Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    ত্বহা হুসাইন এর দিনগুলি

    পর্ব-দুই

    সুতরাং এ ব্যপারে সে নিশ্চিত ছিলো, যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে তার সামান্য দূরেই, ডান দিকে অবস্থিত ওই খালটির সাথেই পৃথিবীর সমাপ্তি। আর কেনই-বা সে এমন ভাববে না? যেহেতু কোনোভাবেই খালটির অমন সামান্য প্রশস্ততা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ, তা এমনই সংকীর্ণ ছিল যে, চটপটে যেকোনো যুবক এক লাফে তার একপাশ থেকে অন্য পাশে যেতে পারবে। তাছাড়া না সে কখনও খালের ওপারে-এপারের মত মানুষ, পশু বা উদ্ভিজ্জ জীবনের কথা কল্পনা করতে পেরেছে। এমনকি সে এ হিসেবও মেলাতে পারেনি যে, বন্যার সময়ও কীভাবে একজন বয়স্ক মানুষ নিশ্চিন্তে এই খাল পার হয়ে যেতে পারে! এও বুঝতে পারে না কখনও কেন মাঝে মাঝে এই খালে একটুও জল থাকে না। তখন এটা এক দীর্ঘ পরিখার রূপ নেয়; ছেলেরা যেখানে খেলাধুলায় মেতে ওঠে অথবা নরোম কাদামাটির ভেতর রয়ে যাওয়া ছোটো মাছের তালাশে মত্ত হয়। পানি শুকিয়ে যাবার পর যেসব মাছ মারা গিয়েছিল।

    আসলে এসব বিষয়ে কোনো গভীর দুশ্চিন্তা ছিলো না তার। সে বরং মনেমনে ওই খালটির কথাই চিন্তা করত। বোধহয় সে যে পৃথিবীতে বাস করে তার থেকে এই খালের জগতটি সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বাধীন। তা এমন এক পৃথিবী; যেখানে অসংখ্য অদ্ভুত প্রাণীর বাস। যেমন, সেখানে আছে কুমির; যা কিনা মানুষকে এক গ্রাসেই গিলে ফেলতে পারে। এছাড়াও আছে জাদুকর গোষ্ঠী; সমস্ত উজ্জ্বল দিন আর অন্ধকার রাতে যারা জলের নীচে বসবাস করে। ভোর ও সন্ধ্যাতে কেবল এক কণ্ঠ বায়ু গ্রহণে জলের ওপর পৃথিবীতে উঠে আসে। সেসময় শিশুদের জন্য তারা মহাবিপদ আর বড়দের জন্য এক অশুভ মোহাবিষ্ট ভ্রম হয়ে ওঠে।

    সে বরং মনেমনে ওই খালটির কথাই চিন্তা করত। বোধহয় সে যে পৃথিবীতে বাস করে তার থেকে এই খালের জগতটি সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বাধীন। তা এমন এক পৃথিবী; যেখানে অসংখ্য অদ্ভুত প্রাণীর বাস

    এমনকি এসব অদ্ভুত প্রাণীদের মাঝে অতিকায় মাছেরাও আছে; যারা কোনো একটি শিশুকে ধরা মাত্রই মুহূর্তে গিলে ফেলে। তখন শিশুদের মধ্যে যাদের ভাগ্য ভালো; তারা কখনও ওসব মাছের পেটে থাকা আংটিটি ধরে ফেলতে পারে- যা তাদেরকে শক্তির সাম্রাজ্যে নিয়ে আসে। আর একবার তা পেয়ে গেলে, কেউ তা নিজের আঙুলের চারপাশে ঘোরানোর সাথে সাথেই দুটি জিন তার সমস্ত ইচ্ছে পূরণের জন্য এসে হাজির হয়। মূলত এটাই সে আংটি; নবী সুলাইমান যেটা পরতেন। ফলে, জিন, বায়ূ ও প্রাকৃতিক সমূহ শক্তি তার ইচ্ছে পূরণে অনুগত হয়ে গিয়েছিল। তাই এখন সে শুধু ওই খালের কিনারে যেতে চায় এই আশায় যে, ওখানে থাকা মাছের কোনো একটি তাকে গিলে ফেলবে আর সে তার ভেতরে গিয়ে আংটিটি দখল করবে। কেননা এটি যে তার খুবই প্রয়োজন। আসলে সেতো কেবল জিনের কোনো এক সেবকের মাধ্যমে খালের ওই প্রান্তে থাকা তার কল্পিত বিস্ময় দেখতে আগ্রহী ছিলো! অন্যদিকে আবার আশীর্বাদপুষ্ট ওই মাছের কাছে পৌঁছানোর আগে যে ভয়াবহতা তাকে ভোগ করতে হবে- তার কারণেও নিজেকে সঙ্কুচিত করে নিয়েছিল।

    যাহোক, মূলত দীর্ঘ এক দূরত্বের কারণে খালের তীরে কোনোরূপ অন্বেষণ করতে সক্ষম হয়নি সে। কেননা তার ডান-বাম সবদিকই ছিল অসংখ্য বিপদে পরিপূর্ণ। ডানদিকে ছিল উচ্চবর্গীয় মিশরীয় লোকদের বসবাস। যারা বিরাট এক বাড়িতে থাকে। আর তাদের বাড়ির প্রধান দরজার পাহারায় আছে বৃহৎ দুটি কুকুর। সেগুলো অবিশ্রান্ত ঘেউঘেউ করে যায়। এক কথায় তারা এমনই হিংস্র, প্রতিবেশী একজন পথচারী বহু কষ্টেই কেবল তাদের থেকে পালাতে পারে। আর বামদিকে ছিল সাইদ আল-আরাবীর তাঁবু। যার মন্দ কাজ ও চতুরতা সম্পর্কে বেশ গুজব ছিল। এমনকি তার রক্ত-পিপাসা সম্পর্কেও ছিল সরব রটনা। তার স্ত্রী কাওয়াবিস। যে কিনা বৃহৎ একটি নাকফুল পরত এবং প্রায়ই বাড়ির ওদিকে গেলে ঘনঘন বালকটিকে চুমু খেত। এটা তাকে বেশ যন্ত্রণাই দিত এবং সেই সাথে বিরক্তও করত। সুতরাং তার ডান দিকে যাওয়া এবং সেখানে ওই হিংস্র কুকুর দুটির মুখোমুখি হওয়া বিষয়ক ভয় ও বাম দিকে সাইদ ও তার স্ত্রী কাওয়াবিসের দুষ্টুমি সত্ত্বেও- সে তার নিজের সীমিত ও সীমাবদ্ধ জগতের প্রতিটি অংশেই খুঁজে পেত এক আলাদা আনন্দ। বিভিন্ন ধরণের বিনোদন ও অভিনব পরিতোষ। সমস্ত দিনজুড়ে তার ওপর যা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

    প্রকৃত, শিশুর স্মৃতি এক অদ্ভুত জিনিস। অথবা আমরা বলতে পারি, মানুষের স্মৃতি মূলত অদ্ভুত এক কৌশল চালনা করে, যখন সে তার শৈশবের স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করে। এর ফলে কিছু ঘটনা সে এমন স্পষ্টভাবে চিত্রিত করে, যেন সেসব এই কিছুদিন পূর্বেই ঘটেছে। যদিও তা অন্য ঘটনাগুলো এমনভাবে মিটিয়ে দেয়; যেন কখনওই সেগুলো তার দৃষ্টিসীমা বা জ্ঞানের ভেতর ছিল না। যেমন, আমাদের বন্ধুটি ওই বেড়া এবং চষা জমির কথা স্মরণ করতে পারে, যা তার ঘর বরাবর ছিল। সে মনে করতে পারে ওই খালের কথা; যা পৃথিবীর শেষপ্রান্ত হিসেবে তার কাছে চিহ্নিত। এমনকি সাইদ, কাওয়াবিস এবং ওই কুকুর দুটির কথাও স্মরণ করে সে। কিন্তু যখনই এসব জিনিসের স্মৃতিচারণের চেষ্টা করে, তখন এসবের আদৌ কিছু বুঝতে পারে না। যেন এমন যে, কোনো এক রাতে সে ঘুমুতে গিয়েছে, আর সকালে বেড়া, মাঠ, সাইদ ও কাওয়াবিসের কোনো চিহ্নই খুঁজে না পাওয়ার জন্য জেগে উঠেছে। অথচ দেখ! সে কিন্ত ঠিকই উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত ওই খালের কিনারা পর্যন্ত বেড়ার জায়গাটি, মাঠের মাঝে অবস্থিত ঘরবাড়ি ও সুশৃঙ্খল রাস্তাগুলো দেখেছিল। সেখানে সে নারী পুরুষ এমন অনেককেই মনে করে, যারা ওসব বাড়িঘরে বসবাস করতো। এমনকি ওখানের বহু শিশুর কথাও; যারা দিনভর ওখানের পথঘাটে খেলাধুলা করে বেড়াত।

    সে এও মনে করতে পারে যে, হিংস্র ওই দুই কুকুরের ভয় এবং সাইদ ও তার স্ত্রীর ধূর্ততা ছাড়াই পরে এক সময় সে ওই খালের পাড় ধরে এর দুপাশেই ঘোরাফেরা করতে সক্ষম হয়েছিল। সেইসাথে সে এ কথাও মনে করে, রোজ কীভাবে আনন্দ ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ঘন্টার পর ঘন্টাগুলো সে ওই খালের ধারে কবি হাসানের কবিতা ও গান শুনে কাটিয়ে দিত। যিনি খালের অপর পাশে তার জমি সেচ দেওয়ার সময় আবু যায়েদ, দিয়াব ও খলিফার সমস্ত কবিতা ও গানগুলো গাইতে গাইতে পানি তুলতেন। তাছাড়া তার এও মনে পড়ে, কতবার সে ওই জাদুর আংটি ছাড়াই তার এক ভাইয়ের কাঁধে চড়ে খালটি পার হয়েছিল! এবং একাধিকবার এই খালের উল্টো পাশে এমন এক জায়গায় গিয়েছিল, যেখানে দাঁড়িয়েছিল নিশ্চল কিছু তুঁতগাছ। যেসবের সুস্বাদু ফল সে খেয়েছিল। এমনকি কীভাবে সে একাধিকবার খালের পাড় ধরে মকতব শিক্ষকের আপেল বাগান অবধি চলে গিয়েছিল! মাঝে মাঝে সেখান থেকে দু’একটি আপেল ভক্ষণ করেছিল এবং পুদিনা ও তুলসি সংগ্রহ করেছিল।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.