লোকেরা বিশ্বাস করতো শ্রষ্টাকে কোন মন্দিরে কিংবা চার-দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা এক ধরনের অবমাননার সামিল। বরং মানুষের উচিত নদী, বন কিংবা মাটিতে যে স্থানগুলো শ্রষ্টারই প্রতিরূপ হয়ে উঠে তেমন উন্মুক্ত স্থানে তার উপাসনা করা। এবং বর্তমান উগান্ডাতে আমরা মন্দিরের যে ধারনা পাই তার অনেকগুলোতেই প্রাচীন জার্মানিকদের ধারনার প্রতিফলন দেখি। কাবাকাদের সৌধ একরকম মন্দির বটে কিন্তু সারা বুগান্ডা (রাজতন্ত্র চলাকালীন উগান্ডার নাম) জুড়ে এমন অনেক মন্দির আছে- যেমন জলপ্রপাত কিংবা কিম্ভুতকিমাকার কোন পাথর যা মন্দিরের মতই উপাসনাযোগ্য। যদি কোন পর্যটকের বাগান্ডা উপজাতীর পবিত্রতা বিষয়ে ধারণা না থাকে, এই ধরনের পরিবেশে কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা না-থাকে, কিংবা উপজাতীয়দের গল্প মেনে নিতে কষ্ট হয় তারপরও তারা ঐসব স্থানের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হবেন এবং নিজেকে প্রকৃতির একটি অংশ বলেই মনে করবেন।
    কাম্পালা শহর থেকে ত্রিশ মাইলেরও কম দূরে মুকোনো জেলায় অবস্থিত সিজিবুয়া জলপ্রপাতকে তেমনি একটি প্রাকৃতিক মন্দির হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রিন্স কাসিম আমাকে পরবর্তী সময় জানিয়েছিল মুকোনো’র ঐ জলপ্রপাত বিখ্যাত ‘উৎসর্গ’ করার জন্য। যখন আমরা সেখানে যাই তখন আমরা এই তথ্যটি জানতাম না। ফলে যখন কাসিম আমাকে উৎসর্গের কথা বলেন তখন আমি বুঝতে পারি এই তথ্যটি আগে জানা থাকলে— ঐ জলপ্রপাত দেখার দৃষ্টিভংগিতে নতুন কোন মাত্রা যোগ হতে পারত।
    ঐ মন্দির দেখার জন্য আমরা জিনজা নামের রাস্তা ধরে রওয়ানা দিয়েছিলাম। এবং ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে দেখেছিলাম কেমন করে অপরিকল্পিত আধা-নগরায়ন ভূমির প্রকৃতি এবং পুরনো সামাজিক ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। ঐ রাস্তা ধরে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একটা বাণিজ্যিক কেন্দ্রের সামনে এসে একটু বাঁক নিয়ে আমরা পুরনো কাম্পালার ভাঙ্গা রাস্তা ধরে এগুতে থাকি। আমাদের চারপাশের সবুজ ঝোপগুলো এমন একটা পর্দা তুলে রেখেছিল যে রাস্তার শেষ মাথায় কি আছে তা আমরা আগেই দেখতে পেতাম না। হঠাৎ রাস্তার শেষপ্রান্ত আমাদের সামনে উদয় হলে আমরা প্রায়শ বিস্মিত হচ্ছিলাম। এমনি এক সময় আমরা এক রাস্তার মাথায় একটি জলপ্রপাতের চিহ্ন আঁকা সাইনবোর্ড দেখি এবং সেই সাইনবোর্ডের পরেই ঝোপ-ঝাড়ের মাঝে পথরুদ্ধ করে রাখা একটি লোহার উঁচু গেইটের সন্ধান পাই।
    সেই গেটের পাশেই কয়েকজন তরুণকে আপাতদৃষ্টিতে অলস বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। তবে তাদের মধ্যেই একজন ছিল আমাদের গাইড। আমরা ঐ প্রাকৃতিক মন্দির দেখতে যাবার আগেই ঐ গাইডের বন্দোবস্থ করে রেখেছিলাম। সেই গাইড রাস্তার মাঝের প্রতিবন্ধকতাটি সরিয়ে নিয়েছিল এবং প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের জানিয়েছিল এই প্রাকৃতিক মন্দিরের একটা ‘সাংস্কৃতিক মূল্য’ আছে। সাংস্কৃতিক মূল্যের কথা বলে সে আমাদের মধ্যে আরও জানার যে স্পৃহা তৈরি করেছিল পরবর্তী সময় আমাদের সেই প্রত্যাশা সে পূরণ করতে পারেনি। কারণ গাইড ছিল ইংরেজিতে কাঁচা। বলতে গেলে প্রথম বাক্যের মধ্য দিয়েই সে তার সব কথা বলা শেষ করেছিল।

    কয়েকজন তরুণকে আপাতদৃষ্টিতে অলস বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। তবে তাদের মধ্যেই একজন ছিল আমাদের গাইড। আমরা ঐ প্রাকৃতিক মন্দির দেখতে যাবার আগেই ঐ গাইডের বন্দোবস্থ করে রেখেছিলাম। সেই গাইড রাস্তার মাঝের প্রতিবন্ধকতাটি সরিয়ে নিয়েছিল এবং প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের জানিয়েছিল এই প্রাকৃতিক মন্দিরের একটা ‘সাংস্কৃতিক মূল্য’ আছে। সাংস্কৃতিক মূল্যের কথা বলে সে আমাদের মধ্যে আরও জানার যে স্পৃহা তৈরি করেছিল পরবর্তী সময় আমাদের সেই প্রত্যাশা সে পূরণ করতে পারেনি

    আমরা জলপ্রপাত দেখার আগেই আছড়ে পড়া জলের শব্দ শুনেছিলাম আর দেখেছিলাম জলপ্রপাত থেকে নেমে আসা জলের ধারা। আমাদের বাম পাশে একটা নদীর ধারা নজরে পড়েছিল যা নেমে এসেছিল প্রায় একশ ফুট উঁচু খাঁড়া পাথুড়ে পাহাড় থেকে। আমাদের কাছে হঠাৎ উন্মুক্ত ভূমি, জলের ধারা এবং ঝর্ণার পতনের ভয়ংকর শব্দ অপ্রত্যাশিত ছিল। উপর থেকে আছড়ে পরা জল বহুধারায় বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার নদীতে এসে মিলিত হয়েছিল। জমা হওয়া জলের পাশে, জলপ্রপাত থেকে বেশ দূরে, একটা ঘাসের অববাহিকা নজরে পড়েছিল। দূরের জলপ্রপাত থেকে নেমে আসা পানির ছাটের কারনে সেই অববাহিকার ঘাসগুলো ছিল সর্বদা সতেজ। শুধু ঘাসই নয় জলপ্রপাতের চারপাশের সব কিছুই ছিল ঘন সবুজ। অনেক ধ্বংসের পরও প্রকৃতি এখানে তখনও প্রাণবন্ত। জলের ধারা বাম থেকে নেমে ডানে চলে যাচ্ছিল এবং ক্রমশ শান্ত নদীতে রূপ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তের কোন একটা ছোট পাহাড়ের গা ছুঁয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল। পতনশীল জলের ধারার পেছনে এক সারি কাপড় ঝুলানো ছিল। সম্ভবত ঐ প্রাকৃতিক মন্দিরের যারা দেখ-ভাল করেন তারা কাপড়গুলো রোদে শুকাতে দিয়েছিল। আমাদের হাতের ডানের সূর্যালোকিত স্থানে মোচাকৃতির কিছু কুঁড়ে ঘরের ছাদ উঁকি দিচ্ছিল। সেখানে সম্ভবত মন্দিরের পরিচর্যাকারিরা অবস্থান করেন।
    ঐ প্রাকৃতিক মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র জায়গা মনে করা হয় জলপ্রপাতের শীর্ষতম স্থানকে। এই পবিত্র স্থানের আত্মা ঐখানে কেন বাস করে তা নিয়ে উপজাতীয়দের নিশ্চয়ই একটা গল্প আছে। এখানকার মানুষের বিশ্বাস ঐ উচ্চতম স্থান থেকে গড়িয়ে পড়া পানি সব পাপ ধুয়ে ফেলে। আপনাকে সেই পবিত্রস্থানে যেতে হলে সম্মানপ্রদর্শনের জন্য খালি পায়ে যেতে হবে। এবং আপনার মুখ এবং হাত নয়বার ঐ জলপ্রপাতের পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। আমি সেই জলপ্রপাতের চূড়ায় একটা সবুজ বেষ্টনী দেখেছিলাম। সেই বেস্টনীটি সম্ভবত কেউ যেন চূড়ার খুব সন্নিকটে না যায় তাই দেয়া হয়েছে।
    ঐ স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষ কিভাবে উপভোগ করবে তা সহজেই বোঝা যায়। আমি ভেবেছিলাম, জলপ্রপাত এবং তৎসংলগ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্যেও বিষয়টি মানুষের কাছে আদিকাল থেকে পরিচিত এবং এর পবিত্রতার ধারনাটিও অনেক প্রাচীন। কিন্তু যে তথ্যটি আমার মধ্যে ধাঁধার জন্ম দিয়েছে তা হলো প্রথম এই স্থানটি যিনি পরিদর্শন করতে আসেন এবং প্রথম যিনি এই স্থানটিকে পবিত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি কোন প্রাচীন শাসক নন। তিনি কাবাকা মুয়াংগা। যিনি ছিলেন মিউতসা-১ এর উত্তরসূরী এবং ১৮৮৬ সালে নিজ ভৃত্যদের পুড়িয়ে মারার নির্দেশ প্রদানের জন্য বিখ্যাত।
    এ পবিত্রস্থান মুয়াংগা পরিদর্শনে এসে একটি বৃক্ষরোপন করেছিলেন। যে বৃক্ষটিকে এখনও সম্মান করা হয়। পরবর্তী সময় তার অনুকরনে মিউতসা-২ যাকে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং ১৯৬৯ সালে যিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন তিনিও একটি চারা রোপন করেছেন।

    পাঁয়ে হাঁটা একটি সেতু জলপ্রপাত সংলগ্ন জলাধারের উপর দিয়ে পর্যটকদের অন্যপাশের পাথুরে ঢালে নিয়ে যায়। সেই ঢালে অনেকগুলো অল্পবয়সী ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগানো আছে। মাত্র দশ বছর আগে লাগানো এই গাছগুলো রোপন করা যে ভুল ( কারন ইউক্যালিপ্টাস বিদেশি গাছ) হয়েছে তা এখন কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছে। সেই গাছগুলোকে স্থানীয় গাছ দিয়ে প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনার কথাও আমরা গাইড মারফত জানতে পারি। হয়ত একারণে ইউক্যালিপ্টাস গাছের মাথাগুলো কেটে ফেলা হয়েছে তবে গাছের গুড়িগুলো এখনও অক্ষত। ইউক্যালিপ্টাস গাছের পেছনে একটা পিচ্ছিল আঁকা-বাঁকা রাস্তা উপরে উঠে গেছে। ঐ আঁকা-বাঁকা পথের শেষ মাথা থেকে শুরু হয়েছে ধর্মীয় মন্দিরের প্রথম অংশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। সেখানে খুব পরিশীলিত একটি ছোট গুহা দেখা যায়। অগভীর সেই গুহাতে একটি মাটির পাত্র, বর্শা এবং নৈবদ্যসব কিছু ঝুড়ি দেখা যায়। আমাদের গাইড জানায় সাধারনত নৈবদ্য হিসেবে ডিম প্রদান করাই এখানকার রেওয়াজ। কারণ গুহার ভেতরে একটি অজগর সাপ বাস করে এবং সে সময় সময় ডিম খেতে বের হয়ে আসে। তবে আমি গুহার ভেতরে বা বাইরে কোথাও অজগর সাপের চলাচলের কোন প্রমান খুঁজে পাইনি।
    গুহা দেখা শেষ করে আমরা কুঁড়ে ঘরের মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করি। এটি নানারকম বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত। তবে আমরা সেই সকালে কোন পুরোহিত বা পরিচারককে মন্দিরে উপস্থিত পাইনি। সম্ভবত যখন কোন সম্মানি বা অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা থাকে তখনই পুরোহিত হাজির হন কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমরা কোন প্রাপ্তিযোগের আশায় সেখানে যাইনি। আমরা ছিলাম দর্শক মাত্র। যে কারণে একজন দৈবজ্ঞর প্রয়োজন হয়, আমাদের ক্ষেত্রে সেই কারণটি ছিল অনুপস্থিত। আমাদের সেই জলপ্রপাতের  কাছ থেকে কোন দৈববাণী লাভের কোন ইচ্ছা বা সম্ভাবনা ছিল না। যেহেতু আমাদের কোন প্রাপ্তির সম্ভাবনা বা আগ্রহ নেই সেহেতু আমরা মন্দিরের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ থেকে বিরত থাকি।
    পরে আমি জানতে পারি, সেই কুঁড়ে ঘরের মন্দিরটিকে (সম্ভবত একমাত্রও বটে) একাধিকবার খ্রিষ্টানরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। খ্রিষ্টানরা কোনরকম প্রমাণ ছাড়াই এই সুপ্রাচীন দর্শনীয় স্থানটি নিজেদের বলে দাবী করে থাকে। চার্চ থেকে একজন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি এসে এই স্থানটিকে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে যাতে কোন আত্মা এখানে থাকতে না-পারে। মজার কথা হলো, ঐ আত্মার হাত থেকে মন্দিরটিকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে তারা প্রাগৈতিহাসিক আত্মার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করে গেছে। এবং মানুষের মনে আরও দ্বিধা তৈরি করতে যেখানে একটা পায়ে হাঁটা সেতু ছিল সেখানে কাবাকা ফাউন্ডেশনের নাম উৎকীর্ণ করে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।

    অবশেষে আমাদের প্রস্থানের এবং একই সাথে গাইডকে অর্থ প্রদানের সময় চলে এল। গাইডকে আমাদের পবিত্রস্থান পরিভ্রমণে এবং আমাকে ইউক্যালিপ্টাস গাছের গুড়ির পিচ্ছিল পথ ধরে উপরে উঠতে সাহায্য করার জন্য আমরা অর্থ প্রদান করেছিলাম। কিন্তু বিদায় বেলায় মন্দিরে প্রবেশের গেইট অতিক্রমের পর আমাদের কাছে ভেতরে প্রবেশের জন্য আরেক দফা অর্থ দাবী করা হয়। পরে প্রিন্স কাসিমের কাছ থেকে মুকোনো জেলা এবং বিশেষত সেজিবোয়া জলপ্রপাতে উৎসর্গ করার বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছিল।
    আমি মূলত কাবাকা মুয়াংগা কর্তৃক ১৮৮০ সালে ঐ স্থানটিকে পবিত্র হিসেবে ঘোষণার পরও দুই বার সেই মন্দিরটি কেন পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তা জানতে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু তা জানতে গিয়ে আমি উৎসর্গ বিষয়েও বিশদ জানতে পারি।
    প্রিন্স কাসিম জানান, ‘এই মন্দির পুড়িয়ে দেয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল এখানে এক সময় প্রচুর নরবলি চলত। মাত্র তিনমাস আগেও অঙ্গছেদন করা একটি শিশুর শরীর এখানে পাওয়া গেছে।’
    তার এই বক্তব্য আমাকে বিস্মিত করে। আমি অনুভব করি, পবিত্রতার ধারনার অনেকগুলো দিক আছে।
    প্রিন্স কাসিম উগান্ডান করাতের একটা বিশেষ অংশ আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি একাধারে কাবাকাদের বংশধর এবং রাজবাড়ির বাসিন্দা। আবার একই সাথে মিউতসা-১ এর সূত্রে উগান্ডার মুসলমানদের নেতাও বটে।
    তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে বিদেশি ধর্মগুলো উগান্ডার মানুষের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। তারা নেতাদের প্রথমে ধর্মান্তর করেছে তারপর সাধারণ মানুষ নেতাদের অনুসরন করেছে। তারা এই কাজটি করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যে প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শেখানো হতো যে আফ্রিকান দেবতা ছিল অনেক এবং তাদের সন্তুষ্টির জন্য প্রচুর প্রাণী এবং মানুষকে বলি দিতে হতো। যদিও চিরায়ত ধর্মের বিষয়ে আমি যথেষ্ট জ্ঞান রাখি না। আমি জানিও না কোথা থেকে চিরায়ত আফ্রিকান ধর্মের কিংবা যাদুবিশ্বাসের শুরু, তবে আমি জানি, চিরায়ত ধর্ম আর যাদুবিশ্বাস একসাথে মিশ্রিত একটি ধারনা। চিরায়ত ধর্ম বিশ্বাসের শীর্ষে অবস্থান করতেন কাবাকা কিন্তু তিনি তার এই সিংহাসন ইংরেজ চার্চের কাছে সমর্পন করলেন এবং পরে ইংরেজ চার্চ আবার নতুন পুরোহিত নিয়ে এলো। আমার ধারনা চিরায়ত ধর্মের মূল শক্তি হলো— মিথ এবং কুসংস্কার। আমার শিক্ষা আমাকে বুঝিয়েছে যে এটা একটা প্রহসনের ঝাঁপি। আমি একেশ্বরের ধারনা নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছি। যদিও আরবরা কাবাকার দরবারে এসেছিল হাতির দাঁত আর দাসের সন্ধানে। তবে আমাদের ইতিহাস বলে আরব দাস ব্যবসায়ী ইব্রাহিত বতুতা প্রথম প্রজাদের প্রতি সুন্নাহ যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সে কাবাকা সুন্নাহকে জানায় যে, এই জীবনের পর আরেক জীবন আছে এবং সেখানে তাকে প্রজাদের প্রতি প্রদর্শিত নিষ্ঠুরতার জবাব দিতে হবে। রাজা যেখানে নিজেই নিজেকে এতদিন দেবতার আসনে কল্পনা করে এসেছেন তিনি তার এই কথায় বিস্মিত হন। এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান সুন্নাহ। সুন্নাহ’র পূববর্তী শাসকদের ধারনা ছিল যে মৃত্যু-ই চূড়ান্ত এবং মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। মৃত্যুর পর তারা যে রাজার চোয়াল ভেঙ্গে দেয়— তার কারণ রাজার ভূত যেন শক্তিহীন হয়ে যায়। তাদের প্রচলিত বাক্য হলো, “তিনি তার চোয়াল ফেলে দিয়েছেন” মানে হলো রাজা সর্বভাবে চূড়ান্ত পরিণতি বরণ করেছেন। পরবর্তী সময় উগান্ডায় অনেক কিছু হয়েছে। ১৮৮৮ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত যে ধর্মযুদ্ধ চলেছে তা বাগান্ডা সমাজকে অনেক নীচে নামিয়ে এনেছে।’
    আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম গান তৈরির রাজকীয় প্রথার বিষয়ে। যেহেতু অভিযাত্রী স্পেকে এই নিয়ে বিস্তর লিখেছেন তাই আমারও আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। প্রিন্স জানায়, ‘এইগুলো সর্বদাই বিদ্যমান ছিল। এছাড়া প্রাসাদে আর কি-ইবা করার ছিল? সারা বছর ধরেই প্রাসাদে ভোজ, উৎসব লেগে থাকত আর তাতে গান ছিল অনুসংগ।’
    কিন্তু এটা কি দুঃখজনক না-যে এত এতকাল ধরে চলে আসা চিরায়ত প্রথাগুলো যা মানুষকে তার মূলের সাথে সংযুক্ত রেখেছে— তা হারিয়ে যাচ্ছে?

    ইতিহাস বলে আরব দাস ব্যবসায়ী ইব্রাহিত বতুতা প্রথম প্রজাদের প্রতি সুন্নাহ যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সে কাবাকা সুন্নাহকে জানায় যে, এই জীবনের পর আরেক জীবন আছে এবং সেখানে তাকে প্রজাদের প্রতি প্রদর্শিত নিষ্ঠুরতার জবাব দিতে হবে। রাজা যেখানে নিজেই নিজেকে এতদিন দেবতার আসনে কল্পনা করে এসেছেন তিনি তার এই কথায় বিস্মিত হন। এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান সুন্নাহ। সুন্নাহ’র পূববর্তী শাসকদের ধারনা ছিল যে মৃত্যু-ই চূড়ান্ত এবং মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা ঘুরে বেড়ায়

    প্রিন্স কাসিম তখন বুগান্ডা রাজ পরিবারের সদস্যের মত কথা বলা শুরু করেন, ‘দুঃখবোধ করার অনেক কিছুই আছে। ১৯৬৬ সালে কাবাকা’কে ভিন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। সেই ঘটনা এখন পর্যন্ত একটা নৈতিক অবক্ষয় এবং স্বৈরাচারী আচরনের প্রতীক। সেই সময় কোন কিছুর প্রতি কারও কোনরূপ শ্রদ্ধা ছিল না। এমনকি পরিবেশও নষ্ট করা হয়েছে। কাবাকা ছিল একটা প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। বাগান্ডার মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন আশীর্বাদের ঝর্নাধারা। এমন একজন ব্যক্তিকে নিজ রাষ্ট্র ত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সূচিত হয়েছিল। কোনদিন কাবাকাকে বা রাজপ্রাসাদে আক্রমন করা হতে পারে— তা উগান্ডার মানুষের কাছে ছিল কল্পনার অধিক। বুগান্ডারা নিজস্ব অধিকার এবং ভাষা নিয়ে একটা জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। রাজার অধীনে আমরা সম্মানের সাথে একটি রাষ্ট্রে বসবাস করতাম। কিন্তু আমাদের সেই সম্মান নষ্ট করা হয়েছে।’
    ‘এই অবক্ষয়ের মধ্যে আপনারা কিভাবে বেঁচে আছেন?’
    ‘আমার কিছু রাজকীয় দায়িত্ব আছে এবং আমি তা পালন করি। আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্মান রক্ষার্থে আমাকে সেই সব দায়িত্ব পালন করতে হয়।’
    ‘আপনাদের কাছে কি পুরনো কোন স্মৃতি-স্মারক আছে?’ আমি প্রত্যাশা করেছিলাম কিছু থাকবে।
    ‘সব কিছু নষ্ট করা হয়েছে। আমাদের সব নিদর্শনগুলো লুট করা হয়েছে বা ধ্বংস করা হয়েছে।’ সুন্নাহ’র সৌধের খারাপ অবস্থা আমরা নিজেরাই দেখে এসেছিলাম। সেই প্রসংঙ্গ টেনে প্রিন্স কাসিম বলেন ‘আমাদের জেগে উঠতে হবে। যে অধিকার আমাদের জন্য সংরক্ষিত। তা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। এটা একটা অসাধারন স্থাপত্য যার ছাদ ঘাস দ্বারা আচ্ছাদিত হবার পরও তুমুল বৃষ্টির সময়ও এক ফোঁটা জল ভেতরে আসতে পারে না। আমাদের দক্ষতা আছে, সক্ষম মানবশক্তিও আছে। তারা তাদের রাজার প্রতি এখনও অনুগত। সুযোগ পেলে তারা সেই দক্ষতার প্রমান রাখতে চায়।’
    প্রিন্স কাসিমের দীর্ঘ আলোচনার প্রায় শেষ সময়ে এসে তার হতাশারই পুনঃ প্রতিফলন দেখতে পাই। যখন তিনি বলেন, ‘নতুন ধর্মের নীচে আশ্রয় নেয়ার পর তারা আর আগের মত বাধ্য নেই’। এবং এই কথাটি অবশ্যই খ্রিষ্টান এবং মুসলমান উভয় ধর্মের জন্য প্রযোজ্য। যে কোন একটি ধর্মের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়ার মানে হলো বিশাল পৃথিবীর বিশ্বাসের অংশ হওয়া, যে সব ধর্ম একাধারে সংগঠিত এবং অনুমোদিত। যার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক পুস্তক এবং প্রতিষ্ঠান। সুতরাং চাইলেই মানুষ বৃহৎ জিনিসের প্রলোভন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ক্ষুদ্র জিনিসের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করার মত মহত্ব অর্জন করতে পারে না।

    [অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.