Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    কেন সাহিত্য পড়বে?

    মূল : ডেভিড এম. রাইট অনুবাদ : কাউসার মাহমুদ

    সাংস্কৃতিক জনপ্রিয়তা, রাজনীতির অশান্ত জলবায়ু, পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া, ভুল তথ্য প্রকাশ, আধুনিক শিক্ষা তত্ত্বের জলোচ্ছ্বাস ও প্রযুক্তির আগ্নেয়গিরির ভেতর একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উপস্থিত রয়েছে যে, সাহিত্য কেন পড়বে? কী মূল্য সাহিত্যের?

    মূলত সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো নিরীক্ষা ও দূর করতে সাহিত্য সহায়তা করে। কারণ, সাহিত্য প্রায়শই বিশৃঙ্খলাবদ্ধ জগতের মাঝে একটি সচল বক্তব্য হিসেবে অবিচল ছিল। এজন্যই ওয়ার্ডসওয়ার্থের সে আর্তনাদ সমস্ত বয়সের জন্য প্রযোজ্য। এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি প্রাকৃতিক দর্শন:

    দূরে থেকেও পৃথিবী আমাদের অনেক কাছে,
    চাওয়া পাওয়ায় আমরা নিজেদের ক্ষয় করি;
    আমরা আমাদের পৃথিবীটা ছোট করে দেখি
    আমাদের হৃদয় ঢেকে ফেলেছি কালিমায়

    সত্যিই তো আমরা আমাদের হৃদয়কে দূরে সরিয়ে রেখেছি। স্রষ্টা, প্রকৃতি এবং অন্য সব সৌন্দর্য থেকে নিজেদের বিমুখ করে হয়েছি নিঃসঙ্গ। এমন মলিন যাপন থেকে মুক্তি পেতে সাহিত্যে পুনরুদ্ধারযোগ্য নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কোন ধরণের সাহিত্যে এ জাতীয় ক্ষমতা রয়েছে? উত্তরটি হল ‘শ্রেষ্ঠ বই’। স্যামুয়েল জনসন তাঁর ‘প্রেফেস টু শেক্সপীয়রে’ বলেছিলেন, ‘সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র পরীক্ষা হল সময়কাল এবং গ্রহনযোগ্যতার ধারাবাহিকতা’। তদুপরি, একটি বই যদি তিনটি মানদণ্ড পূরণ করে তবে তা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রথমটি সর্বজনীনতা। একটি সেরা বই বহুযুগ ধরে মানুষের সাথে কথা বলে, প্রভাবিত করে; তাদের ভেতর অনুপ্রেরণা জোগায়। এবং যে সময়, কাল ও স্থানে এটি লেখা হয়েছিল তা থেকে বহুকাল, বহুবছর পরে এসেও পাঠকদের প্রভাবিত করে।
    দ্বিতীয়ত, এটির একটি কেন্দ্রীয় ধারণা এবং থিম রয়েছে যা স্থায়ী গুরুত্বের বিষয়গুলোকে সম্বোধন করে। আর তৃতীয়ত, এটি হয় মহৎ ভাষা বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ। অবশ্যই একটি শ্রেষ্ঠ বই উৎকৃষ্ট ভাষায় রচিত, যা মনকে সমৃদ্ধ করে এবং আত্মাকে উন্নত করে।

    অনেক আগে, ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের পূর্ব অংশে একটা ম্যাক্সিম খোদাই করা ছিল যে, ‘নিজেকে জানো’। আর সাহিত্য পাঠই কেবল তা তথা নিজেকে জানার সুনির্দিষ্ট অর্থ। জীবনকে যাপনের জন্য ‘পরীক্ষিত জীবনকেই’ সক্রেটিস একমাত্র জীবন-যাপনের মূল্যবান বলে ঘোষণা করেছিলেন

    যাহোক, উপরের ছোট্ট আলোচনায়; কী ধরণের সাহিত্য পড়তে হবে তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এখন ‘কেন সাহিত্য আমাদের পড়া উচিত’ তা নিয়ে আলোকপাত করা যাক। আলোচ্য নিবন্ধে এর ছয়টি কারণ রয়েছে:

    ১. সেরা সাহিত্যকর্ম পাঠ মানে আপন কল্পনার অনুশীলন। আমরা গল্প উপভোগ করি। গল্পে বিভিন্ন চরিত্রের সাথে সাক্ষাৎ, তাদের পৃথিবীতে বসবাস এবং তাদের সুখ ও বেদনা অনুভব করে এক অভূতপূর্ব আনন্দে আন্দোলিত হই। ব্যবহারিক অর্থে, একটি সক্রিয় কল্পনা সত্য উপলব্ধি, অভিমত মূল্যায়ন এবং সৃজনশীল উপায়ে জীবনের জটিলতাগুলো মোকাবেলায় সহায়তা করে। এমনকি যুক্তি ব্যবহারেও আমাদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।

    ২. সাহিত্য পাঠ বর্তমান প্রেক্ষাপটের বাইরে আমাদেরকে অন্যান্য যুগ এবং স্থানগুলোতে নিয়ে যায়। আর সেসব স্থান এবং দীর্ঘ সময়জুড়ে চরিত্রগুলোর সাথে আলাপচারিতা আমাদের অজ্ঞতা হ্রাস করে। মার্ক টোয়েন একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভ্রমণ; কুসংস্কার, সংকীর্ণতা এবং গোঁড়ামির জন্য প্রাণনাশক। একটিমাত্র জীবনে, সমস্ত পৃথিবীর এককোণে থেকে, প্রকৃতি, মানুষের দাতব্য দর্শন ও অন্যান্য জিনিসের বিস্তৃতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা সম্ভব নয়।’ কারণ, আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই যেহেতু মিসিসিপি নদীর তীরে জলযান চালনা করতে পারে না। এবং জীবনভর পৃথিবীর দেশে দেশে ভ্রমণ করতে সক্ষমও নয়। তাই সাহিত্য আমাদের অনুসন্ধানের জন্য উপযুক্ত গাইড এবং জাহাজ হিসেবে কাজ করে।

    ৩. সাহিত্য পাঠ আমাদের অন্যের চোখে বিশ্ব দেখতে সাহায্য করে। এটি মনকে নমনীয় এবং অন্যান্য দৃষ্টিকোণগুলো বোঝার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। এছাড়াও অন্য এক যুগ, শ্রেণি বা বর্ণের ব্যক্তির চোখ দিয়ে জীবন দেখতে একজনের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা করে দেয়। সাহিত্য-পাঠ সহানুভূতিপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি লালন ও তার শক্তির বিকাশ করে।

    ৪. সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহ সমাজ গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘গিলগামেশের মহাকাব্য’। একটি মহাকাব্য অনুসন্ধানে বীরের প্রত্নতাত্ত্বিক বর্ণনাটি শুরু করেছিল, যা বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের জন্য একটি জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী নীলনকশা হয়ে উঠেছে। এ ছাড়াও আরো কিছু অনন্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, হোমারের ‘ওডিসি’, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’, শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ এবং সেরভানতেসের ‘দন কিহোতে’, যা পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসাবে খ্যাত। এবং সেইসাথে এমন একটি ধরণ যা আধুনিক যুগে সাহিত্যের প্রভাবশালী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর কিছু পরে, গ্যোথের ‘দ্য সোরস অফ ইয়ং ওয়ার্থার’ গভীরভাবে প্রভাববিস্তারক ছিল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজের ‘লিরিক্যাল বল্ল্ডস’ ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগের সূচনা করেছিল এবং হ্যারিয়ট বিচার স্টো’র ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ বিভক্ত জাতিকে দাসত্বের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে সহায়তা করেছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, আপটন সিনক্লেয়ারের উপন্যাস ‘দ্য জঙ্গল’ আমেরিকার মাংসপ্যাকিং শিল্পের ভয়াবহতা প্রকাশ করে এবং খাদ্যের ব্যাপক উত্পাদনে বহু সংস্কার সাধন করে। মূলত, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস রক্ষা ও এগুলোর আকৃতিকে ধরে রাখার অভূতপূর্ব ক্ষমতা আছে বইয়ের।

    সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহ সমাজ গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘গিলগামেশের মহাকাব্য’। একটি মহাকাব্য অনুসন্ধানে বীরের প্রত্নতাত্ত্বিক বর্ণনাটি শুরু করেছিল, যা বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের জন্য একটি জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী নীলনকশা হয়ে উঠেছে। এ ছাড়াও আরো কিছু অনন্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, হোমারের ‘ওডিসি’, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’, শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ এবং সেরভানতেসের ‘দন কিহোতে’, যা পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হিসাবে খ্যাত

    ৫. সাহিত্য পাঠ চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে উৎসাহ দেয় এবং ভাষা ও শব্দভাণ্ডার দ্বারা আমাদের উন্নত করে। তবে এই টেক্সটগুলোর সাথে আলাপচারিতার জন্য প্রয়োজন একান্ত ইচ্ছা, এবং এসব উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন আত্মসচেতনতা ও চিন্তার মধ্যে থাকা। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিটি বাক্যে গড় শব্দ-সংখ্যা ছিল ৬৫-৭০, এবং এটি আশ্চর্য নয় যে, আধুনিক যুগে সেই সংখ্যাটি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে আজ প্রায় ১৫ টি শব্দের দিকে এসেছে। তেমনি, প্রতি শব্দে আবার অক্ষরের গড় সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, যা দীর্ঘতর শব্দের ব্যবহার প্রকাশকে হ্রাস করে। বিশদ, সুসম্পন্ন উন্নত বাক্য গঠন এবং রচনার ক্রমাগত প্রকাশ কেবল আমাদের চিন্তাভাবনাই নয়, বরং আমাদের কথা বলা ও লেখার দক্ষতারও বিকাশ ঘটায়। ধরণ এবং শব্দভাণ্ডারে মহান লেখকদের কৌশল অনুকরণ করে, তাদের পদ্ধতিতেই আমরা একটা বাক্যের কল্পনা শুরু করি। টি এস এস এলিয়ট তাঁর ‘ফোর কোয়ারটাটস’ কবিতায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আমরা ‘বিভ্রান্তির দ্বারা বিভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্ত হব।’ অথচ পরিতাপের হলো, আমরা কোনও অর্থবহ দৈর্ঘ্যের জন্য কোনও ধারণাকে ধরে রাখতে এবং প্রতিফলিত করতে অক্ষম। তাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম পাঠই এই প্রবণতার বিরুদ্ধে একটি সক্রিয় চেষ্টা।

    ৬. পরিশেষে, সাহিত্য পাঠ আমাদের নিজেকে এবং একইসঙ্গে (সংক্ষেপে) অন্যকেও বুঝতে সাহায্য করে। সাহিত্যের বিষয় মানুষ। এর পৃষ্ঠাসমূহে আমরা আমাদের বিবেক, সৃজনশীল ও নৈতিক দক্ষতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো; আমাদের আত্মা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করি, শিখি। আমরা মানুষকে তার গৌরবের উচ্চতা এবং তার মূর্খতার গভীরতায় প্রতিটি হৃদয়বিদারক চিন্তা, কর্ম, সংবেদন এবং এর মধ্যে বিশ্বাসকে দেখি। অন্য কথায়, সাহিত্য মানব প্রকৃতিতে একটি আয়না ধারণ করে এর অভ্যন্তরীণ গভীরতা এবং জটিলতাগুলো প্রকাশ করে। সেইসাথে গুণাবলী ও কুফলসমূহের শ্রেণীবিন্যাস এবং তদ্ব্যতীত এটি একটি সাংস্কৃতিক যুগ পর্যন্ত এ আয়না ধরে রেখে এর আকার এবং নীতিগুলো আলোকিত করে।

    অনেক আগে, ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের পূর্ব অংশে একটা ম্যাক্সিম খোদাই করা ছিল যে, ‘নিজেকে জানো’। আর সাহিত্য পাঠই কেবল তা তথা নিজেকে জানার সুনির্দিষ্ট অর্থ। জীবনকে যাপনের জন্য ‘পরীক্ষিত জীবনকেই’ সক্রেটিস একমাত্র জীবন-যাপনের মূল্যবান বলে ঘোষণা করেছিলেন। সর্বোপরি, সাহিত্য সহজাতভাবে অধিবিদ্যা এবং সত্ত্বার সৃজনশীল প্রকাশ হতে পারে: কিছু রহস্যজনক উপায়ে প্রতিটি জীবনই প্রতিটি জীবন, এবং সমস্ত জীবনই একটি জীবন। একটি শ্রেষ্ঠ বইয়ের পাতায় পাতায় প্রতিটি চরিত্রের সাক্ষাতে আমাদের নিজেদেরই কিছু আছে।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.