প্রান্তিক কবি
আমি এক নির্জনে পড়ে থাকা প্রান্তিক কবি। যেন সমাজতাত্ত্বিক সীমারেখার শেষপ্রান্তে ঝুলে থাকা এক পরিত্যাক্ত পলিথিন ব্যাগ। এখানে লুকিয়ে রেখেছি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ভগ্নস্বাস্থ্য, অসাম্য, অশিক্ষা ও মানুষের ছলাকলার ইতিহাস। আমি গাণিতিক ধারণার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনস্তিত্বের অপ্রয়োজনীয় সংযুক্তি। তবে জিপসিদের মত আমিও দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে পারি। আমিও মাটির ঘ্রাণ থেকে জেনে নিতে পারি ক্রীতদাসের বুৎপত্তির ইতিহাস। কর্পোরেট সম্মেলনে হানা দিতে পারি অনায়াসে বঞ্চনার প্ল্যাকার্ড হাতে। আমি কোনো ‘পে রোলে’ নেই। তাই উন্মোচন করে দিতে পারি মুনাফার বিবিধ জীবনপ্রণালী। এক নিমেষে নষ্ট করে দিতে পারি প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ভিত।। আমি উদ্ভিদ নই কোনো। তবে ওয়াড্রোবে ফেলে রাখা ন্যাপথলিনের মত লুকিয়ে থাকি ঘাপটি মেরে। আর আমার দানাদার স্ফটিক ও উগ্রগন্ধযুক্ত বেনজিন তোমাকে উর্ধ্বপাতিত করতে পারে অবলীলায়। আমি বহুকাল ধরে বেঁচে আছি পলিথিন হয়ে। মাটির রক্তাক্ত বর্জ্যের ইতিহাসে আমি এক প্রাণঘাতী ভাইরাস। আমি কন্ঠহীন মানুষের কন্ঠস্বর হয়েও হানা দিতে পারি তোমার সুইস-ব্যাংকের লকারে। ওখানে লুকানো আছে তোমার চেতনা বিক্রির ইতিহাস। ভেঙ্গে দিতে পারি তোমার শ্রেণিবিন্যাসের সুত্র, গোঁফের কাব্যকথা ও দাড়ি-কমার ব্যারিকেড। লাতিন ‘মারগো’ থেকে বের হয়ে রবার্ট পার্কের হাত ঘুরে আমি এখন এক অভ্যাসগত সংস্কৃতির অনিশ্চিত আচরণ। নিক্তি দিয়ে আমাকে মাপতে গেলেই খাদ মিশিয়ে দেই আমার অস্থি মজ্জায়। ভুল পরিমাপে তোমরা বিক্রি করে দাও আমার স্থিতিস্থাপকতার গোপন সূত্র। এখন উপযোগিতা হারাতে হারাতে আমি জেনে গেছি তোমার অভিধানের গোপন সিনট্যাক্সট। হে বুর্জোয়া বণিকগণ, আমি আজ জেনে গেছি এতদিন পর, সীমান্ত থেকে রাজধানীর দূরত্ব কতখানি। কতটুকু জলে কতটুকু তেলে মিলেমিশে তৈরি হয় কবিতার ভাস্কর্য। আর কতটুকু অপরিণামদর্শী হলে প্রান্তিক কবিতার হয় অকাল প্রয়াণ।
নারী
সূর্যের আলো মোম হয়ে গলে গলে প্রথম যেদিন
তোমার খোঁপার অন্তঃপুরে ও সিঁথিতে লেপ্টে গেল,
সিঁদুরে মেঘ আর একটুকরো সভ্যতার মেহময় অবয়বে,
আমি তোমায় তখন দেখিনি।
প্রভাতফেরীর শিশির ভেজা ঘাসে প্রথম যেদিন
তোমার পায়ের ধ্বনি ভিজে গিয়ে
পুরুষতন্ত্রের জলপাই আগুনে মিইয়ে গেল,
আমি তখনও তোমায় দেখিনি।
রমনার বৃক্ষতলে কিংবা ছায়ানটের বর্ষবরণে
যেদিন তুমি কপালে টিপ পরে
পান্তাভাতের মহোৎসবে শপথ নিলে,
আমি তবুও তোমায় দেখিনি।
তখন সব ঠিকঠাক ছিল….
সাজানো গৃহ, ফুলের টব, প্রশান্তির নিঃশ্বাস…
পুরানা গঁদ, বার্নিশের গন্ধ, সাদা মুখ, বিমূর্ত হাসি..
সব ঠিকঠাক ছিল।
তোমাকে নিয়ে প্রকৃতির ভেষজ খেলা দেখতে দেখতে
অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আমার দু’চোখ যেদিন তোমাকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হতে দেখলো,
সেদিন কনকচাঁপার শেষ হাসির মতো……
দিগন্তের ঐ শেষ প্রান্তে আমি সূর্যের ঢলে যাওয়া দেখলাম,
আর জেনে গেলাম, সংসার থেকে শেয়ারবাজারের দূরত্ব কতখানি,
জেনে গেলাম, কতটুকু বিনিয়োগে কতটুকু মুনাফা হয়।
ভয়ংকর সুন্দর এক
এক একটি সকাল আসে
শিশুর চোখের জলের মতো শিশির নিয়ে,
শরীরের গভীরে এক ‘ভয়ংকর সুন্দর’
কাঁটা দিয়ে ওঠে এক লহমায়।
সন্ধে বেলার ‘জোনাকিবোধ’ জেগে ওঠে
সকাল বেলার সজনে ডাঁটা ও হলুদ বসন্ত দিনে,
পাতা ও ফুলেরা খানিকটা চোখ বুজে শুয়ে থাকে,
নুইয়ে পড়ে লজ্জাবতীটাও আলোর প্রেমিক পরশে।
আর আমি দেখি নির্জনে চোখ বুজে আসা এক ‘সবুজ দিনের মৃত্যু’,
বিউগলের মতো ‘নিম নিম ডাকা’ রাতের পাখিটা
মনে করিয়ে দেয় পরাণমন্ডলের দিনের শেষকৃত্যের কথা।
আমি দেখি চারিদিকে মরা আর ঝরা পাতার ভীড়,
দেখি ঝরাপাতার নিচে শালিক পাখির নিথর দেহ,
আমি দিনের আলোয় পাহাড়ের জুম-চাষও দেখি,
দেখি শূন্যতার মাঝে আবার জন্মেছে নতুন কিছু।
মৃত্যু হামাগুড়ি দেয় আমার শিশির ভেজা ঘাসে,
আমার বাড়ির আঙিনায়, পাশের ফ্লাটে,
আর আমি প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে বলে উঠি,
সুন্দর এমন করে কেন চলে যায়?