Monday, October 27, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    অপর্যাপ্ত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই শুরু করার সাহস থাকা চাই

    ফ্রস্টের কবিতায় এক অদৃশ্য আনন্দলোকের উপলব্ধি হয়। এমনই তার চিত্রকল্প মনে হয় তা যেন কোথাও আছে, দেখেছি আমি। মূলত আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্পের যে অবাস্তব দৃশ্যকল্পের সমাহার; তাই বাস্তব অঙ্কনে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তার প্রথমদিকের কবিতাগুলো বিশেষত ‘নর্থ অব বোস্টনে’ প্রকৃতি সম্পর্কে নিত্যনৈমিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, তাত্ত্বিক জোর, প্রতিষ্ঠিত শ্লোকের রূপ এবং থিমগুলোয় এর দাসত্বপূর্ণ সামঞ্জস্যের সঙ্গে উনিশ শতকের শেষের রোমান্টিক শ্লোক থেকে মূলত পার্থক্য রয়েছে। তবে ফ্রস্টের কবিতায় প্রকৃতির বিশেষ ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি থাকলেও তাকে যে মূলত ‘প্রকৃতি কবি’ বলা হয়; ফ্রস্ট তার জীবদ্দশাতেই তা নাকচ করে দিয়ে গেছেন। আলোচ্য সাক্ষাতকারে তা সবিস্তারে উল্লেখ আছে। মূলত কবিতায় ফ্রস্ট থিমের একটি ঈর্ষণীয় বহুমুখিতা প্রদর্শন করেছিলেন। সাধারণভাবে প্রাকৃতিক জগতের সবচেয়ে ছোট ছোট সাক্ষাতে মানব জীবনের যোগাযোগগুলো তদন্ত করেছিলেন, যা মানব অবস্থার বৃহত্তর দিকগুলোর রূপক হিসেবে কাজ করে। তিনি প্রায়ই প্রাকৃতিক বিবরণটিকে সংবেদনশীলতায় চিত্রিত করেছিলেন। যেটা তার ‘স্নো অব ডাস্ট’ কবিতায় দেখা গেছে। ফ্রস্ট তার মেট্রিক্যাল ফর্ম বা ছন্দোবদ্ধ রীতিতে দক্ষতার জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এবং ট্র্যাডিশনাল স্ট্যানযা বা ঐতিহ্যবাহী স্তবক ও ছন্দোময় লাইন তাঁর হাতে নতুন প্রাণশক্তি অর্জন করে। ফ্রস্টের ট্র্যাডিশনাল ছন্দের কমান্ডটি ‘ডিজাইন’ এবং ‘সিল্কেন টেন্ট’-এর মতো সনেটগুলোর আঁটসাঁট, পুরনো, নির্ধারিত নিদর্শনগুলোতে স্পষ্ট প্রমাণিত। তাঁর সুদৃঢ় বশ্যতা সম্ভবত ‘এ,বি,এ,বি, এবং এ,বি,সি,বি’-এর মতো সহজ ‘চতুষ্পদী শ্লোক’ ছন্দের সঙ্গে। এবং এর বিধিনিষেধের মধ্যেই তিনি এক অসীম বৈচিত্র্য অর্জন করতে সক্ষম হন, যা তার ‘ডাস্ট অব স্নো’ এবং ‘ডেজার্ট প্ল্যাসেস’ কবিতায় ফুটে উঠেছে। ফ্রস্ট কখনোই ‘ফ্রি ভার্স’ বা মুক্ত শ্লোকে উৎসাহী ছিলেন না। ‘নতুন’ তবে ‘নতুন হওয়ার পুরনো উপায়গুলো’ কাজে লাগানোর জন্য তাঁর দৃঢ় সংকল্পটি তাকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভার্সমুক্তের উকিলদের উগ্র পরীক্ষামূলকতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এই উপলক্ষে, সুবিধার জন্য ফ্রস্ট ‘ফ্রি ভার্স’ কাজে লাগিয়েছিলেন। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তার ‘আফটার অ্যাপল পিকিং’ কবিতা। এটির দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত রেখার র‌্যান্ডম প্যাটার্ন এবং ছড়ার ব্যবহারহীন ব্যবহার। এখানে তিনি কবিতায় পুরনো এবং নতুনের মধ্যে রূপান্তরকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের দাঁড়ানোর শক্তি প্রদর্শন করেন। ‘মেন্ডিং ওয়াল’ এবং ‘হোম বোরিয়াল’-এর মতো কবিতায় নাটকীয় আখ্যানগুলো যথোপযুক্ত এবং ভাষার ব্যবহারের জন্য ফ্রস্ট কয়েকজন আধুনিক কবির একজন হয়ে উঠেছেন। এই নাটকীয়-কথোপকথনের কবিতাগুলোয় তার প্রধান প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন হলো কথোপকথনের অনিয়মিত ছন্দের সঙ্গে নিয়মিত পেন্ট ব্যাসের লাইনকে একত্রিত করা। ফ্রস্টের ‘ব্লাঙ্ক ভার্স’ কবিতায়ও একই কাজ ও সংক্ষিপ্তসার রয়েছে, যা তাঁর কবিতাকে সাধারণভাবে চিহ্নিত করে। এ কবি তার সাহিত্যিক করণকৌশল, বেড়ে ওঠা, কবিতা ও তার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাসহ নানা বিষয়ে আলাপ করেছেন বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক বেলা কর্নিৎজারের সঙ্গে। পরবর্তীকালে যা শ্রেষ্ঠ সাক্ষাৎকারগুলোর একটি বলে গণ্য হয়।
    হাঙ্গেরীয়-বংশোদ্ভূত বেলা কর্নিৎজার (১৯১০-১৬৬৪) বেশ কয়টি উচ্চপ্রশংসিত পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কর্নিৎজার ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। সিনেমায় যাওয়া থেকে তিনি মূলত ইংরেজি শিখেছিলেন এবং খুব দ্রুত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার ভিত্তি করে একটি ম্যাগাজিন নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। মূলত বায়োগ্রাফার হিসেবে তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের সূচনা করলেও রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম এবং শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে সর্বাধিক বিশিষ্টজনের অনুসন্ধান ও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন ট্রাম্যান,আইজেনহাওয়ার, কেনেডি, জনসন, নিকসন, ডগলাস ম্যাক আর্থার, বিলি গ্রাহাম, রিচার্ড কার্ডিনাল কুশিং, স্যাম রেবার্ন, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট আইনস্টাইন, উইনস্টন চার্চিল, সিসিল বি। ডিলমিল, ফেলিক্স ফ্র্যাঙ্কফুর্টার, জে এডগার হুভার, জোসেফ পুলিৎজার, জুনিয়র, র‌্যাল্ফ বুঞ্চ, নরম্যান কাজিন ও ওয়াল্টার অ্যানেনবার্গ। এই সাক্ষাৎকারগুলোর ওপর ভিত্তি করে কর্নিৎজার অসংখ্য নিবন্ধ এবং বেশকিছু পুস্তক রচনা করেন। ১৯৫২ সালে নেয়া রবার্ট ফ্রস্টের এই বিখ্যাত ইন্টারভিউটি এনবিসি নিউজ ‘এ কনভারসেশন উইথ রবার্ট ফ্রস্ট’ নামে প্রকাশ করে। এ সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন কাউসার মাহমুদ


    বেলা কর্নিৎজার: কেমন আছেন বলুন, স্যার?
    রবার্ট ফ্রস্ট : আমার সাক্ষাৎকার নিতে ভার্মন্ট পর্যন্ত এলে, এ তোমার মহানুভবতা।
    কর্নিৎজার: মোটেই নয়। এটা আমার জন্য আনন্দের এবং সেই সঙ্গে সৌভাগ্যের ঘটনা, মিস্টার ফ্রস্ট।
    ফ্রস্ট: প্লিজ, বসো।
    কর্নিৎজার : অসংখ্য ধন্যবাদ। শুরুতেই আপনাকে এটা জানানো কর্তব্য মনে করছি যে, আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে আপনিই প্রথম কবি; যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি।
    ফ্রস্ট : আমারো মনে হয় তোমাকে সতর্ক করা উচিত যে, তুমি প্রথম মাগিয়র (হাঙ্গেরীয়) যে আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। সুতরাং বলে নিচ্ছি, তুমিও আমার ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারটায় সতর্ক থাকবে।
    কর্নিৎজার: ঠিক আছে, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, মিস্টার ফ্রস্ট।
    ফ্রস্ট: কখনো পড়নি এমন কবির সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তোমাকে কিন্তু একজন সাহসী লোক হতে হবে।
    কর্নিৎজার: হ্যাঁ, আমার মনে আছে, আপনি নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘সাহস হলো সবচেয়ে দামি মানবিক গুণ। আর সীমিত জ্ঞানের ওপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়াই সাহসিকতা- এটাই কি আপনার দর্শন নয়, মিস্টার ফ্রস্ট?’

    কখনো পড়নি এমন কবির সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তোমাকে কিন্তু একজন সাহসী লোক হতে হবে

    ফ্রস্ট: হুম। প্রত্যেকেই বলেছে, সাহসই শ্রেষ্ঠ গুণ। তবে আমি যা বলেছিলাম তা হলো, আমরা সীমিত জ্ঞানের ওপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়ার কথা। একজন জেনারেলকে সীমিত জ্ঞান, অপর্যাপ্ত তথ্য এবং মোট কথা অপর্যাপ্ত সবকিছু নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হয়। আর কেউ একজন বলেছিল যে কোনো কবিকে কিছু লেখার আগে অন্য সব কবি যা বলেছিলেন, সেসব শিখতে হবে, যাতে সে পুনরাবৃত্তি এড়াতে পারে। যদি তিনি তা করেন, তাহলে শুরুর আগেই তো তাঁর বয়স পঞ্চাশ হয়ে যাবে। আর দুনিয়াতে যা কবিতা লেখা হয়েছিল, তার বেশিরভাগই তো পনেরো থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে লেখা শুরু হয়েছিল। সুতরাং, অপর্যাপ্ত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই তোমাকে শুরু করতে হবে এবং সেই সাহস তোমার থাকা চাই।
    কর্নিৎজার : যৌবনে আপনি জুতোর কারখানায় কাজ করেছেন। সম্পাদক, স্কুলশিক্ষক এবং কৃষক ছিলেন। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, এসবের ভেতর কোন পেশাটি আপনার পেশাগত জীবনে বেশি প্রভাব ফেলেছিল?
    ফ্রস্ট : আমি মনে করি কৃষিকাজটি আমার ওপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। আমি বরাবরই কৃষক ছিলাম, সেটা অন্য যে কোনো কাজ করার সময়ও। আমার বাড়ির উঠোনে সবসময় একটি খামার ছিল, এমনকি সান ফ্রান্সিসকোতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে সংবাদপত্রে কাজ করে আমি শিখতে পেরেছিলাম যে আমাকে আমার কাজগুলো শেষ করতে হবে। আমি না পারলে অর্ধেক লিখে রেখে দিতাম। আর শিক্ষক হিসেবে আমি আসলেই অনেক কিছু শিখেছিলাম। শিক্ষক হওয়ায় আমাকে সবাইকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হতো। এ কারণেই বোধহয় আমি এমন সব কবির তালিকায় পড়ি, যারা বোধগম্য কিছু লেখার চেষ্টা করেন।
    কর্নিৎজার : আপনি কবি হিসেবে বেশ দেরিতে পরিচিতি পেয়েছেন, ঊনচল্লিশ বছর বয়সে এবং আপনার প্রথম বইটি ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়েছিল, আমেরিকায় কেন নয় মিস্টার ফ্রস্ট?
    ফ্রস্ট : এটা অবশ্য প্রায় আকস্মিক একটা ঘটনা ছিল। বস্তুত আমেরিকায় কেউ কখনো আমাকে নিরুৎসাহিত করেনি। আবার খুব বেশি উৎসাহিতও করেনি। ম্যাগাজিনগুলোয় বিক্ষিপ্তভাবে কবিতা লিখতাম। তবে কেউ কখনো আমার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটি চিঠিও লেখেনি, উপরন্তু কিছু লোক আমাকে প্রত্যাখ্যান করে বসে। আমি পরিবারের জন্য কিছু একটা করার নিমিত্তে একটি উপন্যাস বা একটি নাটক লেখার ধারণা নিয়ে ইংল্যান্ডে আসি। সেখানে একদিন রাতে, মেঝেতে বসে আমি আমার কবিতাগুলো দেখছিলাম। এবং দীর্ঘক্ষণ নাড়াচাড়া করে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা মতো তৈরি করে তা এক অচেনা প্রকাশকের কাছে নিয়ে যাই। আর আশ্চর্য! এ ঘটনারতিনদিনের মধ্যেই প্রকাশক আমার সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আসলে, ব্রিটিশদের কাছে আমি খুব ঋণী এর জন্য। এটা এখানেও (আমেরিকায়) ঘটতে পারে; জানি না পারে কিনা। সেটা আমার কাছে এক দারুণ সময়ও ছিল। তারা আমাকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। আমি সেখান থেকে অনেকটা কবি পরিচিতি নিয়েই (আমেরিকায়) আমার নিজের বাড়িতে ফেরত এসেছি। তুমি জানো, আমি লিখি। কিন্তু এখানে কখনোই কোনোপ্রকাশকের সঙ্গে কোনোচুক্তি করিনি। এমনকি আমি জানতামও না যে, এখানে আমার একজন প্রকাশক রয়েছেন। আসলে হয়েছে কী, জর্জ ওয়াশিংটনের জন্মদিনের দিন আমি এখানে আসি। সন্ধ্যায় পাশের নির্জন রাস্তায় একাকী হাঁটছিলাম। হঠাৎই ‘দ্য নিউ রিপাবলিক’ নামের ম্যাগাজিন চোখে পড়ে, যার নাম আগে কোনোদিন শুনিনি। খুলে দেখি ওটার ভেতর‘হেনরি হল্ট অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে প্রকাশিত আমার বইয়ের একটা পর্যালোচনা, তা-ও সে প্রায় দুই বড় বড় কলাম জুড়ে! মূলত সেসময় থেকেই আমি হেনরি হোল্ট অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের কাছে আমি ঋণী।

    কৃষিকাজটি আমার ওপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। আমি বরাবরই কৃষক ছিলাম, সেটা অন্য যে কোনো কাজ করার সময়ও

    কর্নিৎজার : মিস্টার ফ্রস্ট, সময় সচেতনতা কি সার্থক কবিতা লিখতে সাহায্য করে? আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে জানতে পেরেছিলাম, আপনি আপনার ‘শীত সন্ধ্যায় বনের কিনারে’ (স্টপিং বাই উডস অব এ স্নো ইভিনিং) শিরোনামে সেই মনোমুগ্ধকর কবিতাটি প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে লিখেছিলেন!
    ফ্রস্ট : ওহ, হ্যাঁ, কম-বেশি তো অবশ্যই। খুব স্বল্প সময়ে, চট করে লিখে ফেলা।
    কর্নিৎজার : আপনি দয়া করে কি একবার এটি আবৃত্তি করবেন?
    ফ্রস্ট : তুমি আমার থেকে শুনতে চাচ্ছ?
    কর্নিৎজার : অবশ্যই।
    ফ্রস্ট : আচ্ছা! শোনো তবে-

    ‘শীত সন্ধ্যায় বনের কিনারে’

    এই বাড়ি কার জানি বলে মনে হয়!
    বুঝি বাড়ি তার ঐ গায়ে নিশ্চয়;
    জানবে না সে তো দেখছি দাঁড়িয়ে আমি
    বন তার হলো এখন তুষারময়।

    ঘোড়াটা ভাবছে ব্যাপার চমৎকার।
    খামার ছাড়াই কী যে লাভ থামবার,
    বন আর এই জমাট হ্রদের মাঝে
    আজকে সন্ধ্যা সবচে অন্ধকার।

    ভুল হয়ে গেছে ভেবে সে শব্দ করে
    নাড়ায় ঘুনটি, এবং বনের পরে
    শুধু আরেকটি শব্দ যাচ্ছে শোনা :
    হালকা বাতাসে বরফের কুচি ঝরে।

    কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে,
    কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকি আছে।
    যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে,
    যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।
    (অনুবাদ : শামসুর রাহমান)

    কর্নিৎজার : সত্যিই অসাধারণ, মিস্টার ফ্রস্ট। আচ্ছা! আপনার কি মনে হয়,পাঠ্যপুস্তকগুলো আপনার কবিতার অর্থ এবং চেতনার সঠিক ব্যাখ্যা দিচ্ছে? যেমন, উল্লেখিত কবিতাটিকে পাঠ্যপুস্তকে একটি আত্মঘাতী কবিতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্রেণিবিন্যাস সঠিক?
    ফ্রস্ট : এ তো ভয়ের ব্যাপার হে, তাইনা? তবে এটা স্রেফ পাঠ্যপুস্তক। অবশ্য আমি আমার চারপাশের মানুষ থেকে ভালো প্রতিক্রিয়াই পেয়েছি। পাঠ্যপুস্তকগুলোর লেখক আর সমালোচকদের বেশিরভাগ আমাদের কলেজগুলোতে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁদের মারফতে আমার জীবনযাত্রার এক-তৃতীয়াংশের খরচ মিটেছে। তারা আমার বইগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তারাই আমার জনতা। আমি নিজে রিভিউ পড়ি না, তবে লোক মারফত কিছু শুনি। মনে তো হয় তারা আমাকে ভালোভাবেই নিয়েছে। কলেজগুলো হলো আমার সবচেয়ে বড় পাঠক। বলতে পারো কলেজের অধ্যাপকরা আমার যত্ন নিয়েছেন। তবে আমার সবচেয়ে বড় ঋণ মিশিগানের আর্মহার্স্ট কলেজের কাছে। আমি সেখানে, ডার্টমাউথে দীর্ঘদিন থেকেছি। আর্মহার্স্টÑ হ্যাঁ আর্মহার্স্ট। বিগত পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে প্রায়কুড়ি বছর আলগাভাবে হলেও আমি আর্মহার্স্টের অন্তর্গত ছিলাম। জানো তো, আগেকার দিনে যেমন রাজা-গজা ধরনের পৃষ্ঠপোষকের খোঁজ করতে হতো লেখকদের, এখনো সেই অবস্থাই আছে। এদেশে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা আসে ওই কলেজগুলো থেকেই। এটা চল্লিশ বছর আগে ছিল না। তবে বলতে পারো আমি ওই কলেজ আর হেনরি হল্ট অ্যান্ড কোম্পানির ওপরেই মূলত টাকা-পয়সার জন্য নির্ভর করেছি।
    কর্নিৎজার : প্রাবন্ধিক এবং সমালোচকরা কখনো আপনাকে বলছে প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ কবি। আবার বলছে নিউ ইংল্যান্ড ইয়াঙ্কি, প্রতীকীবাদী, মানবতাবাদী, সংশয়ী, অ্যান্টি-প্লাটোনিস্ট এবং আরো বহু কিছু। এসবের কোনটাকে আপনি-
    ফ্রস্ট : কোনো একটিকে বিশেষভাবে গ্রহণ করি না। সবটাই আমার পছন্দ।
    কর্নিৎজার : আচ্ছা, আপনি নিজেকে কোন ধরনের কবি বলে মনে করেন, মিস্টার ফ্রস্ট?
    ফ্রস্ট : সেকেলে কবি। অবশ্য তোমাকে সেটা বলার মতো যথেষ্ট আত্মসচেতন মানুষ আমি নই। মূলত সবই পছন্দ করি। মানবতাবাদী বলা বেশ পছন্দ করি, যদিও আমি কঠোরভাবে মানবতাবাদী নই। তাছাড়া আমার মনে হয় মূলত আমি ‘প্রকৃতি কবি’ নই। মানুষের উপস্থিতি ছাড়া কেবল দুটি কবিতা আমি লিখেছি। মাত্র দুটি। আমার সব কবিতাতেই মানুষের উপস্থিতি আছে।
    কর্নিৎজার : আপনার মতো প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল একজন মানুষ কী বিশ্বাস করেন যে, প্রকৃতি মূলত সবার প্রতি দয়ালু?
    ফ্রস্ট : আমি জানি প্রকৃতি দয়ালু নয়। ম্যাথু আর্নল্ড বলেছিলেন,‘প্রকৃতি নিষ্ঠুর’। মানুষই রক্ত দেখে ক্লান্ত। তবে বেশি ক্লান্ত না। প্রকৃতি সর্বদা কম-বেশি নিষ্ঠুর হয়। তোমাকে একটা গল্প বলি, এক প্রফেসরের বাড়ির বারান্দায় একবার কী হয়েছিল। লোকটা আবার যাজকবৃত্তিও করত মনে হয়। যা-ই হোক, তখন যুদ্ধের সময়। সুন্দর এক চাঁদনি রাতের কথা। তিনি তাঁর বাড়ির বারান্দায় কিছু ছেলের সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে কথা বলছিলেন। বলছিলেন মানুষ একে অপরের প্রতি কতটা নিষ্ঠুর অথচ প্রকৃতির কেমন দয়ার শরীর। কেমন স্নিগ্ধ গ্রামীণ পরিবেশের চাঁদনি রাত। তিনি হাত নেড়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎই বনের মধ্যে একটি পাখি পাখা ঝাঁপটানো শুরু করল;মনে হয় তার ছোট্ট বাসায় কিছু একটা জানোয়ার আক্রমণ করেছে। বুঝলে প্রকৃতি এখানে কিন্তু নিষ্ঠুর। এবং অরণ্যের মাঝেও খুনোখুনি হয়। এখান থেকেই ওই‘সূর্যে স্থান পাওয়ার’ (a place in the sun) অভিব্যক্তিটি এসেছে। একটি বৃক্ষ সূর্যের ভেতর স্থান পাওয়ার জন্য ব্যাকুল অথচ বাকি গাছগুলো সেটা হতে দেবে না।

    একটি বৃক্ষ সূর্যের ভেতর স্থান পাওয়ার জন্য ব্যাকুল অথচ বাকি গাছগুলো সেটা হতে দেবে না

    কর্নিৎজার : আমার যদ্দূর জানা, আপনার বয়স যখন মাত্র দশ, তখন আপনার পিতৃবিয়োগ হয়। আপনার বাবা সানফ্রান্সিসকো পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আপনার সুস্পষ্ট স্মৃতি কী?
    ফ্রস্ট : তিনি সাঁতারু ছিলেন। ঘণ্টায় ছয় মাইল ধরে হাঁটতে পারতেন। রাজনীতিতে অত্যন্ত। উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং খুব অল্প বয়সেই সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সাঁতারের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সানফ্রান্সিসকো বে-তেদীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটতেন তিনি। একবার ডুব দিতেন আবার দীর্ঘক্ষণ পর আরেক প্রান্তে ভেসে উঠতেন। সন্ধ্যার আলোয় সে দৃশ্য আমার আজো মনে আছে। বাবার সঙ্গে আমরা অনেকটা সময় থাকতাম।আমি খুব বেশি স্কুলে যাইনি। যে বছর গ্রোভার ক্লেভল্যান্ড প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছিল, সেবার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে প্রচার প্রচারণায় গিয়েছি। সারাদিন তার সঙ্গে একটি ঘোড়ার গাড়িতে ছিলাম। আসলে, আমার কাছে তিনি অত্যন্ত কঠিন, আপসহীন হলেও তার সঙ্গে আমার আড়ম্বরের সম্পর্ক ছিল না। তিনি নিয়মিত চৌঠা জুলাইয়ে ঘটা করে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস পালন করতেন।
    কর্নিৎজার : বুঝতে পেরেছি, আপনার বাবা একজন অনুশাসনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। প্রায়ই হয়তো ছোটখাটো অপরাধের জন্য আপনাকে শাসনও করতেন। আপনার বাবার মতো আপনিও কি আপনার সন্তানদের প্রতি শক্ত মনোভাব দেখান?
    ফ্রস্ট : এ প্রশ্নটা আমি আমার বাচ্চাদেরই করতে চাই। মনে হয়, মাঝে মাঝে আমি বিশ্রী রকমের দুষ্টুমিও করতাম, মনে হয়।
    কর্নিৎজার : আপনার বাবা মারকুটে ডেমোক্র্যাট ছিলেন। রিপাবলিকানদের ঘৃণা করতেন। তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল! রাজনীতি কি কখনো আপনার কবিতায় এসেছে?
    ফ্রস্ট : খুবই কম। তবে আমি সর্বদাই রাজনীতিতে আগ্রহী। কলেজ হোক বা অন্য কোথাও- যেকোনো কমিউনিটি থেকেই রাজনীতির ভেতর আমি খুব দ্রুত ঢুকে পড়ি। আমি রাজনৈতিকভাবে সচেতন, এটা সম্ভবত বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে থাকার কারণে হয়েছে। তাই বলে আমি রিপাবলিকানদের ঘৃণা করি তা না। তোমার সঙ্গে প্রথম দেখার সময় আমি সেটা তোমায় বলেছিলাম। অথবা তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি কোথাও কোনো এক বইতে পড়েছ যে আমার বাবা মনে করতেন সব রিপাবলিকানরাই হিপোক্রেট, সাদা চামড়ার প্রাচীনপন্থী। অথচ আমি তেমনটা মনে করি না। নির্বাচনে হ্যানককের ব্যর্থতার পর জেনারেল হ্যানককের একটি ক্যাম্পেইনিং বায়োগ্রাফি বাবা রাগের চোটে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি হেরে গিয়ে নিজে যেচে নির্বাচিত জেনারেল গারফিল্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। আমার বাবা ভেবেছিলেন, একজন ডেমোক্র্যাটিকের পক্ষে রিপাবলিকানের সঙ্গে হাত মেলানো এক বড় ধরনের হিপোক্রেসির উদাহরণ। তিনি সেই ক্যাম্পেইন বায়োগ্রাফিটা পোড়ালেন। মনে আছে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, বইটা কই রে? তিনি ভেতরের পাতাগুলো মেলে ধরলেন, তারপর দেয়াশলাই দিয়ে ফস করে আগুন ধরিয়ে সেটা স্রেফ ছুড়ে ফেলে দিলেন ফায়ারপ্লেসে।

    ডেমোক্র্যাটিকের পক্ষে রিপাবলিকানের সঙ্গে হাত মেলানো এক বড় ধরনের হিপোক্রেসির উদাহরণ। তিনি সেই ক্যাম্পেইন বায়োগ্রাফিটা পোড়ালেন

    কর্নিৎজার : রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ীদের কথা কম শুনে কবিদের কথা আরো বেশি শুনলে কি বিশ্বের আরো উন্নতি হতো না?
    ফ্রস্ট : মুনাফার বণ্টন নিয়ে আমার অসন্তুষ্টি নেই। এটা সর্বকালে এমনই ছিল। আসলে কবিতার তেমন কিছুই বলার নেই তার নিজের সময়ে। হোমার সময়ের সম্পর্কে বলা হয়, ‘যে সাতটি শহরে জীবিত হোমার একসময় রুটি ভিক্ষা করেছিলেন, তারাই তার মৃত্যুর বহু বছর পর তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করেছিল। কবিতা তার যতটুকুপ্রাপ্য পেয়ে যায়। কবিতা একটা বড় মেশিনের খুব ছোট অংশের মতো। ছোট তবে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা লিখে কিছু হলো না জাতীয় নিন্দেমন্দ শুধু তারাই করে, যারা আসলে কবিতা লিখতে জানে না অথবা কবিতা বেচতে পারে না। এরা মনে করে পৃথিবীরই সব দোষ। কিন্তু এভাবে দেখাটা আসলে ঠিক নয়। কবিতাকে অবহেলার সঙ্গে দেখা হলেও এটা কিন্তু কবিতার জন্যই বরং ভালো। সব ধরনের আর্টের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। কেউ কেউ তো এও মনে করে শিল্পীদের কিছু ফাউন্ডেশন মানি দিলেই চলবে। এর বেশি দরকার নেই।
    কর্নিৎজার : আচ্ছা, আপনি কি সাহিত্যের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট?
    ফ্রস্ট : হ্যাঁ।
    কর্নিৎজার: বর্তমান আমেরিকার প্রেক্ষাপটে বলছেন?
    ফ্রস্ট : হ্যাঁ। যথেষ্ট সন্তুষ্ট। আমি জানি না আর কী হবে। আমি সবসময় আরো লেখক, আরো কবিদের চাই। সত্যি বলতে কি, এই একটা চাওয়া যেটা হৃদয়ের অন্তস্তল থেকেই চাইছি। তবে কবি লেখকদের সংখ্যা বাড়ছে। উনিশ শো পনের থেকে পঁচিশের মধ্যে তো কবি-সাহিত্যিক তৈরির একটা গণজোয়ার এসেছিল। হয়তো এখন অত বড় কেউ একটা নেই। হার্টের ভাল্ব খোলে বা বন্ধ হয়, জানো তো।
    কর্নিৎজার : তরুণরা কি প্রতিশ্রুতিশীল?
    ফ্রস্ট : হ্যাঁ, বলা যায়। আমি তাদের অনেককেই চিনি। তুমি জানো কিনা, এদের মধ্যে অন্তত অর্ধ ডজনদের নিয়ে সম্ভাবনা আমি দেখি। তুমি এখনই খুব বেশি কিছু বলতে পারবে না। তবে তাদের মধ্যে এমনও আছে কবিতা লেখা ছেড়ে ব্যাংকের কেরানি হয়ে গেছে।
    কর্নিৎজার : আমার মনে হয়, আপনি একজন আশাবাদী, মিস্টার ফ্রস্ট। আমি কি ঠিক ধরেছি?
    ফ্রস্ট : আমি আশাবাদী কিনা এটা জানতে চাইছো?
    কর্নিৎজার : মানে আপনি হতাশবাদী না আশাবাদী?
    ফ্রস্ট : তুমি বলো, তুমি কি হতাশবাদী?
    কর্নিৎজার : আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি।
    ফ্রস্ট : বলো না, তুমি কোনটা?
    কর্নিৎজার : হুম, আমার বিশ্বাস আছে।
    ফ্রস্ট : তোমার বিশ্বাস আছে?
    কর্নিৎজার : হ্যাঁ।
    ফ্রস্ট : তার মানে আশাবাদী মানেই বিশ্বাসী, এই তো?
    কর্নিৎজার : হ্যাঁ, আমার যুক্তি তো সেটাই বলছে।
    ফ্রস্ট : দাঁড়াও, এই ব্যাপারটা খোলাসা করছি। তুমি বলতে চাইছ যে আশাবাদীরা ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশা পোষণ করে থাকে?
    কর্নিৎজার : হ্যাঁ।
    ফ্রস্ট : সেই অর্থে আমি কেবল ভবিষ্যতেরই আশা করি না, বর্তমান এবং অতীতকে নিয়েও আমার আশা রয়েছে।
    কর্নিৎজার : মানে ঠিক বুঝলাম না। এর অর্থ?
    ফ্রস্ট : আশা এই অর্থে যে অতীতে যা ঘটে গেছে সেটা ওই অতীতের বিচারে ঠিকই আছে। আর আমাদের বর্তমানও তো তাই। আমি আশা করি বর্তমানও বর্তমানের বিচারে ঠিকই আছে আর এভাবেই এটা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেবে। তুমি কী চাও, আরেকটু খুলে বলি ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে আমাদের বর্তমানকে?
    কর্নিৎজার : খুব খুশি হব।
    ফ্রস্ট : ইতিহাস আমাদেরকে মনে করিয়ে দেবে যে এই বর্তমানটি হলো সভ্যতা এবং আমাদের কল্পনার ইউটোপিয়ার মধ্যকার ফারাক। ইউটোপিয়া হচ্ছে শেষ পরিণতি, বলতে পারো সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত উপসংহার। আমরা আবারো পার্থক্য খুঁজছি, কী বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে আর কী পড়ে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছু বিজ্ঞানের কাঁটায় মাপা যায় না। যদি আমাদের সময়ের কোনো খুঁত থেকে থাকে, সেটাকেও ভালো চোখে বর্ণনা করতে পারাটা দরকার। এটা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা যে সে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। বিজ্ঞানের সামর্থ্যরে বাইরের বিষয় নিয়েও আমরা আশা করে গেছি। দেখো, বিজ্ঞান যতটুকু পারফর্ম করতে পারছে, তার চেয়ে বেশি আমাদের প্রত্যাশা।

    মানুষ তোমাকে এর উল্টোটা বলবে। তারা বলবে সতর্ক হওয়ার মধ্যেই মুক্তি। অথচ সাহসী হওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সত্যিকারের মুক্তি

    তুমি একজন আত্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানীর কাছে যাও, দেখবে সে বলবে যে বিজ্ঞান নাকি এতদূর চলে গেছে যে এটি আর কতটা দূর যেতে পারবে না- এটা ভাবাও ধৃষ্টতা। দেখো এই মুহূর্তে তোমাকে আমি বলছি, আমাদের জীবনের অর্ধেক জিনিসই বিজ্ঞান দিয়ে মাপা চলে না। এই সীমাবদ্ধতাটুকু সম্পর্কে আমরা আমাদের বর্তমানের বাকি সময়গুলোতে আরো জানব। ইতিহাস এভাবেই আমাদের বর্তমানকে মনে রাখবে।
    কর্নিৎজার : ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত আপনার কাব্যসমগ্রের পরিচিতিতে আপনি একটা কথা বলেছিলেন, মি. ফ্রস্ট। আমি ওটা পরে মুখস্থ করার চেষ্টা করব; আমার মনে হয়েছে ওটা আপনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটা বিবৃতি।আপনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার গণতান্ত্রিক হীনম্মন্যতা ছেড়ে দিয়েছি। আমি মনে করি উঁচু শ্রেণির দরকার নেই সমাজের নিচু শ্রেণিতে যাদের বসবাস, তাঁদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা।’ আপনি আরো বলেছিলেন, ভুল বললে শুধরে দেবেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমার কাছে কিছুই নয়। আমিই এটিকে বাম এবং ডান নাম দিয়েছি।’ আমি কি ঠিক বলছি, মিস্টার ফ্রস্ট?
    ফ্রস্ট : হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।
    কর্নিৎজার : আপনি আপনার ওই কথায় কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়নি।
    ফ্রস্ট : দেখো, মূলত সেখানে দুটি বিষয় আছে, যা আমি নতুনভাবে বলতে চেয়েছি। যেন নিন্মশ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাকে রীতিমতো জোর করা হয়েছে। ব্যাপারটা এরকম, তারা যাতে বীমার আওতাভুক্ত থাকতে পারে, এজন্য প্রতি সপ্তাহে তাদের বেতনের কিছু অংশ আটকে রাখার দায়িত্ব যেন আমার। মানে আমি বলছি এভাবে করে আরো গভীরে গেলে এ রকম আরো উদাহরণ পাবে।(সমাজের উপরতলার লোক হিসেবে) আমি এসবের দায়িত্ব নিতে কেয়ার করি না। নাহ, ভুল বললাম। কেয়ার করি। তারা আমাকে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে এতে আমি খুশি। তবে ঠিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা শুধু নয়, আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
    কর্নিৎজার : বুঝতে পেরেছি।
    ফ্রস্ট : হ্যাঁ, আসলেই সবসময় এমনটাই হয়েছে, এখানে এবং অন্য কোথাও।
    কর্নিৎজার : আপনার কয়েকটি কবিতায় কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে এই দর্শনটা পাওয়া যায়, এই যেমনটি আপনি এখন বললেন।
    ফ্রস্ট : উদাহরণ হিসেবে (আমার কবিতা) ড্রামলিন উডচাকের কথা ধর, যেখানে এক লোক নিজের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিজেই তৈরি করছে। অথচ দেখো কীরকম অগণতান্ত্রিকভাবে আমাদের উচ্চ শ্রেণির লোকেরা নিন্মবিত্তদের সুরক্ষা প্রদান করার কথা ভাবছে। আমি এ জিনিসটাই বলতে চেয়েছি।
    কর্নিৎজার : আপনি মৌলিকতা এবং উদ্যোগ বা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন একবার। আপনি কি এর মাধ্যমে কবিতা বা সাধারণ আমেরিকান জীবনে প্রয়োগ করার জন্য এটি বলেছিলেন?

    বায়রন কোথাও একবার বলেছিলেন, কারাগারের প্রকোষ্ঠেও স্বাধীনতা জ্বলজ্বল করে, কারণ এর অবস্থান মানব হৃদয়ে। এ ধরনের স্বাধীনতা অবশ্য বরদাস্ত করা কষ্টের

    ফ্রস্ট : সাধারণভাবে আমেরিকান জীবনের কথা বলেছিলাম। আমি বলতে চেয়েছিলাম স্বাধীনতার কথা। চিন্তার মৌলিকত্ব ও তদনুযায়ী উদ্যেগ গ্রহণ করতে পারা যেটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় মুক্তি। মানুষ ভয় পায় সাম্যের কথা বলতে কারণ তারা মনে করে স্বাধীনতার উল্টোটা হচ্ছে সাম্যতা। এখন সবাই যদি একইভাবে চিন্তা করে ও পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সেটা তো আর মৌলিক রইল না। স্বাধীনতার ধারণাটাই একটা বড় রহস্য। আমার মনে হয় এক ফরাসিরা ছাড়া আমরা (আমেরিকানরা) সবচেয়ে বেশি এই স্বাধীনতা শব্দখানা ব্যবহার করেছি। তুমি যখন চিন্তা কর যে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য তুমি তোমার কিছু স্বাধীনতা ছেড়ে দেবে, তখন দ্বন্দ্বটা আসে ঠিক যখন ভেবে দেখতে হয় যে ঠিক কতটুকু স্বাধীনতা তোমায় ছাড়তে হবে। কিন্তু স্বাধীনতা এমন এক শক্তি, যেটা সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। এমারসন একবার বলেছিলেন, ঈশ্বর মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার পরপরই আকাশ থেকে সূর্য সরিয়ে দেবেন। স্বাধীনতা মানুষের বুকের গভীরে থাকে। আর যা কিছু ইতিহাস, তা এই কথাই বলে। বায়রন কোথাও একবার বলেছিলেন, কারাগারের প্রকোষ্ঠেও স্বাধীনতা জ্বলজ্বল করে, কারণ এর অবস্থান মানব হৃদয়ে। এ ধরনের স্বাধীনতা অবশ্য বরদাস্ত করা কষ্টের। আমরা এখানে সাধারণ স্বাধীনতার কথা বলছি যেটা আমাদের মুক্ত করবে- ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা দেবে। আমাদের জাতীয় পরিচয় তৈরি করবে। আমিআন্তর্জাতিক আবার সেই সঙ্গে অন্তর্বাদীও বটে। আমার মতো ধ্যাণ-ধারণা যারা পোষণ করেন, তাঁদের সঙ্গে মেলামেশায় আমার আগ্রহ।আমি চাই আমার দেশ এমন একটা স্মার্ট পরিচয় তৈরি করুক, যেটা সব দেশের সঙ্গে মানানসই। এভাবেই একটা সত্যিকার আন্তর্জাতিকতা তৈরি হতে পারে। নইলে সব ভজঘট পেকে যাবে। আমাদের মনের খোরাকিই হচ্ছে চিন্তা বা একে অপরের সঙ্গে চিন্তার পার্থক্য যা আমরা বহন করি আমাদের জীবনে-আনন্দ, বিষাদ, যুদ্ধ, বেদনা সব সময়ে। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে চিন্তা করতে পারার সাহস এবং সেই সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। কোনো এক কবি বলেছিলেন, জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে সতর্কতার সঙ্গে সাহস দেখিয়ে এগোনো। সাহস আগে, তারপর সতর্কতা (হওয়া উচিত)।সতর্কতা হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা লাগে সেই সম্পর্কিত জ্ঞান, তথ্য বা অন্য কিছু। কাজেই সতর্কতাই হচ্ছে নিরাপত্তা। আর সাহসিকতাই হচ্ছে স্বাধীনতা, যা সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে এগিয়ে চলে, সত্যিকারের আজাদি। সত্যিকারের আজাদির মধ্যেই সাহসিকতা থাকে। কিন্তু মানুষ তোমাকে এর উল্টোটা বলবে। তারা বলবে সতর্ক হওয়ার মধ্যেই মুক্তি। অথচ সাহসী হওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সত্যিকারের মুক্তি।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.