Saturday, September 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    চৌধুরী রওশন ইসলামের ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’

    ‘প্রভু, নিরস জীবন দিও না আমায়
    প্রয়োজনে তুচ্ছ করো ঘাসের মতোন,
    তবু সতেজ সবুজ রেখো এ জীবন;
    সরসতা চাই প্রাণে— খরায়-বন্যায়।’

    সম্ভবত সব কবিরই এ-এক পরম চাওয়া। প্রাণে সরসতা না থাকলে কবিতার বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে বাধ্য। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ঈশ্বরী পাটনী দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন— ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। কবি চৌধুরী রওশন ইসলামের প্রভুর কাছে এ মিনতিও চিরন্তন। মূলত ব্যক্তিক অপ্রাপ্তি, অভিমান কিংবা ব্যর্থতার সিম্ফনি ও সামষ্টিক জীবনের বিচূর্ণ আয়নায় আত্মদর্শনের তীব্র অভিপ্রায়ে জন্ম নেয় কবি চৌধুরী রওশন ইসলামের জিজ্ঞাসু কবিতারা; যেখানে উঁকি দিয়ে বিদ্যমান পরিপার্শ্ব অথবা পাঠক হয়তো নিজেকেই ভিন্নরূপে খুঁজে পাবেন। সমাজ কিংবা বিরূপ বিশ্বব্যবস্থায় কবি প্রবল মানবিক বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে চান। কিন্তু ভেতরে টের পান অসহায়ত্বের বেদনা—

    ‘আমি এক সাদা মেঘ আকাশের গায়
    কাউকে ভেজাতে পারি সেই সাধ্য নাই’

    মানুষের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা কবিকে ভাবায়। সমাজে যখন ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে, মানুষ তখন হয়ে ওঠে শক্তিহীন। টুকরো হতে হতে তারা অবশেষে নেকড়ের খাবার হয়ে ওঠে। কবির ভাষায়— ভাঙতে ভাঙতে মানুষগুলো টুকরো হয়ে যাচ্ছে/ নেকড়ে কুকুর হায়েনারা টুকরোগুলো খাচ্ছে।

    এ কাব্যের কবিতাগুলো মানবিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ও সামষ্টিক চেতনায় আচ্ছন্ন। কবি চিন্তাকে দুলিয়ে দেন কাব্যের নান্দনিক আবহাওয়ায়, যা পাঠককে খুব সহজেই নাড়া দিতে সক্ষম

    আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতা, হতাশা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ এ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় প্রকট হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশ একাকিত্বের বেদনায় হাহাকার করেছেন- তবু কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী। শামসুর রাহমান বিচ্ছিন্নতাবোধের তীব্রতায় বলেছেন— তবে কি এভাবে অন্ধ দেয়ালের সাথে কথা বলে যাব একা একা? এ কাব্যের ‘সাধারণ’ কবিতায় কবি বলেন—

    আমি কারও চোখে নেই, কারও কানে নেই, মুখে নেই
    আমি কারও কাক্সিক্ষত স্পশে নেই, কারও স্মৃতিতে নেই।

    রোম্যান্টিক অনুভব ও প্রণয়-ঝঙ্কার এ কাব্যের কবিতাগুলোতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। তবে লক্ষণীয় যে, কবি প্রণয়ের প্রবল আবেগে গা ভাসিয়ে দেন না। বরং চিন্তা ও আবেগের মেলবন্ধনে তৈরি করেন বিশেষ এক রম্যভঙ্গি যা পাঠকের ভাবনার সলতে উসকে দিতে পারে। কবি যখন বলেন— ‘কতকাল ধরে বসে আছি চুরি হবো বলে/ কতকাল মূল্যহীন জ্ঞানে তুমি গেছ চলে’ অথবা, ‘তুমি আমার গোপন কুঠি স্বপ্ন-রাখা সিন্ধুক/ কানাকানি করুক না হয় পাড়ার কিছু নিন্দুক’। তখন প্রেমানুভূতি ও হিউমার একাকার হয়ে ওঠে।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতায় কিনু গোয়ালার গলির পঁচিশ টাকা বেতনের সেই কনিষ্ঠ কেরানি বিয়ের লগ্নে পালিয়ে এসে অনুভব করেছিল- ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া…/ পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর। এ-কাব্যের কবির চেতনায়ও যেন জেগে ওঠে সেই কনিষ্ঠ কেরানির একান্ত বিরহ ও অপ্রাপ্তির বোধ—

    ‘তবু কেউ একজন
    একবার উঁকি দিয়েছিল
    এই দীঘ জীবনে এর চেয়ে বেশি
    কোনো গল্প আমার নেই।’

    ডুবতে ডুবতে ভাসি চৌধুরী রওশন ইসলাম
    কবিতা । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৫ । মুদ্রিত মূল্য: ১৮০ টাকা
    ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
    রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/445738
    কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

    সমাজের বিশেষ চাটুকার শ্রেণির উত্থান কবিকে ব্যথিত করে। শোকাহত করে সারাবিশ্বে শিশুহত্যার করুণ দৃশ্য। গাজায় শিশুহত্যার প্রতিবাদে তিনি লেখেন— বিধাতা তোমার ধরা কেঁদে ভাসায় নিষপাপ শিশু/ ওদের জন্যে কোথায় তোমার সে প্রেমময় যিশু?

    পাপ-পুণ্য ও ধমীয় অনুভব মানবীয় চেতনার দ্যোতনা নিয়ে ধরা দেয় আলোচ্য কাব্যে। পৃথিবীতে পাপহীন কোনো মহান মানুষ নেই। কিন্তু পাপ করার পর যার ভেতর অনুশোচনা তৈরি হয় না তার চেয়ে বড় পাপী আর কেউ নেই। বরং অনুতাপের আগুনে পুড়ে পাপীও পুণ্যবান হয় বলে কবি মনে করেন— ‘মানুষের নেই পাপ হতে পরিত্রাণ / অনুতাপে পুড়ে পাপী হয় পুণ্যবান।’ ‘সিয়াম’ কবিতায় রমজানের মাহাত্ম্য ও জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে। পাপ-তাপ হতে পরিত্রাণের পথও এখানে দৃশ্যমান।

    বৈষ্ণব পদাবলির অন্যতম কবি জ্ঞানদাস বলেছিলেন— ‘নগর বসালাম সায়র বাঁধিলাম মাণিক পাবার আশে /সাগর শুকাল মাণিক লুকাল অভাগার করম -দোষে’। কবি চৌধুরী রওশনও যেন একই বেদনায় নীল। ‘আহ্বান’ কবিতায় কবি বলেন— আমার সাথে যে মিশেছে তারই কপাল পোড়ে/ যে ঘরেতে নিমন্ত্রিত, ঝড়ে ভেঙে পড়ে।

    শহরের ইট-পাথরের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষাও এ কাব্যে দৃশ্যমান। কবির চেতনায় মা ও গ্রাম একাকার হয়ে ধরা দেয়। মা যেন গ্রামের পথে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কবিকে ডাকছেন, এমন স্বপ্নে বিভোর কবি শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে যেতে ব্যাকুল। শ্রমিকের শ্রম-ঘামও ভাষা পায় কবির অনুভবের শব্দমালায়।

    সর্বোপরি, এ কাব্যের কবিতাগুলো মানবিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ও সামষ্টিক চেতনায় আচ্ছন্ন। কবি চিন্তাকে দুলিয়ে দেন কাব্যের নান্দনিক আবহাওয়ায়, যা পাঠককে খুব সহজেই নাড়া দিতে সক্ষম।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.