Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    ত্বহা হুসাইনের দিনগুলি

    ছয়

    সেদিন থেকে আমাদের ছোট্ট বন্ধুটিও শায়খ হয়ে গেছে। যদিও তখনও তার নয় বছরই হয়নি। কিন্তু সে তো কোরান মুখস্থ করেছে। আর যে কোরান মুখস্থ করে, বয়স যতই হোক; সে শায়খ। ফলে তার বাবা তাকে শায়খ বলে ডাকে, মা-ও ডাকে এ নামেই। এমনকি আমাদের শিক্ষকও বাবার সামনে তাকে শায়খ বলে সম্বোধন শুরু করে। এছাড়াও যখন তিনি বাবাকে খুশি করতে চাইতেন এবং তার থেকে কোনো আনুকূল্য প্রত্যাশা করতেন; তখনও তিনি আমাদের বন্ধুটিকে শায়খ বলে ডাকতেন। অথচ এর বাইরে তিনি তাকে তার নাম ধরেই ডাকতেন এবং অন্যথা প্রায়ই শুধু কেবল ‘বালক’ বলেই সম্বোধন করতেন।
    আমাদের বালক-শায়খ বন্ধুটি ছিল খাটো, জীর্ণশীর্ণ, ফ্যাকাশে ও শারীরিকভাবে শ্রীহীন আকৃতির। তার মাঝে না ছিল শেখসুলভ কোনো গাম্ভীর্য; না ছিল তাদের মত সামান্য কোনো হাবভাব। আসলে বাবা-মা এই উপাধি দিয়ে তাকে মহিমান্বিত ও সম্মানিত করার মাঝে নিজেরাই আনন্দিত হতেন। নিজেদের গর্ব ও তুষ্টির জন্যই নামের সাথে উপাধিটি যুক্ত করেছিল তারা। কিন্তু এটা ভেবে দেখেননি, বিষয়টি তাকে ক্ষুব্ধ বা সন্তুষ্ট করে কি-না!
    যদিও উপাধিটি প্রথম প্রথম তার ভালো লাগত। কিন্তু প্রকৃত সে এই অনুপ্রেরণা ও পুরস্কারের দৃশ্যমানতা থেকে বরং অন্য কিছুর অপেক্ষা করেছিল। মূলত সে একজন বাস্তবিক শায়খ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তখন সে পাগড়ি নেবে, জুব্বা ও কাফতান গায়ে চড়াবে। কিন্তু এ কথা তাকে বোঝানো কঠিন যে, পাগড়ি বহন ও একটি কাফতানে প্রবেশের জন্য সে এখনও খুবই ছোটো।
    কিন্তু কীভাবেই বা সে এতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে অথচ সে একজন শায়খ; যে কিনা পুরো কোরান মুখস্থ করেছে! কীভাবে একজন ছোটো কেউ কোরান মুখস্থ করতে পারে? আর যে কোরআন মুখস্ত করেছে; কীভাবেই বা সে ছোট হতে পারে? সুতরাং নিশ্চয় তার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। আর তার মাঝেও তার জুব্বা, পাগড়ি, কাফতানের অধিকারের মাঝে এরচেয়ে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে!
    অতএব, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে এই শায়খ উপাধিতে বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে। কেউ এ নামে ডাকলেও সে ঘৃণা করে। তদুপরি সে উপলব্ধি করে, জীবন হলো; অবিচার ও প্রতারণায় ভরপুর। সেখানে মানুষ এমনকি তার পিতাও তার প্রতি অন্যায় করেছে। কেননা পিতৃত্ব-মাতৃত্বও তার পিতামাতাকে মিথ্যা, ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বিরত রাখেনি।
    মূলত এই উপলব্ধি এবং পিতামাতার গর্ববোধ ও আত্মপ্রশংসায় ডুবে থাকার অনুভূতি শীঘ্রই তাকে ‘শায়খ’ উপাধিটির প্রতি অবজ্ঞার একটি জায়গা করে দিয়েছিল। তারপর অবশ্য অল্প কিছুদিনেই অন্য সমস্ত কিছুর সাথে এসবও ভুলে গিয়েছিল সে।
    মূলত তাকে যে শায়খ বলে ডাকা হত; এর যোগ্য সে ছিল না। বরং কোরান মুখস্থ করা সত্বেও পূর্বের মতোই জীর্ণ বসনে মকতবে যাওয়ার উপযুক্ত ছিল সে। মাথায় তখন সপ্তাহান্তে কদাচিৎ পরিস্কার করা একটি টুপি। সারা বছরে মাত্র একবার পালিশ করা একজোড়া জুতো থাকে পায়ে। আর তা এমনই পুরনো যে, একেবারে পরার অনুপুযুক্ত হলে-তবেই তা বর্জন করতে পারে। তখন সে তা পরিত্যাগ করে এবং এক সপ্তাহ বা কয়েক সপ্তাহ অবধি ওভাবেই খালি পায়ে চলাফেরা করে। যতদিন পর্যন্ত না একজোড়া নতুন জুতোর জন্য ঈশ্বরের অনুমতি হয়।
    এসবেরই যোগ্য সে। কেননা বেশিদিন সে কোরান মুখস্থ রাখতে পারে নি। কিন্তু এর জন্য কী সে একাই তিরস্কৃত হবে? নাকি অপরাধটি তার ও আমাদের শিক্ষকের মাঝে সমানভাবে বিভক্ত ছিল! অথচ, সত্য হলো একটা সময়ে আমাদের শিক্ষক তাকে অবজ্ঞা করেছেন এবং যারা তখনও কোরান সমাপ্ত করেনি, তাদের দিকে মনোযোগী হয়েছিলেন। তার এই অবজ্ঞার হেতু মূলত বিশ্রাম এবং সেইসাথে এও যে, আমাদের বন্ধুটি কোরান খতম করার পর তাকে তার প্রার্থিত পারিশ্রমিক দেওয়া হয়নি।
    অন্যদিকে নিঃসন্দেহে আমাদের বন্ধুটিও এ অবহেলা মনেপ্রাণে উপভোগ করেছে। ফলে প্রত্যহ মকতবে গিয়ে, সম্পূর্ণ বিশ্রাম ও নিরবিচ্ছিন্ন খেলাধূলাতেই কাটে তার সময়। সেইসাথে বছর শেষ হওয়া ও কায়রো থেকে তার আযহারে পড়ূয়া ভাইয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা। এরপর যখন তার ছুটি শেষ হবে, তখন সে আবার কায়রো ফিরে যাবে। তবে এবার সাথে করে আমাদের বন্ধুটিকেও নেবে আল আজহারে ভর্তি করা ও প্রকৃত শায়খ হওয়ার জন্য।
    এভাবেই মাসের পর মাস কাটতে থাকে। আমাদের বন্ধুটিও রোজ মকতবে যায় এবং কোনোপ্রকার পড়াশোনা ছাড়াই ফিরে আসে। সে নিশ্চিত যে, তার কোরান মুখস্থ আছে। অধিকন্তু আমাদের শিক্ষকও এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, নিদারুণ, অশুভ সে দিন পর্যন্তও তার কোরান মুখস্থ থাকবে।… আর হ্যাঁ সত্যিই তা অশুভ, সর্বনাশা এক দিন ছিল। যেদিন এই প্রথম আমাদের বন্ধুটি, অপমান, লাঞ্ছনা, হীনতা ও জীবনের প্রতি ঘৃণার তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে।
    বরাবরের মতোই সেদিন আসরের সময় বেশ শান্ত ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে মকতব থেকে ফিরেছে মাত্র। অমনি ঘরে ঢোকার আগেই বাবা তাকে শায়খ সম্বোধনে কাছে ডাকেন। ডাক শুনে বাবার কাছে যায় সে। দেখে, তিনি তার দুই বন্ধুর সঙ্গে বসে আছেন এবং তাকে দেখা মাত্রই সানন্দে সাক্ষাৎ করেন। তারপর একটি কোমল স্বরে তাকে বসতে বলে নিয়মমাফিক গতানুগতিক কিছু প্রশ্ন করেন।

    তবু এই ঘৃণ্য অশুভ সন্ধ্যাটি আগামীকাল মকতবে যাওয়ার চেয়ে বহুগুণ ভালো ছিল। কেননা পরদিন সে মকতব যাওয়া মাত্রই আমাদের শিক্ষক কর্কষ গলায় তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘গতকাল কি হয়েছিল? আর হ্যাঁ! কীভাবে তুমি সূরা শুয়ারটি তেলাওয়াত করতে পারলে না! সত্যিই কী তুমি তা ভুল গেছ? আচ্ছা দেখি আমাকে শোনাও তো।’

    এরপরই মূলত তিনি তাকে সূরা ‘শুয়ারা’ তেলাওয়াত করার জন্য অনুরোধ করেন। যা তার ওপর হঠাৎ এক বজ্রাঘাতের মতো মনে হয়। সুতরাং গভীর ধ্যানে তড়িৎ সে তা মনে করার চেষ্টা করে এবং তোতলাতে তোতলাতে আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ে। কিন্তু কোনোভাবেই সূরা ‘শুয়ারা’ মনে করতে পারে না। তবে এটুকু মনে পড়ে যে, এটা হলো তিন সূরার ওই একটি; যার শুরু ‘ত্ব-সীন-মীম’ দিয়ে। সুতরাং বারংবার শুধু ওই ‘ত্ব-সীন-মীম’টুকুই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে সে। এর পরের অংশ কী তা আর বলতে পারে না। বাবা তখন তাকে পরের বাক্যটকু বলে দেন। কিন্তু তদসত্বেও কোনোভাবেই সে সামনে পড়তে পারে না। এই দেখে বাবা বলেন, ‘আচ্ছা সূরা নামল পড়।’ ফলে সে মনে করে সূরা নামল এর শুরুও সূরা শুয়ারার মত ‘ত্ব-সীন’ দিয়ে। সুতরাং পূর্বের মতোই সে ‘ত্ব সীন’ বলে শুরু করে এবং তোতলাতে থাকে। এসময় আবার বাবা তাকে সাহায্য করেন, কিন্তু কোনক্রমেই সে এগুতে পারে না। তখন বাবা বলেন, ‘আচ্ছা তাহলে সূরা ‘ক্বাসাস’টি পাঠ করো।’ এবার তার এটুকু মনে পড়ে যে, এটি হচ্ছে ‘ত্ব-সীন-মীম’ দিয়ে শুরু হওয়া সূরা সমূহের তৃতীয়টি। সুতরাং পূর্বের মতোই সে তোতলাকে থাকে। কিন্তু এবার বাবা তাকে আর সাহায্য করেন না। পরিবর্তে শান্তভাবে তিনি বলেন, ‘দাঁড়াও! ভেবেছিলাম সত্যিই তুমি কোরান হিফয করেছ!’
    আমাদের বন্ধুটি লজ্জিত ও অবনমিত চোখে দাঁড়ায়। তার পুরো শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল তখন। এসময় বাবার সঙ্গে থাকা লোক দুটি অবশ্য তার লাজুকতা ও অল্পবয়স্কতার কথা বলে কিছুটা অজুহাত তৈরি করেছিল এবং সে ওখান থেকে দূরে সরে এসেছিল। তখন সে ভাবতে থাকে, সে যে কোরান ভুলে গেছে-এজন্য কি নিজেকেই দোষ দেবে নাকি শিক্ষককে! কেননা তিনি তাকে অবহেলা করেছেন। না-কি তার বাবাকে দোষারোপ করবে; কারণ তিনি তার পরীক্ষা নিয়েছেন।
    সে যাহোক। সেদিনের সন্ধ্যা ছিল তিমিরাচ্ছন্ন, থমথমে এক সন্ধ্যা। ফলে রাতে খাবারের জন্য সে দস্তরখানে আসেনি এবং বাবাও জিজ্ঞেস করেনি কোথায় সে? অবশেষে মা আসেন এবং কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই তার সঙ্গে আহারের জন্য ডাকেন। কিন্তু তাতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি চলে যান এবং ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।
    তবু এই ঘৃণ্য অশুভ সন্ধ্যাটি আগামীকাল মকতবে যাওয়ার চেয়ে বহুগুণ ভালো ছিল। কেননা পরদিন সে মকতব যাওয়া মাত্রই আমাদের শিক্ষক কর্কষ গলায় তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘গতকাল কি হয়েছিল? আর হ্যাঁ! কীভাবে তুমি সূরা শুয়ারটি তেলাওয়াত করতে পারলে না! সত্যিই কী তুমি তা ভুল গেছ? আচ্ছা দেখি আমাকে শোনাও তো।’
    সুতরাং আমাদের বন্ধুটি বলতে শুরু করে ‘ত্ব-সীন-মীম’ এবং সেরূপই ঘটে যেরূপ তার পিতার সামনে গতকাল ঘটেছিল।
    আমাদের শিক্ষক তখন চিৎকার করে বলে, ‘তোমাকে উত্তমরূপে শিক্ষাদানে যে সময় ও প্রচেষ্টা আমি ব্যয় করেছি-বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। কিন্তু তুমি যেহেতু কোরান ভুলে গেছ, তাই আবার তোমাকে তা মুখস্থ করতে হবে। এমন নয় যে এর কারণে আমি বা তুমি দোষী। বরং সমস্ত নষ্টের গোড়া হলেন তোমার বাবা। তিনি যদি তোমার খতমের দিনই আমাকে আমার পাওনাটা বুঝিয়ে দিতেন; তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তোমার হিফযে বরকত দিতেন। কিন্ত তিনি যেহেতু আমাকে আমার হক থেকে বঞ্চিত করেছে, তাই আল্লাহও তোমার হৃদয় থেকে কোরান মুছে দিয়েছেন।’
    অতএব আবার সে শুরু থেকে তার কাছে কোরান পড়া শুরু করে। ওসব ছাত্রদের সাথে; যারা শায়খ বা হাফেজ কিছুই ছিল না।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.