মুহূর্তকে বেঁধে রাখার চেয়ে বাঘ বেঁধে রাখা সহজ। মুহূর্ত চলে যায় অনন্তের পথে। আর সেই পথ ধরেই আসে মৃত্যুর পরোয়ানা। অন্ধ জাতিস্মর কিনারা করে উঠতে পারে না কিছুই। তার প্রাণহীন চোখ থেকে হারিয়ে যায় কার্তিকের মাঠ, তার ওপর চড়ুইভাতির রোদ, ঝিঁঝিঁ পোকাদের অকারণ ছুটোছুটি, ঘরময় ছড়িয়ে থাকা পাণ্ডুলিপি, বারান্দার কোনে নুয়ে পড়া জুঁই ফুলের চারা, ঝুড়ি চাপা বেড়ালছানা— চারদিকে এক নিমেষহারা অন্ধকার। অন্ধকারের এমন বৃত্তের কাছে ধরা দিয়ে ২০২৩ সালে শিল্প-সাহিত্যের যে সকল গুণীজনরা আমাদের ছেড়ে গেছেন তাদের কথা জেনে নেয়া যাক।
সমরেশ মজুমদার
৮ মে ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ সহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা তিনি। তিনি আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ সহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সমরেশ মজুমদার সেই ধ্রুপদী ঔপন্যাসিক যিনি তাঁর আখ্যানের অন্তর্গত করে নিতে পারেন সমকালের দগ্ধজীবনকে। কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি পাঠক যে তাঁর সাহিত্যভুবনে বাঁধা পড়েছে, তার প্রধান কারণ বোধহয় এই যে, অক্ষরকেই জীবনের সার্থকতম আয়না করে তুলেতে পেরেছিলেন।
আসাদ চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি আসাদ চৌধুরী ৫ অক্টোবর, ২০২৩ কানাডার টরন্টোর একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। তার প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পানু’এ পরিচিতি পান আসাদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। ২০১৩ সালে পান একুশে পদক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর পদচারণা। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন।
মলয় রায়চৌধুরী
মলয় রায় চৌধুরী একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার কারণে মলয় রায়চৌধুরী ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যের জন্য প্রদানকৃত সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার সহ বহু পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। মলয় রায় চৌধুরী ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন।
মোহাম্মদ রফিক
২০২৩ সালের ৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন কবি, লেখক ও শিক্ষক মোহাম্মদ রফিক। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন ও কবিতায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ যুগিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০১০ সালে একুশে পদক এবং ২০২০ সালে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন মোহাম্মদ রফিক।
সুফিয়া খাতুন
২০২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন লেখিকা সুফিয়া খাতুন। ‘আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনি’ শ্রেণীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
পণ্ডিত বিজয়কুমার কিচলু
পণ্ডিত বিজয়কুমার কিচলু ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী। ভারত সরকার ২০১৮ সালে তাকে চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী প্রদান করে। বিগত পঁচিশ বছর ধরে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ‘বটবৃক্ষ’ ছিলেন। সঙ্গীত সাধক পণ্ডিত বিজয়কুমার কিচলু ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাপস বাপি দাস
ভারতীয় গায়ক-গীতিকার, গিটারবাদক এবং সঙ্গীতজ্ঞ তাপস বাপি দাস ২৫ জুন ২০২৩-এ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বাংলা রক ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাকে ‘মহীনের আদি ঘোড়া’ সম্বোধন করা হতো।
জয়ন্ত মহাপাত্র
জয়ন্ত মহাপাত্র ২৭ আগস্ট ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় কবি যিনি ইংরেজি কবিতার জন্য সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার জিতেছেন। তিনি ‘ইন্ডিয়ান সামার’ এবং ‘হাঙ্গার’-এর মতো কবিতার লেখক, যেগুলোকে আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশ্রেণীর রচনা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ২০০৯ সালে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মশ্রীতে ভূষিত হন। তবে ভারতে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ২০১৫ সালে তিনি পুরস্কারটি ফিরিয়ে দেন।
পান্না কায়সার
লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার ০৪ আগস্ট ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পান্না কায়সার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল মেয়াদে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন পান্না কায়সার। তার স্বামী শহীদুল্লা কায়সার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক এবং রাজনীতিক ছিলেন।
কল্যাণী কাজী
কল্যাণী কাজী একজন ভারতীয় বাঙালী গায়িকা। তিনি নজরুলগীতির গায়িকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘সঙ্গীত মহাসম্মান’ পুরস্কারে ভূষিত করে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যা ছিলেন। তিনি ১২ মে ২০২৩ তারিখে ৮৭ বছর বয়সে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
ড. অনুপ ঘোষাল
ভারতীয় বাঙালি গায়ক, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী ড. অনুপ ঘোষাল ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন এবং হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রে গান গেয়ে বিশেষভাবে সুনাম অর্জন করেন। তিনি মূলতঃ নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতে কন্ঠ দেওয়ার জন্য বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১১ সালে তাঁকে ‘নজরুল স্মৃতি পুরস্কার’ ও ২০১৩ সালে ‘সংগীত মহাসম্মান’ প্রদান করে।
আবুবকর সিদ্দিক
বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাবান কবি আবু বকর সিদ্দিক ২৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৯৩৪ সালে জন্ম নেওয়া কবি ঘুমিয়ে পড়েছেন রূপসার তীরে খুলনায়। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। সাহিত্যভুবনে আবুবকর সিদ্দিক স্বল্পালোচিত, অথচ বহুমুখী প্রতিভাগুণে সমৃদ্ধ এক বিশেষ সাহিত্যব্যক্তিত্ব ছিলেন।
মার্টিন লুইস এমিস
মার্টিন লুইস এমিস একজন ইংরেজ ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, স্মৃতিকথাকার ও চিত্রনাট্যকার। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হল মানি ও লন্ডন ফিল্ডস। তিনি এক্সপেরিয়েন্স স্মৃতিকথার জন্য জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার অর্জন করেন এবং দুইবার বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালে দ্য টাইমস তাকে ১৯৪৫ সালের পর ৫০ সেরা ব্রিটিশ লেখকের একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
হিবা কামাল আবু নাদা
হিবা কামাল আবু নাদা ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, পুষ্টিবিদ ও উইকিমিডিয়ান। তার উপন্যাস ‘আল-অক্সিজিন লাইসা লিল্ মাউতে’ ২০১৭ সালে আরব সৃজনশীলতার জন্য শারজাহ পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলো। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনি নিহত হন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৩২। এক্সে তার শেষ পোস্টে তিনি লিখেছিলেন—
‘গাজার রাত রকেটের আভা ছাড়া অন্ধকার, বোমার আওয়াজ ছাড়া শান্ত, প্রার্থনার আরাম ছাড়া ভয়ঙ্কর, শহীদদের আলো ছাড়া কালো। শুভ রাত্রি, গাজা।’
করম্যাক ম্যাকার্থি
পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী আমেরিকান লেখক করম্যাক ম্যাকার্থি মারা গেছেন ১৪ জুন, ২০২৩। তার বয়স হয়েছিলো ৮৯ বছর। তার আসল নাম— চার্লস ম্যাকার্থি, তিনি মূলত ওয়েস্টার্ন প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লিখে থাকেন। নব্বইয়ের দশকে লেখা ‘বর্ডার উপন্যাসত্রয়ী’ তার সেরা সৃষ্টি। দ্য রোড উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন।
কেন্জাবুরো ওহয়ে
কেন্জাবুরো ওহয়ে বিংশ শতাব্দীর একজন জাপানী কথাসাহিত্যিক। আধুনিক জাপানী সাহিত্যে তিনি এক কিংবদন্তি চরিত্র। তার সৃষ্টিকর্মের অধিকাংশই ফরাসী এবং আমেরিকান সাহিত্য ও সাহিত্য-তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। তার সাহিত্য কর্মগুলো পারমাণবিক অস্ত্র, পারমাণবিক শক্তি, অস্তিত্ববাদ প্রভৃতি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দার্শনিক বিষয়বস্তু নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ী এই কথাসাহিত্যিক ৩ মার্চ, ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন।