Author Picture

ত্বহা হুসাইনের দিনগুলি

কাউসার মাহমুদ

পনেরো.

সূফী ঘরনার শায়খ। সূফী শায়খ মানে কি? কারা তারা? তারা ছিল অসংখ্য। সমস্ত ভূমির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল যারা এবং শহর যাদের থেকে খুব কমই খালি ছিল। তাদের মতবাদ ছিল আলাদা আলাদা। লোকদের বিভক্ত করে অতপর নিজেরা বিভিন্ন দলে পরিণত হয়। এমনকি তারা তাদের আবেগ ও ভালোবাসাগুলোও খুব বড় মাত্রায় ভাগ করে। যেমন, ওই অঞ্চলে সূফীদের দুই দলের পরিবারের মাঝে ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যাদের একদল ধরে রেখেছিল প্রদেশের উপরীভাগ, অন্যরা দখলে রেখেছিল নীচের অংশ। কিন্তু অঞ্চলের লোকেরা যেহেতু সাধারণ চলাফেরাই করে এবং গ্রাম থেকে গ্রাম বা শহর থেকে শহরে অভিবাসনের কোনো চিন্তাই ছিলো না তাদের, তবু একবার এক পরিবারের অনুসারীরা নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করে, যেখানে আগ থেকেই বিরোধী পরিবারের প্রভাব ছিল। ফলে এই দুই পরিবারের নেতারা প্রায়ই এখন তাদের অনুসারীদের সাক্ষাতে ওই এলাকায় যাতায়াত শুরু করে। আর আল্লাহই জানে, সেদিন কী বৈরীভাব ও শত্রুতাটাই না জেগে উঠত; যেদিন উপরিভাগের নেতা নীচ অঞ্চলে অথবা নীচ অঞ্চলের নেতা উপরে বেড়াতে আসত!

শায়খ এর যেকোনো দর্শনই পরিবারের মজুদকৃত গম, ঘি, মধু ইত্যাদি বস্তুসমূহের বিরাট একটি অংশ ধ্বংসের কারণ হত। অধিকন্তু এ আগমন বাড়ির কর্তাকেও অতিরিক্ত ঋণগ্রহণে বাধ্য করত। কেননা শায়খ এর আপ্যায়নে প্রয়োজনীয় ছাগ ও মেষ কিনতে হত তার। আর শায়খও নিদেনপক্ষে পর দিনটা থাকার মনস্থ না করে এ বাড়িতে পা রাখত না।

আমাদের বালকের পিতা ছিল উচ্চ অঞ্চল প্রধানের অনুসারী। তার থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করা হয়ছে, যেভাবে বহুবছর আগে তার পিতার থেকেও গ্রহণ করা হয়েছিল। তাছাড়া বালকের মা’ও উচ্চ অঞ্চল প্রধানের অনুসারী ছিলেন অবশ্যই। অধিকন্তু তার (মায়ের) বাবা ছিলেন ওই নেতার অন্যতম বিশেষ সহযোগী ও অন্তরঙ্গ শিষ্যদের একজন। যাহোক, তো ওই উচ্চ অঞ্চলের নেতা মৃত্যুর পর তার ছেলে এখন তার স্থলাভিষিক্ত। তিনি একজন হাজি এবং বাবার চেয়েও বহুগুণ সক্রিয়। কৌশল, শত্রুতা আর ঝগড়াবিবাদ জাগানোর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। পার্থিব বিষয় আশয়ে সে ছিল বাবার চেয়ে অনেক নিকটে এবং ধর্মীয় বিষয়াদিতে ছিল বহু, বহুদূরে। তা বালকের পিতা প্রদেশের নীচ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে ওখানেই থিতু হয়েছিলেন। ওদিকে উচ্চ অঞ্চল প্রধানের প্রতি বছর তার ওখানে একবার সাক্ষাতের অভ্যেস ছিল। ফলে যখন তিনি আসতেন তখন একা বা গুটিকয় সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আসতেন না। বরং শিষ্যদের বিরাট এক দল নিয়ে তবেই ওখানে আগমন করতেন। যেন নিদেনপক্ষে একশো লোক না নিলে কোনোভাবেই তার দল পুরো হত না। আর এখানে ভ্রমণে কখনোই তিনি ট্রেন বা নৌকায় আসতেন না। পরিবর্তে ঘোড়া, গাধা, খচ্চরে আরোহী তার শিষ্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত পথেই তিনি এগিয়ে যেতেন। এভাবে যখন তারা গ্রাম ও ছোট শহরগুলো অতিক্রম করে যায়, তখন প্রবল প্রতাপ ও মহিমান্বিত হয়ে এমনসব স্থানে অবতরণ করত; যেন সেখানে তারা ভিন্ন অন্য কোনো রাজাধিরাজ নেই। তদুপরি এমন সব জায়গায় একত্রিত হত; যেখানে প্রতিপক্ষও তাদের মত শক্তিশালী ছিল। এভাবে তারা বালকের পরিবার সঙ্গে সাক্ষাতে আসত। এবং যখন তারা এখানে উপস্থিত হত, তখন তাদের ঘোড়া, গাধা আর খচ্চরে সমস্ত পথঘাট পূর্ণ হয়ে যেত। মূলত বাড়ির নিকটস্থ ঐ খাল থেকে এর দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত তারা দখল করে নিয়েছিল। তাদের জন্য মেষশাবক জবাই করা হত এবং পথের ওপর টেবিল বিছানা হত। এরপর খুব শিগগির ইচ্ছে মত তারা তাদের ভূরিভোজ সারত। পরিমাণে যা ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য।

শায়খ তখন বাড়ির অতিথিশালায় বন্ধু ও ভক্তদের নিয়ে বসেন। আর বাড়ির মালিক ও তার পরিবারবর্গ শায়খ এর সামনে তার আদেশ পালনে বিনয়ের সাথে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে যখন তারা দুপুরের আহার শেষ করে তখন শায়খককে বিশ্রামের জন্য একাকী রেখে রেখে সবাই বেরিয়ে আসে। ফলে শায়খ তার প্রয়োজনমত ঘুমিয়ে নেন। এরপর জেগে ওঠে অযু করেন এবং দেখেন, কীভাবে লোকেরা তাকে অযুর পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা ও পরস্পর ঝগড়া করে! আর যখন তা সম্পন্ন হয় তখন আরও আশ্চর্যের বিষয়টি হলো, লোকেরা তার অযুর অবশিষ্ট ওই পানি-পানের জন্য কী উদ্বাহু হয়েই না পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়! কিন্তু শায়খ তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে নিজের চিন্তাতেই আচ্ছন্ন থাকেন। দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ পড়েন ও মোনাজাত করেন। তা সম্পন্ন করে স্থির হয়ে জনসাধারণের জন্য বসেন। তখন লোকেরা তার দিকে পঙ্গপালের মত ছুটে আসে। কেউ তার হাত চুম্বন করে ভীত হয়ে পেছনে চলে আসে, কেউ কয়েক মুহুর্ত কথা বলার অভিপ্রায়ে সামনে এগিয়ে যায়, কেউবা আবার তাদের নানাবিধ প্রয়োজনের কথা বলে। জবাবে শায়খ তাদের এমনই অদ্ভুত, অবোধ্য এক অভিব্যক্তির অবতারণা করেন; যা তারা তাদের পছন্দমতো ব্যখ্যা করতে পারে। এভাবে একপর্যায়ে বালককেও তার কাছে আনা হয়। তখন তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে কোরানের এই আয়াত পাঠ করেন, ‘এবং তোমার ওপর আল্লাহর অসীম করুণা রয়েছে।’*

মূলত সেদিন থেকেই বালকের বাবা এই ভেবে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তার ছেলে মহান কেউ হওয়ার জন্য নির্ধারিত। এসময় মাগরিবের ওয়াক্ত হলে তারা নামাজ আদায় করে এবং এরপরই তাদের আহারের আয়োজন করা হলে তারা খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়। তারপর এশার নামাজান্তে পুনরায় তাদের বৈঠক বসে। বৈঠক মানে হলো তারা সকলেই জিকিরের জন্য গোল হয়ে বসে। শান্ত সমবেত হয়ে আল্লাহর জিকির করে। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হলে ধীরেধীরে তারা তাদের মাথা নাড়াতে থাকে এবং কণ্ঠস্বর সামান্য উঁচু করে। এরপর হঠাৎ এক কম্পন তাদের শরীরে বয়ে যায় এবং তৎক্ষনাৎ তারা দাঁড়িয়ে যায়। এমন, যেন হঠাৎই তারা পেঁচ দিয়ে বাতাসে লাফিয়ে উঠেছে। শায়খ তখন ওই বৃত্তের চারধারে ঘুরেঘুরে ইবনে ফরিদের কবিতা ও এমন অন্যান্য কবিতাসমূহ অনবরত আবৃত্তি করতে থাকেন। যদিও বিশেষত তিনি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসরা ও মিরাজ* সংক্রান্ত কবিতাগুলোই আবৃত্তি করতে বেশি ভালোবাসতেন। যেমন, কাব্যগুলোর শুরুর একটি পঙক্তি ছিল এই : ‘মিন মক্কাতা ওয়াল বাইতিল আমজাদ/ লিলকুদসি সা-রা লাইলান আহমাদ।’
এভাবে শায়খ অনবরত তার কবিতা ও সঙ্গীত সুর করে গাইতে থাকেন, তখন যাকেররাও (যারা যিকির করে) সেই সুরের সাথে তাদের শরীর চালনা করেন। কখনও নমিত, কখনওবা সোজা ভঙ্গিতে-যেন শায়খই তাদের নৃত্য করাচ্ছিল। সুতরাং বালক সবকিছু ভুলে গেলেও কোনোদিন সেই রাতের কথা ভুলবে না, যেদিন আবৃত্তিকারীদর একজন ভুল করেছিল। মূলত গীতিকাব্যের কোনো একটি শব্দের স্থলে অন্য শব্দ বলেছিল সে। এই শুনে শায়খ যেন মুহুর্তে রাগে জ্বলে ওঠেন। চিৎকার করে বলেন, ‘এই কুত্তার বাচ্চা! তোর বাপ, দাদা, পরদাদা, তার বাবা, তার দাদা এমনকি আদম নবী পর্যন্ত সবার ওপর খোদার লানত। তুই কি এই বাড়ির লোকজনের ওপর ধ্বংস আনতে চাস, নচ্ছার কোথাকার!’

ফলে বালক আর যা-কিছু ভুলুক না কেন, কখনোই সে যাকের (যিকিরকারী) এবং ওখানে উপস্থিত অন্য সকলের ওপর ওই ক্রোধের প্রভাবের কথা ভুলবে না। যেন এটা ঠিক এমন যে, লোকেরা দৃঢ় বিশ্বাস করে নিয়েছিল পদ্যের ভেতর এই যে ভুল; এটা কোনো অশুভ কিছুরই ইঙ্গিত হবে। আসলে যার সাথে অশুভতার কোনো সাদৃশ্যই নেই।
এতে বালকের পিতা প্রথমত তার উৎকণ্ঠা ও ভীতভাব প্রকাশ করেন। অবশ্য এরপরই সে শান্ত ও স্থির হয়ে যান। এভাবে পরদিন যখন শায়খ প্রস্থান করেন। তখন তার চলে যাওয়ার পর পরিবারের লোকেরা তার সম্বন্ধে ও যিকিরকারী ও আবৃত্তিকারদের বিষয়ে কথাবার্তা বলে যে, তাদের মাঝে কি কি ঘটেছিল! এই শুনে তখন তিনি এমনই এক হাসি হাসেন, যা দেখে বালকের নিশ্চিত বিশ্বাস হয়েছিল, তার বাবার বিশ্বাসও এই শায়খের ব্যপারে সন্দেহ ও ঘৃণা থেকে মুক্ত নয়।… হ্যাঁ সত্যি সন্দেহ ও ঘৃণাই! কেননা নিঃসন্দেহে শায়খের লোভ লালসা এমনই স্পষ্ট যে, সামান্যতম বিবেকবুদ্ধি যার আছে, সেই তা বুঝতে পারবে। আর যে মানুষটা শায়খকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করত এবং তার প্রতি ছিল যারপরনাই রুষ্ট; তিনি ছিলেন বালকের মা। শায়খ এর আসার কথা শুনলেই তার গা রি-রি করত। আর চলে আসলে মনে হত লোকটার উপস্থিতিই অসহ্যকর। যেন তার ছায়াও বোঝা মনে হয় তার কাছে। ফলে তার যেমন থাকার তিনি থাকেন এবং যা-কিছু প্রস্তত করার ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের সাথে তা করেন। যদিও এসময় বহুকষ্টে তিনি তার জিহবা সংযত রাখেন। আর এসবের কারণ হলো, সবসময়ই শায়খের মোলাকাত এই পরিবারের ওপর বিশাল এক বোঝা; যা কিনা কিছু সময়ের আরামদায়ক পরিস্থিতি ছিল মাত্র; কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ দারিদ্র্যতার ওপর। আদতে শায়খ-এর যেকোনো দর্শনই পরিবারের মজুদকৃত গম, ঘি, মধু ইত্যাদি বস্তুসমূহের বিরাট একটি অংশ ধ্বংসের কারণ হত। অধিকন্তু এ আগমন বাড়ির কর্তাকেও অতিরিক্ত ঋণগ্রহণে বাধ্য করত। কেননা শায়খ এর আপ্যায়নে প্রয়োজনীয় ছাগ ও মেষ কিনতে হত তার। আর শায়খও নিদেনপক্ষে পর দিনটা থাকার মনস্থ না করে এ বাড়িতে পা রাখত না। এরপর যখন সে প্রস্থান করত; তখন যা কিছু তার ভালো লাগে ও দামী, সবকিছুই সঙ্গে করে নিয়ে যেত। যেমন একবার সে পুরু কার্পেটখানা নেবে তো পরেরবার কাশ্মিরী শালটা। এভাবে এজাতীয় যা-কিছু তাকে মুগ্ধ করবে,সবই তার বগলদাবা হবে।

তবে এও ঠিক যে, শায়খ ও তার অনুসারীদের সাক্ষাৎ পরিবারটিকে কঠিনভাবে চাঙা করে তুলত। কেননা এতে প্রতিবেশীদের মাঝে তাদের সম্মান ও দম্ভ বেড়ে যেত বহুগুণ। কিন্তু তবু তারা এটা ঘৃণা করে। কেননা যাচ্ছেতাইভাবে তাদের টাকা খরচা হয় এতে। সেইসাথে ঝক্কিঝামেলার কথা তো অবর্ণনাতীত। আদতে এ ছিল একটা অনিবার্য শয়তানি। যা বহুকালের প্রথা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং যা কিছু মানুষের আকাঙ্খা পূরণ করে। সুতরাং এখন এই বাড়িটির সাথে আধ্যাত্মিক পথের অনেক বিষয়াদিই খুব গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। যা তাদের কাছে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনার কথা ও আশ্চর্য গল্পগাথাসমূহের অনন্ত নিদর্শন প্রোথিত করে দিয়েছে। বালকের পিতামাতা যা তাদের সন্তানদের বেশ আগ্রহ করে শোনাতেন। আর বিশেষত মা কখনো সুযোগ পেলেই নিন্মোক্ত ঘটনাটি শোনাবার সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একবার আমার দাদীকে নিয়ে শায়খ খালিদের সঙ্গে হজের সফরে যান। ইতিপূর্বে শায়খ অবশ্য তিন তিনবার হজ পালন করেছিলেন এবং প্রতিবারই বাবা তার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এবার আমার দাদিও তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। তো যখন তারা হজ সম্পন্ন করে মদিনার পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আমার দাদি উট থেকে পড়ে যান এবং তার শরীরের একপাশ খুব মারাত্মকভাবে ভেঙে যায়। ফলে কোনোপ্রকার হাঁটাচলা ও নড়াচড়া করতে অক্ষম হয়ে পড়েন তিনি। এতে তার ছেলে মানে আমার বাবাই তাকে সর্বত্র বহন করে নিয়ে যেতে থাকেন। কিন্ত পথ যেহেতু দীর্ঘ আর সফরও অনেকদিনের। তাই এভাবে এতে বিরক্ত হয়ে একপ্রকার অভিযোগের স্বরেই একদিন তিনি শায়খ খালিদের কাছে বিষয়টি জানান। জবাবে শায়খ তাকে বলেন, ‘তুমি কি এ কথা স্বীকার করো না যে তিনি (মা) হাসান বিন আলির বংশপরম্পরায় নবিজির বংশধর? ’ ‘জ্বি নিশ্চয়।’

প্রতিত্তোরে শায়খ বলেন, ‘তাহলে! শোনো, তিনি তার পরদাদার কাছে যাচ্ছেন। সুতরাং যখন তুমি মসজিদে নববীর কাছে আসবে, তখন ধীরে তাকে একপাশে নামিয়ে দেবে এবং কিছুই বলবে না। তার পরদাদা তার সঙ্গে যেমন ইচ্ছে আচরণ করবেন।’ শায়খ এর কথা মতো বাবা ঠিক তাই করেন। অর্থাৎ যখন তারা মসজিদে নববীর কোনো এক প্রান্তে এসে উপনীত হন, তখন তিনি তার মা-কে আলগোছে তার পিঠ থেকে নামান এবং বেশ আদুরে ও ভালোবাসা মিশ্রিত কর্কষ কণ্ঠে বলেন, ‘নাও। তুমি তোমার দাদার কাছে এসেছো। এখন আমার আর কোনো মাথাব্যথা নেই।’ এরপর তিনি তাকে ছেড়ে শায়খ এর সঙ্গে নবিজির রওজা যিয়ারতের জন্য চলে আসার মনস্থ করেন। এ জায়গায় এসে বাবা বলেন, ‘আল্লাহর কসম! কয়েক কদমও অতিক্রম করিনি, অমনি আমি আমার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পাই যে, তিনি আমাকে ডাকছেন। ফলে চমকে পেছনে ফিরে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর আমি যখন তার কাছে যেতে এমনি কিছুটা অমত করি, দেখি তিনি যেন আমার দিকে একপ্রকার দৌড়েই আসছেন। এমনকি আমাকে অতিক্রম করে, আমার আগেই শায়খকে ধরে ফেলেন এবং অন্যান্য যিয়ারতকারীদের সাথে তারাও যিয়ারত করেন।’

অন্যদিকে কখনও সুযোগ পেলে বালকের বাবাও আরেক শায়খ সম্পর্কিত নিন্মোক্ত ঘটনাটি পুনরাবৃত্তির সুযোগ হাত ছাড়া করেন না। তিনি বলেন, ‘একবার কেউ একজন ওই শায়খ এর সামনে গাজালির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, ইমাম গাজালি তার কোনো একটি কিতাবে উল্লেখ করেছেন, ‘নবীজিকে স্বপ্নে দেখা যায় না।’ এই শুনে শায়খ চিৎকার করে বলেন, ‘তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি ওহে গাজালি! আমি আমার এই চোখ দিয়ে নবিকে খচ্চরের ওপর আরোহী দেখেছি।’ কিন্ত গাজালির এই কথাটিই যখন তার কাছে পরে আরেকবার উল্লেখ করা হয়, তখনও তিনি সেইরূপ ক্রোধ নিয়ে বলেন, ‘তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি হে গাজালি! আমার এই চোখ দিয়ে আমি নবিকে উটনীর ওপর আরোহী দেখেছি।’ ফলে বালকের পিতা এই ঘটনা থেকে এ সমাধানই বের করেছেন যে, ‘হয়তো ইমাম গাজালি ভুল করেছেন। কেননা সাধারণ মানুষও নবিজিকে স্বপ্নে দেখতে পারে। আর উলি-আউলিয়ার কথা তো আলাদাই। তারা তো জেগে থেকেও নবীকে দেখতে পারে।’ তদুপরি বালকের পিতা যখনই এই ঘটনাটি বলেন, তখন নবির এ হাদীস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত করেন যে, নবীজি বলেছেন, ‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখে, সে সত্য দেখেছে; কেননা শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না।’ আর এভাবেই বালক মোজেযা, কারামত ও সূফিবাদের রহস্য সম্পর্কে সমস্ত ধরণের বিষয়াদি আত্মস্থ করে নিয়েছিল। ফলে যখনই সে মকতবে তার সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে এসব বিষয়ে কিছু বলত, অমনি তারাও ঠিক অনুরূপ গল্প জুড়ে দিত তার সঙ্গে। যেগুলোকে তারা নিন্মাঞ্চল প্রধানের দিকে আরোপিত ও সম্পর্কযুক্ত করত; এবং ওসবের প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল গভীর, প্রগাঢ়। মূলত গ্রামীণ জনপদের আবাল,বৃদ্ধা, বণিতা- সকলেরই বিশেষ এক মানসিকতা ছিল। তা ছিল: সরলতা, তাসাউফ ও অজ্ঞতা। আর তাদের এই মানসিকতা গঠনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব যারা রেখেছে, তারা হলো সুফিরা।

* সূরা নিসা : আায়াত ১১৩
* ইসরা ও মিরাজ : নবীজির পবিত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় এটি। এই সম্পর্কে কোরানোর আয়াত দুটি হলো : ১. পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতের এক অংশে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু জানেন।- সূরা ইসরা. আয়াত ১৭।
২. নিশ্চয়ই তিনি তাকে (জিবরাঈল আ.-কে) আরো একবার দেখেছিলেন। সিদরাতুল মুনতাহার (সীমান্তবর্তী কুল বৃক্ষ) নিকটে। যার নিকটে অবস্থিত জান্নাতুল মা’ওয়া। তখন সেই কুল বৃক্ষটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে জিনিস, যা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাঁর (রাসূলের) দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি এবং দৃষ্টি সীমালঙ্ঘনও করেনি। অবশ্যই তিনি তাঁর প্রতিপালকের মহান নির্দেশনাবলী দেখেছিলেন।-সূরা নাজম. আয়াত ১৩-১৮।
বস্তত ইসরা হচ্ছে, মক্কা মুকাররমা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণের সেই পর্বটুকু, রাতের একটি অংশে যা সংঘটিত হয়েছিল। আর মিরাজ হচ্ছে সেখান থেকে ঊর্ধজগৎ পরিভ্যমণের সেই বিস্তৃত অধ্যায়। যদিও ইসরা ও মিরাজ সম্বন্ধে কোরানে সংক্ষেপে উপরোক্ত আয়াত দুটি বর্ণিত হয়েছ। তবে এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে হাদীসের পাঠগুলোতে। সীরাত, সুন্নাহ ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সূত্রাবলীতে রয়েছে এর বিশদ বর্ণনা।
* ইবনে ফরিদ : উমর ইবনে ফরিদ (১১৩১-১২৩৪) একজন আরব কবি। তার সমস্ত কাব্য জগতজুড়েই ছিল সুফিবাদের বিস্তার। এমনকি আরবদের সর্বশ্রেষ্ঠ মরমি কবি হিসেবেও গণ্য করা হয় তাকে।
* গাজ্জালি : আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ আল-গাজ্জালি (১০৫৮-১০১১) মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাবিদ ইমাম আল-গাজ্জালি ১০৫৮ সালে খোরাসানের তুশ নগরীতে জন্মগ্রহণ এবং ১১১১ সালে এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার নামটিও ছিল তার নামের অনুরূপ, মুহাম্মদ। মুহাম্মদের পিতা অর্থাৎ ইমাম গাজ্জালী-এর দাদার নাম ছিল আহমদ। তার পিতা মুহাম্মদ তখনকার সময়ে একজন স্বনামধন্য সূতা ব্যাবসায়ী ছিলেন। গাজল অর্থ সূতা। নামকরনের এই সামঞ্জস্যতাই তার বংশকে গাজ্জালী নামে পরিচিত করেছে। আবার কারো মতে তিনি হরিণের চক্ষু বিশিষ্ট অপরূপ সুদর্শন ছিলেন, আর গাজাল অর্থ হরিণ, তাই পিতা মাতা তাকে শৈশবে আদর করে গাজ্জালী বলে ডাকতেন। উভয় বর্ণনানুসারে তাকে গাজ্জালী বা গাজালীও বলা হয়। তিনি সে সময়ে ইরানের শিক্ষা নিয়ে বিপুল কাজ করেন। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য তিনি বহু দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!