ব্যক্তিগত অবহেলা
অবহেলা আমাকে দিয়ে
আস্ত একটা কবিতা লিখিয়ে নিবে
অথচ আমি জানতেই পারব না
কেন আমাকে অবহেলা করা হচ্ছে,
অবহেলার যন্ত্রণায় আমার বুক ভারি হয়ে আসবে
তবু আমি কাউকে কিছুই বলতে পারব না।
খুব কাছের বন্ধু কৌশলে আমাকে এড়িয়ে যাবে
আমি বুঝতে পারব ঠিকই
কিন্তু কাউকেই কিছু বলতে পারব না।
আমার চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসবে
বুকের ভেতর ঝড় ওঠবে
আমি হয়তো বুঝতেও পারব না
আমার কতটুকু তছনছ হলো!
শুধু এইটুকুই জানব,
যে একদিন হৃদয়ের কাছে ছিল
সে আজ দূর থেকে বহু দূরে….
পার্ফেক্ট মার্ডারার
কোথাও কোন রক্তের দাগ নেই
কোন ছুরি বা পিস্তলের ব্যবহার হয়নি
একটা চিহ্নও নেই খুনের
না আছে কোন প্রমাণ
এমন ‘পার্ফেক্ট মার্ডার’ আর কে করতে পারে বলো?
যে খুনের কোন সাক্ষী নেই
থানা পুলিশের ভয় নেই
মামলা নেই, বিপক্ষ উকিল নেই
জজ নেই, আদালত নেই
তোমার খুনের কোন বিচার নেই!
শুধু ঘরের ভেতর থেকে
ছটফট করতে করতে ভাববো,
তুমি আমাকে এমনভাবে খুন করে গেছ
অথচ কেউ জানলোই না…
তনুতাকে
রাত আরও বাড়বে
আমার ঘুম আসবে না অথবা
আমি অকারণেই ঘুমাব না
গান শুনতে শুনতে হঠাৎ বাইরে ছড়িয়ে থাকা
ফুলের গন্ধ আমার নাকে আসবে
আমার ঘুম আসবে না
ঠিক এমন সময় তোমাকে মনে পড়বে
আমার আরও ঘুম হবে না
আমি একা অনুভব করব
মধ্যরাতে জানলা খুলে দেব
জ্যোৎস্না দেখতে গিয়ে দেখব-
বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে…
তখন তোমার পাশে অন্য কেউ শুয়ে আছে।
খুন
এখানে প্রতিদিন খুন হয়
একটার পর আরেকটা খুন হতে থাকে
খুন হতে হতে পৃথিবীর কোথাও আর মানুষ নেই;
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে
আমি আমার মৃত্যুর কথা ভাবি
ভাবি, কবে যে আমি খুন হয়ে যাই!
ঠিক খুন হয়ে যাবার আগে
আমি একবার সমুদ্রে যাব,
তারপর পাহাড়ি জঙ্গল ঘেরা আমাদের সেই
পুরনো বাড়ি; যেখানে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল।
তোমার রাষ্টের কাছে যেখানে তুলে দিয়েছিলাম
আমার সমস্ত স্বাধীনতা।
আমার সমস্ত চাওয়া পাওয়া তোমার পায়ের কাছে
লুটিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘মহামান্য আমাকে ক্ষমা করুন,
খুন হওয়া থেকে আমাকে রক্ষা করুন’…
আমি আমার খুনের কথা ভাবতে ভাবতে পালাতে থাকি
একবার পালিয়ে যাই জঙ্গলে, আবার সমুদ্রে
কেঁচোর মতো গর্তে পালাতে গেলে পারি না
ভাবছি মায়ের গর্ভে পালাব
আবার ভাবছি, মা-ও তো খুন হয়ে যেতে পারে।
হে মহামান্য বলুন,
আমার এই অনিশ্চিত জীবন নিয়ে আমি পালাব কোথায়?
তুমি আছ
আমার ক্লান্ত চোখের নিচে তোমার ছায়া,
কালো কালো দাগ
মায়ের গন্ধেভরা আঁচলের ভাজে তুমি আছ;
তুমি আছ বিকেলের স্নিগ্ধ রোদে
শীতের দুপুর, কুয়াশার সাদা সাদা রঙে,
বিলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা
একটি বকের একাকীত্বে তুমি আছ।
বেকার যুবকের শূন্য পকেট
ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না
মধ্যরাতে ব্যর্থ প্রেমিকের চিৎকার
বাবা হারা এতিম শিশুর জীবনের গল্পে তুমি আছ।
তুমি আছ প্রান্তিক কৃষকের ফসলের মাঠে
আকাশের নীলে, বাতাসের মৃদু কম্পন আর-
ঢেউ ভাঙা সমুদ্রের তীরে
জন্মের পাশে, মৃত্যুর পাশে তুমি আছ।
জীবন
জীবন একটা গ্রাম্য প্রাইমারি স্কুল
মাঝে ছোট্ট খেলার মাঠ
ক্লাস প্রাঙ্গণে থাকা ফুলের বাগান
এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা শেওলা পড়া
বৃদ্ধ করই গাছ।
শৈশব তো প্রথম বাংলা ক্লাস,
বই খাতাহীন মুখে মুখে পড়ে ফেলা- অ, আ, ই…।
যৌবন তো ইংরেজি ক্লাস,
বিদেশি ভাষার মতো দুর্বোধ্য
বুঝে উঠতে না পারা অগণিত ভুল।
বয়স যেন মান্নান স্যারের গণিত ক্লাস
১,২,৩,৪ সংখ্যার ক্রমানুসারে
বাড়তে বাড়তে কখন যে ফুরিয়ে যায়…
আর মৃত্যু?
মৃত্যু তো শেষ বিকেলের ছুটিরঘণ্টা
বেজে উঠলেই… সব ক্লাস শেষ।
তোমাকে দেখার অপেক্ষায়
বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে
দুখের নদী। খাঁচায় বন্দি ঘুঘুটি ডাকবে না আর
শিস দিবে না ভোরের দোয়েল;
আমাদের মাঠে ফলবে না সেই সোনালি ফসল।
জ্বলন্ত হৃদয়ের তাপে
শুকিয়ে যাবে কাগজের ফুল।
অন্ধ হয়েও অন্ধ হবে না সমাজের চোখ
শুধু তোমাকে দেখার অপেক্ষায়…
প্রত্যাশা
আম্মা চাইতেন আমি ডাক্তার হই
আব্বা চাইতেন ইঞ্জিনিয়ার হই
আমি চাইতাম পাখি হতে,
ডানায় ভর করে শূন্যে উড়াল দিতে
উড়তে উড়তে পাহাড়ের বুকচেরা ঝরনার কাছে যেতে
আমি চেয়েছিলাম গভীর জঙ্গলে যেতে
সাপ বিচ্ছুর ভয়। গভীর অন্ধকার…
তোমাদের মধ্যে যে মেয়েটি পাখি পুষতে জানে
আমি তাকে ভালোবাসতে চাইতাম।
আমার তো পাখির স্বভাব। পালকের সাধ।
আব্বা গান শুনতে ভালোবাসতেন আর আম্মা পাখি পুষতে
আমি পাখি হতে চেয়েছিলাম, আম্মার পোষা পাখি।
আমি গান হতে চেয়েছিলাম, বেগম আখতারের গান।
আব্বা কষ্ট পেলে আমাকে মনজুড়িয়ে শুনতেন।
কবি তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন সৃজন পাঠচক্রে তার একক কবিতাপাঠে উপরের কবিতাগুলো পাঠ করেন। উপস্থিত কবিদের মধ্যে পঠিত কবিতার ওপর আলোচনা করেন- কবি আকেল হায়দার, কবি ওয়াহিদ জামান, কবি ও কথাসাহিত্যিক আহমেদ বাসার, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারুল হক, কবি ও সম্পাদক জুননু রাইন। সেই আলোচনা তুলে ধরা হলো:
তৌহিদের কবিতা মূলত প্রেম-বিরহ নির্ভর। যেমন ‘পারফেক্ট মার্ডারার’ — প্রিয় মানুষের প্রস্থান প্রহরের মাধ্যমে সৃষ্ট বেদনা তাকে কীভাবে আহত করেছে এবং আপাদমস্তক সুস্থ একজন মানুষকে কীভাবে প্রাণহীন অবস্থায় পরিণত করেছে তার অনবদ্য বর্ণনা ফুটে উঠেছে। মানুষ হয়ে আমাদের পৃথিবীতে সে বেঁচে আছে অথচ প্রতিনিয়ত এক গহিন ক্ষত তার বুকের অভ্যন্তরে ব্যথার নদী হয়ে বয়ে চলেছে। বিরহগাঁথার এই হাহাকার সে খুব সহজ-সরল সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করেছে এই কবিতায়। ‘তনুতাকে’ কবিতাটি প্রিয় মানুষকে স্মৃতিচারণ করে বাস্তবতা ও রূপকের যৌথ মিশেলে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। এর মধ্যে কয়েকটা লাইন যদি উল্লেখ করি- ‘মধ্যরাতে জানালা খুলে দেব, জ্যোৎস্না দেখতে গিয়ে দেখব বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে,
তখন তোমার পাশে অন্য কেউ শুয়ে আছে।’
এ ধরনের হৃদয় নিংড়ানো কাব্যিক উপস্থাপন এই কবিতাগুলোর শরীরে প্রাণের স্পন্দন এনে দিয়েছে।
আমাদের যে জীবন, আয়ু এবং আমাদের যে প্রতিদিনের কাজ, সেগুলো নিয়ে খুব চমৎকার দার্শনিক একটি চিন্তা আছে তৌহিদের কবিতায়। সবকিছু মিলিয়ে খুব সহজ ভাষায় সুন্দর করে, সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করে এবং শেষের দিকে একটা চমৎকার উপসংহার টেনে কবিতাগুলো লেখা।
-আকেল হায়দার
তৌহিদ আহাম্মেদ লিখনের কবিতা আসলে এক ধরনের সরল প্রকাশ। কিন্তু কবিতার ভিতরে জীবনের একটা নির্মল তাৎপর্য আছে। সরল প্রকাশ এজন্য বললাম যে, রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, ‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’ সহজ কথা আসলে সহজ করে বলা খুব কঠিন, কিন্তু তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন খুব সুনিপুণভাবে তার কবিতায় সেটা করেছেন। তার কবিতার এই সারল্য সাধারণ পাঠকের বোধে সহজে পৌঁছায়। এজন্য লিখনের কবিতা আমার ভালো লাগলো। কবিতার ব্যাপারে ইংরেজিতে একটা কথা আছে,
‘Poets talk to themselves, We only over there.’
অর্থাৎ কবি কবিতায় তার নিজের কথাই বলবেন। কিন্তু পাঠক যারা কবিতাটি পড়বেন, তারা কবিতাটিতে নিজেকে আবিষ্কার করবেন, তাদের মনে হবে কবিতাটা আমার, কথাটা আমার। লিখনের ‘ব্যক্তিগত অবহেলা’ কবিতাটি ভিন্ন মাত্রার। অবহেলা তাকে করেছে হয়তো কেউ, বিশেষ করে তার প্রেয়সী বা তার কাছের মানুষ। আমি কবিকে বলব দুঃখ না পাওয়ার জন্য। কারণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কথা আছে, ‘তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি, যখন দেখি না।’ অবহেলা সবসময় অবহেলা নয়, তার মধ্যে খুব সুক্ষ্মভাবে ঐকান্তিক প্রেমের এক চিরন্তন চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে। অতএব কবি কবিতা লেখা চালিয়ে যাবেন এবং নানা বৈচিত্র্যময় কবিতা উপহার দিবেন। অবহেলা কবিকে নানাভাবে সংক্ষুব্ধ করেছে। তাই বললেন, ‘অবহেলা আমাকে দিয়ে আস্ত একটা কবিতা লিখিয়ে নিবে।’ কবিরা তো অবহেলিত হবেই। কারণ কবিরা সুন্দরের পূজারী। বধির সমাজের সৌন্দর্যকে দেখতে পায় না। একমাত্র কবি তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সমাজের সৌন্দর্যকে দেখে। এজন্য কবিরা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। লিখনের কবিতাগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে আমার খুব ভালো লাগলো এবং কবিতার ভেতরে তার ব্যক্তিগত অনেক বিরহের কথা এবং সমাজের প্রতি তার আক্রোশ এবং তার একটা সমাধান কবিতার ভেতরে সে দিয়েছে। আর কবিতা তো এমনই হওয়া উচিত যে কবি শুধু কবিতা লিখবেন কেন! মানুষ কবিতা পড়ে তার নিজের জীবন পরিচালনা করার জন্য, যাপিত জীবন তার কিভাবে চলবে, কবি একটা পথ সেখানে বাতলিয়ে দিবেন। এটি হবে আসলে কবিতার আসল রূপ এবং তার পূর্ণাঙ্গ আঙ্গিক যা আমি লিখনের কবিতার ভিতরে পেলাম। সেজন্য কবি তৌহিদ আহাম্মেদ লিখনকে অনেক ধন্যবাদ। সরল প্রকাশের ভেতর দিয়ে সমাজের অনেক জটিল সমস্যা, ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় যে সমস্যা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন ফেস করি বা সম্মুখীন হই, এসব তার কবিতায় উঠে এসেছে।
-ওয়াহিদ জামান
তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন এই সময়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি। আজকে তার কবিতাগুলো শুনতে শুনতে বুদ্ধদেব বসুর কথা মনে পড়লো। সেই তিরিশের দশকে বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার ইশতেহারে বলেছিলেন, আধুনিক কবিতা হবে হতাশার, ক্লান্তির, বিষাদের, বিবমিষার। সেখানে জীবনের ইতিবাচক দিক থাকবে না। তিনি মূলত রবীন্দ্রনাথের সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাংলা কবিতা আশাবাদী কবিতা হতে পারে বলে তিনি মনে করতেন না। তৌহিদ আহাম্মেদ লিখনের কবিতাগুলোতে আমি সেই বিষয়গুলো খুঁজে পেলাম; যেখানে আছে হতাশা, ক্লান্তি, বিষাদ, এক ধরনের ব্যক্তিগত বেদনা । এ অনুভূতি কবিতাগুলোকে মর্মস্পর্শী করে তুলেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের যাপিত জীবনে আসলে আশাবাদী হওয়ার মত খুব বেশি কিছু পাওয়া যায় না। একজন কবির ভিতরে দহন, হতাশা, বিষাদের ক্ষতচিহ্নগুলো উঠে আসাই স্বাভাবিক। তো এখানে আটটি কবিতা পড়া হয়েছে। আমি যদি এই কবিতাগুলো নিয়ে বলি। প্রথম কবিতা ‘ব্যক্তিগত অবহেলা’। এই কবিতার মধ্যে আমি পেয়েছি অবহেলাজনিত যন্ত্রণা। ‘পারফেক্ট মার্ডারার’—এখানে তিনি বলতে চাচ্ছেন প্রেম আসলে এক উচ্চতর খুনই বটে। ‘তনুতাকে’ কবিতায় দেখা যাচ্ছে প্রেয়সীকে হারানোর হাহাকার। ‘খুন’ কবিতায় একটা সামাজিক অস্থিরতার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, যে সামাজিক অস্থিরতায় একজন নাগরিকের অসহায়ত্ববোধ, সেটা তিনি এখানে তুলে ধরেছেন। ‘তুমি আছ’ কবিতায় কবির জীবনে যে প্রার্থিতার সর্বব্যাপী বিস্তার, সেটা তিনি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘জীবন’ কবিতায় তিনি জীবন ও মৃত্যুর এক ধরনের দার্শনিক ভাবনা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ‘তোমাকে দেখার অপেক্ষায়’ কবিতায় তিনি প্রেয়সীকে দেখার যে অতৃপ্ত তৃষ্ণা, সেই দিকটা এখানে তুলে ধরেছেন এবং ‘প্রত্যাশা’ কবিতায় পারিবারিক প্রত্যাশার চাপে একজন ব্যক্তির আত্মিক মৃত্যুর দিকটি উঠে এসেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, এখানে আসলে কবির ব্যক্তিগত বেদনা, আমাদের সামাজিক জীবনের অনিশ্চয়তা, আমাদের পারিবারিক প্রত্যাশা এবং তার অপ্রত্যাশিত চাপে একজন মানুষের যে ভেতরগত মৃত্যুর মর্মযন্ত্রণা এবং জীবন-মৃত্যুর এক ধরনের দার্শনিক ভাবনা এ কবিতাগুলোতে তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই কবিতাগুলোর ভাষাভঙ্গি খুবই সহজ-সরল। তিনি খুবই সহজ ভাষায় স্বকীয় ভঙ্গিতে নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশের পথ খুঁজেছেন। এমনই হয়তো হওয়া উচিত কবিতার ভাষা। এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। তো কবি তার নিজের এক ধরনের ভাষাভঙ্গি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং আমি আশা করব কবি ভবিষ্যতে তার যে প্রকাশভঙ্গি সেটাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, আরো কিভাবে নিজের মনের ভাবকে আরো বেশি শিল্পসক্ষম করা যায় সেটা নিয়ে ভাববেন।
-আহমেদ বাসার
এই কবির লেখার সাথে আমার পরিচয় আছে। তার কবিতা ভালো লাগে। আজকে এখানে যে কবিতাগুলি পড়লেন তার মধ্য থেকে আমাকে সবচেয়ে বেশি, যাকে বলে যে নস্টালজিয়ার মতো একটা ভাবনার মধ্যে নিয়ে গেছে, সেই কবিতাটির নাম, ‘জীবন’, চমৎকার একটি কবিতা। সহজ ভাষায় তার ভিতরে যে মূর্ছনা, শব্দের সরলতা, বুনন- আমাকে মুগ্ধ করেছে। এবং বলতে চাই, ‘জীবন’ কবিতাটি আসলে আমাদের সকলের জীবন। পার হয়ে আসা স্মৃতি। মনে রাখার মতো শব্দ দিয়ে রচনা একটি কবিতা। এর যে বিষয়, ভাবনা বা চিন্তা, সেই ভাবনা চিন্তা এখানে আমরা যারা এই বয়সটা পার হয়ে এসেছি, তাদের মধ্যে সেটা আলোড়ন তুলতে পারে। এবং চমৎকার করে কবি যখন বললেন, ‘জীবন একটা গ্রাম্য প্রাইমারি স্কুল।’ আমাদের মনে পড়ে যায়, সেই ছোটবেলার প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠ, ক্লাস প্রাঙ্গণে থাকা ফুলের বাগানসহ চমৎকার একটি চিত্রকল্প কবিতাটির পরতে পরতে আছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যাওলা পড়া বৃদ্ধ কড়ই গাছটির মতো। শৈশবেই তো শুরু হয় আমাদের প্রথম বাংলা ক্লাস। বইখাতাহীন মুখে মুখে পড়ে ফেলা অ, আ, ই…
চমৎকার। কবি যখন এই কবিতাটা পড়ছিলেন, আমি আমার সেই ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম অনায়াসে। যৌবন তো আসলেই ইংরেজি ক্লাস। বিদেশি ভাষার মতো দুর্বোধ্য। বুঝা না বুঝা, এমন একটি সময় আমাদের যৌবন। কেউ বুঝি, কেউ বুঝি না। যারা বুঝি না, তারা তাকে অপচয় করি। আর যারা বুঝি, তারা খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে আসি। সেইরকম একটি সময় আমরা পার হয়ে এসেছি প্রায় এখানে সবাই। এই বিষয়টি আমাকে খুব বেশি নাড়া দিয়েছে, মুগ্ধ করেছে। এবং সত্যি সত্যিই, ‘বয়স যেন মান্নান স্যারের গণিত ক্লাস’/ ১, ২, ৩, ৪ সংখ্যার ক্রমানুসারে বাড়তে বাড়তে কখন যে ফুরিয়ে যায়। তবে আমি মনে করি, বয়সকে ফুরাতে না দিলে বয়স কখনো ফুরায় না। আর বয়সটা আসলেই একটি সংখ্যা মাত্র। সেই হিসেবে বয়সকে না ধরে একজন কবি সংখ্যাকে পাত্তা না দিয়েই এগিয়ে যায়। কবি জানে, কবির মনের বয়স কখনো বাড়ে না। এটা আমি জানি। ব্যক্তিগতভাবেই জানি। মনের বয়সকে যদি আপনি বাড়তে না দেন, তাহলে সে কখনোই বাড়বে না। শরীরের বয়স বাড়তেই পারে। সেক্ষেত্রে কবি চিরঞ্জীব এবং কবির চিন্তাভাবনা চিরঞ্জীব।
এখানে বেশ কয়েকটি কবিতা আছে। আটটি কবিতার মধ্যে বেশ কয়েকটি কবিতা আছে যেগুলি আমাকে আলোড়িত করেছে বা আমাকে মুগ্ধ করেছে। যেমন, ‘প্রত্যাশা’ কবিতাটি। আমার মাও চাইতেন, আমার আব্বাও চাইতেন, আমি এমন হই, তেমন হই। আমার মনে আছে, আমার আব্বা চেয়েছিলেন আমি ইকনোমিক্সে পড়ি এবং একজন ভাল ইকনোমিস্ট অথবা ওই রকমই একটা কিছু হব। আমি অনার্সে ভর্তির সময় বাংলায় পরীক্ষা দিয়ে এসে বলেছি, ইকনোমিক্সে আমি পাশ করিনি। তার মানে হচ্ছে, আমি আমার মতো করে বড় হয়েছি। তো এখানেও কবি, তার কবিতায় যা চেয়েছেন, আশা করি বা মনে করি, তিনি তাই হয়েছেন এবং এই কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি তার মনের ভাবনাকে যেভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, সত্যিই মনে রাখার মতো হয়েছে কবিতাগুলো। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই এবং ভবিষ্যতে আরো ভালো ভালো কবিতা তিনি আমাদেরকে উপহার দেবেন এবং তার যে ভবিষ্যৎ সামনে আছে, কবির ভবিষ্যৎ, যদিও সেখানে ব্যক্তিগত অবহেলা আছে, ব্যক্তিগত সুখ আছে, দুঃখও আছে, কিন্তু তারপরেও একটি আনন্দও আছে যেটা আমি কবিতা পড়ে ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছি।
আমার সবচেয়ে বড় ভালো সময় হচ্ছে বা কাটে লেখার টেবিলে এবং পড়ার টেবিলে পড়ায় নিমগ্ন থাকার বেলা। এই সময়গুলি একজন কবির জন্য সবচেয়ে ভালো সময় এটা নিশ্চয়ই তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন অনুভব করেন বলে আমি মনে করি। এই সময়কে উতরেই তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, এগিয়ে আসবেন এবং ভবিষ্যতে তিনি আমাদেরকে আরো ভালো ভালো কবিতা উপহার দেবেন।
কবিতাপ্রিয় পাঠকের মনে যোগ্যতায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নেবেন।
-আনোয়ারুল হক
কবি তরুণ বা প্রবীণ হয় না। কবিতাটা যখন উত্তীর্ণ হয়, প্রসঙ্গ হলো কবিতা, এবং সেই কবিতাটি। সেটা র্যাঁবো লিখুক অথবা রবার্ট ফ্রস্ট লিখুক, যে বয়সেই সে লিখুক, যদি উত্তীর্ণ হয়ে যায় সেইটা কবিতা। তৌহিদের কবিতায় প্রচন্ড রকমের বিরহ, প্রেম, অভিমান পেলাম। এটা প্রথমত আমরা যারা প্রথম প্রথম কবিতা লিখি বা প্রাথমিক স্টেজের কবিতাগুলো সাধারনত এরকম হয়। কিন্তু এরকম হওয়া মানে এই নয় যে এই কবিতাগুলো কাঁচা কবিতা। ওই সময়টা বা বয়সটা অনেক বেশি প্রখর থাকে। এবং ওই সময়টায় ওই কবি অনেক বেশি সুস্থ থাকেন। তাকে মনে হবে যে সে অসুস্থ, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে একজনের জন্য, একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অথবা এই সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সে ভয়াবহ অসহ্য মনে করছে।
যে অর্থে আমরা কবিদেরকে একটু পাগল বলি বা পাগলাটে বলি, আসলে ওই সময়টাই ওই ব্যক্তি সবচাইতে সুস্থ থাকে। কারণ তার সমাজ এবং তার চারপাশের মানুষের সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা এবং অসুস্থতাগুলো সে নিতে চায় না…, এজন্য সে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়, অনেক গভীরভাবে দেখায়।
তো যখন একটা সময় পার হয়ে যায়, যেতে যেতে ব্যাপারটা এরকম হয় যে নিজেকে খাপখাওয়ে নেওয়া। মানে সেও সমাজের অসুস্থতা থেকে কিছুটা অসুস্থতা গ্রহণ করে খাপখাওয়ে নেয়। তখন আর তাকে এই ধরনের প্রখর অনুভূতির কবিতা লিখতে হয় না। তৌহিদের এই কবিতাগুলো আমার আগেরই পড়া। প্রত্যেকটা কবিতাই আমাকে টাচ করেছে, ভালো-মন্দ সেটা সময় বলবে। আমি আলোড়িত হয়েছি। তার কারণ হলো যে তার ভেতরের সুস্থতা এবং সে একটা সুস্থ সুন্দর এবং প্রেমময় সমাজ চায়, আশেপাশে স্বাভাবিক মানুষ প্রার্থনা করে। সমাজ বা রাষ্ট্রকে সে সুস্থ এবং প্রেমময় করে কাছে পেতে চাওয়ার যে আকুতি- সেই ব্যাপারটা তৌহিদের কবিতায় আছে। এরকমই সতেজ কবিতা কবি যতদিন লিখবেন তার কবিতা আরো বেশি আকর্ষণীয় হবে, আরো বেশি প্রাকৃতিক হবে।
কবিতায় কবিতা থাকে এবং কবিতার মাধ্যমে কিছু বলা হয়, দুইটা জিনিস একে অন্যের বাহক। আমরা সাধারণত কবিতার মাধ্যমে যা বলা হয় সেটাকেই কবিতা বলি। একটা কবিতাকে উপস্থাপন করার যে প্রক্রিয়া আছে; ভাষা উপমা চিত্রকল্প বা বাক্যের প্যাটার্ন…, আমি উপলব্ধি করি ওইটাই কবিতা। যদিও কবি জীবনানন্দ দাশও বলেছে চিত্রকল্পই কবিতা, কোলরিজও অনেকটা একই কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা আমি তাদের বলা থেকে বলছি না, আমি উপলব্ধি করেছি। কারণ মেসেজ তো একই। এই একই কথা, একই প্রেমের কথা, একই সমাজ যন্ত্রণা, রাষ্ট্রীয় সমস্যার কথা তো আমরা নানাভাবেই বলতে পারি। গল্পে বলতে পারি, প্রবন্ধে বলতে পারি, সংবাদভাষ্যে বলতে পারি। কিন্তু কবিতায় কেন বিষয়টা অন্যরকম লাগে? কবিতায় কেন অন্য একটা মাত্রা পায়? তার কারণই হলো যে- আমি কিভাবে জিনিসটাকে তুলে ধরতেছি। তো সেই জায়গাটাই আমার কাছে কবিতা। যেমন তৌহিদ লিখেছে ‘অবহেলা আমাকে দিয়ে আস্ত একটা কবিতা লিখিয়ে নিবে।’ এখানে এই কবি দেখতে পাচ্ছে তার অবহেলা তার সাথে কাজ করছে, সেটা সে বুঝতেছে। মানে সে নিজে ব্যক্তিকেও দেখতেছে। এই অবহেলা তার মধ্যে কি কাজ করতেছে সেটাও দেখতেছে। কিন্তু আমরা সাধারণ একটা মানুষ যখন থাকি, আমাদের মধ্যেই আমরা যখন ব্যক্তি জীবনটাকে উপলব্ধি করি, আমরা হয়তো রেগে যাই, আমরা খুব আবেগপ্রবণ হই, সেইটা যদি পারিবারিক, সামাজিক বা নানা কারণে হয়ে থাকে, আমরা ওই বিষয়টার মধ্যে এমনভাবে যুক্ত হয়ে থাকি যে আমরা একজনই থাকি। কিন্তু যখন কবি কবিতা লেখে বা কবিতার আবহাওয়ায় ওই বিষয়টাকে চিন্তা করে, তখন সে অবহেলাকেও দেখতে পায়, অবহেলা কি করে সেটাও দেখতে পায়। …এই উপস্থাপনগুলোকেই আমার কবিতা মনে হয়। লিখনের কবিতা আমি অনেকদিন ধরে পড়ি। আমার মনে হয় লিখন যদি আরো নিজের পঠন-পাঠন বাড়ায়, জীবন প্রকৃতি এবং মানুষ বোঝার যেসব পদ্ধতি আছে সেইগুলোর ব্যাপারে আরো বেশি সক্রিয় হয়, আমার মনে হয় সে অনেকদিন লিখবে এবং অনেক ভালো মানের নতুন নতুন কবিতা লিখতে পারবে।
-জুননু রাইন




