Saturday, October 25, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    দাতা

    জমির চাচা আমাকে দেখেই রিকশা থামালেন । জন্মের পর থেকেই দেখছি এই মানুষটা রিকশা বেয়ে যাচ্ছেন । প্রথমে দেখছি তিনি প্যাডেল মেরে রিকশা চালাতেন । প্রযুক্তির এই যুগে তিনি এখন অটো রিকশা চালান । যাক এতে করে তার শরীরের ধকল কম যায় । কষ্ট কম হয় ! অথচ হাজারো কষ্ট পুষে নিয়ে চলছেন এই মানুষটা । কিছু কিছু মানুষের কষ্ট পুষে রাখতে হয় না , কষ্টই তাদের পুষে রাখে । জমির চাচা স্টিয়ারিং এর বাটন চেপে ধরে রিকশা চালাচ্ছেন । আমি বললাম , জমির চাচা মন খারাপ ?
    জমির চাচা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন । তার নিশ্বাসে একরাশ অভিমান ঝরে পড়লো । আমি বললাম , মন খারাপের শহরে কারই বা মন ভাল থাকে বলেন ।
    জমির চাচা বললেন , হ বাজান ঠিকই কইছো ।
    আমি যদ্দূর জানি বলতে ভাল করেই জানি , জমির চাচার ছোটভাই জাহিদ ইঞ্জিনিয়ার । ঢাকায় থাকে । খুব ভাল আয়ও করে । শুনেছি ঢাকায় বাড়ি গাড়িও আছে । অথচ জমির চাচা রিকশা চালান । সেদিন এলাকার এক দোকানে চা খাচ্ছিলাম । জমির চাচাও খাচ্ছেন । এলাকার আরেক চাচা রুহুল বললো , কিরে জমির ছোটভাইরে তো জীবন পানি করে প্যান্ডেল মারি মানুষ করলি । বাপের ভাগের জমি যা পাইছিলি হেইডাও তো বিক্রি করে দিলি ।মানুষ করলি ছোট ভাই তো ঠিকই উড়াল মারলো । আজকাল কার ছোট ভাইরা উড়ালচন্ডি পাখি । বুঝছোস ।
    জমির চাচা , চুপ করে চা খাচ্ছেন
    রুহুল চাচা আবার বললো , শোন জমির , আমাদের কপালটাই এরকম । তুই রিকশা চালাস আমি দেই কামলা । পার্থক্য কি আমি খেতে কাম করি আর তুই প্যাসেন্জার টানোস । আমি খেত কামলা তুই জনগণের কামলা । বুঝলি ।
    জমির চাচা রুহুল চাচার কথা শুনে একটু হাসলেন । যে হাসিতে হাজারটা দুঃখ লুকিয়ে থাকে । সেই হাসি হাসলেন ।

    রুহুল কাকা আবার বললেন , শুনলাম জাহিদ বিয়েও করছে । যে ভাইরে জান দিয়ে দিলি সেই ভাই তোরে না জানিয়েই বিয়ে করলো ।
    এবার জমির চাচা খানিকটা রেগে গেলেন । হয়তো আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে বাইরের কেউ কিছু বলুক সেটা হজম করতে নারাজ । বললেন, চুপ করবি । খবরদার আমার ভাইকে নিয়ে একটাও বাজে বলবি না । জমির চাচা মন খারাপ করে চলে আসলেন । আমিও জমির চাচার পিছু হাঁটা দিলাম । খানিকটা দূর এগিয়ে যেতেই তিনি হারিয়ে গেলেন । যেমনটা জাহিদ তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ।

    আমার মনে আছে , একদিন সকালে আব্বু আমি খেতে বসছি । আব্বু তখনো বসেননি । হঠাৎ জমির চাচা এসে আব্বুর হাত ধরে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন । ভাইজান আমার ছোটভাইটা মেট্টিক পরীক্ষা দিব । ফরম ফিলআপ করতে তিন হাজার লাগবো । ভাইজান আমি রিকশার খেপ দিয়ে ১হাজার টাকা জোগার করছি । আর আপনি যদি…..
    আব্বু জমির চাচার কথা শেষ না হতেই মানিব্যাগ থেকে ২ হাজার টাকা বের করে দিলেন ।
    জমির চাচা টাকাটা হাতে নিয়ে বললেন , ভাইজান অশেষ শুকরিয়া । তয় ভাইজান কি করমু আজ যদি আব্বা বাঁইচা থাকতো । জাহিদের জন্য আমি কি আপনার কাছে আসতাম? আমার ভাইটা যাতে আব্বার অভাব না বোঝে । আমি জাহিদরে মানুষের নাহাল মানুষ করমু ভাইজান ।
    আব্বু বললেন , আচ্ছা জমির যাও । তোমার ভাইটা মানুষ হলে তোমাদের আর অভাব থাকবে না । তোমরা অনেক ভাল থাকবা । দোয়া করি ।
    সেদিন জমির চাচা চট করে আব্বুকে সালাম করছিলেন , বলছিলেন ভাইজান দোয়া করবেন । জাহিদ মানুষের মতো মানুষ হবে ।

    আমি তখন ছোট । জমির চাচার ছেলে জহিরও ছোট । জহির আমার ক্লাসমেট আবার খেলার সাথি । সবকিছু মিলিয়ে জহির আমার ভাল বন্ধুও বটে । আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম । কত খেলতাম মারবেল , গোল্লাছুট , তিনগুটি , ক্রিকেটসহ । স্কুল টাইম বাদে আমাদের সারাদিনের সঙ্গীই ছিল খেলাধুলা । আজ আমি একটা বেসরকারি ভার্সিটিতে অনার্স করছি । জহির চান্স পেয়েছে ঢাকা ভার্সিটিতে । অথচ আমার কোন কিছুর অভাব ছিল না । ছিল কিছুটা মেধার অভাব । আজ জহির অভাবকে জয় করেছে । কিন্ত জহির মেধার অভাব দূর করলেও অর্থনৈতিক অভাব দূর করতে পারেনি । কেমনেই বা পারবে ? তার বাবা তো আর জাহিদ নন ।
    তার বাবা জমির যে কিনা এই শহরেই রিকশা চালায় । আমরা জহিরকে খুব কাছ থেকে কষ্ট করতে দেখেছি । ছেলেটা এখনো লড়ছে জীবনের সাথে । আমরা যখন কলেজে উঠলাম । তখন দেখতাম এই জহির কেজি স্কুলে ক্লাস করিয়ে যা পেত তা তার বাবাকেও হেল্প করতো । জহির দমে যাওয়ার পাত্র না । জহির একলা চলো নীতি অনুসরণ করলেও তার বাবাকে সঙ্গে নিয়েই যুদ্ধে নেমেছে । জমির চাচা তার ভাইয়ের জন্য কী করে নাই । জমির চাচার অতসব ক্ষোভ নেই । জাহিদ পাশে থাকলো কিনা থাকলো না এসব ভাবেও না । জমির চাচার প্রতিটা নিশ্বাসই যেন বলে ওঠে , জাহিদ ভাল থাকুক । আমি তো বেঁচে আছি মরে তো যাইনি । এই শহরে বেঁচে থাকা মানেই ভাল থাকা ।

    ইন্টার পাশ করেই ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছুটলাম পাবলিক ভার্সিটি গুলোতে । আমার সঙ্গী হল জহির । জহিরকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার বুকে এলাম । জমির চাচা বারংবার বললেন , জাহিদের বাসায় যেতে । বললেন , তোমরা গেলে নিশ্চয়ই জাহিদ খুব খুশি হবে । জাহিদের নিজের বাড়ি , গাড়ি আছে থাকার কোন সমস্যা হবে না ।জমির চাচা জহিরের কাঁধে হাত দিয়ে বলল , ঢাকা শহর যাচ্ছ । কাকার গাড়িতে শহর ঘুরে ঘুরে দেখবা । দেখবা মন ফেরেশ হবো ।
    জমির চাচা কিছু কাঁচা বাজারও করে দিলেন । জাহিদ অনেক দিন দেশের বাড়িতে আসে না । এসব টাটকা খাবারও খেতে পারে না নিশ্চয়ই । সাথে মহিষের দই ও গুড় দিলেন ।

     

    তার বাবা জমির যে কিনা এই শহরেই রিকশা চালায় । আমরা জহিরকে খুব কাছ থেকে কষ্ট করতে দেখেছি । ছেলেটা এখনো লড়ছে জীবনের সাথে । আমরা যখন কলেজে উঠলাম । তখন দেখতাম এই জহির কেজি স্কুলে ক্লাস করিয়ে যা পেত তা তার বাবাকেও হেল্প করতো । জহির দমে যাওয়ার পাত্র না । জহির একলা চলো নীতি অনুসরণ করলেও তার বাবাকে সঙ্গে নিয়েই যুদ্ধে নেমেছে । জমির চাচা তার ভাইয়ের জন্য কী করে নাই । জমির চাচার অতসব ক্ষোভ নেই । জাহিদ পাশে থাকলো কিনা থাকলো না এসব ভাবেও না । জমির চাচার প্রতিটা নিশ্বাসই যেন বলে ওঠে , জাহিদ ভাল থাকুক । আমি তো বেঁচে আছি মরে তো যাইনি । এই শহরে বেঁচে থাকা মানেই ভাল থাকা ।

     

    আমরা জাহিদ কাকার বাসা থেকে বলতে জাহিদ কাকার ড্রাইভারের বাসা থেকে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম । সেদিন জাহিদ কাকার বাসায় থাকার সৌভাগ্য হয়নি । কাকার ভায়রার ছেলেমেয়েরা আসছিলো যে কারণে ডিনারের পর আমাদের ঠাঁই হয় ড্রাইভার শামসুর বাসায় । কথার প্রসঙ্গে ড্রাইভার শামসু বললো , ভাইজানেরা ইচ্ছে করতাছে আপনেগর ঢাকা শহর চক্কর দিয়ে ঘুরায়ে নিয়ে আসি । কিন্ত আমি ভাই ড্রাইভার চাকর । মালিকের কথার বাইরে একটা হাওয়াও ছাড়তে পারি না । আজ আপনারা যদি স্যারের ভাইয়ের ছেলে না হয়ে ভায়রার ছেলে হতেন । দেখতেন আদর কারে কয় !
    জহির আমার সামনে একটু লজ্জায় পেল । কিছু কিছু সময় লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় ।
    জহির হয়তো ভেবেছিল , ভাতিজা ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিবে নিশ্চয়ই কাকা প্রাইভেট কারেই পাঠাবে । জহির তো ছোটলোক না । সে একজন ইঞ্জিনিয়ারের ভাতিজা । চাড্ডি খানি কথা না !
    জাহিদ কাকা জহিরকে দেখে যতোটা খুশি হলেন তার চেয়ে বিরক্তই হলেন বেশি । তার চাহনিতে বলে দিচ্ছে । আমরা ছিলাম বিরক্ত উপেক্ষা করে ।জহিরের কাকি তার বোনের ছেলেমেয়েরা আসছে তাদের নিয়ে ব্যস্ত । জহিরকে একবার টু দিয়েই উধাও । জাহিদ কাকার মস্ত ফ্ল্যাটে একজন অসহায় জহিরকে সেদিন দেখেছিলাম ।
    ভাগ্য সহায় ছিল জহির চান্স পেল, আমি পেলাম না । আমি চান্স না পেলেও জহির পাওয়াতেই সবচেয়ে বোধহয় বেশি খুশি হয়েছিলাম । কারণ আমার বাবার সামর্থ্য ছিল বেসরকারিতে পড়াবার । জহিরের বাবার কি তা ছিল ?

    সেদিন ঢাকা গিয়ে জহিরকে ফোন দিলাম । দোস্ত কই তুই ?
    জহির বলল , দোস্ত আমি ফার্মগেটে ।
    আমি বললাম , তোর ভার্সিটির পাশেই না তোর কাকার বাসা ?
    জহির স্বর নিচু করে বলল , বাদ দে তো ! কই তুই ?
    আমি বললাম , মিরপুরে আছি কাকার বাসায় ।
    জহির বলল , বিকেলে এদিকে আয় । আড্ডা দিমুনি ।

    বিকেলে জহির আর আমি রিকশায় ঘুরছি । এই শহরে রিকশা যতোটা আপন করে নেই বাস মাইক্রো ততোটা আপন করে নেয় না । যান্ত্রিক এই বহনগুলো শুধু যন্ত্রণা দেয় । হঠাৎ চোখ গিয়ে পড়লো একটা দেয়ালে । সেখানে লেখা ‘দাতা কখনোই গ্রহীতা হয় না’ -( আল হাদিস) আমি হাদিসটি নিয়ে ভাবতে লাগলাম । উত্তরটাও পেয়ে গেলাম । আজ জমির চাচার রিকশা উঠেও ওই হাদিসটি নিয়ে ভাবতে লাগলাম । জমির চাচা বললো , বাজান কই নামবা ? বাজারে তো আইসা পরছি ।
    আমি বললাম , চাচা দুপুরে খাইছেন ?
    জমির চাচা বলল , আর দুইটা খেপ মারি খাবার যামু । রোদের মধ্যে
    ভাড়া বেশি পাওন যায় ।
    আমি বললাম , চলেন আগে দুই চাচা ভাতিজা খাই ।
    শাহজাহান হোটেলে জমির চাচা আর আমি খাচ্ছি । আমি ঠিক যতোটা আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছি , তিনি ঠিক ততোটায় অনাগ্রহ নিয়ে খাচ্ছেন । তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম ,চাচার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে । তিনি বাম হাতে চোখের পানি মুছে বললেন , জহিরের সাথে তোমার কথা হয় ?
    আমি বললাম , জ্বি চাচা । ও খুব ভালই আছে । কয়েকটা টিউশনিও করাচ্ছে ।
    ~ ছেলেটা আমার জন্মের পর থেকে কষ্টের নদীতে সাঁতার কাঁটছে ।
    ~ সব ঠিক হয়ে যাবে চাচা । এতো কষ্ট আর থাকবো না । কষ্টের পর সুখ আসে ।
    জমির চাচা বললেন , কিছু কিছু মানুষের কষ্টের পরেও কষ্ট আসে । সব নিয়তির খেলা বাজান ।
    কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না । তবুও নিরুত্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে
    বললাম , চাচা , হাদিসে আছে ‘ দাতা কখনোই গ্রহিতা হয় না’ ।
    জমির চাচা বললেন , ব্যাপারটা বুঝলাম না বাজান ।
    আমি তাকে বুঝানোর স্বরে বললাম , যে দান করে সে দাতা , আর যে গ্রহণ করে সে গ্রহীতা । মানে আপনি যেখানে দাতা হবেন সেখানে গ্রহীতা হওয়ার সুযোগ নেই ।
    জমির চাচা মিটমিটি হাসতে লাগলেন । হয়তো তিনি নিজের হাসির মধ্যে বিজয়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন ।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.