Saturday, September 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ কাব্যগ্রন্থের বিশেষ কবিতা-ভিত্তিক একটি বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা

    কাব্যগ্রন্থটি যত্নসহকারে ও সময় নিয়ে পড়লাম। প্রথমেই যে বিষয়টি আকর্ষণ করলো, তা হলো কাব্যগ্রন্থের নাম। ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’—এই কাব্যগ্রন্থের নামটি নিজেই একটি পরিপূর্ণ রূপক এবং দার্শনিক ভাবনার প্রতিচ্ছবি। বেশিরভাগ কবিতার পাঠান্তে প্রতীয়মান হলো যে নামকরণের মধ্যেই কাব্যগ্রন্থের আত্মার প্রকাশ ঘটেছে; যেখানে একদিকে ব্যক্তি জীবন ও সমাজের জটিলতায় ব্যক্তির আত্মসত্তা বারবার ডুবছে, অন্যদিকে অদ্ভুতভাবে ভেসে থাকার এক অব্যক্ত তাগিদ অনুভব করছে। এই দ্বৈত অনুভূতি, আত্মদ্বন্দ্ব এবং অস্তিত্বের অনির্বচনীয় সংকটই এই শিরোনামের মর্মার্থ বলে মনে হলো।

    এ যেন একজন মানুষের ভেতরের নিঃশব্দ সংগ্রামের দিনলিপি। চৌধুরী রওশন ইসলামের কবিতাগুলো নিছক ছন্দ বা উপমার মোহে আবদ্ধ নয়; বরং এগুলো আমাদের সময়, সমাজ, আত্মা ও আত্মবোধের জটিলতার প্রতিচ্ছবি। বইটির ভাষা কখনো সংবেদনশীল, কখনো দর্শনময়, আবার কখনো প্রতিবাদী কিংবা আত্ম-অবলোকনমুখী।

    কাব্যভাষা ও কাব্যশৈলীর অভিনব উপস্থাপনার ক্ষেত্রে চৌধুরী রওশন ইসলামের কবিতা একাধারে অন্তর্মুখী, আত্মসন্ধানী এবং সমাজ-সমসাময়িক চিন্তায় ঋদ্ধ। তাঁর লেখনীতে দেখা যায়— গদ্যছন্দ ও মুক্ত ছন্দের সফল ব্যবহার, গভীর আবেগ ও দর্শনচিন্তামূলক বাক্যবন্ধ, উপমা ও চিত্রকল্পের আশ্চর্য নান্দনিক প্রয়োগ, সংলাপভঙ্গির মতো লেখা, যেন কবি পাঠকের সঙ্গে কথা বলছেন।

    কিছু কিছু কবিতায় গদ্যকবিতার ছায়া, আবার কোথাও গীতিকবিতার মাধুর্য, এই সব মিলিয়ে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বর্তমান সময়ের পাঠকের জন্য এক শিল্পিত ও আত্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা। কবিতাগুলোর মধ্যে বহুমাত্রিক প্রতিপাদ্য ও থিমের এক সর্বজনীন কিন্তু মিশেল অবয়ব যেন পাঠকের কর্ণকুহরে ফিসফিস করে কথা বলার চেষ্টা করেছে। পুরো কাব্যগ্রন্থ জুড়ে এক অনুক্ত অস্তিত্বচেতনা ও আত্মসংঘর্ষের সুর কঁকিয়ে কঁকিয়ে বারবার বেজে উঠেছে।

    এই রিভিউতে আমি ১২টি নির্বাচিত কবিতাকে থিম, দার্শনিকতা, ভাষা এবং মানসিক অভিঘাতের দিক থেকে পর্যালোচনা করেছি।

    এক.
    ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতা। এ কবিতায় কবি সময়ের অনিবার্যতা, স্মৃতির অস্পষ্টতা ও চিরাচরিত চক্রকে থিম হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।

    এই কবিতার কেন্দ্রীয় বোধ যা কবি তুলে ধরতে চেয়েছেন বলে মনে হলো তা যেন এক আগমন ও প্রস্থানের জীবনলিপি। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে আমরা চলে যাই, আবারো ফিরি, কিন্তু আর আগের মতো থাকি না। ‘ভুলে-যাওয়া-সব পুরানো বান্ধবের মাঝে নব জীবনের ধারা’—এই পঙক্তিটি বহন করে কবির উপলব্ধি, যে মানুষ রয়ে গেলেও স্মৃতি বদলে যায়, সময় তাকে গ্রাস করে। মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম নয়, বরং সামাজিকভাবে ভিন্নরূপে ফিরে আসা—এখানে এ এক প্রগাঢ় বাস্তবতা।

    কাব্যভাষা ও কাব্যশৈলীর অভিনব উপস্থাপনার ক্ষেত্রে চৌধুরী রওশন ইসলামের কবিতা একাধারে অন্তর্মুখী, আত্মসন্ধানী এবং সমাজ-সমসাময়িক চিন্তায় ঋদ্ধ। তাঁর লেখনীতে দেখা যায়— গদ্যছন্দ ও মুক্ত ছন্দের সফল ব্যবহার, গভীর আবেগ ও দর্শনচিন্তামূলক বাক্যবন্ধ, উপমা ও চিত্রকল্পের আশ্চর্য নান্দনিক প্রয়োগ, সংলাপভঙ্গির মতো লেখা, যেন কবি পাঠকের সঙ্গে কথা বলছেন

    দুই.
    ‘কখনও বলিনি’ কবিতা। এই কবিতাটিতে সামাজিক ভণ্ডামি ও সম্পর্কের ভয় থিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

    এই কবিতা আমাদের চেনা-অচেনা মুখোশের সমাজে স্থাপন করে এক বাস্তবতার আয়না। কবি বুঝিয়ে দেন—ভালো থাকার ভান করা যেন সামাজিক দায়িত্ব। “রঙিন মুখোশ তবু ভালো লাগে খুব”—এই ব্যঙ্গ ও বিষণ্নতা একসাথে কবিতাকে শক্তিশালী করে। এখানেই কবিতা একধরনের বুদ্ধিদীপ্ত নির্লিপ্ততার মধ্যে সমাজের অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে।

    তিন.
    ‘ভালো নেই’ কবিতা। আমার কাছে মনে হয়েছে যে কবি এই কবিতায় আত্মিক শূন্যতা ও ব্যক্তিগত মানসিক সংকটকে থিম হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।

    ‘ভালো নেই’ শব্দটি যেন আজকের প্রজন্মের এক অভ্যন্তরীণ নিঃশব্দ চিৎকার। কবি তাঁর নিজের নাম ‘আতাহার’ নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা করেন—এ এক অনন্য আত্ম-সংলাপ। কবিতাটি স্পষ্ট করে দেয় যে আত্মোপলব্ধি বা ভেতরের যন্ত্রণা সমাজে প্রকাশ করাও একটি বিপজ্জনক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকে কবিতার মূল সুর।

    চার:
    ‘নাগর’ কবিতা। দুঃখের প্রেমিকস্বরূপ উপস্থিতি কবি অভিনব উপায়ে উপস্থাপন করেছেন।

    এই কবিতার চারটি অংশ যেন এক দীর্ঘ প্রেমের উপাখ্যান। দুঃখকে এখানে নাগরের রূপে দেখা হয়েছে। “দুঃখ আমার রক্ত-গোলাপ”—এই উপমাটি গভীর, সাহসী ও বেদনায় স্নিগ্ধ। এটি শুধু মানসিক বেদনার কবিতা নয়, বরং বেদনার সাথে সহবাসের কবিতা। এই দুঃখ-নাগর যেন কবিজীবনের প্রেমিক, নেশা, অভিশাপ ও আশ্রয়—সবই একসাথে।

    পাঁচ.
    ‘সাজ’ কবিতা। নারীর সৌন্দর্য, গ্রামীণ নিসর্গ ও চিত্রকল্প ইত্যাদি যেন এই কবিতার শরীর। আর এই শরীরে লেগে আছে গ্রামীণ সৌন্দর্যের নির্যাস। শর্ষে ফুলের হলুদ শাড়ি, মৌমাছি, সন্ধ্যাকাল- সবকিছু যেন এক দৃশ্যমান ছন্দের আবহ। কবিতাটি চিত্রকল্প নির্মাণে অত্যন্ত সফল, যা পাঠককে চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে বাধ্য করে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের সৌন্দর্য উপলব্ধি করাতে।

    ছয়.
    ‘চুরি’ কবিতা। প্রেমের আকস্মিকতা ও আত্মসমর্পণ কীভাবে প্রাপ্তির এক অব্যক্ত রূপ হতে পারে, কবি তা তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন।

    ‘গতরাতে চোর এসে নিয়ে গেল আমারেই’— এই পঙক্তিটি একটি প্রেমের পটভূমিকে রহস্য ও রূপক দিয়ে পরিণত করেছে। চুরি এখানে একটি পবিত্র প্রাপ্তি। প্রেমের অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা ও অনুরাগের আকস্মিকতাই কবিতাটিকে করে তোলে ব্যতিক্রম।

    সাত.
    ‘বুদ্ধিমান’ কবিতা। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও রাজনৈতিক দ্ব্যর্থতা এখানে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

    এখানে কবি নিজের বিপ্লবী চেতনার জন্য ‘বুদ্ধিমান’ বন্ধুদের বিচ্ছিন্নতা দেখেন। “বুদ্ধিমানেরা শোরগোল করে বিচ্ছিন্ন হয় না”-এটি আমাদের সমাজের বহুল চর্চিত, কৌশলী নীরবতার অসাধারণ ব্যাখ্যা। এই কবিতা নৈরাজ্যিক বাস্তবতার ভেতরে এক সামাজিক দলচ্যুতির কাহিনি।

    ডুবতে ডুবতে ভাসি চৌধুরী রওশন ইসলাম
    কবিতা । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৫ । মুদ্রিত মূল্য: ১৮০ টাকা
    ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
    রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/445738
    কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

    আট.
    ‘খ্যাতির পাপ’ কবিতা। অহং, পরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও পারিবারিক বিচ্ছেদের এক মিশেল অবয়ব কবিতাটিতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।

    এই কবিতা মানুষের জীবনের এক বেদনাবিধুর আত্মস্বীকারোক্তি। খ্যাতি ও গুণের দায় যেমন ব্যক্তিকে বড় করে, তেমনি বিচ্ছিন্নও করে। কবি জানান -তাঁর গুণ নিজ পরিবারকে অশালীন করে তুলেছে, নিজেকেও আত্মঘাতী করে তুলছে। এমন সাহসী আত্মস্বীকার আজকের কবিতায় বিরল।

    নয়.
    ‘রাজার ধন’ কবিতা। নিয়তি ও জীবনের সাময়িকতা কবিতাটির প্রধান সুর।

    এই কবিতাটি শুদ্ধ ভক্তিভাব ও দার্শনিক আত্মসমর্পণের এক অনন্য রূপ। রাজা এখানে ঈশ্বর বা প্রকৃতি, যিনি দেন এবং ছিনিয়ে নেন। কবি একজন শিষ্য, যিনি সব হারিয়েও প্রশ্ন তোলেন না। অত্যন্ত সরল অথচ গভীর।

    দশ.
    ‘ছবি’ কবিতা। সময় ও স্মৃতির অনন্ত চক্র কবিতাটির শব্দবন্ধে গাঁথা রয়েছে মালার মতো।

    “আজ ওরা শুধুই ছবি”— এই একটি পঙক্তিতে কবি বন্দি করেছেন সময়ের পরিহাস। শতবর্ষ আগে বেঁচে থাকা মানুষদের আজ আমরা দেখি শুধুই দেয়ালে ঝুলন্ত ছবিতে। আমাদের পরিণতিও তাই। এই কবিতাটি ইতিহাস, মৃত্যুবোধ ও জীবনচক্রের এক মূর্ত রূপ।

    এগারো.
    ‘তৃষ্ণা’ কবিতা। প্রেমের অপ্রাপ্তি ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা কবিতাটির মূলভাব হিসেবে ধরা পড়েছে।

    কবিতাটি যেন মরুপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে এক প্রেমিকের কাছে জলের আকুতি। প্রতিটি উপমা, প্রতিটি চিত্রকল্প যেন দহনময়। প্রেম এখানে জল নয়, মরীচিকা-এবং কবি প্রতিবার দগ্ধ হন, তবু ফেরেন না।

    বারো.
    ‘অবসর’ কবিতা। নিঃসঙ্গতা, অতীত স্মৃতি ও পরিণতির দহন কবিতাটিতে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

    কবিতাটি অতীত প্রেমের স্মৃতি নিয়ে বর্তমান নিঃসঙ্গতার ক্যানভাসে আঁকা একটি ছবি। ‘নৌকা এখন স্রোতের টানে যাচ্ছে ভেসে দূরে’-এই পঙক্তি তার সর্বশেষ উপলব্ধি। এখানে অতীত স্নিগ্ধ এবং বর্তমান নৈঃশব্দ্যভরা, যেখানে কবি শুধুই একা।

    উপসংহারে বলা যায়, চৌধুরী রওশন ইসলামের ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ কাব্যগ্রন্থটি একাধারে আত্মজৈবনিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক ও নান্দনিক। এটি সময়ের কবিতা, মানুষের কবিতা, সমাজ ও সম্পর্কের কবিতা। তার কবিতা ভাবনাচর্চার পরিধিকে শুধু প্রসারিতই করে না, সেটিকে আরও প্রগাঢ়, মানবিক ও অনুভবযোগ্য করে তোলে।

    এই গ্রন্থটি বাংলা কবিতার আধুনিক ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এবং অবশ্যই একজন পরিপক্ব কবির আত্ম-আলোড়নের অনবদ্য দলিল।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.