Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    এবার আমার কোনো বই আসবে না (পর্ব-২)

    প্রথম পর্ব : পড়ুন 

    অথবা জীবনের বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো আপনার ঘুমকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে নিয়ে গেছে। দুপুরের দিকে ঘরটা খালি থাকে। ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রামের পর আরেকটা ওজনসম্বলিত বিকেলবেলা ঘাড়ে নিয়ে জেগে উঠেন। আবার প্যান্টের ভেতর ঢুকান নিজের ক্লান্ত পা দুটো, শার্টের ভিতর ঢুকান নিজের শরীরটা, তারপর বেরিয়ে পড়েন- এই ক্ষুদ্র শহরটার অলিগলি বেয়ে হাঁটতে। কিন্তু কোথায় আপনি পৌঁছতে চান? বিকেলের দিকে যান সার্কিট হাউজের পাহাড়টায়। এখান থেকে সমস্ত কক্সবাজারটাকে দেখতে পান একটা মহাকালিক উঁচু দৃষ্টিকোণ থেকে। মানুষ যতই উপরের দিকে উঠতে থাকে ততই সে বড় কিছুর অংশ হতে থাকে। আর আপনি যখন উঠছেন পাহাড়ের শরীরের ওপর বিছিয়ে দেয়া অজগরের কালো দেহের মতো রাস্তাটা বেয়ে- দেখতে পান সারিবদ্ধ গাছের গুড়িগুলো এবং ঝোপগুলো যেগুলো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জুটিতে। তারা মত্ত প্রেমে, শীৎকারে। তাদের পেরিয়ে যান। কিন্তু যৌনগন্ধী লোভ হতাশা বয়ে আনে, তবু পিছু ফেরেন না, শীৎকার শোনার ভয়ে কানে তালা লাগান। তাদের পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে বসে পড়েন। সামনের পাসপোর্ট অফিস, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অফিস, সিভিল সার্জনের সুন্দর সুন্দর অফিসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেশের অন্যান্য জায়গার মতোই এখানেও শুধু সরকারি অফিসগুলো সবচেয়ে পরিছন্ন, ব্যয়বহুল। কিন্তু যে পরিমাণ মানুষের অর্থ এখানে ব্যয় হচ্ছে মানুষ কি তার কানাকড়ি পরিমাণও সেবা পাচ্ছে এই সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে? এসব ভাবতে ভাবতে একা হয়ে যান, একা হতে হতে আপনি বিন্দু হয়ে যান। ভয় পান প্রশ্নের দরজা খুলতে। কেননা তারা আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এসবের ভীড়ে একটি প্রশ্ন নিরন্তর গুঞ্জন তোলে আপনার কানে ‘জীবনের মানে কী!।

    অনেক দিন থেকে খুঁজে চলেছেন এর উত্তর। একটা গর্দভের মতো। সেই সব হাদা দার্শনিকদের মতো যারা আর এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সেই লোকটার কথা মনে পড়ে, সেই পর্যটক য়ুরোপ ঘুরে এসে হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া সেই বুড়া বাহার। সে ছেলেমেয়েদের ফরাসি আর স্প্যনিশ শেখায় আর সবসময় সোনালী জল পান করে। মোটা পরত দেওয়া পাওয়ারি চশমা পড়া, ঘাড়ের দুদিকে পাকনা লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়া, সারাক্ষণ মাতাল বাহার। লোকে তাকে অনেক বড় জ্ঞানী বলে জানে। সৌরজগতের নীচে অবস্থিত সমস্ত বস্তু বিষয়ে দুঘণ্টা অনবরত বকরবকর করতে পারে নাকি সে, এটা তার ছাত্রছাত্রীদের দাবি। তাকে আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘জীবনের মানে কি স্যার’? সে সোনালী পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে তাকিয়ে ছিল সবসময় কম কথা বলা আপনার দিকে, হয়তো সে পরিমাপ করতে চেয়েছিল আপনার হতাশার গভীরতা। আর বলেছিল অবিকল মাতালের মতো ‘মৃত্যু’। তারপর হেসেছিল অনেকক্ষণ। তার হাসির শব্দ এখনোব্দি আপনি শুনতে পান, যেন সেই হাসি জীবনকে নিয়ে এক ধরনের ঠাট্টা ছিল। যদিও বাহার এখন আর বেঁচে নাই। সন্তুষ্ট হতে পারেননি আপনি তাদের উত্তরে যারা ছিল এই প্রশ্নের থেকে পলায়ন বাদী মানসীকতায় ভরা। আর সেই মাঝ বয়সী নাবিক যার সাথে আপনি তৈরি করেছেন একটা বিহ্বল সম্পর্ক সে আপনাকে বলেছিল ‘জীবনের মানে হচ্ছে জীবন’।

    আর আপনি যখন উঠছেন পাহাড়ের শরীরের ওপর বিছিয়ে দেয়া অজগরের কালো দেহের মতো রাস্তাটা বেয়ে- দেখতে পান সারিবদ্ধ গাছের গুড়িগুলো এবং ঝোপগুলো যেগুলো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জুটিতে। তারা মত্ত প্রেমে, শীৎকারে। তাদের পেরিয়ে যান। কিন্তু যৌনগন্ধী লোভ হতাশা বয়ে আনে, তবু পিছু ফেরেন না, শীৎকার শোনার ভয়ে কানে তালা লাগান।

    প্রত্যেকে নিজের নিজের ধরনে তৈরি করে যাচ্ছে তাদের প্রশ্নোত্তর। আপনি দেখেছেন এই সংক্রামিত প্রশ্নটি যাদের জিজ্ঞেস করেছেন আপনি, সকলে অংশীদার হয়ে গেছে আপনার দুঃখের। বা আপনিও তাদের। সেই লোকটির কথা, সেই বিজ্ঞ বাহারের কথা যদি ধরেন তবে মূলত তার জীবন তাকে টেনে এনেছে এই পথে যেখানে দাঁড়িয়ে খুব সহসা সে উচ্চারণ করতে পারে ‘মৃত্যু’। স্কলার ছিল সে, জীবনে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি। খুব সহসা যা চেয়েছে তা পেয়েছে। আত্মসন্ধানী লোক ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার পর ওখানেই শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পায়। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যায় কেম্ব্রিজে। ওখান থেকে মিশরের এক সহপাঠির প্রেমে পড়ে চলে যায় মিশর। সে মিশরের একটা কলেজে পড়াত। ওখানে সে থিতু হতে পারে নাই। পিরামিডের গল্প সে বলে বেড়ায়, এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধেক দেশে শিক্ষকতা করেছে সে আর ঘুরে বেড়িয়েছে য়ুরোপ। শিখেছে ফ্রেন্স, স্প্যনিশ। সে আড্ডা দিয়েছে সমকালিন লেখকদের সাথে প্যারিসের খাবার দোকানগুলোতে, সে পান করেছে লাল-নীল-সোনালী পানিয় কর্ডোভার পানশালায়। তবুও শেকড়ের টানে সে বাংলাদেশের এই মফস্বল কক্সবাজারে স্থীর। তার অভিজ্ঞতা তাকে দুঃখ দিয়েছে, দুঃখী করেছে। প্রায় তার কাছ থেকে শুনতে হয় এখানে বই পাওয়া যায় না, ইচ্ছে মতো শুনতে পারি না পছন্দের মিউজিক, দেখতে পারি না পছন্দের ছবি। আর্থিক সামর্থ্য প্রায় শূন্যের কোটায়। সারাদিনে কয়েক ব্যাচ ছাত্রছাত্রীকে সে ইংরেজি পড়ায় এই তার ইনকাম। সে বলে এদেশ ছেড়ে যাওয়ার ছাড়পত্রও পাব না। এদেশে প্রতিটি মানুষকে দুই সত্তার সাথে যুদ্ধ করতে হয়, একটা রাষ্ট্র অন্যটা এখানকার জনতা, তিনি বলতেন। সুতরাং আমি মরার জন্য বসে আছি। আর সব কাঁপিয়ে শুধু হাসতো সে। এভাবে কেটে যেতে থাকে লোকটির জীবন। দিনের পর দিন সে সোনালী পানিয়ের গ্লাস মুখে নিয়ে প্রতিক্ষায় থাকে মৃত্যুর।

    আর সেই মধ্য বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত গণিকার কথা যদি বলেন তবে বলতে হয় কৈশোরে প্রেমিকের হাত ধরে পালানো এই মহিলা প্রেমের মোহ কেটে যাবার পর নিজের আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য ওয়াফেজ না এসে কাজ নিয়েছিল গার্মেন্টসে। নানা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অভ্যস্ত হয়েছিল দেহবিক্রিতে। স্বামীর সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পর আরবিয় এক শেখের রক্ষিতা হয়ে পাড়ি জমিয়েছিল দুবাই। সেখানে সে তার জীবনের অর্ধেক কাটিয়ে চলে আসে দেশে। সাথে নিয়ে আসে প্রচুর টাকা, দেশে এসে সে একটার পর একটা সম্পদ কিনতে থাকে এবং অতিদ্রুত কক্সবাজারের কয়েকজন ধনীর অন্যতম ধনীতে পরিণত হয়েছে। এখন তার সেই সব জারজ সন্তানাদি এবং তাদের পুত্র-কন্যারা মিলে তার বিশাল পরিবার। সে ধরে থাকে অর্থনৈতিক সুতো এবং বিয়ে করে চলে একটার পর একটা। তার বিয়ের রূচিটাও বেশ অন্যরকম। সে বাইরের কাউকে বিয়ে করে না। সে বিয়ে করে তার ট্রাক ড্রাইভার, তার হোটেল ম্যানেজার। খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না বিয়েগুলো। আর সে সহসা বলে ‘জীবনের মানে হচ্ছে জীবন’। তবুও পারেন না মেনে নিতে। আপনার মনে হয় এগুলো জীবনের কতিপয় খন্ডাংশ মাত্র।

    প্রথম সাক্ষাতে প্রেমে পড়ার মতো ভাবালু নন। বেশ কয়েকবার আড্ডার পর যখন বুঝতে পেরেছিলেন সারাকে ভালোবাসেন তখনো কামনা করতেন পরস্পরের প্রতি বোঝাপড়া, বিশ্বস্ততা, পরস্পরের তদারকি করাই প্রেম। এভাবেই প্রথাগত ব্যাপারটাকে স্বাগত জানাতে চেয়েছিলেন জানতে চাননি সারা কোন পরিবারের সন্তান অথবা তার পরিচিতি। অথচ সে এখন আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা।

    সুতরাং আবার নেমে পড়েন সার্কিট হাউজের উঁচু পাহাড় থেকে আবার হেঁটে যেতে থাকেন সমুদ্রের দিকে। দেখতে পান না সমুদ্রে স্নানরত সুন্দরীদের। যারা চমৎকার চর্চা করা উচ্চারণে কথা বলে। ভাবেন এদেরও জন্ম হয়েছে কয়েকটা বাচ্চার মা হওয়ার জন্য। পৃথুল শরীর নিয়ে এক সময় অবসাদে ডুবে বুড়ো হয়ে মরে যাবার জন্য। তবে কী এই জীবনের মানে? আদৌ কী কোন মানে আছে? নাকি সবাই নিজের মতো জীবনের মানে তৈরি করে? আপনি শুনতে পান সুন্দর নতুন মডেলের গাড়িগুলোর হর্ন। শব্দ দূষণ সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র সচেতনতা নাই। না ড্রাইভারের না মালিকের। মাঝে মাঝে আপনার মনে হয় সুন্দর সুন্দর মডেলের বেশির ভাগ গাড়ির ভেতর বসে থাকে রোদচশমা পড়া অন্ধ অশিক্ষিত জন্তুরা।

    বৈকালিক সমুদ্রের বাতাস আপনাকে আপনার অবসাদ থেকে তুলে আনতে পারে না। কোনো উত্তর পান না আপনি হাওয়া খেতে আসা যুবক-যুবতীর মুখ থেকে। সন্ধ্যার দিকে আবার আপনি ফিরে আসেন নিজস্ব নির্জনতায়। প্রতিদিনকার অভ্যাসমত কলম নিয়ে বসেন কিছু লিখতে। প্রকাশকের তাড়া মনে পড়ে। সামনের মেলায় বই করার তাড়া। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না যে কবিতার বইটি প্রকাশককে দেয়ার কথা তা আদৌ আপনি দিতে পারবেন কিনা। কারণ অর্থহীনতার ভেতর থেকে উঠে আসতে পারছেন না। বিষন্নতা আপনাকে ঠেলে তুলে দাইমার মতো বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। আর আত্ম অনিয়ন্ত্রিত হতে থাকেন আপনি।
    সারার কথা মনে পড়ে আপনার। সেই আনন্দদায়ক মুহূর্তগুলো যা পেতে চেয়েছিলেন প্রেমে। আর পেয়েছিলেন এক সমুদ্র তরল বিষাদ। যে বিষাদের লাভা থেকে বেরুতে পারছেন না এখনোব্দি, ডুবে আছেন। সারাকে কোনো বিশেষণেই বিশেষিত করতে পারেন না আজ। প্রথম সাক্ষাতে প্রেমে পড়ার মতো ভাবালু নন। বেশ কয়েকবার আড্ডার পর যখন বুঝতে পেরেছিলেন সারাকে ভালোবাসেন তখনো কামনা করতেন পরস্পরের প্রতি বোঝাপড়া, বিশ্বস্ততা, পরস্পরের তদারকি করাই প্রেম। এভাবেই প্রথাগত ব্যাপারটাকে স্বাগত জানাতে চেয়েছিলেন জানতে চাননি সারা কোন পরিবারের সন্তান অথবা তার পরিচিতি। অথচ সে এখন আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা। সারা সংক্রান্ত ব্যাপারটায় ব্যথা পাননি, বিস্মিত হয়েছিলেন। সারার কাছে পাঠ নিয়েছিলেন মানুষের পাশবিক বহুগামিতার। প্রতিটি মানুষই একেকটা বিষয়ে শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে। মানুষ একটা ছদ্মজীব এখন আপনার মনে হয়। সে যে কোন পশুর মতই বহুগামি। এই লোভ-যৌনতা-ভোগমত্ত বাস্তবতা আপনি সবই সারার কাছে জেনেছিলেন।

    চলবে…

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.