পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৯)
উনিশ
আমরা সিঁড়ি বেয়ে বারন্দাতে নামি। ড্যাব করে একটা আওয়াজ হয়। একটা ফুলের টব উল্টে গেছে। প্লাস্টিকের হালকা টব। মাটি আছে ওটার ভেতরে। সোনিয়া বসে গাছটার গোড়া ধরে ওটাকে টেনে তোলে। বারান্দার ছাদের বাইরের দিকের দুই কোনায় দুটি বাল্ব আছে। তাদের ঢাকনাগুলি বেশ পুরনো আর ওদের ওপর অনেক ধুলাও জমেছে। আবছা আলো। এখানে আমি গোটা বিশেক গোলাপের চারা লাগিয়েছিলাম। তারপর ওরা অযত্নে বেড়ে উঠেছে। আমি বা পাগল তার কোনও খোঁজ রাখিনি। সোনিয়া রেখেছে। কৃষিতে সোনিয়ার সহজাত হাত। সেই হাত গোলাপের গাছগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সোনিয়া পড়ে যাওয়া গোলাপ গাছটাকে মায়ার চোখে দেখছে। যে গাছের তিন ডালের একটা ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা ডালে একটা ফুল, শানের উপর লুটিয়ে আছে।
. এ ভাবে পড়ে যাওয়া। আমি জানি পতনের কষ্ট। জীবনে আমি এ ফুলটির মতই ফুটেছিলাম। আবার এর মতই আমার পতন হয়। তবে সে পতন কোনও শান বাঁধানো মেঝের ওপর নয়। একেবারে গিরিখাতের তলায়। অত্যুচ্চ পর্বতের শ্যাওলা-পিচ্ছিল-পাথর গা বেয়ে মাইলের পর মাইল নিচের দিকে এক গড়ানিতে এক নিমেষে পড়ে যাওয়া। সে এমন এক জায়গা যেখানে পৃথিবীর কোনও মানুষের পা কখনও পড়েনি আর পড়বেও না। যেখানে হাত বাড়াতে চাইলে পর্বতের পিঠের ভেজা কালো পাথরের পিচ্ছিল ছোঁয়া। যেখানে সূর্যের আলো কোনও দিন পৌঁছেনি আর পৌঁছবেও না। পতনের পর মাথা তুলে ওপরের দিকে যত তাকিয়েছি তত শুধু আমাকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের সুড়ঙ্গের অন্ধকার অনুভব করেছি। আর কোনও কিছু দেখিনি। এমন সুড়ঙ্গের তলানিতে পড়ে গেলে কত কিছুর ভয়। পচে মরার ভয়। সাপখোপের ভয়। ভয়ের কষ্ট। নিশ্বাস নিতে না পারার কষ্ট।
. আমার দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি মরিনি। বরং মেরেছি। আর তা ভুল ছিল। তার প্রমাণ পেতেও দেরি হয়নি। আমার বাইরের জগৎ থেকে আমাকে ঘিরে থাকা হিমালয় কিংবা আল্পস কিংবা কিলিমানজারোর গুহার দেয়ালগুলি উধাও হয়ে গেল বটে। আবার সাথে সাথে আরও বেশি দুর্ভেদ্য আরও বেশি অলঙ্ঘ্য আরও বেশি অবর্ণনীয় এক গুহা চেপে বসে আমার মনের ভেতরে, যা আমি কোনও দিন সরাতে পারব না। আর তার পার্শ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমার আব্বা মরে যায়ে, ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শুধু পাগল যায় না। সে আমাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখে। আমরণ আমার সঙ্গে থাকার প্রতিজ্ঞা করে।
. আমার কানের লতি গরম হয়। মগজ টগবগ করে। আমি নিজেকে থামাতে পারি না। ফুলটাকে টেনে তুলে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরি। আঙ্গুল আর হাতের তালুতে কাঁটার খোঁচা খাই। আমি ফুলটাকে পিষে ফেলতে উদ্যত। কিছু রস এর মধ্যে বের হয়ে গেছে। হাতের তালু স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। মনে হয় গোলাপের নির্যাস নয়, জাঁতা দিয়ে পিষে আমার নিজের প্রাণ বের করে নিচ্ছি। নিজের প্রাণ বের করে নেয়া! শিশিরকণা সব কিছু করেছে। এ কাজটা করেনি। মনে প্রশ্ন। আধা সচেতনতায়। ফুলটাকে ধ্বংস করা কি ঠিক হচ্ছে? উত্তর আসে, ঠিক হচ্ছে না।
. আমার কাঁপন বন্ধ হয়। দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়। বুকে ঠাণ্ডা ঘামের অনুভব পাই। কানে কিসের বাতাস লাগে। বেশ আরামদায়ক। আমি আমার সালোয়ারের কোমলতা অনুভব করি। জামার হাতায় কিছু মুক্তার কাজ রয়েছে। ত্বকে মুক্তার ঘষা খাই। সেই সাথে যেই সুতা দিয়ে মুক্তাকে জামার হাতায় আর গলায় লাগানো হয়েছে সেই সুতার ছোঁয়া। নাকে গোলাপের গন্ধ। শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ এমনভাবে অনুভব করি মনে হয় আমার বোধি লাভ হতে চলেছে। বুদ্ধের দেহের শান্তি আমার দেহে প্রবেশ করছে। কামনাবিহীন শান্তি। যা স্থায়ী। যা এক ঘষাতে জ্বলেও ওঠে না, আবার এক ফুরুতে নিভেও যায় না। আমি জীবনে অনেক বেঠিক কাজ করেছি। এখন থেকে সব সঠিক কাজ করব। আমি আর কিছু ধ্বংস করব না। সব কিছু নির্মাণ করব। অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেব। ক্ষুধার্তকে আহার দেব। তৃষ্ণার্তকে জল। আমি মমতায় হাত খুলি। চোখের সামনে দেখি এবড়োখেবড়ো পাপড়িগুলি খুলে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখেও সুখ। এর অংশিদারী হতে পারা আরও বেশি সুখের। আমি ফুলটাকে গাছের গোড়ায় রেখে দিই। রাতের বাতাসে তার ক্ষত নিরাময়ের জন্য। মনে হয় আমার জীবন আর এক বার বদলে গেল। শুরু হোক এবার আমার জীবনের সাধনা। শুরু হোক পাগলের নিরাময়। আমার হাতে। ভবিষ্যতে আর কোনও অন্ধকার থাকবে না। আমি শিশিরকণা সবাইকে দেখিয়ে দেব, আমি কী দিয়ে তৈরি। জীবন নিয়ে আর কোনও পরীক্ষা-নীরিক্ষা নয়। গোলাপি কমনীয়তায় কামনার সিঞ্চন নয়। শুরু হোক উচ্চতর কিছু।
. “আমার কুনো দোষ নাই,” সোনিয়া বলে। “আইন্নের দিগে চাইবার গিয়া ভাইঙ্গালাইছি।”
. আমি সোনিয়াকে কাছে টেনে ওর মাথাটা আমার বুকে চেপে ধরি।
. জীবনে প্রথম এমনটা করতে পারলাম। আত্মশ্লাঘার বিষাক্ত চাদরখানা গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া। আমার চোখে আনন্দাশ্রু।
. আমি সোনিয়ার হাত চেপে ধরি। ওকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু যেই গতিতে যেতে চাই সেই গতিতে যেতে পারি না। বিহ্বলতায় দোল খাই। একটু মাথাও ঘোরে। আমি চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিই। বোঝার চেষ্টা করি। ব্যাপারটা কী।
. বুঝি সমস্যা পায়ের নিচে। কিন্তু কী তা? আর কোথা থেকেই বা এল?
বিশ
আমি সাবধানে পা ফেলি। না। এটা আমার মনের ভুল নয়। বারান্দায় আমার চপ্পল বার বার আটকে যাচ্ছে। মনে হল আমি পানির ওপর হাঁটছি। ভেবেছিলাম বাতাসের ওপর হাঁটব। আর হাঁটছি পানির ওপর। একটু আগে আমার বুকে সুখের যে জোয়ার উঠেছিল, এখন তাতে ভাটার টান লেগেছে। আমার পায়ের দু-একটা আঙ্গুল ভিজে গেছে। পার্বিতেও পানির ছোঁয়া।
. দরজা খুলে আমরা ঘরে ঢুকি। সোনিয়া ডান দিকের কনসোলটার সাথে বাড়ি খেয়ে কুপোকাত। শব্দ হয়: পেচাআআআত…ফট্। আমি বিরক্ত হই। আতশবাজি দেখার খুশিতে যেন সোনিয়া লাফ দিতে গিয়ে চিত হয়ে পড়ে গেছে।
. সোনিয়া উঠে দাঁড়ায়।
. “ব্যথা পেয়েছিস?”
. “না খালাম্মা। কুনো বেতা পাই নাই।”
. সোনিয়ার লাল কামিজ আর সাদা সালোয়ার ভিজে গেছে।
. বুঝতে পেরেছি, আমি নিজেকে বলি। দরজা ভেজানো থাকায় দরজার নিচে লাগানো রাবারটা দরজা আর ফ্লোরের মাঝের ফাঁকটা বন্ধ করে রেখেছিল। তারপরও বারান্দায় কিছু পানি চলে এসেছে। এখন দরজা খোলা। তাই পানি কলকল করে বারন্দার দিকে ছুটে আসছে। আমি এক ঠেলায় দরজা বন্ধ করি। দুই পায়ে দুই আছাড় দিয়ে সেন্ডেল খুলি। আমার পায়ের পাতা পানিতে ডুবে যায়।
. কী ভাবতে ভাবতে নিচে এলাম? এখন কী দেখি? আমি কীভাবে এর ব্যাখ্যা করি? গ্রিক পুরাণের বহুমস্তকবিশিষ্ট সর্প হাইড্রা। কোথা থেকে এল এই অপরাজেয় বিকট প্রাণির ধারণা? আমি ভাবতে পারি না যে ওরা আমার সমস্যাগুলি না দেখে হাইড্রার কল্পনা করতে পেরেছিল। আর তা-ই যদি হয়, এখন আমি কী করতে পারি? আমি হাইড্রার একটা মাথা কাটব, হাইড্রার আর একটা মাথা গজাবে। আমি কীভাবে হাইড্রার দফারফা করব? আমি কি হারকিউলিস? আমি কী দেবতা জিউস আর মানবী অ্যালসিমিনার মিলনের ফল। আমি হলাম আমলা শামসুর রহমান খান আর ডাক্তার মরিয়ম কবির খানের ঘরে জন্ম নেয়া এক নারী। অথচ জীবন আমাকে একটার পর একটা হাইড্রার মুখোমুখি করছে। আমি অবশ্যই নিজেকে ঠুনকো কোনও নারী ভেবে বড় হইনি। কিন্তু তারপরও আমি কী করে নিজেকে অর্ধদেব হারকিউলিসের সমকক্ষ ভাবি? ডান্ডার মধ্যে হারকিউলিসের শক্তি লুকানো। আমার ডান্ডা কই? ভাবতে গিয়ে রাগে আমার বুক ভেঙ্গে যেতে চায়।
. আমি কাঁদি না। কেঁদে কী হবে? আমি সচেতন থাকার চেষ্টা করি। দেখা যাক। হাইড্রার মাথা কাটতে কাটতে আমার কাস্তে হাইড্রার ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে কি না। আমি সিদ্ধান্ত নিই আমি কাস্তে চালিয়ে যাব।
. আমি এর শেষ দেখতে চাই। আমার দিনের বেলার কথা মনে আসে। কোন কষ্টে সে দিন যাপন করে? তার এই কষ্ট পৃথিবীর কেউ বুঝবে না। ক্যান্সার, আলজাইমার’স, আর্থরাইটিস, সিরোসিস কোন অসুখের চেয়ে এই অসুখকে খাটো করে দেখব? হ্যাঁ, এটা অন্য অসুখের সাথে তুলনা করা যেত, যদি এই অসুখের কষ্ট খালি চোখে দেখা যেত। এটাতো খালি চোখেও দেখা যায় না, চোখ বন্ধ করেও দেখা যায় না। এই অসুখের কষ্ট আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ দেখে না। তাই এই অসুখ বেশি নিষ্ঠুর, বেশি অমানবিক। আমি নিজেও এই সত্য সব সময় মনে রাখতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করেছি তাকে ভাল করতে। সে ভাল হয়নি। সে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। আমি তা ধরতে পারিনি।
আমি জীবনে অনেক বেঠিক কাজ করেছি। এখন থেকে সব সঠিক কাজ করব। আমি আর কিছু ধ্বংস করব না। সব কিছু নির্মাণ করব। অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেব। ক্ষুধার্তকে আহার দেব। তৃষ্ণার্তকে জল। আমি মমতায় হাত খুলি। চোখের সামনে দেখি এবড়োখেবড়ো পাপড়িগুলি খুলে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখেও সুখ। এর অংশিদারী হতে পারা আরও বেশি সুখের
. পা টেনে টেনে আমি ড্রয়িং রুমে ঢুকি। আমি লাইট জ্বালাই। ড্রয়িং রুমের পানিতে কই মাছ ছেড়ে দেয়া যায়। ডাইনিং হলে একটা লাইট জ্বালানো ছিল। আমি বাকি তিনটাও জ্বালিয়ে দিই। ঘর আলোয় ভরে যায়। চারি দিকে পানি। পানি আর পানি। জানি না, কতক্ষণ মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারব। যদিও আমি প্রাণপনে চাই, আমার সচেতনতাটুকু যেন চলে না যায়।
. হামিদের খুনের সেই দুর্যোগের রাতে রান্নাঘর থেকে প্রথমবারের মতো সে বটি বের করে এনেছিল। আমাকে জবাই করার জন্য। তবে আজকের মতো সে রাতে সে এত উন্মত্ত ছিল না। আজকে সে দা হাত থেকে ফেলেনি। মেঝেতে পড়ে না গেলে সে আমাকে কোপাত। সে রাতে আমি জবাই হওয়ার জন্য ফ্লোরে শুয়ে তার দিকে গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি তাকে আহ্বান করেছিলাম আমার গলায় পোঁচ দেয়ার জন্য। আমি আকাশবাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করেছিলাম। তখন সে বটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে বুকে তুলে নিয়েছিল। আলিঙ্গনের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে ফেলতে। বাকি রাতটা আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে পার করে দিয়েছিলাম। মুরগি ছানা আমিন আর সিলিকনের স্তন পরা তরী বেগম ভাবল হৃদরোগের হাতে পরাজিত তাদের পুত্রের শোকে আমাদের মা মেয়ে কাঁপছে। সে রাতে সে আমাকে যা দিয়েছিল, তা কোনও মা কী কোনও মেয়েকে কখনও দিয়েছে? নিশ্চয়ই দিয়েছে। কিন্তু অন্য মায়েরাতো আমার মা নয়। আমার মায়ের দান আমার জীবনে অতুলনীয় ছিল।
. অথচ আজ আমি কী করলাম? দা দিয়ে আমি তার গলায় পোঁচ দিলাম। জানি কাটেনি। কিন্তু অপমানতো হয়েছে। সে উঠে চলে গেছে। আমি আর তার দেখা পাইনি। কত ভিন্ন দুটি দৃশ্য। সে রাতে সে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। আজ আমি যা করলাম তারপর আর আলিঙ্গনের কোনও সুযোগ রইল না। তাকে একা একা থমকে যেতে হল। কীভাবে সে থামল, সে কথা ভাবতে গিয়ে আমার গলা শক্ত হয়ে যায়। জানি গলাটা একটু শিথিল করলেই আমি ঝরঝর করে কাঁদব। তবু যতটা পারা যায়, গলাটা শক্ত করে রাখি। কারণ আমাকে সবটুকু ভাবতে হবে। এত অল্প ভেবে কাত হলে আমার চলবে না। সে আমাকে অনেক দিয়েছে, তা সত্যি। কিন্তু মা হলে আরও বেশি দিতে হয়। এটা মায়ের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকে আমি তাকে অব্যাহতি এত সহজে দিতে পারছি না। তা ছাড়া এখন আমার বিপদ। সবার আগে আমাকে দেখতে হবে, সে কোথায়? আমি পা টেনে টেনে তার সন্ধানে বের হই।
. আমার গর্ভকে প্রাণহীন করার পর আমি বুঝতে পারি সন্তান মায়ের বুকের কত গভীরে নাড়া দেয়। তাই বলে আমি আহাম্মক হয়ে বড় হয়েছি, তা বলা যাবে না। আমি সব বোধ সময়মতো অর্জন করেছিলাম। নারীর বোধ। মায়ের বোধ। মানুষের বোধ। আমার ডিম্বাশয় দুটি ডিম্ব উৎপাদন শুরুর আগেই আমার মনে এই সত্য উৎপাদিত হয় যে, অসুখী সংসারে সন্তানের জন্ম দেয়া মানব জীবনে সবচেয়ে স্বার্থপর কাজ। বাসর নামক মশকারির রাতেই হামিদ আমাকে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। আমি তা ঠেকিয়েছি। যদিও কারণটা ভিন্ন ছিল। শুষ্ক নদীর পিঠে লোহার নৌকা কে ঠেলে? কিন্তু আমার এখন সে সব ভাবার সময় নয়। পাগলের জন্য আমার মন অনেক খারাপ। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জ্বলছে আমার মনে দ্রোহের আগুন। হামিদের উন্মত্ততা আমাকে কাত করতে পারেনি। কষ্ট পেয়েছি অনেক। কিন্তু গর্ভ ধারণ করব কি করব না, আমার এই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের কোনও সুযোগ আমি হামিদকে কখনওই দিইনি। নারীর জীবনের এই সংগ্রাম একান্ত এবং অনেকটা অপরাজেয়, যদি না ডিম্বাশয় ডিম্বহীন হয়। এই সংগ্রামে পরাজিত হলে আমি হামিদকে দায়ী করতাম না। যে সংগ্রাম আমার নিজের, তাতে পরাজিত হওয়ার মানুষ আমি নই। হামিদের সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থেকে আমি অবশ্যই মানবতার কাজ করেছি। মানুষ হিসাবে ওটা আমার পরীক্ষা ছিল। আমি পাশ করেছি। পাগল ফেল মেরেছে।
. আমি বার বার পাগলকে বলেছি, তার মা হওয়া উচিত হয়নি। এমন অপমান করার জন্য অনেক সময় নিজে লজ্জিত হয়েছি। কিন্তু এখন এই বন্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি মনে করি, আমার কথাই ঠিক। পাগলের কখনওই মা হওয়া উচিত হয়নি। সে আমার যত যত্নই করুক না কেন, আমাকে সে সুখী করতে পারেনি। আর কোনও কিছুর জন্য না হলেও, সে যে পাগল হয়ে গেছে মা থাকা অবস্থায়, শুধু এ কারণেই তার সন্তান জন্মদান কোনওভাবেই ঠিক হয়নি। আমার আব্বার উচিত ছিল না কোনও সন্তানের জনক হওয়া। শুধু শিশুকে আদর করতে জানে এই যোগ্যতায় এই পুরুষগুলি বাপ হয়ে যায়। এরা বোঝে না পিতামাতা হওয়া শুধু শিশুকে আদর করা আর ঘি-মাখন খাইয়ে মোটাতাজা করা পিতৃত্ব আর মাতৃত্ব নয়। যে মানুষ সমাজের কুসংস্কারগুলোর গোলাম, তার কখনওই মাতাপিতা হওয়া উচিত নয়। এটা আমার নিজস্ব মতামত নয়। আমার সিদ্ধান্ত আরও কঠোর। আমার কথা হল এমন মানুষের সন্তান জন্ম দেয়ার কোনও অধিকারই নাই। মনুষ্য শিশু। কত জন জানে কত শত অত্যচারের মধ্য দিয়ে সে বড় হয়। শিশুর এক মাত্র আশ্রয়স্থল পিতামাতার কোল। সে কোলে চড়তে তার যদি কোনও অস্বস্তি হয়, তবে তার দায়ভার কার? অবশ্যই পিতামাতার। এ কর্তব্য সমাজ বোঝে না। রাষ্ট্র বোঝে না। আর আমরা মেয়েরা। আমরা ভাবি কোনও রকম পেট থেকে একটা বের করতে পারলেই হল। এখন পাগলা তুই যাবি কই? কিন্তু পাগলা ঠিকই পালিয়ে যায়। আর এ দিকে একটা বের করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা দুইটা, তিনটা, এমনকি ছয় কি সাতটা পর্যন্ত বের করি। চকমকির পাথরে জ্বলে ওঠা আলোর আমরা অন্যায় অপব্যবহার করি। আমাদের বোন-ভাবিরা আমাদের শিখিয়ে দেয়: ধরে রাখতে চাও? তা হলে গাভিন হও, আর দ্রুত বিয়াও। আমরা যারা এই কুবুদ্ধি দিই, তাদের রাস্তায় উলঙ্গ করে পেটানো উচিত। যেন রক্ত থেকে এই কুবুদ্ধি চিরতরে বিদায় নেয়। করিম চাচার স্ত্রী এই কুবুদ্ধির শিকার ছিলেন। চাচির হঠকারিতাকে করিম চাচা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। এ জন্য আমি করিম চাচাকে সম্মান জানাই। চাচি পরে যখন সুখী হয়েছিলেন, কোল ভরে সন্তান পেয়েছিলেন, তখন অবশ্য আমাকে বলেছিলেন, তাঁর ওইভাবে গর্ভ ধারণ করতে চাওয়াটা ভুল ছিল। চাচি স্বীকার করেছেন করিম চাচাই তাঁকে সেই ভুল থেকে রক্ষা করেছিল। চাচি যে কাজে ব্যর্থ হয়েছিলেন হাজার হাজার মেয়ে সে কাজে সফল হয়। তারপর ভাতারের সাথে রাতদিন চুলাচুলি করে। দুই বছরের, তিন বছরের শিশুদের সামনে। আর পিতামাতার তৈরি বিষে ওই শিশুগুলির মস্তিষ্ক নিষ্পেষিত হতে থাকে। আমি বরং বাহার চাচা কিংবা সোনিয়ার আব্বা যা করে তাকে অপেক্ষাকৃত ভাল মনে করি। এদের ঘরে শিশু এসেই বুঝতে পারে এরা প্রকৃতির প্রাণি। জগতের আর জীবজন্তু যে ভাবে বেড়ে উঠে, তারা সে ভাবে বেড়ে ওঠে। তারা পাতা খায়, বিষ্ঠা খায়, মাটি খায়, পোঁদে সতীর্থের আঙ্গুলের গুতা খায়, যোনিতে শিশুকামীর ধ্বজের ঠেলা খায়, আর এগুলিকে তারা স্বাভাবিক মনে করে, আর তাতে করে এরা অন্তত মস্তিষ্কবিকৃতির হাত থেকে রক্ষা পায়। এরা হয় প্রকৃতির সন্তান। এরা দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে যায়, অন্তত মানসিকভাবে। তবে পৃথিবীতে মানবশিশুর আদর্শ জায়গা কী, তার সিদ্ধান্ত আমি দেব না। এটা সমষ্টির সিদ্ধান্ত।
. আমার পায়ের নিচে পানির গভীরতা বাড়ে। আর তার সাথে তাল মিলিয়ে আমার ক্রোধও বাড়ে। আমার সচেতনতা চলে যাচ্ছে। আতশবাজি দেখার আনন্দ এখন সারারাত পানি সেঁচে পরিশোধ করতে হবে।
. সোনিয়া বালতি আর একটা তোয়ালে নিয়ে এসেছে। এবং কাজও শুরু করে দিয়েছে। এভাবেই সোনিয়া সব সমস্যার গোড়ায় হাত দেয়। গত দুই বছরে আমি ওকে প্রথম পাঁচ ক্লাশের বই পড়িয়েছি। সুযোগ পেলে ও যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাই। আমি ওকে সাহায্য করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু এত পানি তোয়ালে দিয়ে শুষে আনা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। তারপরও সে চেষ্টা করছে। তার চেষ্টায় বালতি ভরে যাচ্ছে, মেঝেতে ধেয়ে আসা পানিতে।
আমার গর্ভকে প্রাণহীন করার পর আমি বুঝতে পারি সন্তান মায়ের বুকের কত গভীরে নাড়া দেয়। তাই বলে আমি আহাম্মক হয়ে বড় হয়েছি, তা বলা যাবে না। আমি সব বোধ সময়মতো অর্জন করেছিলাম। নারীর বোধ। মায়ের বোধ। মানুষের বোধ। আমার ডিম্বাশয় দুটি ডিম্ব উৎপাদন শুরুর আগেই আমার মনে এই সত্য উৎপাদিত হয় যে, অসুখী সংসারে সন্তানের জন্ম দেয়া মানব জীবনে সবচেয়ে স্বার্থপর কাজ
. আমিও একটা বালতি নিয়ে কাজে নেমে যেতে চাই। কিন্তু তার আগে দেখতে চাই, সে কী করছে? আমি ঘুরে অন্য দিকে পা বাড়াই। যত সামনের দিকে এগোই তত মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। ঘরে বুঝি ফ্লাডলাইট জ্বলছে। আর তার নিচে সমুদ্রে রোদের আলো খেলা করছে। আমি দ্রুত পা চালাই। বার বার পা আটকে যায়। এই বাড়িতে অনেক আসবাবপত্র। পাগল মনে মনে একটা খালি বাড়ি চায়। কিন্তু আসবাবপত্রগুলো সে ছাড়তে চায় না। মনে তার বাসনা। তার মেয়ের আবার বিয়ে হবে। জামাইয়ের জন্য আসবাবপত্র দরকার। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির অন্তত পঞ্চাশ জন মানুষ যাতে বসতে পারে। সপ্তাহে একবার পাগল তাদের দাওয়াত দিবে। আমি মনে মনে বলি আমি পাগলের আশার নিকুচি করি। আমি এই জোয়ার থেকে নিষ্কৃতি চাই। আর কিছু চাই না।
. কী জন্য দরজার কাছে ফিরে এলাম ভুলে গেছি। বোধ হয় দরজা বন্ধ করা হয়েছে কি না, তা দেখতে। আমার মাথা ঠিক আছে কি? দরজাতো অনেক খেয়াল করেই বন্ধ করেছিলাম। উল্টো দিকে ঘুরতে গিয়ে আমার বাম কনুইয়ে ধাক্কা খাই। বাড়ি খাই সেই হাড্ডির মাথায়, যেখানে বাড়ি লাগলে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। বিদ্যুৎ ঝলকের ইস্পাতের লাঠি আমার চান্দিতে আঘাত হানে। বশশ্। বিকট শব্দটা আমার হৃৎপিণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়। মনে হল বিল্ডিংটাই ভেঙ্গে পড়েছে। তারপর পটপটভটভট শব্দগুলি হৃদয়ের দরজা দিয়ে ভাঙ্গা কাচ হয়ে ঢোকে। দৃশ্যপটে চোখ ঘুরিয়ে যা দেখি তা আমার সারা অঙ্গে শত শিশুকামীর শত ধ্বজের ঘষা দিয়ে যায়।
. কনসোলটা বন্যায় লুটানো। কনসোলটার একটা পা নাই। বোধ হয় সোনিয়ার ধাক্কাতে ওটা খুলে গিয়েছিল। তখন খেয়াল করিনি।
. আমার আনন্দ লাগে। আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য বাসায় বন্যার সৃষ্টি করা। আর এখন? পাগলের প্রিয় কনসোল বন্যায় ভাসছে। আমাদের ইউরোপ ট্যুরের পর ঢাকায় এসে পাগল যত্ন করে ঘরে হাতিলের মিস্ত্রি এনে দু’টি কনসোল বানিয়েছিল। যদি মেয়ের আবার বিয়ে হয়। অতিথিরা ঘরে ঢুকেই যেন পৃথিবীর পুরনো সভ্যতাগুলির সাথে পরিচিত হতে পারে। আর এখন? পতিত এই আসবাবকে আর তোলা যাবে না। অর্ধেক সভ্যতা এখন বন্যায় ডুবে গেছে। আমি পানির ঝাপটায় ভিজে গেছি। আমার চোখের সামনে পেঁচাটা উল্টে পড়ে আছে। পৌরাণিক পেঁচার বুদ্ধিদ্বীপ্ত চোখজোড়া আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। উরুগুয়ের পার্ল হোয়াইট মার্বেলের তৈরি দামি পেঁচা। এথেন্স শহরের প্লাকা বাজার থেকে আমরা দুজনে কিনেছিলাম।
. শিল্পীর কারুকাজ। পেঁচাটাকে সব সময় জীবন্ত মনে হয়েছে। সাততলা থেকে নিচে কংকরের রাস্তায় ছুঁড়ে মারলেও ওর গায়ে আঁচড় লাগবে না, এত মজবুত পাথরে তৈরি সে। মায়া খালার মেয়ে রনির মতো রক্তমাংসের দেহ নয় তার। বিচক্ষণতার দেবি কুমারী আথেনার প্রতিনিধিত্ব করা পেঁচা। এত শক্ত তবু মনে হয় পেঁচাটা পাগলের তৈরি বন্যায় অসহায়ভাবে চিত হয়ে শুয়ে আছে। উল্টে পড়ে আছে গ্রিক আর মিশরীয় সভ্যতার সব চিহ্ন। সক্রেটিস, প্লেটো, হোমার, সফোক্লিস, আক্রোপলিস, সম্রাট আদ্রিয়ানের গ্রন্থাগার, আলেকজান্ডার, দ্বিতীয় রামসিস, আমেনহোতেপ, তুতানখামুন, নেফারতিতি, ক্লিওপেট্রা, এন্তনি, সিজার। বানের জলে ডুবে আছে পুরো মিশরীয়, গ্রিক আর রোমান সভ্যতা। আমাকে কষ্ট দেয়া? বান্দি দেখ্, তোর সাধের কনসোল কুপোকাত। সকালেই দারোয়ান ডেকে আমি এসব খালি করব। এই ঘর খালি করব। পাগলকে এবার দড়ি দিয়ে বাঁধব। এবার আমার আধিপত্য চালাব। এখান থেকে শেষ হল পাগলের আধিপত্য।
. মন চায় বাম দিকের কনসোলটাকেও গুঁড়িয়ে দিই। না হয় ডান কনুইয়ে আরেকটা বিদ্যুচ্ছটার আঘাতই পেলাম। কিন্তু তা করা হয় না। কনসোলটা খাড়া থাকে। ওটা ধারণ করে আছে প্রাচীন ভারতীয় আর দক্ষিণ আমেরিকার সভ্যতাগুলি। টিকে গেছে টিকাল মন্দির। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে পাড়ে ঘটে যাওয়া ধ্বংসজজ্ঞ দেখে যেন জাগুয়ারের পিঠে সওয়ার ইনকা রাজা আতাহুয়ালপা মিটিমিটি হাসে। ধ্বংস যে মানবমস্তিষ্কের গূঢ়তম নেশা, সে কথাই এই রাজার হাসি বলে দেয়। এই রাজাগুলির আনন্দ ধ্বংস সাধনে। গত শতাব্দীতে এরা দশ কোটি মানুষ মেরে ফেলেছে। কিন্তু কেউ অপরাধবোধ নিয়ে মরেছে, এমনটা জানা যায়নি। প্রকৃতিও এদের ধ্বংসের জন্য গড়েছে। এদের সভ্যতম অংশটুকুও একটু একটু আঘাত করা ছাড়া নিজেকে আনন্দ দিতে পারে না। আমার এখন ওই রাজাদের দশা। দুই চারটা সভ্যতা গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিযে দিতে পারলে আমার সুখ হয়। ইচ্ছা হয় কোমরে ইস্পাতের অস্ত্র পরে মানবজাতির কোমর অবশ করে দিই।
একুশ
আমি নিজেকে নিন্দা জানাই। আমি অযথা সময় নষ্ট করছি। প্রথমে দেখা দরকার, কী হয়েছে? বন্যার পানি গভীর হোক। আমার ঠ্যাঙ কি কম লম্বা? আমি তাদের সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করি। যত পাগলের ঘরের দিকে যাই তত পানির গভীরতা বাড়ে। পাগলের ঘরের দরজা খোলা। ঘরের মেঝেতে ঢুকে নাস্তানাবুদ হই। এই ঘরে নৌকা চালানো যাবে। এটা এমনিতেই সব সময় অগোছালো থাকে। আর এখন মনে হচ্ছে অশান্ত মহানন্দার বুকে ভেসে যাচ্ছে একটি খাট, দুটি আলমারি, একটা আরামকেদারা, আর নানান রঙের শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, শালোয়ার, কামিজ, ওড়না, চাদর, রুমাল।
. কিন্তু বিছানায় পাগল নাই। ছাদে যাওয়ার আগে তাকে যেভাবে মটকা মেরে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল সে অন্তত বাহাত্তর ঘন্টা সেভাবে থাকবে। যেই আমরা ছাদে গেলাম সেই বুঝি সে উঠে গেল। বুঝা যাচ্ছে সে বাথরুমে আছে। সে যে বিছানা থেকে উঠেছে এটা একটা ভাল বিষয়। আমি আতঙ্কে ছিলাম কী করে তাকে বিছানা থেকে তুলব। আমি তার মটকা মেরে পড়ে থাকাকে ভয় পাই। এখন সে নিজেই উঠে গেছে। নিজেকে আমার হালকা লাগত, এই বন্যাটা না হলে।
. বান অতিক্রম করে আমি বাথরুমের দিকে যাই। বাথরুমের দরজা বন্ধ। দরজার কাঠ নীচ থেকে প্রায় কোমর পরিমাণ ভেজা, পাউরুটি যেমন করে চা গিলে তেমন করে দরজার কাঠ পানি গিলেছে। আমি দরজায় কয়েকটা ঘুসি দিই।
. “মা! মা! মা!”
. কোনও সাড়া পাই না।
. বাথরুমের ভেতরে টেপ থেকে শোঁশোঁ করে পানি পড়ছে। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই। আমি নক করি। ঠক! ঠক! ঠক!
. “মা, পানি বন্ধ করো! ঘর ভেসে যাচ্ছে!” আমি গলা ফাটাই।
. এমনিতেই পনেরো বিশ মিনিট নক না করলে সে দরজা খোলে না। আজ যে কয়েক ঘন্টায়ও তা খুলবে না, তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না।
. কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও বাথরুমের পানি এভাবে বাইরে চলে আসেনি। এ ব্যাপারে সে শুরুতে অসংযত ছিল। পরে অবস্থার উন্নতি ঘটে। আর গত এক সপ্তায় মনে হয়েছিল সে একদম ভালো হয়ে গেছে। আমি মনে মনে জরিনা খালার প্রতি কত যে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আল্লাহকে ডেকেছি। সিন্নি মানত করেছি। ব্যাংক থেকে দশ টাকার নোটের দশ হাজার টাকা তুলেছি শুধু ভিখারীদের জন্য। ওদেরকে ব্যাগ খালি করে দুই হাতে ভিক্ষা দিয়েছি। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি আমার মার অসুখ ভাল হয়ে যাচ্ছে এই কল্পনা করতে করতে।
. এখন আমার কাছে সব কিছু বিভ্রান্তিকর। জরিনা খালার চিকিৎসায় কি আসলেই তার কোনও উন্নতি হয়েছে? পানি যত বাড়ছে আমার মাথাও তত গরম হচ্ছে। এমন বিপদে কেউ কাউকে ফেলে? সে কি জানে না আমি বাইরের লোকের সাহায্য চাইতে লজ্জা পাই। সে যেমন লজ্জা পায়, আমিও তেমন লজ্জা পাই। তা হলে সে কেন এই অনাচার ঘটাচ্ছে? কেন আমার ওপর এই অবিচার করছে?
. আমি এর একটা স্থায়ী বিহিত করার কথা ভাবি। তার ওপর আমার যে নির্ভরতা তার দড়ি আমার কেটে দিতে হবে। সোনিয়াই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি তাকে পাগলা গারদে পাঠানোর কথা ভাবি। জরিনা খালাকে ফোন করার মুখ নাই। খালা নিজেই হয়তো জ্বরে পড়েছে এর মধ্যে। জরিনা খালার সাহায্য আমি নিব না। আমি একা একাই ডাক্তার খুঁজে বের করব। পুনর্বাসন কেন্দ্র খুঁজে বের করব। দেখব কোথায় তাকে রেখে এলে ভালো হয়। কোন জায়গায় এমন পাগলের ভাল যত্ন করা হয় তা আমাকে জানতে হবে।
. পায়ের নিচে পানির গভীরতা বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে এ পানি সেঁচার জন্য দমকল বাহিনী ডাকতে হবে। দমকল বাহিনীর এক কর্তাকে এক সময় চিনতাম। সে আব্বার প্রবেশনার ছিল। সেও বোধ হয় অবসরে গেছে। কী করি? কার কাছে যাই? চেয়ারম্যান স্যারকে ডাকলে দৌড়ে আসবে। দরকার হলে তানিয়ার বুক থেকে উঠে চলে আসবে। সব সাহায্য করবে। কিন্তু সকাল হলেই যোনি ভিক্ষা চাইবে।
. আমি আর পারি না। এবার মরে যাক। এবার সব লজ্জার অবসান হোক। এমন পাগলের বেঁচে থাকা সাজে না। এই ঘরে বাস করি আমি আর সে আর সোনিয়া। আমরা দুজনেই পাগল। সোনিয়াও পাগল। পাগলের সাথে পাগলের বসবাস অসম্ভব। সে-ও তা বোঝে। সে-ও হয়ত আমার মৃত্যু চায়। আমার ধৈর্য শেষ। আমারওতো ওসিডি আছে। আমারও কষ্ট আছে। পানি উপচে বের হচ্ছে দরজার নীচ দিয়ে। আমার হাঁটুর ওপর। আমার মাথা জ্বলে ওঠে। রাগে কাঁধ দুটি ওপরের দিকে উঠে আসে। মাথার তালু জ্বলে। “মরে যা তুই!” এবার আমি দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করি। “কল বন্ধ র্ক, মা…!”
আমি এখন একশটা খুন করতে পারি। কিন্তু খুন কাকে করব? তাকেতো আগে বের করতে হবে। আমি তার ধৈর্যের বাঁধ কেটে দিতে চাই। “বের হয়ে আয়, বাজারের বেশ্যা!” আমি বলি। “কত খারাপ কথা কানে গেলে তোর ইজ্জতে লাগবে?” কোন গালি শুনলে এই খাণ্ডারনির লাশ কবর থেকে জেগে উঠবে আমি ভেবে পাই না। আমি তাকে আসপাসিয়া, ইসাবেলা, ভেরোনিকা, লরা বেল, মাতা হরি-সহ ইতিহাসের যত বিখ্যাত বারবনিতার নাম জানা আছে, একে একে সব নামে ডাকি
. না আমি মা ডাকিনি। সে শব্দে তাকে ডেকেছি। যে শব্দে সে আমাকে আজ ডেকেছে। যে শব্দ বাড়িতে আমদানি করার জন্য সে এক দিন ভাইকে দা দিয়ে তাড়া করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
. আমার মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। তার ছিঁড়ে গেলে আমার আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমার চিৎকারে সারা বাড়ি কাঁপে। আমি আরও জোরে তাকে গালি দিই। আমার মাথা আরও গরম হয়। আমি গালির বন্যা ছুটাই। কেঁপে কেঁপে ক্রোধ ঝাড়ি।
. আমি হাঁপাই। নিজের বুকের উঠানামায় নিজে চমকে উঠি। সে আমার কথা শুনছে না। কল বন্ধ করছে না। যে সংযম জরিনা খালার সামনে রাখার দরকার ছিল তার এখন কোনও দরকার নাই। আমি জোর করে একটা নিশ্বাস টেনে পেটে ঢুকাই। আর তাতে যে শক্তি সঞ্চয় হয় তা মুখ দিয়ে ছেড়ে দিই। “র্ম, তুই র্ম! গলায় ফাঁস দে! রনির মতো বিশ তলা থেকে লাফ দে! নইলে বের হয়ে আয়! আমি তোকে গুলি করি! আগে তোর বুকে গুলি করব! তারপর নিজের মাথায়! বের হয়ে আয় তুই!”
. খিস্তি দিতে দিতে আমার গালে খিল লেগে যাচ্ছে। সে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বাথরুম থেকে পানি বের হয়েই যাচ্ছে। ভিতরে পাঁচটা কলা আছে। কয়টা খুলে দিয়েছে কে জানে? বের হয়ে আসার পর এবার সত্যি আমি তাকে জবাই করব। যদি জবাই না-ও করি। পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে আমি তাকে ন্যাংটা করে বেত দিয়ে পেটাব।
. মেজাজ খিঁচে ধরে আমি আর এক দফা তাকে মিনতি করি। “মা, মাগো, দরজা খোলো। আর কষ্ট দিয়ো না। দেখো, ঘরে এক হাঁটু পানি। মা আমাকে মাফ করে দাও। কল বন্ধ করো। বের হয়ে আসো, মা। মা, তোমার কোনও চিন্তা নাই। নিজ হাতে তোমাকে খাওয়াব। তুমিতো সারা দিন কিছু খাওনি। আজ আমি তোমাকে তোমার মনের মতো পরিষ্কার করব। ধোয়া জামা দিব পরতে। বিছানা বদলে দিব। মা রহম করো। বের হয়ে আসো, মা। মাগো, বের হয়ে আসো। এত পানি। বড় বিপদ, মা!”
. আকুতি করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। আশা করি সে বের হয়ে আসবে।
. সে বের হয়ে আসে না।
. কেন সে বের হয়ে আসে না? আমি দরজায় লাত্থি মারি। পানি থেকে পা টেনে তোলা কষ্টের কাজ। তবু আমি দরজায় পা চালাই। কখনও এমন দুর্দশায় পড়িনি। লাত্থি জোরে লাগে না দেখে দরজায় আবার ঘুসি মারি। কয়েকটা ঘুসি মারার পর বুঝতে পারি আমি শেষ। আমি এখন একশটা খুন করতে পারি। কিন্তু খুন কাকে করব? তাকেতো আগে বের করতে হবে। আমি তার ধৈর্যের বাঁধ কেটে দিতে চাই। “বের হয়ে আয়, বাজারের বেশ্যা!” আমি বলি। “কত খারাপ কথা কানে গেলে তোর ইজ্জতে লাগবে?” কোন গালি শুনলে এই খাণ্ডারনির লাশ কবর থেকে জেগে উঠবে আমি ভেবে পাই না। আমি তাকে আসপাসিয়া, ইসাবেলা, ভেরোনিকা, লরা বেল, মাতা হরি-সহ ইতিহাসের যত বিখ্যাত বারবনিতার নাম জানা আছে, একে একে সব নামে ডাকি। আর দুই হাতে দরজায় ঘুসি চালাতে থাকি। ডাকতে ডাকতে আমার চোয়াল ব্যথা হয়ে গেছে। “কেন তোর কানে কোনও কিছু ঢুকে না?” আমি গগনভেদী আর্তনাদ করি। আমি তাকে বুন্দি, তিলাওয়ালা, নাকাসু পের্লভকা-সহ জগতের নাম করা সব গণিকালয়ের বাসিন্দা বানাই।
. তারপরও তার নড়নচড়ন নাই। এ দিকে বানের জোয়ার বুঝি এবার আমাকেই টেনে নিয়ে সাত তলা থেকে ফেলে দেবে। আমি দম নেয়ার জন্য থামি। আমার ভিতর যে এই হিংস্রপশু বাস করে, তা আমি জানি। তবে আমার মুখ যে এত খারাপ হতে পারে, তা আমি জানতাম কি না, কে জানে? কিন্তু সে যখন প্রতিবাদ করছে না, খুন্তি আর শাবল নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে না, তখন আমি একাকি আর কত এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারি?
. মাথার ভেতর একটা খটকা কিছু সময় ধরে দানা বাঁধছে। এখন তা অঙ্কুরিত হয়েছে। চারা গাছ হচ্ছে। আর দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল যে সে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। আমি তাকে ভালবেসে পাগল ডেকে এসেছি। ওসিডি ছাড়া তার আর কোনও রোগ নাই। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে সে দেড়শ বছর বাঁচবে। পানিতে এত ভিজে থাকে অথচ তার আঙ্গুলে কখনও ফাঙ্গাস পড়ে না। হার্টে কোনও সমস্যা নাই। যদিও মাঝে মাঝে এক সপ্তাহ বিছানা থেকেই উঠে না। এক ইঞ্চি সর না পড়লে সে দুধ পাতে নেয় না। তারপরও ডাক্তাররা বলে তার হার্ট নাকি এখনও আঠারো বছরের সুস্থ-সবল কুমারীর হার্ট। না। সে মরবে না। যদি না আমি মেরে ফেলি। এক জনকে মেরেছি। আর এক জনকে মারতে অসুবিধা কোথায়?
. “কল বন্ধ র্ক।” আমি চিৎকার করি। কিন্তু কেন যেন গলা বন্ধ হয়ে আসে। আর গালি দিতে পারি না। সে যেন আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। যেন দেখতে চায় আমি কত গালি দিতে পারি। সে জিতে যাচ্ছে। আমি হেরে যাচ্ছি। তাতে ক্ষতি নাই। কিন্তু? কিন্তু কী?
. কিন্তু যদি সে বাথরুমে না থাকে? আবার তা-ই বা যদি না থাকে, তবে বাথরুমের দরজা বন্ধ কেন? আবার যদি বাথরুমেই থেকে থাকে তবে এত গালি, এত আকুতি, এত ধমক, কোনও কিছুই কেন তাকে স্পর্শ করছে না? কিন্তু কেন? মনে হয় সারা বাড়িটা এক বার দেখা দরকার। যদি অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকে। আমি দীর্ঘ শ্বাস টেনে বুক ভরাট করি। পানিতে পা টেনে টেনে উল্টোদিকে হাঁটি। বাতাসে পানির গন্ধ। ডান পাশের খালি ঘরগুলির প্রথমতটাতে ঢুকি। এ ঘরে পুরনো কতগুলো সোফা আর একটা কালো আলমারি ছাড়া আর কিছু নাই। একটা পুরনো কালো ম্যক্সি আলমারির আড়ালে লুকানো।
. এটা সে সব সময় করে। ভেজা কাপড় শুকাতে না পারলে সে তা এখানে সেখানে লুকিয়ে রাখে। যাতে কেউ টের না পায়। আমি আর সোনিয়া খুঁজে খুঁজে সেগুলি বের করি, মেশিনে ধুই, শুকিয়ে আবার জায়গামতো রাখি। দিনে পাঁচ গামলা কাপড় ধুতে হয়। দশবার সে গোসল করে। আরও বিশবার একারণে সেকারণে হাত ধুতে, মুখে পানি দিতে, পা ধুতে বাথরুমে যায়। প্রত্যেকবার গিয়ে এক থেকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত বাথরুমে থাকে। তাকেতো আমরা আর কোথাও পাই না। আমার চোখে জল আসে। অনেক আগে থেকে সে কালো পোশাক পরা শুরু করেছে কারণ আমার চোখে যেন সে-সব কাপড়ের ভেজা দাগ ধরা না পড়ে। আমি পোশাকটা ধরে দেখি। এর গন্ধ আর স্পর্শ বলে এটা সদ্য ছাড়া পোশাক নয়। কমপক্ষে এক দিন আগে সে এটা এখানে রেখে গেছে। তা হলে সে এর মধ্যেও বাথরুমে সময় কাটিয়েছে। সঙ্গোপনে। জরিনা খালার চিকিৎসায় কোনও কাজ হয়নি। আগে কখনও সে আমকে ধোকা দিতে চাইত না। এবার ধোকা দিয়েছে। ইচ্ছে করে। কীসের জন্য?
আমি শিশিরকণা। পড়েছি। আবার উঠেও দাঁড়িয়েছি। আমি ভারসাম্য ফিরে পাই। আমি আবার আমাতে ফিরে আসি। কী করব, তা-ই ভাবি। পুলিশ ডাকব? ভাইকে খবর দিব? দারোয়ানকে ডেকে আনব? নীচ তলার ভাড়াটিয়াদের কাছে গিয়ে কাঁদব?
. আমি পাশের ঘরে যাই। এই ঘরটায় এক সময় আমার ভাই থাকত। এখানে একটা বিছানা পাতা আছে। আর আছে একটা বিশাল বইয়ের আলমারি। আমি ইচ্ছে করে রেখেছি। আমার মূর্খ ভাইয়ের ছেড়ে যাওয়া খালি ঘর যাতে জ্ঞান দ্বারা ভরা থাকে সে জন্য, অন্তত প্রতীকীভাবে। জ্ঞানের ঘরেও পাগল নাই। আমি বাসার এ মাথা থেকে ও মাথা যাই। পানি বেয়ে বেয়ে। দুপুরে তার ত্রাসে দৌড়েছি সারা বাড়িতে। এখন সারা বাড়িতে তাকে খুঁজছি একই উত্তেজনায়। সব আনাচ কানাচ দেখি। আরও যে চারটা বাথরুম আছে, সেগুলোতে ঢুকি। কোথাও সে নাই। আমি তার বাথরুমের দরজার সামনে ফিরে আসি। আমার বুক ধকধক করে। বাথরুম ছাড়া আর কোথাও সে নাই। বাথরুমে সে পাঁচ ঘন্টা থাকলেও আমার বা সোনিয়ার কোনও দুশ্চিন্তা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই যে পানির স্রোত। কলের পানির অসহ্য শব্দ। তা আমার কানের পর্দায় সরাসরি আঘাত করে।
. এ দিকে বানের জোয়ার বেড়েই চলেছে। সোনিয়া আমার পিছে পিছে ঘোরে। আমরা বাইরের দিকের দরজার কাছে যাই। সোনিয়াকে বলি। কাঁথা বালিশ যা আছে আন। সোনিয়া নড়ে না। আমি একটা ঘরের দিকে যাই। সোনিয়া আমার পিছে পিছে আসে। আমরা দু’জনে ধরে একটা তোশক নিয়ে প্রবেশদ্বারের কাছে রাখি। ভাঁজ করে ঠেলে ওটাকে গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করি। আমি চাই না ঘরের পানি বাইরে যাক। নীচের তলার মানুষরা জানুক এই বাসায় কিছু ঘটছে। পাগল নিজেও কখনও নিজের সমস্যা অন্যে জানুক, তা চায় না। “যা, আর একটা তোষক আন,” আমি সোনিয়াকে বলি। “কাঁথা বালিশ যা পাস, নিয়ে আয়।”
. “আমার ডর করে,” সোনিয়া বলে।
. সোনিয়ার ডর করছে! “সোনিয়া, তুই ভয় পাচ্ছিস?” আমার মুখ থেকে কথাটা বের হয়ে যায়।
. “হ,” সোনিয়া বলে।
. কিন্তু কেন? সোনিয়ার মুখ থেকে ডর কথাটা আগেও শুনেছি, তবে না-বোধক অর্থে। কত বার সোনিয়াকে তরকারি কোটার সময় বলেছি, সাবধান। সোনিয়া বলেছে, “কিছু অইত না, খালাম্মা।” সোনিয়া আমাকে তার হাতে অনেক কাটা দাগ দেখিয়েছে। সোনিয়া সব সময় বলে ও হাত-কাটা, পা-ভাঙ্গা এ সবকে ভয় পায় না। গ্রামে ও গাছের ডাল থেকে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে। বন্যায় ভেসে চলে গেছে কয়েক মাইল। আবার উঠে গিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। আগুনেও পুড়েছে। সে দাগও সে আমাকে দেখিয়েছে। সোনিয়ার কিছু হয়নি। সোনিয়া অনেক গর্ব নিয়ে ওর ছোট্ট শরীরে কাটার দাগ, পোড়ার দাগ, থেঁতলানোর দাগ ইত্যাদি চিহ্ন আমাকে দেখিয়েছে। নির্ভীক সোনিয়া ভয় পায়! আমার বুঝি হুঁশ ফিরতে শুরু করে।
. মাথার মধ্যে বেড়ে ওঠা দ্বিধার বৃক্ষ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। ভালবাসা বার বার আক্রোশের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে। আবার তাকে মা বলে ডাকি। এটা চূড়ান্ত। গালি আর আমার মুখ দিয়ে আসবে না। ঘর ভেসে যাক। বাড়ি ভেঙ্গে যাক। কেয়ামত নেমে আসুক। আমি তাকে আর একটাও খারাপ কথা বলব না। আমি সচেতনতা ফিরে পাই। কেন এই সচেতনতা নিয়ে এত বক্তৃতা, এত লেখালেখি, এত সেমিনার, এত কর্মশালা? কারণ এটা আসে আর চলে যায়, আসে আর চলে যায়। ধরে রাখতে পারলে তুমি রাজা। না ধরে রাখতে পারলে তুমি পাগল। আমি সেই সাধনায় লিপ্ত। সিসিফাস যা অর্জন করেছে। আমি তা অর্জন করতে চাই।
. আমি আবার অনুনয় করা শুরু করি। “মা, মা আমার, আমার জীবনের ভালবাসা, আমার নারী জীবনের আসল প্রেম, আমাকে ক্ষমা করো। কল বন্ধ করো। আমরা ডুবে যাচ্ছি। মাগো, কেন তুমি বের হয়ে আসছো না? কেন তুমি আমাকে এত শাস্তি দিচ্ছো? আমি অপরাধী। কিন্তু আমিতো তোমার মেয়ে। আমি কি কম অসুস্থ, মা? কেন তুমি আমাকে মাফ করতে পারছ না? কেন তুমি আমার কথা একটুও ভাবছো না। দেখো ঘর ভেসে যাচ্ছে। দরজা খোলো। মা, দরজা খোলো। মাগো, দরজা খোলো।”
. চোখের পানি আর বাধ মানে না। হাত আমার একেবারে নরম নয়। তবু সেগুন কাঠের শক্ত দরজা ভাঙ্গার শক্তি আমার নাই। মা মা বলে গলা ফাটাই। যেমন ভেতরের কষ্টে আমার বুক ফাটে, তেমন দরজায় ঘুসি দিয়ে আমি আমার হাত ফাটাই। তা হলে কী সে তা-ই করেছে? যা আমি তাকে করতে বলেছিলাম। তা হলে কি দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল?
. ধুক ধুক করতে করতে আমার বুক ভেঙ্গে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। এর মধ্যে আবার শুরু হয়েছে মাথা ঘোরা। যা এখন বেড়েছে। আমি শুধু ঘুরছি। না পৃথিবী ঘুরছে? আমিইতো ঘুরছি। শাবানার মতো। সুনেত্রার মতো। রোজিনার মতো। নতুনের মতো। অঞ্জু ঘোষের মতো। চন্দন দ্বীপের রাজ কন্যা। বেদের মেয়ে জোসনা। তারও আগের নায়িকা শবনমের মত ঘুরি। উর্দু ছবিতে সে যেমন ঘুরত। বৃত্তাকারে। এক বার পুতুলের মতো। এক বার আমার দেহটা যেন সে বৃত্তের ব্যাস। এক বার দুটোই। মাথার এমন ঘুর্ণন হতে পারে আমি বিশ্বাস করতাম না। তার হার্টের কোনও সমস্যা নাই। ঘরের কোথাও সে নাই। সে আছে বাথরুমে। আমি কাঁদতে কাঁদতে তাকে ডাকি। মা, মা বলে ডাকি। ডাকতে ডাকতে আমি পানিতে লুটিয়ে পড়ি। আমার পিঠের ভূমিকম্পে বন্যার জলে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। পানির উচ্চতা নাভির ওপরে ওঠে। আমি দরজায় মাথা কুটি। ভেজা দরজা। মা, মাগো! একটু দয়া করো। জানো না আমি তোমাকে কত ভালবাসি। কত ভালবাসি তোমাকে। কত ভালবাসি তোমাকে। কত ভালবাসি তোমাকে।
. কতক্ষণ দরজার ওপর কপালে বাড়ি দিয়েছি কে জানে। মাথা ঠুকতে ঠুকতে আমি মাথাটা ভেঙ্গেই ফেলতাম। সোনিয়া আমার ঘাড়ের ওপরের জামার অংশ শক্ত করে টেনে ধরে। আমার শেষবারের মতো হুঁশ আসে।
. আমি শিশিরকণা। পড়েছি। আবার উঠেও দাঁড়িয়েছি। আমি ভারসাম্য ফিরে পাই। আমি আবার আমাতে ফিরে আসি। কী করব, তা-ই ভাবি। পুলিশ ডাকব? ভাইকে খবর দিব? দারোয়ানকে ডেকে আনব? নীচ তলার ভাড়াটিয়াদের কাছে গিয়ে কাঁদব?
. না। যতক্ষণ পারি নিজের চেষ্টা নিজে চালিয়ে যাব। মনের চোখে দেখি সিসিফাস পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে মনের সুখে ভারী পাথরটা ওপরের দিকে ঠেলে চলেছে। পিস্তল দিয়ে গুলি করে দরজার ছিটকিনি খোলার কথা ভাবি। কিন্তু গুলি যদি তার গায়ে লাগে। বাথরুমের কোথায় সে আছে, তা-তো আমি জানি না। এ বাড়ির এক মাত্র অস্ত্র দা। মায়ের অস্ত্র। মেয়ের অস্ত্র। যা আমরা প্রদর্শন করি।
. “সোনিয়া! দা আন!” আমি চেঁচিয়ে উঠি।
ওসিডি‘র প্রকাশিত পর্বগুলো পড়ুন—
ওসিডি (পর্ব-০১)
ওসিডি (পর্ব-০২)
ওসিডি (পর্ব-০৩)
ওসিডি (পর্ব-০৪)
ওসিডি (পর্ব-০৫)
ওসিডি (পর্ব-০৬)
ওসিডি (পর্ব-০৭)
ওসিডি (পর্ব-০৮)
ওসিডি (পর্ব-০৯)
ওসিডি (পর্ব-১০)