Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    গোলাপের রাজতোরণ (পর্ব-৫)

    জয়গর ফোর্টে আমি আগে যাইনি। দুলাভাইর পিড়াপিড়িতে নিমরাজি হয়ে টেক্সি নিলাম। আমের ফোর্ট থেকে বেশ পশ্চিমে—অনেক উঁচুতে এই দুর্গ ফটোগ্রাফারদের স্বর্গ। এটিও আরাবেল্লী পাহাড়ে মাথায় অবস্থিত এবং জয়পুর ও আমেরকে সুরক্ষার জন্য নির্মিত—তবে বেশি খ্যাত এর যুদ্ধ সরঞ্জাম, বারুদ-বুলেট এবং স্পেয়ারের জন্য। রাজপুত, মোঘল, ইংরেজ—সব আমলেই জয়গর একই ভূমিকায় নিয়োজিত ছিল। লাল পাথরে গড়া এই দুর্গও রাজা দ্বিতীয় জয়সিঙের কীর্তি।

    আমি শুধু জানতাম এর ‘জয়ভানা’ কামানের কথা—যা পৃথিবীর বৃহত্তম। একবার মাত্র গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে এই (জয়ভানা) কামান থেকে—তাও টেস্ট কেস; যার গোলা বাইশ মাইল, মতান্তরে পঞ্চাশ মাইল দূরে পৌঁছে বিস্ফারিত হয়েছিল। শহরের মত বিশাল এই দুর্গ উত্তর দক্ষিণে দুই-মাইল লম্বা এবং পুব-পশ্চিমে এক মাইল চওড়া। আমি আমার পর্যটক জীবনে এর চেয়ে বড় কোন দুর্গ দেখিনি এবং জানতেও পারিনি যে এমন আশ্চর্য দুর্গ উপমহাদেশের কোথাও আছে!

    দুহার দরোজার পাশেই চাকার উপর স্থাপিত ‘জয়ভানা কামান’ দেখতে নতুন করে পাঁচ টাকার টিকেট কাটতে হলো। তবে মাইনর্স বলে সবুজ-সাথী ফ্রি।
    খুবই সুন্দর রাস্তা ও সুদৃশ্য রেলিং ঘেরা রাস্তা চলে গেছে আমের ফোর্ট পর্যন্ত—পাহাড়সারির মাথার উপর দিয়ে। কেউ কেউ বললো—দুটোর মধ্যে সুরঙ্গ-যোগাযোগও নাকি আছে—সব দুর্গের মতই—এ-গল্পও আমার বিশ্বাস হলো না। মোঘল-এ-আজমের মত ছবির পরিচালক পর্যন্ত এই-মিথ ব্যবহার করে আকবরকে সর্বাধিক ন্যায়বিচারক দেখাবার চেষ্টা করেছেন—গোপন-সুরঙ্গ পথে আনারকলিকে মুক্তি দিয়ে—যা এই বিখ্যাত ছবির শিল্পমান ক্ষুন্ন না করলেও—বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

    প্রসঙ্গক্রমে আমার মনে পড়লো বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের কথা। তখন আমি চিত্রালীতে টুকটাক লিখি। আমার বাল্যকালের পত্রমিতা লিয়াকত হোসেন খোকন থেকে যিনি আমায় মুক্তোর মত সুন্দর-হস্তাক্ষরে চিঠি লিখতেন—বুলবুল নামকে ‘মেয়ে’ ভেবে ভুল করে! তার এই ভ্রান্তি নিয়ে আমি অনেকদিন লুকোচুরি খেলেছি।
    আমরা কথা বলছিলাম পাশাপাশি বসে। আলমগীর কবীর বললেন—দেখ, বুলবুল—পৃথিবীর সবচেয়ে প্রগতিবাদী-দেশ রাশিয়ায় তৈরি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ফ্যান্টাসী-ফিল্ম! উদ্ভট, অবিশ্বাস্য, ভৌতিক এবং মায়া-যাদুতে ভরপুর। এ কারণেই সবচেয়ে সুন্দর আলীবাবা, আলাদীন অথবা সিন্দাবাদ—ওরাই তৈরি করেছে। আশ্চর্য না?

    আমরা কথা বলছিলাম পাশাপাশি বসে। আলমগীর কবীর বললেন—দেখ, বুলবুল—পৃথিবীর সবচেয়ে প্রগতিবাদী-দেশ রাশিয়ায় তৈরি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ফ্যান্টাসী-ফিল্ম! উদ্ভট, অবিশ্বাস্য, ভৌতিক এবং মায়া-যাদুতে ভরপুর। এ কারণেই সবচেয়ে সুন্দর আলীবাবা, আলাদীন অথবা সিন্দাবাদ—ওরাই তৈরি করেছে। আশ্চর্য না?

    অনুপম হায়াত ভাই ছিলেন একটু দূরে। হেসে বললেন—গোপাল ভাড়ের গল্পে আছে না—যার যা অভাব, সে তাই নেবে—কবীর ভাই? রুশদের অবস্থা হয়েছে তাই, কবীর ভাই। সলোকভ বা সোলঝিনিৎসিন ছাড়া কাউকে এখন আর চোখে পড়ে? কোথায় সেই গোর্কী, শেখভ, তলস্তয় বা দস্তয়ভস্কি? এমনকি, মায়াকোভস্কিরও তো দেখা দেলে না আজকাল!ভালোই বলেছো অনুপম। আচ্ছা, শোনাও দেখি গোপালের গল্পটা—আমি নাহলে নাত’টা ধরতে পারছি না।
    বলছি শুনুন—গোপালকে তো রাজা বিক্রমাদিত্য সারাক্ষণই ঠকাতে চাইতেন। তো একদিন বললেন: গোপাল, রাতে আজ ভারী অবাক-করা স্বপ্ন দেখলাম।
    কি দেখলেন, জাঁহাপনা?
    দেখি, তুমি আর আমি একটা সরু রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি—দু’পাশে দুটো পুকুর। একটায় মধু ভরা, আরেকটায় বিষ্ঠা।
    ছি:ছি:—মহা বিপরীত কান্ড দেখছি। বললেন আলমগীর কবীর—তারপর?
    রাজা বললেন, হঠাৎ আমাদের পা পিছলে গেল। আমি পড়লাম মধুর মধ্যে, তোমার ভাগ্যে গু।
    ও আচ্ছা, তারপর কি হল, মহারাজ? গোপাল অবিচলীত কন্ঠে জানতে চায়।
    কি আর হবে? ঘুমটা ভেঙে গেল—বললেন রাজা।
    কিন্তু আমি তখনো ঘুমাচ্ছিলাম, রাজা মশাই।
    বটে, তো কি হলো তাতে—?
    স্বপ্নের বাকী অংশটা আমি দেখতে থাকলাম।
    বলো-বলো, কী দেখলে তুমি?

    দেখলাম—দুজনেই আমরা পাড়ে উঠে কাঁপছি, ঠান্ডায়-তরলে বিশ্রি অবস্থা। গা মুছবার তোয়ালেটা পর্যন্ত নেই। অথচ আপনি রাজা হয়ে ভিজে কাপড়ে—
    তারপর?
    নিতান্ত লজ্জাজড়িত কন্ঠে বললেন আপনি: গোপাল একটা কিছু ব্যবস্থা করো—এভাবে তো থাকা যায় না!
    তাই নাকি?
    আজ্ঞে, মহারাজ! তখন আমার মাথায় ভগবান এসে ভর করলেন; আর জিহ্বায় সরস্বতী। আমি বললাম: রাজা মশাই—আর যখন কোনো উপায় নেই—তখন আসুন—আমি আপনার গা, আর আপনি আমার গা চেটেপুটে পরিস্কার করে দেই?
    কি বললে—গোপাল?
    কিছু তো বলিনি, রাজা মশাই—যা ঘটেছিল, তাই বর্ণনা করলাম মাত্র।
    তো, এর সাথে অভাবের কি সম্পর্ক, অনুপম? কবীর ভাই ছাড়লেন না আমাদেরকে।
    পরাস্ত ও অপমানিত রাজা রেগে বললেন: শোন গোপাল, তোমার জেগে ওঠার পর আমি আবার ঘুমালাম এবং স্বপ্ন দেখলাম।
    কি দেখলেন, জাঁহাপনা?
    দেখি—আমরা আরো পথ হেঁটে যাচ্ছি—সামনে দুদিকে দুটি ভিন্ন জগত। একটিতে সততা, নিষ্ঠা, ভক্তি এবং অন্যটিতে ঈশ্বরহীনতা ও প্রাচুর্য। আমি বললাম: গোপাল, বেছে নাও—কোনটা নেবে—অসততা ও প্রাচুর্য? নাকি, ধর্ম ও দারিদ্রতা?

    একবার মাত্র গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে এই (জয়ভানা) কামান থেকে—তাও টেস্ট কেস; যার গোলা বাইশ মাইল, মতান্তরে পঞ্চাশ মাইল দূরে পৌঁছে বিস্ফারিত হয়েছিল। ছবি: Bigstock

    তারপর?
    হে:হে:হে:! গাধার মত ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই চট করে তুমি নরক ও প্রাচুর্য বেছে নিলে। লজ্জায় মরি আমি—ছি:ছি: গোপাল, সারাজীবন আমি তোমাকে কি শেখালাম—আর তুমি কি করলে?
    তারপর?
    কাঁদতে কাঁদতে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
    আর, তখনই আমার আবার ঘুম এলো, রাজামশাই।
    বলো কি? তো, কি দেখলে গোপাল—?
    দেখলাম—আমি ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করছি: এ আমি কি করলাম, প্রভু?
    তিনি বললেন: তুমি ঠিকই করেছো, বৎস। যার যা অভাব, আমি তাকে সেটাই দেই।
    হো:হো: করে হেসে উঠলেন আলমগীর কবির। তার মানে, তুমি বোঝাতে চাইছো—অলৌকিকতার সবটুকু বর্জন করেছে বলেই ওরা মিথ্যা এবং যাদুতেই ভর করছে? বাহ্, বেশ ভালো যুক্তি।
    অনুপমদা আরেকটু এগিয়ে বললেন: হিচকককেই দেখুন না, কবির ভাই? ব্রিটিশ সূর্য যখন মধ্যগগনে; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ইংরেজ যখন বিশ্বপথপ্রদর্শক—তখন তিনি দর্শককে নিয়ে গেলেন অন্ধকার, রহস্য ও শিহরণের যুক্তিহীন-জগতে। ঐ একই ঘটনা, কবীর ভাই—যার যা অভাব!
    ভালো বলেছ—তোমার দেখাবার ভিন্নতাটুকু আমার মনে দাগ কাটলো।

    *
    আমি সুরঙ্গের কাহিনী আনারকলির সাথেই মাটি চাপা দিয়ে গোলাবারুদের ঘর দেখতে গেলাম।
    অসংখ্য কামান পড়ে আছে প্রথম ঘরে—কোনটা অর্ধ সমাপ্ত, কোনটা বারো আনা, আবার কোনোটার কেবল কাঠামো বানানো হয়েছিল। সর্বত্র পড়ে আছে লোহার গুটি-মাটি। ইনস্পেক্টর জানালেন: ১৬-ফুটের চেয়ে দীর্ঘ কামানগুলো ২৪০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে ঢালাই হতো—যেন নিজের বারুদে আঘাতে নিজেই বিস্ফারিত না হয়।
    এগুলোর সর্বশেষ তদারককারী ছিলেন যুবরাজ দারা শিকোহ—যাকে আওরঙ্গজেব হত্যা করে শাজাহানের সিংহাসন কেড়ে নেন।
    পরবর্তীতে দ্বিতীয় জয়সিং মোঘলদের ‘বন্ধু’ থেকেই বানান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান-জয়ভানা।
    ফোর্টের ভেতরেই বিশাল বাগান —যার মাঝখানে ‘আরাম-ঘর’। দিল্লীর মোতি মসজিদের মতই—ছোট কিন্তু নয়নাভিরাম।

    আমি বোঝার চেষ্টা করলাম বিজয়-দূর্গের মাহাত্ব্য। পদাতিক বা বন্ধুকধারী সৈন্যদের পুরোপুরি নাগালের বাইরে অবস্থিত এ স্থাপনা এমন কৌশলে নির্মিত—ঘোড়া ছাড়া যার কাছে পৌঁছার কোন উপায়ই ছিল না। রাজা মানসিং এক পরাক্রমশালী সেনাপতি—আকবর যাকে মনোনীত করেছিলেন খান-ই-খানান—সর্দারদের-সর্দার (কার্যত, সেনাপতিদের সেনাপতি)। মূলত মূখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করাই ছিল খান-ই-খানানদের আসল দায়—যাদের বেশিরভাগ সময়েই ব্যস্ত থাকতে হত রাজ্য-সম্প্রসারণ বা বিদ্রোহ দমনে। তবে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে মোঘল খান-ই-খানানদের প্রায় সকলেই ‘ইতিহাসের নায়ক’ হয়ে আছেন।

    আমি বোঝার চেষ্টা করলাম বিজয়-দূর্গের মাহাত্ব্য। পদাতিক বা বন্ধুকধারী সৈন্যদের পুরোপুরি নাগালের বাইরে অবস্থিত এ স্থাপনা এমন কৌশলে নির্মিত—ঘোড়া ছাড়া যার কাছে পৌঁছার কোন উপায়ই ছিল না। রাজা মানসিং এক পরাক্রমশালী সেনাপতি—আকবর যাকে মনোনীত করেছিলেন খান-ই-খানান—সর্দারদের-সর্দার (কার্যত, সেনাপতিদের সেনাপতি)। মূলত মূখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করাই ছিল খান-ই-খানানদের আসল দায়—যাদের বেশিরভাগ সময়েই ব্যস্ত থাকতে হত রাজ্য-সম্প্রসারণ বা বিদ্রোহ দমনে। তবে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে মোঘল খান-ই-খানানদের প্রায় সকলেই ‘ইতিহাসের নায়ক’ হয়ে আছেন। যেমন রাজা মানসিং উষর-মরুভূমির সন্তান হয়ে কাঁদা-মাটির বঙ্গদেশে যুদ্ধ করেছেন নৌবাহিনী ও ঘোড় সওয়ার নিয়ে—কারণ তার প্রিয় ও বিশাল-হস্তিবাহিনী সেখানে কাজে আসে নি। প্রধানতম এই যুদ্ধাস্ত্র হারিয়েও তিনি জয় করেছেন সমস্ত বাঙলা—এক ঈসা-খাঁর কাছে তরবারি ভেঙে যাওয়া ছাড়া।

    সেই রাজা, খান-ই-খানান, আকবরের সম্বন্ধী—যিনি গড়েছেন এই আমের ও জয়গড় দূর্গ—তার সামরিক দূরদর্শিতা তো এমনই হবার কথা—যার এই অমর-দুর্গ একাই ঠেকিয়েছে চারশো পয়ষট্টিটি যুদ্ধ । বিশাল জলাধার থাকায় এই দুর্গ মাসের পর মাস অবরুদ্ধ হলেও কোন সমস্যা হয়নি সৈনিকদের। নিকটস্ত আমের ফোর্টে উঠতেই হাতি লাগে—আর এটাতো আরো ৪০০ মিটার বেশি উঁচুতে।
    পুরো দূর্গের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে দুর্দান্ত ওয়াচ-টাওয়ার—যার উপরে উঠে আমরা দেখলাম পুরো আমের, জয়পুর, নাহারগড় ফোর্ট এবং পানিউড়ি পাখির মত অর্ধেক জলে-ডোবা জলমহল।
    সবুজের ছোট্ট বাইনোকুলার নিয়ে আমাদের সবারই কাড়াকাড়ি।
    দেখছো, মামা—আমার কি বুদ্ধি? সে বুক ফুলিয়ে বললো: নইলে কারো দেখাই সার্থক হতো না।
    ঠিক বলেছিস—মামা, খুব ঠিক। সার্থক শব্দটাও ভালো বেছে নিয়েছিস—সফলতার চেয়ে এর স্পষ্ট পার্থক্য তুই হাতেনাতেই প্রমাণ করে ছাড়লি। লট অফ থ্যাংকস, মাই ডিয়ার লিটল-জিনিয়াস!
    আর আমি যে সারা রাস্তা ওটাকে পিঠের ব্যাগে করে বয়ে আনলাম, তার জন্য কিছুই পাবো না আমি?—সাথী প্রায় কেঁদেই ফেলে।
    নে, মামার লট থেকে তোকে একশো ‘থ্যাংকস’ দিলাম। নে—মুঠি খুলে নিয়ে নে। সবুজ মজা করে জবাব দেয়…।

    *
    আমরা প্যালেসের মাত্র দুটো রুম দেখার সুযোগ পেলাম। সত্যিই রাজকীয় নির্মান—বিশেষত প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের কারণে। সেনাধ্যক্ষ এখানে শুয়ে-বসেই জয়পুর ও আমেরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনএমন দুরন্ত স্থানে তার অবস্থান। দুলাভাই তৃপ্ত মুখে বললেন: এর কাছে সিঙ্গাপুর-হংকঙ বিমান-বন্দরের ওয়াচ-টাওয়ার ফেল, শালা বাবু।
    ঠিক বলেছেন, দুলাভাই।

     

    চলবে…

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.