Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    এবার আমার কোনো বই আসবে না (পর্ব-১)

    আর একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে আপনার মনে হবে শুয়ে আছেন এক বিশাল অর্থহীনতার ভেতর। মানুষের সেজেগুজে অফিসে যাওয়ার ব্যস্ততা, পাখীর কলকাকলী, কিচির মিচির, বইয়ের আলমারিগুলো, লেখার টেবিল, তার ওপর ঢেকে রাখা গত রাতের বাসি পানি ভর্তি গ্লাস। সাদা কাগজের ওপর এখনো খোলা কলম। আর গত রাতের ব্যর্থতা, সারা মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো কাগজের দলা। নিজেকে বন্ধ্যা ভাবছেন। গতরাতে আপনার কান্না পাচ্ছিল। আর ভাবছিলেন আত্মহত্যার কথা, যদিও এটা হাস্যকর প্রতিদিনই ভাবেন। জানেন আত্মহত্যা কখনোই আপনার দ্বারা সম্ভব না। সকালে জেগে উঠে অন্যান্য দিনের মতো জানলাগুলো খোলেন নাই, শরীর চর্চা করেন নাই। যদিও জেগে আছেন তবু গায়ের ওপর কম্বলটা টেনে পড়ে আছেন নিজের ওপর প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে।

    ব্যর্থতাবোধ কাটিয়ে উঠতে পারেন নাই ফলে মাথাটা এখনোব্দি ভারি হয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওটার ভেতর মগজের বদলে এখন শুধু ডাবের পানি। আর জানেন আজকের দিনটাও ঠিক একই রকম গতানুগতিকতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে এবং ভয় পান আরেকটা অর্থহীন সকাল শুরু করতে। আর আপনার কিছুই করবার থাকে না, তবু মেনে নেন না। কেননা স্বপ্নগুলো তাড়া করে আপনাকে। তাই দাঁড়িয়ে থাকেন সময়ের মুখোমুখি তার প্রতিপক্ষ হয়ে। আর সময় খুব সহজেই তার জমানো তীরফলকসমূহ অতি সূক্ষ্মভাবে নিক্ষেপ করতে থাকে আপনার হৃদপিন্ড বরাবর। যেটা অতিযত্নে রক্ষা করে আসছেন এতদিন। লোকে আপনাকে পলায়নবাদী ভাবে। জঘন্য বাস্তবতা থেকে, কৃত্রিম এই সভ্যতা থেকে নিজের মতবাদ আর প্রাকৃতিক স্বভাবকে রক্ষা করবার জন্য অপেক্ষাকৃত কম কোলাহলপূর্ণ পথে হাটা আপনার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আর প্রিয় শহর যেখানে আপনি বাস করেন তাকে ক্রমে মনে হচ্ছে সভ্যতাহীন ঈশ্বর বর্জিত কোনো বিশুস্ক মরুভূমি।

    আরো একটা দিন প্রলম্বিত হতে দেন। আবার বেরিয়ে পড়েন পোশাক পরে শহরের রাস্তায়। সতর্কে পাশ কাটিয়ে যান সামনে থেকে ছুটে আসা রিক্সা, স্কুটার এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের। ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তবু কঁকিয়ে উঠেন, ব্যথা পান, কোথায় যাবেন, এই ছোট শহর কক্সবাজারে? বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত বললেও একটাই মূলরাস্তা এখনও এই শহরের। লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়রের পর মেয়র ক্ষমতায় আসেন। ছোট এই সামুদ্রিক শহরটার মূল সড়কটা দিনের পর দিন অকেজো, চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। মেয়রগণ শুধু ফিতা কাটায় ব্যস্ত। লোকাল পত্রিকাগুলো ব্যস্ত তাদের সদাহাস্যোজ্জল ছবি ছাপার প্রতিযোগিতায়। চারপাশে শুধু চাটুকারিতার মহোৎসব।

    আর গত রাতের ব্যর্থতা, সারা মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো কাগজের দলা। নিজেকে বন্ধ্যা ভাবছেন। গতরাতে আপনার কান্না পাচ্ছিল। আর ভাবছিলেন আত্মহত্যার কথা, যদিও এটা হাস্যকর প্রতিদিনই ভাবেন। জানেন আত্মহত্যা কখনোই আপনার দ্বারা সম্ভব না।

    সূর্য ধীরে ধীরে রণমূর্তি ধারণ করছে। কক্সবাজারে যে কয়টা খন্ড খন্ড অফিস আছে সেদিকে পারত পক্ষে যান না। যদিও এখন অফিসের সংখ্যা অনেক বিশেষ করে রোহিঙ্গারা আসার পর। জগতের সমস্ত এনজিওদের অফিস এখন কক্সবাজারে। শহরটার ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে খুব। শহরের একমাত্র প্রধান সড়ক বেয়ে হাঁটতে থাকেন আপনি যেটা মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরের পানিতে। শুনতে থাকেন ঝাউবিথির গান। দেখতে থাকেন রৌদ্রের মরিচীকা। আরো অবসন্ন হয়ে পড়েন। আপনার বসতে অথবা শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। তিরিশ বছরের জীবনটাকে তিরিশ টন ওজনের মনে হয়। আপনাকে টানে না সমুদ্রের স্বাদ নিতে আসা স্বল্প বসনা সুন্দরীগণ। আপনাকে বিরক্ত করে কুত্তামুখো সমুদ্রের পুলিশগুলো। সমুদ্রের বালিয়াড়ির চাদরের ওপর বসে স্মৃতিচারণ করে সময় কাটাতে যান। অনাত্মীয় শৈশব যা আর কোনোকালে ফিরে পাবেন না। হারানো বন্ধুরা, প্রেমিকারা যারা আর কোনোদিন বুঝতে চাইবে না আপনার এই নিঃসঙ্গতার গল্প। তাদের বিবাহিত জীবনের ফাঁক দিয়ে। আর রৌদ্র নেশাগ্রস্থ করে তোলে আপনাকে আর ভয় পান বিছানাকে। বালুতে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি যান, ফের উঠে পড়েন। সমুদ্রের পানির কাছাকাছি চলে আসেন, জুতা পরে আছেন ফলে পা ডোবান না পানিতে। তবু সমুদ্রের সাদা ফেনাসহ ঘোলাটে পানি হুড়মুড় করে গড়িয়ে আসে আপনার পায়ের কাছে। এই ময়লামাখা হলুদ পানি কিসের বার্তা বয়ে আনে? দেখতে পান গোটা তীর জুড়ে নারকেলের চোবড়া, জেলিফিস, তারা মাছ, গাছের গুড়ি ইত্যাদি ছড়ানো ছিটানো রয়েছে আর আপনি একটা নারকেল চোবড়াকে বলের মতো লাথি মেরে উড়িয়ে দেন। আর এতে বুঝতে পারেন শরীরটা কত ভারি এবং বেজুত হয়ে আছে। প্রায় আধবেলা পর্যন্ত ঘুরতে থাকেন কক্সবাজারের রাস্তায় রাস্তায়। আর ঘুরে ঘুরে দেখেন একই পর্যটন মোটেল, বাসি খাবারে ভরা রেস্তোরা, জীবন সংগ্রামী ব্যস্ত মানুষগুলো। কক্সবাজারে এখন প্রচুর পরিমাণে হোটেল ও রেস্তোরা হয়েছে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত মাত্র কয়েকমাস পর্যটকদের আনাগোনা। বাকী অধিকাংশ সময়ই হোটেল রেস্তোরাগুলো বেকার বসে বসে ঝিমুয়। পরিচিত মানুষগুলো আপনাকে দেখে হাত নাড়ছে কেউ মুখ খুলে শুষ্কভাবে শান্তি কামনা করছে। আর আপনি বুঝতে পারেন এই শান্তি কামনা শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ থাকে।

    কিন্তু ঈশ্বর, ঘুম আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে, আপনি ক্লান্ত বিধ্বস্ত, দ্বিধাভক্ত, ভবিষ্যত সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নৈরাশ্যে ভরপূর। আপনি চোখ বন্ধ করে থাকেন জানেন বাইরে থেকে এমতাবস্থায় যে কেউ দেখে ভাববে তলিয়ে গেছেন ঘুমের গভীরে। আর আপনি জানেন মূলত চোখ দুটো বন্ধ করে নিজের মস্তিষ্কের ক্রিয়াগুলো বুঝতে চেষ্টা করছেন।

    আর হাঁটতে হাঁটতে আপনার মনে পড়ে যাবে একজন নাবিকের গল্প। যিনি আপনাকে বড় হয়ে একজন নাবিক হতে উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সেই পর্তুগিজ নাবিক বঙ্গোপসাগরে জাহাজ দুর্ঘটনায় সে ভেসে এসেছিল এই তীরে। সে খবর হয়েছিল কক্সবাজারের সকল ভোরের পত্রিকায়। আর স্থানীয় পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসাবে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা নিতে গিয়েছিলেন তার কাছে অতপর তার সাথে আপনার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আপনার জীবনের প্রথম বিষ্ময় এই কি সেই লোক যে আপনার জীবনে প্রথম রোপণ করে গিয়েছিল অতৃপ্তির বীজ? যা ধীরে ধীরে মহীরূহ হয়ে বেড়ে উঠেছে নিজের ভেতর। সেই লালচুলো পর্তুগীজ নাবিক তিন মাস ছিল এই কক্সবাজারে। বিকালে সমুদ্রের পারে হাটতে হাটতে সে আপনাকে শুনিয়েছিল তার জীবনের গল্প, যৌনতার গল্প, বন্ধন ছিন্ন করার গল্প, পিছুটানহীনতার গল্প- যেটাকে পরে আপনি আখ্যায়িত করেন তিন মাসব্যাপী একটা ঝড়ে যা বয়ে গিয়েছিল রক্ষণশীল মনের ওপর। আর আপনার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল একটা প্রশ্নে ‘কী’। এই ‘কী’ যা বিগত জীবন থেকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর জন্ম দিচ্ছে দিনের পর দিন, প্রশ্ন থেকে প্রশ্নের।

    দুপূরে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসেন। ঠান্ডা পানি দিয়ে ক্লান্তি দূর করতে চান সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আর দেখেন সাওয়ার বেয়ে পানির সাথে নেমে আসা তরল শ্যাওলা জাতীয় ময়লাগুলো যেগুলো ইতোমধ্যে চুলে লেগে আটা হয়ে আছে। আর আপনার বিষাদের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকে। তবুও ঘামগুলো তাওয়েলে মুছে ফেলেন। ফ্যানের নিচে এসে দাঁড়ান ক্লান্ত শরীরটা শুকিয়ে গেলেই লুটিয়ে পড়েন বিছানায় যেন কলাগাছ, খুব ধারালো যন্ত্রে কর্তিত হওয়ার পর বুঝতে না পেরে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন।

    কিন্তু ঈশ্বর, ঘুম আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে, আপনি ক্লান্ত বিধ্বস্ত, দ্বিধাভক্ত, ভবিষ্যত সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নৈরাশ্যে ভরপূর। আপনি চোখ বন্ধ করে থাকেন জানেন বাইরে থেকে এমতাবস্থায় যে কেউ দেখে ভাববে তলিয়ে গেছেন ঘুমের গভীরে। আর আপনি জানেন মূলত চোখ দুটো বন্ধ করে নিজের মস্তিষ্কের ক্রিয়াগুলো বুঝতে চেষ্টা করছেন। সারাদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হতে থাকে স্মৃতির স্তরে স্তরে। আপনি শুনতে পান রিক্সার টুংটাং শব্দ, গাড়ির বদরাগী হর্ণ, মানুষের কথাবার্তা, মেয়েদের হরেকরকম হাসির শব্দ, আপনি অনুভব করতে থাকেন রাস্তার খাবার দোকানের ভাজাভুজির গন্ধ, হরেকরকম মিষ্টির নাদুস দেহ, সাজানো কেক, পেস্ট্রি, বার্গার ইত্যাদি যেগুলো দেখেছিলেন সেই সব রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়। শুনতে পান আপনার মাথার ওপর দিয়ে শো শো শব্দ করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের শব্দ। এই বালুভরা সামুদ্রিক শহরটার দুপুরের ঝিমুনি। তলিয়ে যান এই সব স্মৃতির সমুদ্রে, মাথার দু’পাশে ব্যথা জমে উঠে। ডানহাতটা সেদিকে ওঠে যায়। কিন্তু ঘুমাতে পারেন না। ঘুম আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। কারণ ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়েই আপনি ঘুমের বড়ি খেয়ে নিজের ঘুমের বারটা বাজিয়েছেন।

    চলবে…

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.