Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস

    ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক হারুন আল রশিদের লেখা চল্লিশটি অধ্যায়ের ১৮২ পৃষ্ঠার, প্রথম পুরুষে বিধৃত, ভিন্ন ধারার উপন্যাস। সমাজের সার্বিক চিত্রের পটে রচিত উপন্যাসটির মূল সূত্র হলো প্রেম। রং-রস-রূপক-চিন্তনের অনুঘটক না থাকলে কেবল জীবন বাস্তবতার আঙ্গিকে রচিত সাহিত্য নিঃসন্দেহে প্রাণহীন হতে বাধ্য। কিংবা হয়ে যেতে পারে কেস স্টাডি বা পত্রিকার প্রতিবেদন। এ-কারণে সাহিত্যে পাঠকের মনকে বিচিত্র রূপে রাঙিয়ে ধোঁয়াশা বা কুহক ছড়িয়ে দিতে পারার মধ্যে লুকিয়ে থাকে চমক, নতুনত্ব এবং সৃষ্টির সাফল্য, যা এ উপন্যাসের পরতে পরতে দেখা যায়। শুধু লেখকের জীবনী থেকেই নয়, এ উপন্যাস নির্মাণের মুনশিয়ানা থেকেও বিশ্বসাহিত্যের ওপর লেখকের দখলের বিষয়টা পরিষ্কার হয়। পাঠক হিসাবে আমরা বুঝতে পারি লেখক হঠাৎ করে ওয়ানটাইম লেখক হওয়ার খায়েশ থেকে উপন্যাস রচনা করতে বসেননি, বরং স্বীকার করতে হবে, তিনি দীর্ঘ প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর, একটি কাল্পনিক জগৎ সৃষ্টি করে জাদুকরি এক উপন্যাস নির্মাণ করেছেন, যা পাঠকের চিন্তার গতি দিগ্বিদিক প্রসারিত করে। হয়তো লেখকের চিন্তার পরিপক্বতা এবং বিশ্বসাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্য ধারণ করে তিনি নিজস্ব ধারার একটি জগৎ সৃষ্টি করে কাল ও ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। শুধু কাহিনি বা প্রেক্ষাপটই লেখকের ভৌগোলিক সীমা ছাড়ায়নি, বরং বলা যায় চরিত্রের নামকরণেও রয়েছে একই প্রবণতা, যা থেকে লেখকের অমোঘ বিস্তৃত কল্পনাশক্তির সন্ধান মেলে। বলতে দ্বিধা নেই যে বাংলাদেশের কোনো লেখক এ ধারার উপন্যাস লিখেছেন, এমনটা আমি দেখিনি; কেউ যদি লিখেও থাকেন তা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি।

    উপন্যাসটি দুটি খণ্ডে রচিত। প্রথম খণ্ডে রুদেশিব শেকাবের পারিবারিক, সামাজিক ও তার কৈশোরের ভাবাবেগে লোটাসের সঙ্গে একটি অকালিক প্রেমের ঘটনা চিত্রিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ড লুনাভা মিনির প্রতি রুদেবিশ শেকাবের নিখাদ গভীর প্রেম উষ্ণতা ছড়িয়েছে। আখ্যানের পরিণতি ট্র্যাজেডির গহিনে লীন, পাঠকের হৃদয়ে মূর্ছনা তোলে ‘রোমিও জুলিয়েটে’র বেদনার সুর।

    ‘আমি সুখী হতে পারতাম।’ উপন্যাসের শুরুর বাক্যটি দিয়ে কুশিলব রুদেবিশ শেকাবের জীবনের কষ্টের দুয়ার খোলা হয়। ক্ষুদ্র এ বাক্যটি পাঠকরে ওপর বিষাদের টোপ ফেলে যা থেকে অনুভূত হতে পারে সুখের অন্বেষায় ব্যাপৃত রুদেবিশ শেকাব কি সুখী হতে পারেনি? কেন পারেনি? কৌশলী এ বাক্যটি পড়ার পর পাঠক জানতে উদগ্রীব হবে : শেষ পর্যন্ত রুদেবিশ শেকাবের কী হলো। উপন্যাসের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা হিসাবে সমাজের প্রচলিত মিথ, ধর্মীয় আচারাদি, আধ্যাত্মিকতার পরাকাষ্ঠাপ্রভৃতি সাহিত্যরস সিঞ্চন করেছে। প্রথম অধ্যায়েই সুখ-সন্ধানী শেকাবের মনে পড়ে জ্যোতিষী ধ্রোনের কথা :

    ‘সুখী হতে চাইলে জিব কামড়ে ধরে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করো। যদি তা না পারো, গ্রামে চলে যাও, ভূমি চাষ করো। যদি জমি না থাকে, গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হও। যদি তা-ও না পার, উপাসনালয়ে যোগ দাও। প্রতিবেশীরা তোমার জন্য খাদ্য নিয়ে আসবে, খাটে তোমার বিছানা পেতে দিবে। তুমি সুখী হবে।’

    শৈশবে রুদেবিশ শেকাব মাতৃহীন হলে তার পিতা এক নারীর সঙ্গে জীবনযাপন করে-যে নারীকে খ্যাপাবুড়ি বা ডাইনি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এ নারীর চরিত্রটি বেশ রহস্যময় করে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে শেকাবের সঙ্গে তার সম্পর্ক কিছুটা ভালো ছিল। শৈশবে শেকাব ছিল দুষ্টামি বা ছলচাতুরিতে পরিপক্ব। শেকাবের ইঙ্গিতপূর্ণ পরিচয় : ‘যে কাজ গ্রামের ছেলেরা বারো বছর বয়সে শুরু করে আমি তা তিন বছর বয়সে শুরু করেছি।’

    রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবনহারুন আল রশিদ
    উপন্যাস । প্রকাশক: সৃজন । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩
    ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
    রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/290130
    কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

    শেকাবের শৈশবের নারী লোটাস যেন আমাদের সমাজের বড় আপা। লোটাসের সঙ্গে প্রেম ছিল অন্য এক ছেলের। লোটাসের বিয়ে না হওয়ার জন্য পরিবারের পীড়নে লোটাস বিমর্ষ থাকে। আবার প্রেমিকও ছিল প্রবঞ্চক। ছদ্মবেশী প্রেমিক বন্ধুদের নিয়ে লোটাসকে ভোগ করে ফেলে রেখে চলে যায়। লোটাসের সঙ্গে শেকাবের সখ্য ছিল গভীর। প্রেমে ব্যর্থ, পারিবারিক যন্ত্রণা ও সামাজিকভাবে নিগৃহীত লোটাস একদিন বিষ পানে আত্মহত্যা করে, কিন্তু তার আগে সে শেকাবের অকালিক কামনা নিবৃত্তি করে, যা লোটাসের অবর্তমানে শেকাবের মনে সৃষ্টি করে বিষাদের ধারা।

    রুদেবিশ শেকাবের কথায়, জন্মের পর থেকে জীবনের নারী ছাড়া আর কোনো কিছু সে ভাবেনি। দ্বিতীয় খণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুদেবিশ শেকাব কলেজ পড়ুয়া লুনাভা মিনির মধ্যে সে তার স্বপ্নের নারীকে খুঁজে পায়। এখানেও ত্রিভুজ প্রেমের জ্যামিতিক কাঠামো পরিলক্ষিত হয়। লুনাভা মিনি শেকাবকে প্রত্যাখ্যান করলে শেকাব নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মজনু কিংবা দেবদাসের মতোই বুঝি। এ প্রেমের প্রধান বাধা হলো ধর্মের। শেকাবের ভাষায়, ‘আমি যখন লুনাভা মিনিকে পাই, তখন এই বিতর্ক সারা পৃথিবীতে ঝড় তোলে। আন্তর্জাতিক চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায় দুই অংশে ভাগ হয়ে একে অন্যকে কেয়ামত ঘনিয়ে আনার দায়ে অভিযুক্ত করেন। বিরোধ দূর করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই পক্ষের পাদ্রিদের ভিয়েনাতে মিলিত করে স্ব স্ব যুক্তি তুলে ধরতে বলেন। এ প্রচেষ্টার ফল হয় উলটো।’

    উপন্যাসটির মূল কাহিনি বিয়োগাত্মক হলেও এতে হাস্যরসের অভাব নেই। আবার রয়েছে গভীর রসবোধ, যেমন শেকাব বলে, যেসব জিনিসে আমরা জাতি হিসাবে পৃথিবীতে শীর্ষে ছিলাম মাথাপিছু ঝরা ঘাম ছিল তার অন্যতম। এ ধরনের বাক্য একদিকে যেমন শিল্পরসে ভরপুর তেমনি তা জীবনের অবস্থাও প্রকাশ করে।

    লুনাভা মিনিকে ভুলে যাওয়ার উপায় হিসাবে শেকাব শহরের আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করে। তার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার কারণেই এক সময় একটি বস্তিতে গিয়ে সে হাজির হয়। শেকাব বস্তিবাসীদের দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা করে যা থেকে পাঠক ধারণা পেতে পারে ওই সমাজের বস্তিবাসীদের যাপিত জীবন সম্পর্কে।

    ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদ রুদেবিশ শেকাবের মৃত্যুর ঘটনাটার বিস্তারিত বর্ণনা দেননি। তবে এ বিষয়ে আমরা কিছু ধারণা পাই। লোটাসের সঙ্গে রোমাঞ্চের পর থেকে তার ধারণা হয় তার প্রাণের আধার হলো তার অণ্ড। রুদেবিশ শেকাবের জবানিতে, ‘আমার শত্রুরা আমাকে হৃৎপিণ্ডে আর মস্তিষ্কে আঘাত করে মেরেছে। আমার প্রাণের আধার দুটি অক্ষত থাকাতে আমি ভেবে নিয়েছি না মরেই আমি পরকালে চলে এসেছি।’

    উপন্যাসটি শেষ হয় পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টিকে ভালোবাসার আহ্বান জানানোর মাধ্যমে। ভালোবাসাই সুখ। লেখকের ভাষায়, ‘মনে রাখুন, প্রকৃতি আপনাকে দুঃখ ভোগের জন্য সৃষ্টি করেনি।’ কৌশলী হাতের রচনা এ উপন্যাসে পাঠক কখনো ঝড়ের, কখনো আগুনের, কখনো নিখাদ হাসির মধ্য দিয়ে গমন করে আর শেষে এক শান্তির বন্দরে এসে তৃপ্তি লাভ করে।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.