Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    দোলা আপা এবং রোমিওদের গল্প

    মফস্বল থেকে বাবা ঢাকায় বদলী হলে আমরা এসে উঠেছিলাম গোপীবাগে, এক ভাড়াটে বাসায়। গোপীবাগে তখন অল্প কিছু বাড়িঘর, হাতে গোনা কিছু দালান কোঠা, স্থায়ী আর ভাড়াটে মিলিয়ে অল্প কিছু লোকের বসবাস। আমি স্কুলে যাই, স্কুলে ভর্তি হওয়ায় বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গেল। আর পাড়ার ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল খুব অল্প দিনের মধ্যেই। পাড়ার ছেলে বলতে, রবি, শাহান, বাবু, মিঠু এবং তাহের। এরা সবাই স্কুলে আমার চেয়ে দু’তিন ক্লাশ উপরে পড়ে। খুব সহজে এই সিনিয়রদের দলে ভিড়ে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ ছিল আর সেটা হলো দোলা আপা।

    আমাদের বাড়িওয়ালা সরকার সাহেবের মেয়ে দোলা। তিন বোনের মধ্যে দোলা আপা বড়। দোলা আপা স্কুলে যায় না। ক্লাশ সেভেন থেকে তার বাবা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কি কারণে দোলা আপার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে সেটা আমরা জানি না। সেটা নিয়ে আমাদের কোন কৌতুহল নেই। তবে সরকার সাহেবকে আমরা খুব সমীহ করে চলি। পাড়ার রাস্তায় কখনও সখনও দেখা হয়ে গেলে সালাম দিয়ে বিনয়ের সাথে পাশ কাটিয়ে যাই। মাথায় অগোছালো সাদাপাকা চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি আর রাশভারী চেহারার সরকার সাহেব নামাজী আবার খুবই বদমেজাজী স্বভাবের লোক। রক্ষণশীলও বটে। বাড়ির মেয়েদের কঠিন নজরদারির মধ্যে রাখেন। মিটফোর্ডের একটা দোকানে ক্যাশিয়ারের কাজ করেন তিনি। সকাল ন’টায় কাজে যান আর রাত করে বাড়ি ফেরেন। পাড়ার কারো সাথে তার তেমন ভাব সাব নেই, মেলামেশা নেই। ছুটির দিন অবসর সময়টুকু একাকি বাড়ির বারান্দায় বসে বসেই কাটান।

    আমার বড় আপার সাথে দোলা আপার বন্ধুত্ব হয়েছে। সেই সুবাদে দোলা আপা প্রায়ই আমাদের বাসায় যাওয়া আসা করে। আমার সাথেও দোলা আপা বেশ গল্প করে। তাকে আমার খুব ভাল লাগে। দোলা আপার গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা। হালকা পাতলা গড়ন। তার অদ্ভুদ দু’টি মায়াময় চোখ, কথা বলার ভঙ্গি আর পাতলা দুটি ঠোঁটে মুচকি হাসির ঝিলিক আমার কিশোর মনকে কাতর করে। কিছু কিছু মেয়ের মধ্যে এমন কিছু রমণীয় অভিব্যক্তি থাকে যা সব বয়সের ছেলেদেরকে সমান ভাবে আকর্ষণ করে। দোলা আপার মধ্যে এরকম কিছু আছে যা এক পলক তার মুখের দিকে তাকালেই মনের ভিতর শিহরণ জাগায়। দোলা আপাদের সাথে আমাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা পাড়ার ছেলেদের নজর এড়ালো না। তাই ওরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে আমাকে ওদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। পরে বুঝেছি- ওদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার মাধ্যমে দোলা আপার খবরাদি নেওয়া। কারণ, এই সব রোমিওরাও দোলা আপার জন্য খুব উতলা ছিল। পাড়ার এই উঠতি বয়সের ছেলে ছোকড়ার এই দলটিতে সবাই যে দোলা আপার প্রেমিক সেটা আমরা আমাদের আচরণে বুঝে ফেলতে পেরেছি।

    গোপীবাগের মোড়েই জজ সাহেবের সুদৃশ্য দোতলা বাড়ি। ঝুল বারান্দার নীচে রাস্তার ধারে একটা প্রশস্ত জায়গায় মতি মিয়া ঝাল বুট আর চিনা বাদামের পশরা নিয়ে বসে। সেখানেই রোজ বিকেলে আমাদের আড্ডা জমে ওঠে। এখান থেকে দোলা আপাদের বাড়ির ছাদ সহজেই নজরে আসে। একটা পুরানো আম গাছ ছাদের একাংশ ঢেকে রেখেছে। বাকি অংশটুকু খোলা। সেখানে কিছু ফুলের টব এলোমেলো ভাবে রাখা। ঐ খোলা ছাদটুকু ঘিরেই আমাদের উৎসুখ দৃষ্টি সারাক্ষণ লুটোপুটি খায়।

    দোলা আপার চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার একটা গোপন প্রতিযোগিতা চলতে থাকে আমাদের মধ্যে। তবে কোন রকম বাড়াবাড়ি নেই। দোলা আপা দুর থেকে যেটুকু হাসির উচ্ছাস, হাত ও চোখের ইশারা আমাদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয় আমরা তাতেই তৃপ্ত থাকি। অবশ্য মাঝে মাঝে আমরা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি।

    বিকেলে বোনদের সাথে দোলা আপা ছাদে আসে। ছাদে রাখা টবগুলোতে পানি দেয়। কখনও কখনও বোনদের সাথে কথা বলতে বলতে আমাদের লক্ষ্য করে জোরে হেসে ওঠে। কখনও চুল ছেড়ে বেনী বাঁধে আবার কখনও বিকেলের হাওয়ায় ওড়নার প্রান্ত ধরে অন্যমনস্ক ভাবে দোলাতে থাকে। তখন তাকে সিনেমার নায়িকার মত মনে হয়। আমরা ক’জন দিশেহারা কিশোর জজ-বাড়ির ঝুল বারান্দার নিচে দাড়িয়ে দারুণ আগ্রহ নিয়ে এইসব লক্ষ্য করতে থাকি। দোলা আপার আঁচলের দোলা ফাল্গুনের উতল হাওয়ার মত এসে দোলা দেয় আমাদের মনে। আমাদের নাজুক বয়সের গভীর অনুভূতিগুলো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে এক অবর্ণনীয় ভালোলাগা বোধে।

    বিকেলে গোপীবাগের মোড়ে এই জায়গাটিতে রোজ একত্রিত হওয়াটা আমাদের জন্য একটা রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের চুলের স্টাইল এবং নতুন পোশাকের মহড়া হয় এখানেই। দোলা আপার চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার একটা গোপন প্রতিযোগিতা চলতে থাকে আমাদের মধ্যে। তবে কোন রকম বাড়াবাড়ি নেই। দোলা আপা দুর থেকে যেটুকু হাসির উচ্ছাস, হাত ও চোখের ইশারা আমাদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয় আমরা তাতেই তৃপ্ত থাকি। অবশ্য মাঝে মাঝে আমরা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। দোলা আপার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজেদের মধ্যে হল্লা করতে থাকি।

    দোতালায় ঝুল বারান্দার লাগোয়া ঘরটিতে থাকেন স্বপন ভাই। জজ সাহেবের একমাত্র ছেলে। সুবোধ এবং পড়ুয়া ছেলে বলে পাড়ায় স্বপন ভাইয়ের খুব নাম। আমরাও তাকে খুব সমীহ করি। স্বপন ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে অনার্স পড়েন। সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে বিকেলে বাড়ীতে এসেই আবার বই হাতে নিয়ে বসেন। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে আলো জ্বলতে দেখি।

    ঝুল বারান্দার নিচে কখনও আমাদের হল্লার মাত্রা বেশি হলে স্বপন ভাই বারান্দায় আসেন। নিচে উঁকি দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসেন। ওতেই কাজ হয়ে যায়। আমরা মুহুর্তে চুপ মেরে যাই। হল্লা করে স্বপন ভাই এর পড়াশুনার মনোযোগ নষ্ট করার জন্য নিজেদেরকে খুব অপরাধী মনে হয়। আর তখন আমাদের এরকম জড়োসড়ো ভাব দেখে ছাদের উপর হাসতে হাসতে গাড়িয়ে পড়ে দোলা আপা।
    দোলা আপাকে নিয়ে গোপীবাগের এই ক্ষুদে রোমিওদের দিনগুলো হয়তো এরকম মোহের মধ্যেই কেটে যেতো যদি না নয়ন এসে আমাদের দলে ভিড়ে পড়তো এবং সবকিছুু ওলট পালট করে দিতো।

    দোলা আপাদের বাড়ির পেছনের দেয়াল ঘেঁষে দোতলা বাড়িটিতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভদ্রলোক ঘিওর থানার দারোগা। অধিকাংশ সময় মফস্বলে থাকেন। তারই একমাত্র সন্তান নয়ন। বয়সে আমাদের চাইতে বেশ ক’বছরের বড় হবেন। বেশ সুঠাম গড়ন, চেহারা সুরত ভাল। তিনবার মেট্রিক ফেল করে পড়াশুনার হাল ছেড়ে দিয়েছেন নয়ন ভাই। অত্যান্ত বেপরোয়া স্বভাবের লোক। পাড়ার রাস্তায় খুব জোরে মোটর সাইকেল চালিয়ে যান। পাড়ার মুরুব্বিদের সামনে সিগারেট ফুঁকেন। ঘন ঘন সিনেমা দেখেন আর সারাক্ষণ সিনেমার গানগুলো গুন গুন করে গাইতে পছন্দ করেন।

    নয়ন ভাইয়ের বেয়াড়াপনা আচরণ আমাদেরকে চিন্তিত করে তুলেছে। পাড়ার বয়োজেষ্ঠরা নয়ন ভাইয়ের উপর অসন্তুুষ্ট হচ্ছেন। তার সাথে মেশামিশির কারণে আমরা কখন আবার কুসংসর্গে জড়িয়ে পড়বো এই আশঙ্কায় অভিবাবক মহল থেকে যে কোন সময় বিধিনিষেধ নেমে আসতে পারে। তাই ইদানীং নয়ন ভাইয়ের সঙ্গ আমরা তেমন স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না। সামনা সামনি সমীহ করলেও আড়ালে আমরা তাকে অপছন্দ করি। শুধু অপছন্দই নয়, হয়তো মনে মনে আমরা তাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছি। কারণ দোলা আপার ব্যাপারে নয়ন ভাই খুব উৎসাহ দেখাচ্ছেন এবং দিন দিন এই উৎসাহ বেড়েই চলেছে। নয়ন ভাইয়ের ঠাকঠমক দেখে আমাদের এমন মনে হতে লাগল যে একদিন এই বেপরোয়া লোকটি হয়তো কোন ভাবে দোলা আপাকে আমাদের স্বপ্ন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।

    শুধু অপছন্দই নয়, হয়তো মনে মনে আমরা তাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছি। কারণ দোলা আপার ব্যাপারে নয়ন ভাই খুব উৎসাহ দেখাচ্ছেন এবং দিন দিন এই উৎসাহ বেড়েই চলেছে। নয়ন ভাইয়ের ঠাকঠমক দেখে আমাদের এমন মনে হতে লাগল যে একদিন এই বেপরোয়া লোকটি হয়তো কোন ভাবে দোলা আপাকে আমাদের স্বপ্ন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।

    নয়ন ভাই আমাকে বোধ হয় বেশি পছন্দ করেন। সুযোগ পেলেই আমাকে সিনেমার গল্প শোনান। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের অনেক কথাই আমাকে অকপটে বলে ফেলেন। একদিন নয়ন ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। দোলা আপার প্রসঙ্গ উঠতেই হঠাৎ নয়ন ভাই একটু নড়ে চড়ে বসলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘দোলা মেয়েটা আসলেই ভাল’। আমি সন্দ্বিগ্ন ভাবে তার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘সেটা কি করে বঝুলেন?’
    নয়ন ভাই মুচকে হাসলেন, বললেন, ‘একটু বাজিয়ে দেখেছিলাম’।
    ‘কি রকম?’ ব্যপারটা জানতে আমার খুব কৌতুহল হল।
    ‘সেদিন আমার জানালা থেকে দোলাদের উঠোনে দোলাকে লক্ষ্য করে একটা চিঠি ছুড়ে দিয়েছিলাম–।’ নয়ন ভাইয়ের কথা শুনে বিস্ময়ে আমার মুখটা হা হয়ে গেল। নয়ন ভাই বেশ সহজ ভাবেই বলতে থাকলেন, ‘দোলা চিঠিটা কুড়িয়ে নিল তারপর আমাকে দেখিয়ে সেটা ছিড়ে কুটি কুটি করে নর্দমায় ফেলে দিল।’
    ‘চিঠি না পড়েই ফেলে দিলো? আমার উদগ্রীব প্রশ্ন শুনে নয়ন ভাই হাসলেন। বললেন,
    হ্যাঁ, চিঠিটা স্রেফ না পড়েই ফেলে দিলো।’

    উত্তরটা শুনে কেন জানি খুব স্বস্তি হলো আমার মনে। দোলা আপার উপর ভক্তিও হলো খুব। মনে মনে ভাবলাম বখাটে লোকটাকে ভাল শিক্ষা দিয়েছে দোলা আপা।
    ‘অবশ্য দোলার এরকম ব্যবহারে আমি অবাক হইনি’ এক ধরনের রহস্যময় চতুর হাসি হেসে নয়ন ভাই আমার দিকে তাকালেন তারপর একটু থেমে, আমার দিকে একটু ঝুকে গভীর স্বরে বললেন,
    ‘বুঝলি, রাগ থেকেই অনুরাগের জন্ম হয়, ভাললাগার শুরু ওখানেই।
    ‘বুঝলাম না।’ আমি নির্বোধের মত নয়ন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। সেই রকম চতুর হাসির ঝিলিক লেগে থাকলো তার মুখে।
    ‘মেয়েরা এরকমই করে’, মাথা দোলাতে দোলাতে নয়ন ভাই বলতে থাকলেন, ‘মেয়েরা যাকে পছন্দ করে প্রথম তাকে অবজ্ঞা করবেই। এটা নারী চরিত্র। আমি সব সিনেমায় এরকম ঘটতে দেখেছি। তুই দেখে নিস, আমার দিকে আরো ঝুকে এলেন নয়ন ভাই, ‘একদিন দোলা আমাকে ঠিকই ভালবাসবে।’

    নয়ন ভাইয়ের কথায় একধরনের গভীর আত্মবিশ্বাসের আবেগ ছিলো যা অনুভব করে আমার বুকটা ছ্যাত্ করে উঠল। লোকটা তাহলো দোলা আপাকে নিয়ে এমনটাই ভাবছে! আমার মনে হল দোলা আপা এই রকম তাচ্ছিল্য দেখিয়ে নয়ন ভাই এর মনে ভালবাসার আগুনটাকে বুঝি নিজের অজান্তে উচকে দিয়েছেন। আমি আমার রোমিও বন্ধুদের খবরটা না জানিয়ে পারলাম না। মনে মনে সবাই বেশ ক্ষুদ্ধ হলেও নয়ন ভাইয়ের সম্মুখে সেটা প্রকাশ করলো না কেউ। তবে নয়ন ভাই আর দোলা আপাকে ঘিরে একধরনের অস্বস্তি এবং উৎকন্ঠাবোধ আমাদের কিশোর মনে তোলপাড় করতে থাকল সারাক্ষণ।

    ক’দিন পরেই একটা ঘটনা ঘটলো। সকাল বেলা নয়ন ভাই এসে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তার চোখ মুখ বেশ গম্ভীর। মনে হল কোন কারণে ভিতরে ভিতরে রেগে আছেন। তাকে অনুসরণ করে দোতলার জানালাটার কাছে গিয়ে দাড়ালাম, যেখান থেকে দোলা আপাদের উঠোন দেখা যায়।
    ‘এটা দোলার বাড়াবাড়ি–’, জানালার পাশে দাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে নয়ন ভাই বলে উঠলেন।
    ‘কিসের বাড়াবাড়ি?’ আমি কিছু বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকালাম।
    ’দেখতে পাচ্ছিস না, ঐ যে উঠোনে তাকিয়ে দেখ।’ ক্ষুদ্ধস্বরে প্রায় ধমকে উঠলেন নয়ন ভাই। আমি বিমুঢ়ের মত উঠোনে চোখ বুলালাম। উঠোনে কেউ নেই। একপাশে ডালিম গাছটার নীচে দোলা আপাদের কুকুর বাঘা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।
    ‘দেখতে পাচ্ছিস না?’
    ‘কিছু দেখছি না তো’।
    ‘চোখের মাথা খেয়েছিস? ঐ দেখ, ডালিম গাছের ডালে–’ নয়ন ভাই উত্তেজিত ভাবে উঠোনের ডালিম গাছটার দিকে আঙ্গুলের ইশারা করলেন। আমার চোখ আছঁড়ে পড়ল ডালিম গাছে। দেখলাম, একটা ডালে দু’টো ছেড়াঁ চপ্পল ঝুলছে!
    ‘আমি জানালার পাশে বসি তাই আমাকে দেখিয়ে দোলা চপ্পলগুলো ওখানে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে’। গভীর ক্ষোভের সঙ্গে নয়ন ভাই বলতে থাকলেন, ‘তবে হ্যাঁ, আমি হাসেম দারোগার ছেলে- আমিও দেখে নেবো। এই বেয়াড়া মেয়েটাকেই বিয়ে করবো। বাবা মফস্বল থেকে ফিরলেই এবার কথাটা মা’কে দিয়ে তার কানে তুলবো, তারপর দেখা যাবে-, কথাটা শেষ না করে নয়ন ভাই আমার দিকে তাকালেন। উত্তেজনায় তার চোখ দু’টো লাল হয়ে উঠেছে। আমার মনে হলো তিনি কথার ইঙ্গিতে দোলা আপা এবং আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে একটা ভয়ানক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।

    সেদিন বিকেলে আমরা জজ সাহেবের বাড়ির নিচে একত্রিত হয়েছি। কথার ফাঁকে ফাঁকে দোলা আপাদের বাড়ির ছাদে চোখ রাখছি। বিকেলের সূর্যটা এক সময় গোধূলীর লালিমা ছড়াতে ছড়াতে আম গাছটার পেছনে লুকিয়ে গেলে দোলা আপাদের ছাদটুকু সন্ধ্যার ছায়ায় ডুবে গেল। দোলা আপা কিংবা তার বোনদের কেউ ছাদে এলো না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা, রোমিওরা মলিন মুখে বিদায় হলাম। আমাদেরকে প্রবল উৎকণ্ঠায় রেখে পরপর চার দিন দোলা আপা ছাদে এলো না।

    আমি বজ্রাহতের মত নয়ন ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফিরলাম। দোলা আপাকে নিয়ে নয়ন ভাই যে ভিতরে ভিতরে এতদুর এগিয়ে গেছেন আর এই রকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এটা ভেবে আমার খুব অস্থির লাগছে। আমি ছুটে গেলাম রোমিও বন্ধুদের কাছে খবরটা পৌছে দিতে। সব শুনে সবাই থ’ হয়ে গেল। আমরা ভাবতে লাগলাম সত্যি কি দারোগা সাহেব ফিরে এলে নয়ন ভাই তার ইচ্ছাটা চিরতার্থ করতে উঠে পড়ে লাগবেন? আমাদের ভালবাসার দেবীকে কি এভাবেই এই সর্বনাশা লোকটি হরণ করে নিয়ে যাবে?

    আমাদের সহজ সরল রোমান্টিক হৃদয়ে নয়ন ভাই আচমকা যেন এক ভয়ানক অশান্তির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিলেন। দারুণ অস্বস্বিতে আমাদের দিন কাটছে। এর মাঝে একদিন দারোগা সাহেব মফস্বল থেকে বাড়ি এলেন। তাকে পাড়ায় হাঁটাহাটি করতে দেখে আমাদের অস্বস্বি এবং উৎকন্ঠা আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।

    সেদিন বিকেলে আমরা জজ সাহেবের বাড়ির নিচে একত্রিত হয়েছি। কথার ফাঁকে ফাঁকে দোলা আপাদের বাড়ির ছাদে চোখ রাখছি। বিকেলের সূর্যটা এক সময় গোধূলীর লালিমা ছড়াতে ছড়াতে আম গাছটার পেছনে লুকিয়ে গেলে দোলা আপাদের ছাদটুকু সন্ধ্যার ছায়ায় ডুবে গেল। দোলা আপা কিংবা তার বোনদের কেউ ছাদে এলো না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা, রোমিওরা মলিন মুখে বিদায় হলাম। আমাদেরকে প্রবল উৎকণ্ঠায় রেখে পরপর চার দিন দোলা আপা ছাদে এলো না। তার বোনদেরও ছাদে দেখা গেল না। গোপীবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চাতকের মত চেয়ে থেকে থেকে আমাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে গেল। দোলা আপার দেখা মিলল না। এমনটি কখনও হয় না। দোলা আপাকে ঘিরে কোথাও একটা অঘটন ঘটে গেছে এরকম আশঙ্কা আর হতাশা নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা বাড়ি ফিরতাম। রোমিওদের দোলা আপা সম্পর্কে কোন খবর দিতে পারছিলাম না বলে ওরাও আমার উপর বেশ অসন্তষ্ট হচ্ছে। বাড়িতে বড় আপাকে দোলা আপার কথা জিজ্ঞেস করতে আমার কেন জানি সাহস হচ্ছিল না। ক’দিন থেকে বড় আপা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। এদিকে নয়ন ভাইও লাপাত্তা । লোকটা কোথায় লুকিয়ে বসে সব অঘটনের কলকাঠি নাড়ছে কে জানে!

    আমাদের উদ্বেগের অবসান ঘটালো মিঠু। খুব ভোর বেলা সে ছুটে এলো আমার কাছে। চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনার ছাপ।
    ‘জানিস, দোলাদের বাড়িতে পুলিশ এসেছিল’ হাঁপাতে হাঁপাতে মিঠু বলল।
    পুলিশ এসেছিল কেন?’ বাড়িতে পুলিশ আসাটা খুব খারাপ সংবাদ। আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম।
    ‘দোলা আপা আর স্বপন ভাই লুকিয়ে বিয়ে করেছে তারপর আজ এক সপ্তাহ থেকে দু’জনই হাওয়া’, একটু থেমে ঢোক গিলে মিঠু বলল, ‘জজ সাহেব থানা পুলিশ লাগিয়েছে তো।’ মিঠুর কথা শুনে আমি একেবারে হা হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি দোলা আপার বিষয়ে আমাদের যতো শঙ্কা ছিলো নয়ন ভাইকে ঘিরে কিন্তু মাঝখান থেকে স্বপন ভাই যে দোলা আপাকে নিয়ে এমন একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসবেন এটা আমরা ধারণাও করতে পারিনি। তবে ঘটনাটা সত্যি। দোলা আপা আর স্বপন ভাইয়ের এই নাটুকে প্রেম নিয়ে পাড়ার আড্ডাগুলো বেশ মশগুল হয়ে থাকলো বেশ কিছু দিন। ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটলে একটা ব্যপারে আমরা খুব নিশ্চিন্ত হলাম যে দোলা আপা রোজ ছাদ থেকে আকার ইঙ্গিতে যে উচ্ছাসটুকু বিকেলের হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতেন তার সবটুকুই আসলে নিবেদিত ছিলো স্বপন ভাই এর জন্য। আর আমরা, গোপীবাগের মোড়ে দাড়িয়ে থাকা এই রোমিওরা ছিলাম উপলক্ষ মাত্র। এত ঘটনার পর নয়ন ভাই সেই যে লাপাত্তা হলেন, তারপর তার সাথে আমাদের আর দেখা হয়নি কখনও।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.