
‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ নামে একেএম শামসুদ্দিনের এই প্রবন্ধ সঙ্কলনটির কেন্দ্রস্থলে যে মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে সে-সংবাদটি বইয়ের নামকরণেরই উপস্থিত। লেখক নিজে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। তাঁর আপন দুই ভাই যুদ্ধে গেছেন, ভগ্নিপতি প্রাণ হারিয়েছেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে। যুদ্ধের সময়ে তাঁর বয়স ছিল অল্প, মাত্র ছয়-সাত বছর, নাহলে তিনিও যুদ্ধে যেতেন; সে-মনোভাব সঙ্কলনের প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত। যুদ্ধের সময় তিনি অনেক ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন; বহু খবর শুনেছেন, জেনেছেন। পরে নিজেও তিনি বাংলাদেশের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছেন, এবং কর্মজীবনে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি মহাকাব্যিক ঘটনা। মহাকাব্যের পক্ষেও একে ধারণ করা কঠিন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা, ভয়ভীতি, ক্ষয়ক্ষতি— কোনো কিছুরই সীমা পরিসীমা ছিল না। সেসব কাহিনী অসংখ্য। বলে শেষ করা যাবে না। অনেক ঘটনার কথাই সমষ্টিগত তো বটেই ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যাবে, ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছেও। একেএম শামসুদ্দিন কিছু কাহিনী তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়। যুদ্ধের সময় আত্মত্যাগ ছিল, আবার বিরুদ্ধাচারণ যে ছিল না তাও নয়। হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতার ঘটনা ঘটেছে। এই বইতেও তার উল্লেখ পাই। ওইসব বেঈমানদের কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, অন্ধকার উজ্জ্বল করেছে আলোককে।
মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র সম্পর্কে লেখকের মূল কথাটা গ্রন্থের শিরনামেই বলা হচ্ছে। সেটি হলো এই যে, এটি ছিল একটি জনযুদ্ধ। সমগ্র জনগণের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এবং জনযুদ্ধ, একই সংগ্রামের দু’টি নাম। যুদ্ধে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন; ছিলেন অতিশয় সাধারণ মানুষেরা, ছিলেন যাঁদেরকে আদিবাসী বলা হয় তাঁরাও। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরাও জনযোদ্ধাই হয়ে গিয়েছিলেন; এক হয়ে গিয়েছিলেন কৃষক, শ্রমিক এবং সকল শ্রেণীর যোদ্ধাদের সাথে। যুদ্ধ কোনো দল, শ্রেণী বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ঘটে নি, ঘটেছে পূর্ববঙ্গের সকল মানুষের মুক্তির স্বার্থে।
যুদ্ধের পরে কিন্তু দেখা গেছে নানা রকমের দলীয়, এমনকি ব্যক্তিগত স্বার্থও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বেরিয়ে এসেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা, যারা যুদ্ধের ধারে কাছেও ছিল না, কিন্তু সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছে; এবং সেটা দেখিয়ে বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। ওদিকে বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরীর কাজটা সুসম্পন্ন হয় নি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় দেখা গেছে রাজাকাররা ঢুকে পড়েছে, আবার রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযাদ্ধার নাম লেখা হয়েছে।

প্রবন্ধ । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মুদ্রিত মূল্য: ৪০০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/289430
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুতের ধারণাটাই আসলে ছিল ভ্রান্ত। একাত্তরে মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহী ছাড়া দেশের সব মানুষই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কেউ ছিলেন দৃশ্যমান, অন্যরা কাজ করেছেন গোপনে। গোপনে কাজ করাটা তখন যেমন জরুরী ছিল তেমনি ছিল স্বাভাবিক। মেয়েরাও যুদ্ধে ছিলেন; প্রত্যক্ষে যুদ্ধ করেছেন কেউ কেউ, অন্যরা ছিলেন সহায়ক ও সাহায্যকারী। যেটা দরকার ছিল সেটা হলো দেশদ্রোহীদের এবং শহীদদের তালিকা প্রস্তুত করা। দেশদ্রোহীদের তালিকাটা পাওয়া গেলে, একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও পাওয়া যেত। কারণ মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহী ছাড়া অন্য সবাই যুক্ত ছিলেন মুক্তির ওই জনযুদ্ধে; অংশ গ্রহণের মাত্রাতেই যা হেরফের। আর দরকার ছিল শহীদদের তালিকা। শহীদদের তালিকা তৈরী করা গেলে তাঁরা প্রত্যেকেই স্মরণীয় হয়ে থাকতেন; প্রত্যেকের প্রতিই সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হতো। প্রতিটি এলাকায় শহীদদের তালিকা দৃশ্যমান করে রাখা যেতো, এবং এলাকাবাসী তাঁদেরকে নিয়ে গৌরব অনুভব করবার সুযোগ পেতেন। আরও একটি বিষয় এই যে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেওয়াটাও ছিল অপ্রয়োজনীয়। সার্টিফিকেটের আশায় কেউ মুক্তিযুদ্ধে যায় নি, গেছে প্রাণের তাগিদে। সার্টিফিকেটের অনেক অসঙ্গত ব্যবহার ঘটেছে; এবং জাল সার্টিফিকেট প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অসম্মানিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসঙ্গটি আসে। আসাটাই স্বাভাবিক। এই সঙ্কলনেও এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবশ্যই একটা অনুভ‚তির ব্যাপার; কিন্তু তার একটা সংজ্ঞাও বোধ করি প্রয়োজন, যদিও সেটা দেওয়া কঠিনও বটে। তবে এক কথায় বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সমাজ-বদলের চেতনা। আমরা কেবল যে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা চেয়েছি তা নয়, চেয়েছি সামাজিক পরিবর্তনও। রাষ্ট্র ছিল ঔপনিবেশিক, আমরা চেয়েছি সেটাকে ভাঙবো। ভেঙে কেবল যে ছোট করবো তা নয়, গণতান্ত্রিকও করবো। এবং গণতান্ত্রিক করার মূল জিনিসটা হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র শাসনে ওই সাম্য প্রতিষ্ঠা ছিল অসম্ভব। বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শাসন এখনো গণতান্ত্রিক হয় নি; সমাজও রয়ে গেছে আগের মতোই বৈষম্যপূর্ণ। সে জন্য দেখা যাচ্ছে উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু উন্নতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে বৈষম্য ও বঞ্চনা। এই সত্যটাও কিন্তু এই গ্রন্থের লেখাগুলোর ভেতরে নানাভাবে উপস্থিত রয়েছে।
গ্রন্থটি প্রাণবন্ত ও সুখপাঠ্য। এবং তথ্য ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ। লেখককে অভিনন্দন।