Author Picture

বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১)

মুহাম্মদ আশরাফুল করিম

আগের পর্বে পড়ুন— সূচনা ও বিকাশ পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮)

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কালে ভাষা আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এপ্রিল  মাসে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় ভাষা প্রস্তাব পাশ সেই সাথে দক্ষিণপন্থী ও মধ্যপন্থীদের অনাগ্রহ, দমননীতি এবং বামপন্থীদের বিপন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে যায়। এই সময়ে রাজনৈতিক ভিন্নমত ও পথের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসক-শোসক গোষ্ঠীর প্রতিভূ মুসলিম লীগ সরকারের জেল, মামলা, হুলিয়া, বহিষ্কার, গুন্ডা আক্রমণ চলতে থাকে। তবুও ভাষার আন্দোলন একেবারে স্থবির হয়ে যায়নি। এই অবস্থা ১৯৫২ সালের জানুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত স্থিত থাকে। এই কালপর্বে আন্দোলনসমূহ বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার অর্থাৎ পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান, স্মারকলিপি প্রদান ও সভার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে।

১৯৪৮ সালের ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রভাষা চুক্তি পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য আবুল কাশেমের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের সভায় নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যা ১৬ এপ্রিল কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়া আব্দুল হক, শ্রী রসিকলাল বিশ্বাস, শ্রী রঞ্জন কুমার মিত্রসহ সাতজন রাজবন্দী ১৭ এপ্রিল যশোর কারাগারে অনশন করেন। ২৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ববঙ্গ অধ্যাপক সম্মেলনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনের সাথে সাক্ষাত করে ১৫ মার্চ সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ি ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতারকৃত অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্তি দাবি করেন। অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ১৪ নভেম্বর সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। এটি ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ২৬ মার্চ ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রভাষা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নইমুদ্দীন আহমদ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত নিখিল পূর্বপাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহিত হয়। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারিদের একাংশসহ নানাশ্রেণি-পেশার মানুষ অবিলম্বে পূর্ববঙ্গে সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবি জানিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের নিকট একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। উর্দুবাদীদের ক্রমবর্ধমান প্রচার, মিথ্যাচার ও চাপের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মার্চ ১৯৫১ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত অধ্যাপক সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলা ভাষা অবহেলিত হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব’।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আগমনের কিছুদিন পূর্বে করাচিতে গণপরিষদের বৈঠকে উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হবে বলে ঘোষণা দেন। এই কারণে ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর তাঁর আগমনকে ঘিরে ঢাকায় ছাত্র সমাজের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৭ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকায় অবস্থানকালে স্মারকলিপিটি তাঁর নিকট সরাসরি প্রেরণ করা হলেও তিনি এর কোনো প্রাপ্তি স্বীকার করেননি এবং কোন সাক্ষাতকারও দেননি। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে লিয়াকত আলী খান এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেরপক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যান্য দাবির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করা ও পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন করার দাবিসহ একটি স্মারকলিপি তাঁকে প্রদান করা হয়। সমাবেশে স্মারকলিপিটি পাঠ করেন ডাকসুর তৎকালীন জিএস গোলাম আজম। ৮১ উল্লেখ্য তৎকালীন সময়ে ডাকসুর ভিপি এবং জি এস সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ছাত্র সংসদের ভিপি এবং জি এস এই দায়িত্ব পর্যায় ক্রমিকভাবে পালন করতেন। গোলাম আজম ফজলুল হক মুসলিম হলের জি এস হিসাবে মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক ডাকসুর জি এস পদে মনোনয়ন লাভ করেন। এই স্মারকলিপি প্রস্তুতিতে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। স্মারকলিপি প্রস্তুত করেন কাজী গোলাম মাহবুবসহ স্টুডেন্টস একশন কমিটির নেতৃবৃন্দ। স্মারকলিপিটি পাঠের দায়িত্ব ডাকসুর তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্টের অরবিন্দ বোসের উপর ন্যস্ত হয়। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির নেতারা ‘বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা’ হিসাবে প্রচার করার পাকিস্তানী চেষ্টার আশঙ্কায় এটি পাঠের দায়িত্ব দেন তৎকালীন জি এস গোলাম আজমকে। গোলাম আজম রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে শুধু কৌশলগত কারণে তাকে দিয়ে সভায় স্মারকলিপিটি উপস্থাপন করা হয়। এই ঘটনার পূর্বাপর ভাষা আন্দোলনের আর কোনো পর্যায়ে গোলাম আজমের অংশগ্রহণ বা কোন ভূমিকা রাখার কথা কোথাও জানা যায়না। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান দাবি নামার রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।

গোলাম আজম রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে শুধু কৌশলগত কারণে তাকে দিয়ে সভায় স্মারকলিপিটি উপস্থাপন করা হয়। এই ঘটনার পূর্বাপর ভাষা আন্দোলনের আর কোনো পর্যায়ে গোলাম আজমের অংশগ্রহণ বা কোন ভূমিকা রাখার কথা কোথাও জানা যায়না

বাংলা পূর্বপাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হলেও উর্দুর সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি এতে দমে না গিয়ে পর্দার অন্তরালে ভিন্ন পথে বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত অব্যাহত রাখেন। ১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনের  উদ্বোধনী ভাষণে পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা লেখায় আরবি হরফ প্রচলনের প্রস্তাব করেন। ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় উক্ত প্রস্তাবটি বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়। ফজলুর রহমান এই উদ্যোগের মূল প্রবক্তা হলেও অন্য অনেকেই একই প্রচেষ্টায় শামিল ছিলেন। ৮ এপ্রিল ১৯৪৮ সালে পরিষদে ভাষা বিতর্কে অংশ নিয়ে মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। কোরানের অক্ষর হিসেবে আরবির প্রতি বাঙালি মুসলমানের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে লিপি পরির্বতনই ছিল এর উদ্দেশ্য। সরকার হরফ পরিবর্তন পরিকল্পনায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সহযোগিতা চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে মুস্তফা নুরউল ইসলামের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীবৃন্দ আরবি হরফ প্রবর্তন প্রচেষ্টার প্রতিবাদে সভায় এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা জানানো হয় এবং একটি বর্ণমালা সাব কমিটি গঠন করা হয়। ৪ মার্চ ১৯৪৯ ফজলুল হক হল মিলনায়তনে প্রিন্সিপাল আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে তমদ্দুন মজলিশের সভায় আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। নাজিমউদ্দিনের সরকার ৯ মার্চ ১৯৪৯ আকরাম খাঁকে চেয়ারম্যান ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি ভাষা কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে আরবি হরফ প্রচলনের বিষয়ে তুমুল বিতণ্ডায় শেষ পর্যন্ত তা ১১-১ ভোটে বাতিল হয়ে যায়। ১১ মার্চ ১৯৪৯ সালে ভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্র ফেডারেশনের নাদেরা বেগম, তকিউল্লাহ, নাসির আহমদ প্রমুখের উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান সহযোগে একটি মিছিল বের হয়। ১২ মার্চ বাজেট অধিবেশন চলাকালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফ প্রবর্তন না করার দাবিতে ছাত্র ফেডারেশন পরিষদ ভবনের অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাধা দেয় এবং আফজাল হোসেন, মৃণালকান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান, আবদুস সালাম, এ.কে.এম মনিরুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখকে গ্রেফতার করে। ২৯ মার্চ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশনে মনোরঞ্জন ধর উল্লিখিত বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রী আবদুল হামিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও পূর্ব বাংলার যুব সম্প্রদায় বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের বিপক্ষে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আবদুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এবং ১০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ আহুত সভায় হরফ পরিবর্তনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এই দিন সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে সাহিত্য মজলিসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা হরফেই বাংলা লিখতে হবে মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১১ ডিসেম্বর কলা ভবনে, ইকবাল হল ও ইডেন মহিলা কলেজে অনুষ্ঠিত সভায় হরফ পরিবর্তন প্রচেষ্টার প্রতিবাদ করা হয়। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ১৩ ডিসেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যামে হরফ পরিবর্তনের উদ্যোগ অস্বীকার করা হয়। তবে পর্দার অন্তরালে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৯ ও ১৯৫০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষাদান প্রকল্পে যে অর্থ ব্যায় করা হয় তার সমুদয় অর্থ ব্যায় হয় বয়স্কদের আরবি হরফে বাংলা লেখার শিক্ষা কার্যক্রমে। এ লক্ষ্যে ১৮ এপ্রিল ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষায় আরবি হরফে বাংলা লেখা কার্যক্রমের জন্য পূর্ব বাংলায় ২০টি কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। ১৯৫০ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধে। ১১ অক্টোবর ১৯৫০ কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তীর প্রশ্নের জবাবেও শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সরকারের আরবি হরফে বাংলা লেখা শিক্ষাদান কার্যক্রমের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তবে হরফ পরিবর্তনের এই প্রচেষ্টা আন্দোলনের মুখে আপাতত চাপা পড়ে যায়।

বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র চলাকালে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত প্রস্তাব দেয়া হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাষ্ট্রভাষারূপে উর্দু ও বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের বিরোধিতা করলেও ধর্মীয় কারণে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি ‘পূর্বপাকিস্তান আরবি সংঘ’-এর কার্যকরী সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৫০ সালের ৬ জানুয়ারি ‘সৈনিক’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করা হয়। ১৮ জানুয়ারি রাজশাহি কলেজের কিছু ছাত্র আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একটি সভা করেন। ২৮ মে সৈনিক পত্রিকায় দেওয়ান আবদুল হামিদ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি হওয়াই বাঞ্ছনীয়’ প্রবন্ধে আরবিকে সমর্থন করেন। ইসমাইলী সম্প্রদায়ের নেতা আগা খান ১৯৫১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। স্টেট ব্যাংকের গভর্নর জাহিদ হোসেন ও সিন্ধুর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ আকবর শাহ একই প্রস্তাব করেন। ১১ মার্চ ঢাকায় জেলা বোর্ডের হলে পূর্বপাকিস্তান আরবি রাষ্ট্রভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই দাবি পাকিস্তানের কোন অংশেই উল্লেখযোগ্য সমর্থন লাভ করেনি।

আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে একান্ন খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাল পর্বে সংঘাতময় রাজনৈতিক পটভূমি, দাঙ্গা, আন্দোলনে বৃহত্তর নেতৃত্বের মতাদর্শগত অন্তর্দ্বন্দ্ব, সমন্বয়ের অভাব ইত্যাদি আন্দোলন পরিস্থিতিকে পিছনে ঠেলে দেয়। তা সত্ত্বেও যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পটভূমির প্রেক্ষিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের উদ্যোগ একেবারেই অনুপস্থিত ছিল এমন নয়

পূর্বপাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গী, বিভিন্ন ন্যায্য দাবী দাওয়া পূরণে অস্বীকৃতি এবং ভাষার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের নীতির বিরোধিতায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ২৩ জুন ১৯৪৯  গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল হিসাবে পূর্বপাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাজপথের আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি পার্লামেন্টেও রাষ্ট্রভাষা ভাষার দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। ১৯৫১ সালে ২৭ ও ২৮ মার্চ ঢাকায় এক যুব সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান যুবলীগের জন্ম হয়। যুবলীগ মূলত পাকিস্তানের প্যান-ইসলামিক মতবাদ থেকে বেরিয়ে পূর্ব-বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ট কণ্ঠস্বর হিসাবে নিজেদের পরিচিত করে।

এই কালপর্বে পশ্চিমা শাসকচক্র শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার জোর প্রচেষ্টা চালান। ১০ জুন ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা বোর্ডের প্রথম সভায় প্রাথমিক শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়ে উর্দু ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পূর্ববঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ১৯৪৭ সালে Madrasah Syllabus Committee গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রতিবেদনে জুনিয়র স্কুলের পর বাংলাকে ঐচ্ছিক বিষয় করা এবং উর্দুকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৯ ঢাকায় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসসমূহের কার্য পরিচালনার জন্য উর্দুকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করিতে হইবে।’ ১৯৫০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড উর্দু ভাষার সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের লক্ষ্যে ড. আবদুল হককে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

১৯৪৮ সালের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পূর্বে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন। বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ছাত্র সমাজে বিরাজমান হতাশার মাঝেই ১১ মার্চ ১৯৫০ আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে এই পরিষদ গঠিত হয়। পূর্বের মতো দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব না হলেও ইশতেহার, পোস্টার, সভা, মিছিল ইতাদির মাধ্যমে এই পরিষদ ভাষার দাবিতে কিছুটা গতি সঞ্চার করতে সমর্থ হয়। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। বাংলাকে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম করা এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল প্রতিষ্ঠানে সভা করা হয়। নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে অলি আহাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় মোহাম্মদ তোয়াহা, শেখ মুজিবুর রহমান, সুলতান আহমদ, জামাল আলম, শামসুল হুদা, বজলুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ব-বাংলার সকল পত্র পত্রিকায় এবং গণ পরিষদের সদস্যদের মাঝে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করে। ৫ এপ্রিল ১৯৫১ সালে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় পতাকা দিবস পালিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পৃথক সমাবেশ করে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। পাকিস্তান গণপরিষদে শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কমিটি (TheBasic Principle Committeeev BPC) ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করে গণপরিষদে প্রতিবেদন পেশ করে। যা পূর্বপাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। গণপরিষদে আওয়ামী মুসলিম লীগ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে। পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি রাজনৈতিক ১৯৫০ সালের ৪ নভেম্বর একটি জাতীয় মহাসম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে বাঙালিদের মূল দাবিগুলোর পাশাপাশি উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১০ ডিসেম্বর ভাসানী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পরপরই ভাসানী মূলনীতি কমিটির প্রতিবেদন (যাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল) প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতীয় মহাসম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ অবিলম্বে মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানান।

আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে একান্ন খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাল পর্বে সংঘাতময় রাজনৈতিক পটভূমি, দাঙ্গা, আন্দোলনে বৃহত্তর নেতৃত্বের মতাদর্শগত অন্তর্দ্বন্দ্ব, সমন্বয়ের অভাব ইত্যাদি আন্দোলন পরিস্থিতিকে পিছনে ঠেলে দেয়। তা সত্ত্বেও যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পটভূমির প্রেক্ষিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের উদ্যোগ একেবারেই অনুপস্থিত ছিল এমন নয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে সকল কর্মতৎপরতা পরিচালিত হয় তা আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছালেও একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। মূলত এই কালপর্বে  ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন ঘটনা বাঙালি মানসে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তারই পটভূমিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ।

 

পরের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ

আরো পড়তে পারেন

ছাত্র-প্রতিবাদ: শক্তির এক প্রমাণপত্র

নিয়তি চিত্রনাট্য লেখে ঠিকই। তবে সেই কলমে কালিটা আপনাকেই জোগাতে হয়। নয়তো নিয়তি নিশ্চুপ বসে থাকে প্রাণহীন কলমের প্রান্ত হাতে; আর জীবন-ইতিহাসের পৃষ্ঠা সাদাই থেকে যায় আলস্যের করুণ পরিণতি হয়ে। সেই করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ আমাদের ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী এক্সটেনশন নিয়ে হাজির হলো নিয়তিকে দিয়ে বাঙালির বিজয়গাঁথা লিখিয়ে নিতে। ‘এমন কতদিন কাঁদিনি /….

বাংলাদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারী পেশার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

কিছুটা বিলম্ব হলেও বাংলাদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারী পেশার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সমূহে দক্ষ চার্টার্ড সেক্রেটারী তৈরিতে দেশে এই পেশার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারীজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)’ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে চার্টার্ড সেক্রেটারী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই পেশার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি….

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

error: Content is protected !!