Author Picture

ওসিডি (পর্ব-০৭)

হারুন আল রশিদ

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৬)

সতেরো

স্যার আজ ভোর ছয়টায় এসে হাজির। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। সোনিয়া এসে বলে, “খালাম্মা খালাম্মা, কেডা জানি আইছে।” আমি ইন্টারকম টেলিফোনের শব্দ শুনি: কিরকিরকির কিরকিরকির। বাধ্য হয়ে উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানে লাগাই। আমাদের ম্যানেজার মাজহার বলেন, “ম্যাডাম, গেরামের স্যার আইছে।” ম্যানেজার কানে কম শুনেন। আমি বলি, “আসতে দেন।” আমি দরজা খুলি আর সোনিয়াকে বলি, “এখানে দাঁড়িয়ে থাক। মেহমানকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে দিস। দরজা বন্ধ করিস না।”

.            আমি রেডি হতে চলে যাই। বাথরুমে ঢুকে ভাবি চেয়ারম্যান স্যারকে ঘন্টা দুয়েক বসিয়ে রাখি। এমনিতেই আমার বাথরুমে বেশি সময় থাকতে হয়, যদিও তা পাগলের মতো এত বেশি নয়। সচেতনতা আসা মাত্র আমি আমার ব্রেইনকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করি। আমি পাগলকে বলেছিলাম একই রকম করতে। পাগল বলেছে, সে চেষ্টা করেছে, তাতে তার কোনও কাজ হয় না। তারপরও আমি চেষ্টা চালাই পাগলের জন্য। মাঝে মাঝে বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি, “মা, তোমার ব্রেইনকে বলো, তুমি পরিষ্কার আছো। চিৎকার করে তোমার ব্রেইনকে জানিয়ে দাও সে বেয়াদবি করছে। জানাও মা, জানাও। দেখবে তোমার ব্রেইন থেমে যাবে। তুমি পানির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে।” পাগল এখন আর আমার কথা শোনে না। পাগল বাথরুমে থাকা অবস্থায় এখন যদি আমি কিছু বলি, বাথরুম থেকে বের হয়ে পাগল আমাকে মারে। পাগল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবে না। আমি পাগলের উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি বের হয়ে আসব। আমি এসেছি। যদিও এখনও পুরোপুরি তা পারিনি। তবে ধীরে ধীরে আমি তা করে ছাড়ব। কোনও ডাক্তারের সাহায্য ছাড়াই।

.            আমি জানি চেয়ারম্যান স্যারের আমার জন্য যে ধৈর্য, তাতে দুই দিন তাঁকে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা সম্ভব। আমি যদি তেমনটা করি তিনি এমনকি বাথরুমেও যাবেন না, বড় বা ছোট প্রয়োজন, কোনওটাতেই সাড়া দেবেন না, ঠায় বসে থাকবেন, মগজে ডোপামিন তৈরি করবেন আমার চিবুক কল্পনা করে করে। আর সেতো মাত্র কথার কথা, কী কী কল্পনা করবেন তা কি আর আমি জানি না? উৎসের রাস্তা। বক্ষের চূড়া। কক্ষের জমি। আমার সমগ্র ফ্লোরা ও ফাওনা। আবহাওয়া ও জলবায়ু। এ অনেক লম্বা কাজ। কাজেই দুই ঘন্টার অপেক্ষাতো তাঁর জন্য কোনও ব্যাপারই না। ভাবি বেলা আটটায় আমি তাঁর সামনে যাব।

.            মনে যদিও একটু খোঁচা থেকে যায়। এটা করে কী লাভ আমার, নিজেকে জিজ্ঞেস করি। যা প্রত্যক্ষ করার তাতো করতেই হবে। সম্মুখীন হতেই হবে, প্রেমিকের হোক কি ঘাতকের হোক। আর একটু কষ্টও পাই মানুষটার জন্য। কী যে গভীর আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে। কত তীব্র তাঁর বাসনা। কী যে ব্যাকুলতা। যা এক নারীর আমি মিটিয়েছিলাম, মানে আমার পক্ষে যতটা মেটানো যায়, আফরোজ ম্যাডামের। সে কাজ এখনও আমাকে আনন্দ দেয়। মানুষের যে কোনও প্রয়োজন মেটানোইতো আমার কাজ। আমি দাতা। আমি তা-ই থাকতে চাই। আমি কি চেয়ারম্যান স্যারের সাথে দাতার আচরণ করেছি? করিনি। যদি এক অপরিচিত নারীর কামনার ডাকে সাড়া দিতে পারি, তা হলে চিরচেনা চেয়ারম্যান স্যারের ডাকে সাড়া না দেয়া নিশ্চয়ই একটা কঠোর নিষ্ঠুরতা। আমি চেয়ারম্যান স্যারের বাসনার কথা ভাবি। তিনি শয়নে স্বপনে জাগরণে টিকলো বোঁটায় ঠোঁট চুবানোর অপেক্ষায় জীবন পার করা মানুষ। একের পর এক। একের পর এক। এতে তাঁর কোনও ক্লান্তি নাই। তাঁকে এ ভাবে অবহেলা করা আমার জন্য কতটা নৈতিক? মানবতার জন্য না হোক, অন্তত করুণার খাতিরে। আমি মন নরম করে দ্রুত একটা টেলিফোন সেরে নিই। তারপর কাপড় বদলে মিনিট পনেরোর মধ্যে তৈরি হই।

.            গতকাল আমার অফিসের ভেতর আমার বিচলিত হবার কারণ ছিল। চাকরির জায়গাটা আমি নিষ্কলুষ রাখতে চাই। ওটা আমার শান্তির জায়গা। অবশ্য চেয়ারম্যান সাহেবের উৎপাতের বিষয়টা বাদে। তা ছাড়া এত ছোটখাটো বিষয়কে উৎপাত হিসাবে আমার আর ভাবার অবকাশ যে নাই, তা আমি জানি। অধিকন্তু, এসব সহ্য করাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ক্লাশ সেভেন থেকে এই উৎপাতের সাথে আমি পরিচিত। চেয়ারম্যান স্যার আমার পিছনে ঘুরছেন এক বছরেরও কম সময় হবে। তার আগেও আমার পেছনে কেউ না কেউ ঘুরেছেন। সব সময়। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে জীবনে এখনও একটা দিন পার করিনি যেদিন কোনও না কোনও পুরুষ আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত ছিল না, ক্ষেত্র বিশেষে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এমনকি চৌদ্দগোষ্ঠী পরিত্যাগ করে হলেও। কেউ কেউ সব জঞ্জাল, যার অন্তর্গত নবতিপর মাতা থেকে নবজাতক পুত্র সবাই ছিল, রাতের অন্ধকারে ঝেড়ে ফেলার, মেরে নদীতে ডুবিয়ে দেয়ার, কিংবা মাটি চাপা দেয়ার, কিংবা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলার, প্রতিজ্ঞাও করেছেন। চেয়ারম্যান স্যারকে এই প্রতিজ্ঞাগুলি করতে হয়নি। কারণ তাঁর বাড়ি খালি। “একেবারে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত,” তিনি বলেছেন। “আর বিশাল বাগান। সামনে পেছনে। আপেল গাছও লাগিয়েছি। সবুজ আপেল ধরে। পুরা চৌহদ্দি উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। আমরা আদম হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াব। বুঝছতো? একেবারে বেহেশতের মতো। দুনিয়ার মতো নয়। দরকার হলে একটা সাপও নিয়ে আসব। বিষদাঁত উপড়ে ফেলা সাপ। তোমার কোনও ক্ষতি করবে না। শুধু তোমাকে প্রেমের শীতল প্যাঁচে জড়িয়ে ধরবে। বেহেশতের মতো, বেহেশতের।” চেয়ারম্যান স্যার এখানেই থেমে যাননি। তিনি মাঝে মাঝেই বলেন, শুধু পৃথিবীতে না, কবরেও তিনি আমার সাথে শুতে চান। তবে কবরে আমার মৃতদেহের যে অবস্থা হবে তা চেয়ারম্যান স্যার কল্পনা করতে চান না। তিনি চান আমাদের কবর হোক সাহারা মরুভূমিতে, যেখানে লাশ পচে না। এক দিন তিনি আমাকে বলেন, ধরো তোমার আর আমার লাশ পুড়ে ছাই করে ফেলা হল। ছাইগুলিকে মিশিয়ে ফেলা হল। আমি তোমার মধ্যে মিশে গেলাম। তারপর আমাদের বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে দেয়া হল। আমি বলেছিলাম, স্যার, গুনা হবে। স্যার বলেছিলেন, হবে তা ঠিক, তবে কতটা? এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ না পড়লে যে গুনা হয়, ওই গুনা তার চেয়ে অনেক কম। আর আমিতো কোনও নামাজই পড়ি না। আমার স্যারের কথা শুনতে ভাল লাগে। নারীর অপানের পানে পুরুষের চোখ। এটা ফেরানোর কোনও শক্তি কি পৃথিবীতে আছে? আমার তা উপভোগ করতে কোনও দ্বিধা নাই।

 রাত তিনটায় যে তিনি গোসল শুরু করেছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর তা সন্দেহাতীত প্রেমের লক্ষণ। আমি কেন তবে প্রেম দেব না? উনি বরের সাজে না সাজলেও জামাইর সাজেতো সেজেছেন। আমার মনে লোভ হয়। বিজ্ঞানের বাণী: বয়স এখন আর ধ্বজের উত্থানে কোনও বাধা নয়। পাগলকে বললে কাজির ব্যবস্থা পঁচিশ মিনিটে সেরে ফেলবে। আর কাবিন হয়ে গেলে পাগল বয়োজ্যেষ্ঠ এই পণ্ডিতের মাথায় হাত রেখে জামাই বাবাজি বলে ডাকবে। তার জন্য পঞ্চাশ রকমের তরকারি রান্না হয়ে যাবে। পাগলের ওসিডি সেরে যাবে। তা যে সেরে যাবে তাতে কোনও সন্দেহ নাই। আমার হাতে খুন দেখে সে পাগল হয়েছিল। আমার আলিঙ্গনে জীবনবল্লভ দেখলে সে আরোগ্য লাভ করবে

.            ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমার মন ভরে যায়। স্যারের বয়স আমার চেয়ে পঁচিশ বছর বেশি। অথচ মনে হল আমার চেয়ে পঁচিশ বছরের ছোট কোনও কিশোরের সাথে আমি অভিসার করতে এসেছি। কী চমৎকার করে তিনি শেভ করেছেন। আর কী খুশবুই না ছড়াচ্ছেন। পরেছেন রক্তলাল কাশ্মিরি সোয়েটার। তার নীচ থেকে শান্তি-নীল টিশার্টের কলার স্যারের ভাঁজহীন গর্দানে উপর মসৃণ করে টানা। ফ্যাকাশে নীল জিন্সের হাঁটুর উপর দুটি অস্পষ্ট সাদা রঙের তালি। বলা চলে বয়সের সাথে মানানো স্টাইল। মাথা ভর্তি সাদা চুল। সেগুলোকে টেনে নিয়ে পেছনে বিশেষ একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বেঁধেছেন। স্যার এই ব্যান্ডগুলি প্রিটোরিয়া থেকে আনান। স্যারের চেহারায় রোশনাই আছে। দাদা ছিলেন উত্তর প্রদেশের জমিদার, যিনি তাঁর সময়ে ভবিষ্যৎ আঁচ করতে পেরেছিলেন। জমিদারি বিক্রি করে দিয়ে হিন্দুদের হাতে মার খেতে খেতে গত শতকের পঁয়তাল্লিশ সালে তিনি কোলকাতা পৌঁছেন। সেখানে এক বছর বসবাস করেন। ছেচল্লিশের আগস্ট মাসে আগের মারের শোধ নিতে দাদাসাহেব কোলকাতায় কতক হিন্দুকে জবাই করেন। সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়। আটচল্লিশে তিনি সপরিবারে ঢাকায় আসেন। এখন ধানমন্ডির দুইটা ব্লকের মালিক আমার স্যার। স্যার বলেছেন তিনি তাঁর দাদার চোখ পেয়েছেন। যেমন স্বচ্ছ তেমন তীক্ষ্ণ। এমন চোখ না হলে কি আর নারীকে দেখে আনন্দ পাওয়া যায়? যত্ম করা চকচকে সাদা দাঁত। তবে বয়সের সাথে সাথে ওগুলো ছোট হয়ে যাচ্ছে। ফাঁকগুলি দৃশ্যমান তবে বেমানান নয়। স্যারের মেদহীন পেট সোফিয়া লরেনের পেটের মতো মনোহর হবে বলে ধারনা করি। সুযোগ পেলে স্যারের পেটটা দেখে নেব। আশা করি কোনও চুল নাই ওখানে। স্যারের সব কিছু উৎকৃষ্ট আর মানানসই।

.            আর যা সতেজ লাগছিল স্যারকে। রাত তিনটায় যে তিনি গোসল শুরু করেছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর তা সন্দেহাতীত প্রেমের লক্ষণ। আমি কেন তবে প্রেম দেব না? উনি বরের সাজে না সাজলেও জামাইর সাজেতো সেজেছেন। আমার মনে লোভ হয়। বিজ্ঞানের বাণী: বয়স এখন আর ধ্বজের উত্থানে কোনও বাধা নয়। পাগলকে বললে কাজির ব্যবস্থা পঁচিশ মিনিটে সেরে ফেলবে। আর কাবিন হয়ে গেলে পাগল বয়োজ্যেষ্ঠ এই পণ্ডিতের মাথায় হাত রেখে জামাই বাবাজি বলে ডাকবে। তার জন্য পঞ্চাশ রকমের তরকারি রান্না হয়ে যাবে। পাগলের ওসিডি সেরে যাবে। তা যে সেরে যাবে তাতে কোনও সন্দেহ নাই। আমার হাতে খুন দেখে সে পাগল হয়েছিল। আমার আলিঙ্গনে জীবনবল্লভ দেখলে সে আরোগ্য লাভ করবে। অন্তত পাগলের পাগলামি সারানোর জন্য হলেও স্যারকে বিয়ে করার কথা আমার নিষ্ঠার সাথে বিবেচনা করা উচিত।

.            “অপেক্ষা একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না, তাই না স্যার?”

.            “ঠিক তাই, শিশিরকণা।”

.            “তা, এখন কী করবেন?”

.            “আমি একটু দরজাটা বন্ধ করি?”

.            আমাদের ড্রয়িং রুমের গড়ানো দরজাটা বন্ধ করা সহজ নয়। কাজটা শেষ করার পর সব সময় মনে হয় কাঁচের দরজাটা একমাইল টেনে আনতে হল। আসলে সব কিছু পুরনো হয়ে গেছে। তাই টানতে অনেক শক্তি লাগে। দরজাটা খোলা বা বন্ধ করার দরকার হলে আমাকে আর সোনিয়াকে একযোগে কাজ করতে হয়। সোনিয়া দুই দিন পর পর ভেজা কাপড় দিয়ে ওটার ধূলা মোছে।

.            “দরজাটা,” স্যার বলেন।

.            “বন্ধ করার দরকার নাই, স্যার,” আমি বলি। “কেউ এ দিকে আসবে না। কেউ উঁকিও দিবে না। ডান দিক থেকেও না। বাম দিক থেকেও না। আপনার গোপনীয়তা এখানে সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত।”

.            “আমি যে দরজা বন্ধ না করলে খোলা মনে কথা বলতে পারব না?”

.            “আপনিতো কথা বলতে আসেননি, স্যার। আপনি এসেছেন প্রেম করতে।”

.            স্যার চুপ হয়ে যান। আমি তাঁকে বুঝি। মানে আমি আমার এসব প্রেমিককে ভালোভাবে বুঝি। আর ওনাকে বুঝতে একটু বেশি সুবিধা হয়। ওনার চোখে অনেক কিছু ভেসে ওঠে। খুব কম পুরুষই তার চোখে ভেসে ওঠা কামনা লুকাতে পারে। তারপরও স্যারের ব্যাপারটা আলাদা। স্যারের চোখ থেকে কামনা উপচে উপচে পড়ে, জলপ্রপাতের মতো। তবে আমি ধারণা করি স্যারের গালের ত্বকের ভাষা দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। এক সময় তা সুস্পষ্ট ছিল। অবশ্য স্যারের গালে এখন অনুভূতি ফুটে না ওঠার জন্য স্যার নিজেই দায়ী। উনি প্রিটোরিয়া থেকে মাথার ঝুঁটি বাঁধার জন্য সাদা রাবারের ব্যান্ড আনলেও মুখের ত্বকের ভাঁজ পোড়ানোর জন্য হারবাল ক্রিম আনেন বার্সেলোনা থেকে। আমাকে ওই দুই শহরে তাঁর সাথে অবকাশ যাপনের নিমন্ত্রণ উনি অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন। বার্সেলোনাতে নাকি আমাকে যেতেই হবে। প্রেমের শহর। সোজাসাপটা প্রেম। যে প্রেমে মধু বেশি। ঝামেলা কম। হোটেলে তা সেরে ফেলে হেঁটে গিয়ে সাগরের জলে ধুয়ে ফেলা যায়। ভূমধ্যসাগরের উষ্ণ জল। সে জলের গলদা চিংড়ি আর চালের তৈরি পাইয়া নামক বিশেষ এক বিরানি খেতে নাকি অনেক স্বাদ। এক প্লেট খেলেই দেহে পুনরায় প্রেমের জোয়ার আসে। স্যার এক রাতে দশ প্লেট খেতে চান। দশ বার প্রেম করার জন্য।

.            “এমন সুযোগ আর কোথাও নাই, শিশিরকণা,” গত মাসে স্যার আমাকে বলেছিলেন।

.            “যাব, স্যার, যাব। আপনার সাথেই যাব। আর আমি কিন্তু এক রাতে দশ প্লেট পাইয়া খাব।”

.            আমার কথা শুনে স্যারের চোখ দুটি বড় হয়ে গিয়েছিল। যেন বরফের টুকরার উপর সূর্যের আলো পড়েছে। আমি স্যারকে বলিনি যে পাগলকে সাথে নিয়ে আমার বাসিলিকা দে লা ছেগ্রাদা ফেমিলিয়া আর ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আকাশচূম্বী ব্রোঞ্জ মনুমেন্ট, পিকাসো মিউজিয়াম, পার্ক গুয়েল ইত্যাদি দেখা হয়ে গেছে। গোসল করা হয়ে গেছে কোস্টা ব্রাভার শীতল জলে।

.            স্যার আবার দরজার কথা মনে করিয়ে দেন।

.            “দরজা বন্ধের দরকার নাই, স্যার।”

.            তিনি এমনভাবে ঢোঁক গিললেন যা দেখে বোঝা যায় স্যারের মুখে অনেক তরল জমা হয়েছিল। আমার মায়া বাড়ে। বেচারা। কী নেশাতেই না আছেন। কত অনিরাময়যোগ্য এই ব্যাধি। যত করেন তত নেশা বেড়ে যায়। আমি নিজ চোখে হামিদকে দেখেছি। এখন স্যারকে দেখছি। করিম চাচাকে দেখেছি। বাহার চাচাকে দেখেছি। সোনিয়ার আব্বা আর নানা আর ভাইদের কথা শুনেছি। মৃত্যুর আগে আর কাকে কাকে দেখব, আল্লাহ ভাল বলতে পারেন। রাশেদকেও সন্দেহ করি। সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করি ওকে। ওকে যেন আমাকে এমন বুভূক্ষু দেখতে না হয়। রাশেদ আমার ভাই। আমি ওর ভাল চাই। আমি চাই না আমার ভাই আমার স্যারের নেশা নিয়ে দেহ ত্যাগ করুক। আমার স্যার যে এই নেশা নিয়ে মরবেন, তাতে স্যারেরও কোনও সন্দেহ নাই, আর আমারও কোনও সন্দেহ নাই। হামিদ জানতে পারেনি কখন ওর নিশ্বাসটা চলে গেছে। স্যারও জানবেন না কখন তাঁর নিশ্বাসটা চলে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা শুধু দেখবে নেশার নিশানা। সিডনি-প্রবাসি স্ত্রী ও মেয়ে তিনটে এসে দেখবে স্বামী এবং পিতার গৌরবোজ্জ্বল স্তম্ভ। লুঙ্গি আর পাজামা যার বিজয় পতাকা।

আমার স্যার যে এই নেশা নিয়ে মরবেন, তাতে স্যারেরও কোনও সন্দেহ নাই, আর আমারও কোনও সন্দেহ নাই। হামিদ জানতে পারেনি কখন ওর নিশ্বাসটা চলে গেছে। স্যারও জানবেন না কখন তাঁর নিশ্বাসটা চলে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা শুধু দেখবে নেশার নিশানা। সিডনি-প্রবাসি স্ত্রী ও মেয়ে তিনটে এসে দেখবে স্বামী এবং পিতার গৌরবোজ্জ্বল স্তম্ভ। লুঙ্গি আর পাজামা যার বিজয় পতাকা

.            স্যার মালটিপল প্ল্যান নিয়ে কাজ করা জেনারেল। যুদ্ধে হার মানবেন কেন? আমার কথাগুলি খাঁটি না ন্যাকামো তা ধরতে না পেরে উনি হাসার চেষ্টা করেন। বইপত্র তাঁকে শিখিয়েছে, কাজের আগে হিরো হতে হবে।

.            “আমি তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি, শিশিরকণা। চূড়ান্ত কথা। তুমি আমাকে অপমান করছো। করো। দেখো আমার মনের দুর্বলতা। তোমার সাথে আমি কথায় পারব না। যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও, শুধু একটা প্রার্থনা রেখো।”

.            “আমিতো আপনার প্রার্থনা রেখেছি, স্যার।”

.            “কোন্ প্রার্থনা? এ পর্যন্ত তুমি আমার একটা ফরিয়াদও মঞ্জুর করোনি, শিশিরকণা।”

.            “স্যার, ভুলে গেলেন। আমি কি আপনাকে দু’চোখ ভরে আমার চিবুক দেখার শর্তহীন স্বাধীনতা দিইনি?”

.            মনে হল স্যার ছোট একটা লাফ দিলেন। নিশ্চয়ই তাঁর স্মরণে এসেছে কত আকুল হয়ে তিনি সেই প্রার্থনা করেছিলেন।

.            “তোমাকে ধন্যবাদ, শিশিরকণা। গত একটা বছর তোমার চিবুকখানাই ছিল আমার বেঁচে থাকার এক মাত্র প্রেরণা। বিশ্বাস করো, শিশিরকণা।”

.            “বিশ্বাস করলাম, স্যার। এখন বলেন আর কী প্রার্থনা আছে আপনার?”

.            “আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না, শিশিরকণা।”

.            “আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম, স্যার।”

.            এই বাক্যটি চয়নে আমি আমার কণ্ঠে দৃঢ়তার কোনও অভাব রাখিনি।

.            “কী বললে, শিশিরকণা? আমি যে মরে যাব।”

.            “মরে যান, স্যার। আপনার কবরে আমার জন্য জায়গা রাখতে পারেন।”

.            “আমরা এক কবরের বাসিন্দা হব, শিশিরকণা। সত্যি বলছ? সত্যি বলছ, তুমি? তুমিতো জানো এটাই আমার চূড়ান্ত স্বপ্ন।”

.            “জি, স্যার। হব। আমরা এক কবরের বাসিন্দা হব।”

.            “আমাকে তা হলে আর ফিরিয়ে দিয়ো না তুমি, শিশিরকণা। ফিরিয়ে দিয়ো না।”

.            “ফিরিয়ে দিলাম, স্যার।”

.            “এটা তোমার মনের কথা না।”

.            “এটা আমার মনে কথা, স্যার।”

.            “সত্যি বোলছ?”

.            “জি, স্যার।”

.            “এই জনমে যদি তোমাকে না পাই অন্য জনমেও পাব না।”

.            “কেন, স্যার।”

.            “তুমি জানো না, শিশিরকণা। পরকালে তোমাকে পাওয়ার পূর্বশর্ত হল তোমাকে এই জনমে পাওয়া। সেখানেতো অন্য ব্যবস্থা নাই, শিশিরকণা।”

.            “তা হলে কোনও জনমেই পাবেন না, স্যার।”

.            “কী বললে, শিশিরকণা? আর এক বার বলো। কসম খেয়ে বলো। তুমি এমন নিষ্ঠুর হতে পারলে, শিশিরকণা। কী করে? কী করে?”

.            “কসম খেলাম, স্যার। আর নিষ্ঠুরও হলাম।”

.            স্যার আমার দিকে তাকান। শিশুর মতো মুখ করে। এক অসহায় মানুষের বিরস বিবর্ণ মুখ।

.            “তুমি আমাকে মেরে ফেললে, শিশিরকণা। তুমি নিজেও জানো না কত নিষ্ঠুরভাবে তুমি আমাকে হত্যা করলে।”

.            “আপনিতো দিব্যি বেঁচে আছেন, স্যার।”

.            “শুধু এই দেহটা বেঁচে আছে। প্রাণ চলে গেছে, শিশিরকণা। তোমার দেয়া আঘাতে। দেহটাও চলে যাবে। অতি সত্ত্বর চলে যাবে। হয় পক্ষাঘাতে নয় হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।”

.            “আপনি আমাকে পাচ্ছেন না, স্যার।”

.            “তা হলে কেন তুমি আমাকে ডেকে এনেছো? কেন আমার আশাকে এমন করে জাগালে, শিশিরকণা?”

.            ডোপামিন, আহা, ডোপামিন, আমি মনে মনে বলি। “স্যার, আমি আপনাকে বাসায় ডেকেছি একটা কথা বলতে।”

.            “বলো, শিশিরকণা। যে কোনও কথা। শুধু একটা কথা বাদ দিয়ে। আর যে কোনও কথা বলতে পারো, শিশিরকণা। যে কোনও কাজ। কিছু বলার আগে বরং তুমি আমাকে তোমার পায়ের সেন্ডেল দুটি দিয়ে মারো, কয়েক ঘন্টা মারো আমাকে। তারপর বলো।”

.            আমি আমার দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনি। স্যারও শুনেন। আর আমার দিকে গলা টানটান করে তাকান।

.            “আপনি আর কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে হয়রানি করবেন না,” আমি বলি।

.            “কী বোলছ তুমি, শিশিরকণা? কীভাবে আমি তোমাকে হয়রানি করবো? তোমার প্রেমে আমি মরে যাচ্ছি। এই দুর্বলতা নিয়ে আমিতো একটা পিঁপড়াও মারতে পারব না, একটা মশাও তাড়াতে পারব না। তা হলে কী করে আমি তোমাকে হয়রানি করবো? তোমার মতো মেয়েকে আমি হয়রানি করবো? দিয়োনিসাস, ফ্রেয়ার, প্রিয়াপাস, শিব, গেব এদের সাহস আছে তোমাকে হয়রানি করার? আর আমি, যে টনসিলের ব্যথায় কাবু, মাইগ্রেন উঠলে যে চেঁচিয়ে কাঁদে, যে সর্দিজ্বর সহ্য করতে পারে না, সে তোমাকে হয়রানি করবে? তা কী করে সম্ভব, শিশিরকণা? কী অপবাদ দিলে তুমি আমায়?”

প্রেম যদি তা নাও হয়, উনি যেটার জন্য পাগল, যার নেশায় তিনি এমন পাগলামি করছেন, সেটাই দিয়ে দিই। তবে মনে হচ্ছে, ওনার সাথে প্রেমও সম্ভব। সন্দেহ করা আমার রোগ হয়ে গেছে, আমি নিজেকে ভর্ৎসনা করি। প্রেম সম্ভব। প্রেম সম্ভব! আমি নিজেকে বলি। এই জ্ঞানী বৃদ্ধের সাথে। নাকের অদৃশ্য রশির জায়গায় আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমি তাকে বাঁধি। এখান থেকে শুরু হোক। শুরু হোক আমার জীবনের আর একটা পরিবর্তন

.            এই যে তিনি এক কথায় পৃথিবীর পাঁচ কোনার পাঁচ দেবতার নাম নিলেন। তাঁর এ সব কথা কামনার অঙ্কুরে স্পন্দন সৃষ্টি করে, সে কথা অস্বীকার করি না। আর অঙ্কুরের আর্দ্রতার সাথে হৃদয়ের আর্দ্রতার সম্পর্ক নাই, এ কথা বলার মতো কপট আমি নই। তবু আমি সচেতনভাবে শ্বাস গ্রহণ করি। আর বলি:

.            “স্যার, আপনি কখনও আমার অফিসে ঢুকবেন না।”

.            “তা হলে, বাসায়?”

.            “না।”

.            “কোথাও না?”

.            “না, কোথাও না।”

.            “প্রতিদিন না হোক। মাঝে মাঝে? কাশবনে বা ফুলবনে?”

.            “কখনও না। কোথাও না। কক্ষেও না। গুহায়ও না।”

.            “তা হলে আমি কী ভাবে বাঁচব, শিশিরকণা?”

.            “আপনার আরও অনেক প্রেমিকা আছে। তাদের নিয়ে বাঁচবেন। আর কেউ না থাকলে আমার চিবুকের কথা ভাবতে পারেন। সহায়ক হিসাবে তেল আছে। যন্ত্রপাতি আছে। এগুলোর কথা আমরা উভয়েই জানি।”

.            “আমার কোনও প্রেমিকা নাই, কেউ নাই, শিশিরকণা। আমাকে মেরে ফেলো না।”

.            “প্রেমিকাদের নিয়ে বাঁচেন, স্যার।”

.            “এ সব মিথ্যা কথা, শিশিরকণা। আমার কোনও প্রেমিকা নাই। লোকে আমার নামে মিথ্যা কথা ছড়ায়। তুমি তাতে যোগ দিয়ো না, শিশিরকণা। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু আমার একটা কথা রাখো। একটা প্রার্থনা।”

.            “কী?”

.             “তোমার ভাবির সাথে ডিভোর্সের সব বন্দবোস্ত হয়ে গেছে।”

.            “আমি কী করব?”

.            “তুমি আমাকে ফেলে দিলেও ডিভোর্স হয়ে যাবে। এই আমার শেষ কথা, শিশিরকণা।”

.            “তা হয়ে যাক।”

.            “আমাকে শুধু একটা কথা দাও, শিশিরকণা।”

.            “কী কথা?”

.            “তোমাকে পাওয়ার সাধানাটা আমাকে চালিয়ে যেতে দাও। এটাই আমার প্রার্থনা।”

.            স্যার আমার পায়ের কাছে চলে আসেন।

.            আমি অবশ্য ড্রয়িং রুমে ঢোকার পর থেকে এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এর মধ্যে স্যার চোখের জলও ছেড়েছেন। স্যার একটু এগিয়ে এসে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকান। তারপর চোখ দু’টিকে জায়গামতো নিয়ে যান। এক ফোঁটা গরম অশ্রু আমার ডান পায়ের পাতার লম্বা হাড্ডিটার মাঝখানে পড়ে। যেখান দিয়ে একটা নীল শিরা চলে গেছে। স্যার আমার ত্বক আর শিরার সংবেদনশীলতাকে প্রভাবিত করেছেন। এখন রক্ত আহরণের কিংবা সেলাইনের জল ঢুকানোর জন্য এই শিরায় একটা মোটা সুঁই ঢোকাতে এমনকি সোনিয়াকেও বেগ পেতে হবে না। আমার দুই পায়ের উপর চেয়ারম্যান স্যারের চোখের পানি ঝরতে থাকে। পেটপেট করে।

.            “আপনার সব প্রেম আজ চোখের জলে বের করে দেন, স্যার,” আমি বলি।

.            “এই সুযোগ দেয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, শিশিরকণা। এখন তোমার দুই হাঁটুতে আমার কপালটা ঠেকাতে একবার অনুমতি দাও। শুধু একবার। শুধু একবার।” স্যারের অশ্রুবিন্দুগুলি ভারী হতে থাকে। এক একটা আমার বুড়ো আঙ্গুলে পড়ার পর মনে হয় ছিটকে গিয়ে কিছু অশ্রু আমার পাজামাতেও লাগছে। “একবার। একবার শুধু। শুধু একবার। শিশিরকণা।”

.            “ঠিক আছে,” আমি বলি।

.            পাঁচ কি সাত সেকেন্ড পর স্যারের মসৃণ কপাল আমার হাঁটুর উপর ঠেকে। স্যারের মাথার ওজন বেশি না। এরপরও আমি ফ্লোরে আমার পা দুটি চেপে ধরি, যাতে ওজনটা নিতে পারি। আমার দয়ালু মন। তার উপর আমি সংবেদনশীল নারী।

.            কাঁদতে কাঁদতে স্যার প্রতি সিরিজে তিন বার করে শ্বাস নেন। “জীবন আমার আবার ধন্য করে দিলে তুমি, শিশিরকণা। আজ আমি পরিপূর্ণতা পেলাম। আজ আমি সব পেলাম।”

.            আমি চুপ থাকি।

.            স্যার বলেন, “আমি সব পেলাম, সব। আমাকে শুধু এভাবে থাকতে দাও, শিশিরকণা। তোমার হাঁটুতে আমার কপাল রেখে একশ বছর আমাকে এভাবে থাকতে দাও। জীবনে আর কিছু চাই না। আর কিছু না। শুধু বাকি জীবনটা তোমার হাঁটুর উপর কাটাতে চাই।”

.            আমার বুকের পেশী আপনাআপনি একটা কাজ করে। ওদের সক্রিয়তায় সজোরে একটা নিঃশ্বাস আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে। সেই নিঃশ্বাসের চাপে আমার গলা থেকে জঙ্ঘা পর্যন্ত অঞ্চল তিনশ ষাট ডিগ্রি ঘেরে স্ফীত হতে থাকে। স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পর আমি সচেতনতার সাথে কোমলভাবে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের বাতাস বের করি। আমি ভাবি, হয়তো লোকটার বহুগামিতা বন্ধ হয়েও যেতে পারে। হয়তো সে এখনও প্রেমের সন্ধান পায়নি। যা পেয়েছে তা শুধু মুষ্কের চাপের মুক্তি। আর তাতো কোনও মুক্তিই নয়। কারণ ফেটে না যাওয়া পর্যন্ত এ আধার ভরতেই থাকবে। মস্তিষ্ক ক্ষয় হয়ে যাবে, হৃৎযন্ত্র ফুটো হয়ে যাবে, যকৃৎ ফাঁফা হবে, ফুসফুস শক্ত হয়ে যাবে, এই আধারের পুষ্টি জোগানোর জন্য। তবু দেহের কোনও অঙ্গ বিদ্রোহ করবে না। তা হলে তা মুক্তি হল কী করে? সাগরে ডোবা মানুষকে পেছন থেকে আসা এক ঢেউ উপরে তোলে, সাথে সাথে সামনে থেকে পেছন আসা আর এক ঢেউ টেনে নিচে নামায়। এ মুক্তি মুক্তি নয়। তবে যদি  সে প্রেম পায়, যদি সে প্রেমের ধরন বুঝতে পারে, তার নেশা কেটেও যেতে পারে। হামিদ, করিম, বাহার, রমিজসহ পৃথিবীর যাবতীয় পুরুষ যা খুঁজে পায়নি, এই স্কলার তা নিজের মধ্যে খুঁজে পাবে। শর্তহীন ভালবাসা। আমি তাঁকে দেব। আমার সেই স্বাধীনতা আছে। তা ছাড়া আমি যা শুনেছি, তাতো নিজ চোখে দেখিনি। ফলে ওই সব সত্য তা-ই বা কেন আমি ধরে নিচ্ছি। আহা। বেচারা কেমন করে পোশা কুকুরের মতো আমার হাঁটুর উপর মাথা পেতে রেখেছে। আমি আমার ভেতর নারীর হৃদয় অনুভব করি। অঙ্কুরের আর্দ্রতায় হৃদয় সিক্ত হলে তা যুদ্ধ। হৃদয়ের আর্দ্রতায় অঙ্কুর সিক্ত হলে তা শান্তি। প্রেম। আমি বুকের গভীরে মায়ার ছোঁয়া অনুভব করি। আমি তার মাথার চুলে হাত ঢুকাই। রেশমি সাদা চুল। জ্ঞানী মানুষের কোমল মোলায়েম চুল। যেন সুখের পরশ। আমি নরম করে হাতটা উপর নীচ করি। তালুর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত মোলায়মে রেশমি চুলের ছোঁয়া উপভোগ করি। তারপর চুলগুলি মুঠোজাত করি। মনে হয়, সম্ভব। এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আমাকে হয়তো খুনের অপরাধবোধ থেকে মুক্তিও দিয়ে দিতে পারে। তানিয়া তা পারবে না। তানিয়াকে নয়। বরং এঁকেই নিজের কথা বলি।

.            আমি স্যারের মাথার চুল শক্ত করে ধরি। আর অনুভব করি আমি আমার জীবনের অবলম্বন আঁকড়ে ধরলাম। স্যারের কান্না বাড়ে। শিশু যেমন অপরাধ করে মায়ের পরশের অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যের শেষ প্রান্তে এসে মায়ের পরশ পায় আর এক নিমেষে কেঁপে ওঠে কান্নার ধাক্কায়, তেমন করে স্যারের সারা দেহ ডুকরে ওঠে।

.            আমি যে একটা ইবলিশ তা নিজের কাছে স্বীকার করি। নইলে সেই অনুভূতিটাকে কেন এতক্ষণ চাপা রেখে দিয়েছি? কৃতজ্ঞতার অনুভূতি। আমি নিঃশ্বাস ফেলি। আমার ভেতরে কৃতজ্ঞতার ঢেউ উথলে ওঠে। ওঠে প্রেমের জোয়ার। জহিরের সাথে যখন পালিয়ে গিয়েছিলাম, তখন চাকরিটাতো এই চেয়ারম্যান স্যারের কারণেই থাকল। তখন উনি চেয়ারম্যান ছিলেন না। কিন্তু আমার চাকরিটা যাতে থাকে তার জন্য এমন কোনও ক্ষমতাবান ব্যক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না, যাঁর কাছে তিনি যাননি। অন্তত সে জন্য হলেও ওনাকে আমার কিছু দেয়া দরকার। প্রেম যদি তা নাও হয়, উনি যেটার জন্য পাগল, যার নেশায় তিনি এমন পাগলামি করছেন, সেটাই দিয়ে দিই। তবে মনে হচ্ছে, ওনার সাথে প্রেমও সম্ভব। সন্দেহ করা আমার রোগ হয়ে গেছে, আমি নিজেকে ভর্ৎসনা করি। প্রেম সম্ভব। প্রেম সম্ভব! আমি নিজেকে বলি। এই জ্ঞানী বৃদ্ধের সাথে। নাকের অদৃশ্য রশির জায়গায় আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমি তাকে বাঁধি। এখান থেকে শুরু হোক। শুরু হোক আমার জীবনের আর একটা পরিবর্তন। সব সময় তা খারাপ হবে কেন? আর হলেই বা কি? কী আর এমন হবে। পরীক্ষাটা করে দেখা যাক। আমি ঝুঁকতে থাকি। দুই বাহু ধরে স্যারকে আমার বুকে তুলে নেয়ার জন্য।

 

ওসিডি‘র প্রকাশিত পর্বগুলো পড়ুন—
ওসিডি (পর্ব-০১)
ওসিডি (পর্ব-০২)
ওসিডি (পর্ব-০৩)
ওসিডি (পর্ব-০৪)
ওসিডি (পর্ব-০৫)
ওসিডি (পর্ব-০৬)
ওসিডি (পর্ব-০৭)

আরো পড়তে পারেন

ওসিডি (পর্ব-১০)

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৯) উনিশ আমরা সিঁড়ি বেয়ে বারন্দাতে নামি। ড্যাব করে একটা আওয়াজ হয়। একটা ফুলের টব উল্টে গেছে। প্লাস্টিকের হালকা টব। মাটি আছে ওটার ভেতরে। সোনিয়া বসে গাছটার গোড়া ধরে ওটাকে টেনে তোলে। বারান্দার ছাদের বাইরের দিকের দুই কোনায় দুটি বাল্ব আছে। তাদের ঢাকনাগুলি বেশ পুরনো আর ওদের ওপর অনেক ধুলাও জমেছে। আবছা আলো।….

ওসিডি (পর্ব-০৯)

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৮) এরপর আমার আসল পরীক্ষা শুরু হয়। পাগল এক বালতি পানি আর একটা নতুন তোয়ালে নিয়ে এসে দরজার সামনে বসে যায়। পাগল পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে ফ্লোর মোছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দরজার সামনে আর যাওয়ার উপায় থাকে না। প্রথম ঝগড়াটা হয় আমার চপ্পল-জোড়া নিয়ে। আমার চপ্পল পাগলের মোছা ফ্লোর ময়লা করে। সেই চপ্পল যেই….

ওসিডি (পর্ব-০৮)

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৭) আঠারো শপাত! শপাত! .            কীইইই? আমি লাফ দিয়ে উঠি। সত্যিই কি চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে জুতার বাড়ি? আমি এতক্ষণে চিত হয়ে পড়ে যেতাম, যদি আমি এক যুগ আগের শিশিরকণা হতাম। সেই পতনে আমার মাথা ফাটত। কিন্তু আমি এক যুগ আগের শিশিরকণা নই। শপাত! শপাত! চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে আবার জুতার….

error: Content is protected !!