প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ (৩)
নীল নদের উৎস অনুসন্ধানে ব্যস্ত অভিযাত্রী স্পেক ১৮৬১ সালে উগান্ডায় উপস্থিত হয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষিক্ত না-হলেও মিউতসা তখন সেই রাজ্যের কাবাকা বা রাজার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে যাচ্ছেন। অভিষেকের পূর্বেই তিনি পিতার নিষ্ঠুরতাকে অনুসরন করতে শুরু করেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে তিনি এতটাই নিষ্ঠুর ছিলেন যে, তার কাছে পাখি মারা আর মানুষ মারা’র মধ্যে কোন প্রভেদ ছিল না। একবার কোন দৃশ্যমান কারণ না-থাকার পরও তিনি বল্লম নিয়ে হেরেমে প্রবেশ করলেন এবং তার ক্রোধ প্রশমন না-হওয়া পর্যন্ত একের পর এক নারীকে খুন করতে লাগলেন। ‘কাবাকা’দের অভিষিক্ত হবার অনেকগুলো রীতি-নীতি ছিল। যা ছিল জটিল এবং সময়-সাপেক্ষ। কখনও কখনও বছর খানেক সময় পার হয়ে যেত অভিষেক সম্পন্ন করতে। ১৮৬১ সাল ছিল মিউতসার অভিষেকের প্রস্তুতির কাল। যদিও অভিষেকের বেশিরভাগ প্রস্তুতি সম্পন্ন হতো অত্যন্ত গোপনে। এবং সেই গোপনীয় কাজের বড় অংশটি সম্পন্ন হতো মিউতসার মায়ের হাতে। এবং আপাত দৃষ্টিতে হাসি-খুশি মিউতসার মা’কে পুত্রের অভিষেক সম্পন্ন করতে অত্যন্ত গোপনে যেসব কাজ করতে হচ্ছিল তার অনেকগুলোই ছিল নির্মম। এই কারণে স্পেক এবং তাঁর অভিযাত্রী দলের প্রতি তাঁর আচরণ সর্বদা একইরকম ছিল না। স্পেক’র স্মৃতিচারন থেকে দেখা যায়, কখনও মিউতাসা’র মা অত্যন্ত উৎফুল্ল এবং অতিথিপরায়ন আচরণ করছে আবার কখনও দেখা যায় স্পেক হয়তো তার দল-বল নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে বসে আছে ( স্পেক’র অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিল পয়তাল্লিশ জন। তার দলটি আপ্যায়নের জন্য মিউতসার মায়ের উপর নির্ভর করত) কিন্তু মিউতসা’র মায়ের সেদিকে কোন নজর নেই।
অভিষেকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিল নির্মম এবং ঐ নির্মম কাজটি মিউতসার মা’কেই সম্পন্ন করতে হত। ভবিষ্যতে মিউতসার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে এমন সন্তানদের পুড়িয়ে মারা ছিল মিউতসার মায়ের প্রধানতম কাজ। যেহেতু মিউতসা’র মায়ের সন্তান সংখ্যা ছিল ত্রিশ সেহেতু তিনজন ব্যতিত বাকি সবাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার কাজটি সহজ ছিল না। কারণ সেই সময়ের উগান্ডার প্রচলিত প্রথায় ক্ষমতার ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিতে রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল। সুতরাং আগুনে পুড়িয়ে মারা ছাড়া মিউতসার মায়ের অন্য কোন উপায় ছিল না
কাবাকা’র অভিষেকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিল নির্মম এবং ঐ নির্মম কাজটি মিউতসার মা’কেই সম্পন্ন করতে হত। ভবিষ্যতে মিউতসার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে এমন সন্তানদের পুড়িয়ে মারা ছিল মিউতসার মায়ের প্রধানতম কাজ। যেহেতু মিউতসা’র মায়ের সন্তান সংখ্যা ছিল ত্রিশ সেহেতু তিনজন ব্যতিত বাকি সবাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার কাজটি সহজ ছিল না। কারণ সেই সময়ের উগান্ডার প্রচলিত প্রথায় ক্ষমতার ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিতে রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল। সুতরাং আগুনে পুড়িয়ে মারা ছাড়া মিউতসার মায়ের অন্য কোন উপায় ছিল না। আপন সন্তানদের গোপনে পুড়িয়ে মারা যে মায়ের মূল দায়িত্ব তার কাছ থেকে সব সময় হাসি-খুশি আর অতিথিপরায়নতা আশা করাও ছিল কঠিন।
এই পুড়িয়ে মারার কাজটি কেমন ছিল? আমরা এই পুড়িয়ে মারার কাজটির একটি সূত্র আবিষ্কার করেছিলাম। চব্বিশ বছর পর মিউতসা’র উত্তরসূরী হয়েছিল মুয়ান্দা। তরুণ এবং উদ্ধত মুয়ান্দার সময়ে নতুন আগমন করা বিদেশী ধর্মগুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমাকার ধারণ করে। এই দ্বন্দ্ব তাকে এতটাই বিক্ষিপ্ত করে তোলে যে তিনি নিজের বাইশজন খ্রিস্টান ভৃত্যকে পুড়িয়ে মারার আদেশ দিতে বাধ্য হন। প্রাচীন ধর্মীয় মতবাদের বিবেচনায় ঐ মৃত্যু ভৃত্যদের শহীদের মর্যাদা দেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি মর্মান্তিক বলেই বিবেচিত হয়েছে। উগান্ডার চার্চ তখনও শক্তিশালী কোন সংগঠনে রূপ নেয়নি। নিতান্তই শিশু অবস্থায় থাকা ঐ চার্চকে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি সহ্য করতে হয়েছিল। সেই খ্রিষ্টান ভৃত্যদের পুড়িয়ে মারার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি চার্চ (কোন সুনির্দিষ্ট চার্চের নাম উল্লেখ করা না-হলেও ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় লেখক কাম্পালায় অবস্থিত মন্যুইনো চার্চের কথা বলেছেন) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেই চার্চটির স্থাপত্যশৈলীতে একটি অগ্নিকুন্ড এবং সেই অগ্নিকুন্ডের ওপর রাখা কাঠির আদলে ছাদ তৈরি করে সেই ধর্মের জন্য শাহাদত বরণ করা ভৃত্যদের স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। অগ্নিকুন্ডের আদলে সেই চার্চ তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি কর্তৃপক্ষ, সেই চার্চের দেয়ালে মুয়ান্দার নির্দেশে পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনাটির একটি সচিত্র বর্ণনা তুলে ধরেছে।
খ্রিস্টানদের হত্যার দৃশ্য সম্বলিত দেয়ালের ছবিতে দেখা যায়, সাতজন জল্লাদ টেনে-হিঁচড়ে সেই ভৃত্যদের এক স্থানে সমবেত করেছে। খ্রিস্টান ভৃত্যদের সবার পরনে ডান কাঁধে বাঁধা সাদা আলখাল্লা। যেহেতু সেই ভৃত্যরা এই নিষ্ঠুর পরিনতির জন্য প্রস্তুত নয় সেহেতু তাদেরকে সমবেত করতে বেশ বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। কারণ আঁকা ছবির জল্লাদদের হাতে ছিল চাপাতি আর খ্রিস্টান ভৃত্যদের পোষাকে ছিল রক্তের দাগ। জল্লাদদের কাছে সেই হত্যাকান্ড একাধারে রাষ্ট্রীয় এবং আধ্যাত্মিক একটি ঘটনা। সে কারণে তাদের সবার পরনে একইরকম বাকলের তৈরি বাদামী রংয়ের পোষাক যা ডান কাঁধে ঝোলানো। সাতজন জল্লাদের মধ্যে একজন হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে লম্বা একটা লাঠি দিয়ে আগুনকে উস্কে দেয়ায় ব্যস্ত। সমাবেশের সম্মুখভাগে অবস্থান নিয়েছে আরেকজন জল্লাদ। তার হাতের ধারালো যন্ত্রটি বলে দেয় পোড়ানোর আগে খ্রিস্টান ভৃত্যদের হাতের রগ কাটা হয়। ছবিতে সেই নিষ্ঠুর কাজে নিয়োজিত জল্লাদটি মাত্রই একজনের হাত কেটে আরেকজনের হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিয়েছে। যে ভৃত্যের বাম হাত ইতোমধ্যে জল্লাদের শক্ত মুঠোর ভেতরে চলে গেছে আঁকা ছবিতে তাকে পেছন থেকে দেখা গেলেও বোঝা যাচ্ছে, সে জল্লাদের মুখের দিকে একটা অনুযোগ নিয়ে তাকিয়ে আছে (হয়তো এক সময় রাজ্যসভার ভৃত্য হিসেবে সেও অনেককে এভাবে প্রস্তুত করেছে)। যার কব্জি কর্তন করা হচ্ছে সেই ভৃত্যের বাম হাতের আংগুলগুলো লক্ষণীয় রকমের ফাঁকা। হয়তো ইতোমধ্যে চাপাতির আঘাতে তার হাতের এমন দশা হয়েছে। হয়তো শিল্পীর সেই হাতটি আঁকার পেছনে নিষ্ঠুরতা ফুটিয়ে তোলার কোন ইচ্ছে ছিল না কিন্তু বিধ্বস্ত হাতটি ঐ বেদনাহীন ছবির একমাত্র বেদনা হয়ে ফুটে উঠেছে।

ছবিতে কর্তনকাজ শেষ হবার পর সেই ভৃত্যদের নলখাগড়ার মাদুরে মুড়ে রাখা হয়েছে। যদিও বাস্তবে তাদের অগ্নিকুন্ডে ফেলে দেয়ার আগে এক রাত স্তুপাকৃতিতে জমা করে রাখা হয়েছিল কিন্তু শিল্পীর আঁকা ছবিতে তাদের প্রত্যেকের পা থেকে গলা অবধি নলখাগড়ার মাদুর দিয়ে ঢাকা। সম্ভবত মানুষের কাছে ঘটনাটিকে আরো দু:খজনক করে তুলতে শিল্পীর আঁকা ছবিতে আগুনের লেলিহান শিখা আর ধূঁয়ার কুন্ডলীর মাঝেও পুড়তে থাকা মানুষের মুখমন্ডল দৃশ্যমান করে তোলা হয়েছে।
তবে খ্রিষ্টান ভৃত্যদের যেভাবে আগুনে পোড়ানো হয়েছে সেই একই পদ্ধতি মিউতসা’র ভাইদের ক্ষেত্রে অনুসরন করা সম্ভব না। উগান্ডার সেই সময়ের প্রথাতে তা নিষিদ্ধ। মিউতসার ভাইরা এক সময় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে এটা যেমন সত্য তেমনি তারা যে মৃত কাবাকা সুন্নাহ’র সন্তান হিসেবে বিশেষ মর্যাদার অধিকারি তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাদের প্রথা মতে, কাবাকা’র পুত্রদের শরীর থেকে রক্ত ছিটিয়ে পড়তে পারে এমন কোন রীতিতে হত্যা নিষিদ্ধ। সুতরাং তাদের মৃত্যুপূর্ব সময়ে ভৃত্যদের মত জমায়েত করা কিংবা ক্রন্ধনের সুযোগ পাওয়ার মত ঘটনা ঘটা সম্ভব না। তাদের জন্যে সবচেয়ে সম্ভব এবং শাস্ত্রমতে সিদ্ধ হত্যা হতে পারে নলখাগড়ার মাদুরে জড়িয়ে সোজা আগুনে নিক্ষেপ করা। আগুনে পুড়ে মরার নিয়তি নিয়েই কাবাকা’র পুত্রদের জন্ম নিতে হতো এবং আরও দু:খজনক হলো মাকেই পুত্রহত্যার এই কাজটির আয়োজন করতে হয়েছিল। হয়তো এই ভায়েরাই এক সময় মিউতেসা’র সাথে খেলত, এক সাথে বাদ্যযন্ত্র বাজাত, ফূর্তি করত। একদা মিউতসা তার ভাইদের নিয়ে দূর পাহাড়ে গিয়েছিল তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি দেখাতে। সব ভাইদের সাথে মিউতাসার মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকার মধ্যে মিউতসা এবং তার মায়ের একটা সূক্ষ উদ্দেশ্য ছিল। তিনি চাইতেন, অন্য পুত্ররা যেন মিউতসার বিরূদ্ধ হয়ে না-দাঁড়ায় কিংবা কোনরকম আগাম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না-পারে। পুরো ঘটনাটি এত গোপনে সংঘটিত হতো যে, স্পেক তা অনুমানও করতে পারেননি। তার দীর্ঘ বর্ণনায় শুধু একবার উল্লেখ করেছেন যে, কোন এক গানের অনুষ্ঠান চলাকালীন মিউতসার ভাইদের অর্ধেকের হাত বাঁধা হয়েছিল।
এইসব ভয়ংকর সব প্রথা-চর্চার তথ্য শুনতে শুনতে একটি স্বস্তিদায়ক তথ্যও জানতে পারি। মিউতসা’র মা এবং মিউতসা হয়তো প্রায়শই গোপনে আলাপ করতেন, এরপর কাকে পুড়িয়ে মারা হবে। এমনি পুত্রহত্যার গোপন আলাপকালে কোন এক সময় হয়তো মা কোন এক সন্তানের নাম প্রস্তাব করলে মিউতসা জানিয়েছিল, ‘কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করি’। মিউতসার ভালবাসা পাওয়া সেই ভাইটিকে পরে আর আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়নি। যে প্রিন্স কাসিমের কথা আমি আগেই আলোচনা করেছি, এবং যাকে কাবাকাদের সরাসরি বংশধর হিসেবে অভিহিত করেছি সেই প্রিন্স কাসিমের দাদা ছিলেন মিউতসার ভালবাসা পাওয়া ভাইদের একজন। মিউতসার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে যে তিনজন সন্তান বাদে অন্যদের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল তাদের সেই তিনজনের একজন ছিল প্রিন্স কাসিমের দাদার পিতা।
[অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]




