Author Picture

ওসিডি (পর্ব-০৫)

হারুন আল রশিদ

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৪)

নয়

.            উপদেবী এজিনাকে সুনিও গিরির নিচে সাদা বালুতটে স্নান করতে দেখে দেবরাজ জিউসের কামনার উত্থান ঘটে। সেই উত্থানের ঝড়ে দেবরাজের ক্লামিস খুলে যায় আর উপদেবীর কাইতেন উড়ে গিয়ে মাঝ সমুদ্রে পড়ে। কয়েক দিন সাগর জলে ডুবে থেকেও দেবরাজের ঘাম ঝরা বন্ধ হয় না। দেবরাজ এজিনাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। তিনি বলেন অপ্সরা এজিনা না নেভালে তাঁর কামনার আগুন মাউন্ট অলিম্পাসের জঙ্গল পুড়ে ছাই করে দেবে। তখন দেব-দেবীরা সূর্যের উত্তাপ থেকে কোথায় আশ্রয় নেবে? তারা যখন তখন লোকালয়ে হামলা করবে। যাকে তাকে ধরে নিয়ে কামনা মেটাবে। এজিনা পৃথিবীর নারীদের কথা ভেবে মহামহিম জিউসের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। জিউস এজিনাকে নিয়ে মিলনের উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে ছুটতে থাকেন। এজিনার পিতা নদ-দেব আসোপাস তাঁদের দেখে ফেলেন। তিনি তাঁদের তাড়া করেন। করিন্থে এসে আসোপাস রাস্তা হারিয়ে ফেলেন।

.            করিন্থের রাজা সিসিফাসের চোখ কিছু এড়ায় না। তিনি আসোপাসকে বলেন, যদি আসোপাস করিন্থের উপর এক বারোমেসে ঝর্না প্রবাহিত করেন তবে তিনি আসোপাসকে অপহরণকারীর পথ দেখিয়ে দিবেন। আসোপাস সিসিফাসের শর্ত পূরণ করেন আর কন্যাকে উদ্ধার করার জন্য সিসিফাসের দেখানো পথে জিউসকে তাড়া করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি জিউসের ছোঁড়া বজ্রের কাছে নতি স্বীকার করেন। জিউসের প্রেমে এজিনা রাজা একাসের জন্ম দেন।

.            দেবরাজ জিউসের ক্রোধ সিসিফাসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।

.            মৃত্যুদেব থানাটস আসেন সিসিফাসের জান কবজ করতে।

.            “পবিত্র জিউসের নির্দেশ,’ থানাটস সিসিফাসকে বলেন। ‘আমাকে তোমার আত্মাটা নিয়ে তারতারুসের গুহে ফেলে দিতে হবে।”

.            তারতারুস হল পরকাল হেডিজের নিকৃষ্টতম স্থান।

.            “পবিত্র জিউসের নির্দেশ শিরোধার্য,” সিসিফাস বলেন। “তার আগে আমি কি একটা ফরিয়াদ জানাতে পারি, মৃত্যুদেব?”

.            “কী চাও তুমি?”

.            “ধন্যবাদ, মৃত্যুদেব।” সিসিফাস থানাটসকে প্রণাম করেন। “আমি দেখতে চাই আপনি কেমন করে আপনার হাতের এই শিকলের গোছা দিয়ে আমাদের আত্মাকে বন্দি করেন।”

.            “এটা খুব সহজ ব্যাপার,” থানাটস বলেন। “দেখে নাও, সিসিফাস। এমন করে।”

.            থানাটস যেই সিসিফাসকে প্রাণসংহারের কৌশল দেখাতে যান অমনি সিসিফাস মৃত্যু-শিকল কেড়ে নিয়ে তা দিয়ে থানাটসকেই বেঁধে ফেলেন।

.            মাউন্ট অলিম্পাসে জিউসের নেতৃত্বে দেব-দেবীদের সভায় উপস্থিত পসাইডন, আথেনা, হেডিজ, হেরা, আপোলো, আরিস, আফ্রোদিতেসহ সব শক্তিমানের কপালে ভাঁজ পড়ে। সিসিফাস কত চালাক! যতক্ষণ থানাটস শিকলে বন্দি থাকবেন ততক্ষণ পৃথিবীতে কোনও মানুষের মৃত্যু হবে না। ক্রোধোন্মত্ত জিউসের নির্দেশে তাঁর পুত্র আরিস বলপ্রয়োগ করে থানাটসকে উদ্ধার করেন আর সিসিফাসকে তাড়া করতে থাকেন।

সিসিফাস জানেন তিনি বেশি দিন দেবতাদের ফাঁকি দিতে পারবেন না। সিসিফাসের মাথায় তখন আর এক বুদ্ধি আসে। থানাটস পুনরায় দেখা দেয়ার আগে সিসিফাস তাঁর স্ত্রীকে বলেন, যদি স্ত্রী তাঁকে সত্যিই ভালবাসেন, তিনি যেন সিসিফাসের মৃত্যুর পর তাঁর উলঙ্গ মৃতদেহ শহরের মূল চত্বরে ফেলে রাখেন। সিসিফাসের স্ত্রী তাঁর স্বামীর মতলব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করেন।

.            পরকাল হেডিজে এসে সিসিফাসের আত্মা হেডিজের রানি পেসেফোনিকে জ্বালাতে থাকেন। সিসিফাসের আত্মা বলেন কত নিষ্ঠুর তাঁর স্ত্রী। কেমন করে তিনি তাঁর স্বামীর প্রাণহীন দেহটা শহরের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, আর কেমন করে তা পচে চলেছে, কেমন করে কাক আর শুকুন একসাথে তাঁর উপর বসে পানি হতে থাকা তাঁর নরম মাংস ঠোঁট দিয়ে কাটছে। দয়ার রানী পেসেফোনি কী করে এমন অন্যায় মেনে নিতে পারেন? সিসিফাস পেসেফোনিকে দিনরাত উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। এক সময় পেসেফোনি সিসিফাসকে পৃথিবীতে ফেরার অনুমতি দেন। যাতে তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে তাঁর অপকর্মের জবাব নিতে পারেন।

.            পৃথিবীতে এসে সিসিফাস আর হেডিজে ফিরতে চান না। তিনি আবার দেবতাদের ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেন। জিউসসহ সব বড় বড় দেবতা সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা সিসিফাসকে আর কোনও সুযোগ দেবেন না। তাঁরা সিসিফাসকে শাস্তি দিবেন।

.            দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত মৃত্যুর পর হেডিজে এনে সিসিফাসকে পুনর্জন্ম দেয়া হয়। দেবতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মৃত্যুকে দুই বার ফাঁকি দেয়ার শাস্তি হিসাবে সিসিফাস এক ভারী শিলাখণ্ড ঠেলে ঠেলে উঁচু এক পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে উপরের দিকে তোলেন। পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলে পাঠানোর ঠিক আগে পাথরটা সিসিফাসের হাত ফসকে পড়ে যায় আর গড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে যেতে থাকে। সিসিফাস গড়ানো পাথরের পেছনে ছোটেন। আবার তিনি পাদদেশ থেকে ওই পাথরকে ঠেলে চূড়ার দিকে তুলতে থাকেন। চূড়ার কাছে এসে আবার পাথর সিসিফাসের হাত থেকে বের হয়ে যায়। আবার সিসিফাস গড়ানো পাথর তাড়া করেন। গোড়ায় এসে তার নাগাল পান। আবার সিসিফাস সে পাথর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরের দিকে ঠেলতে থাকেন।

.            সিসিফাসকে অনন্তকাল পাথরটা পাহাড়ের গা বেয়ে ঠেলে যেতে হবে।

.            সিসিফাস দেবতাদের দেয়া শাস্তি মেনে নেন। নিজের করনীয় হিসাবে। সিসিফাস কর্তৃক অনন্ত শাস্তি মেনে নেয়াকে হোমার প্রজ্ঞা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কামু হোমারের সাথে একমত। কামু এমনও বলেছেন আমাদের উচিত সিসিফাসকে সুখী মনে করা।

.            আমি শিশিরকণা। দাম্পত্যের অস্তিত্ব আমার দুর্ভোগের কারণ। আমি সিসিফাসের মতো তা মোকাবেলা করি।

 

দশ

.            তেরো বছর বয়সে জীবনে আমি প্রথম দাম্পত্যের বিপর্যয় দেখি। আমার আব্বা তখন ফেনীর ডিসি। আম-কাঁঠালের বাগানের ভেতর একটা লাল বাড়িতে আমরা থাকি। বারান্দায় গেলেই আমি একটি আমগাছ আর একটি কাঁঠালগাছ দেখতে পাই। আমার ঘরে সবার আগে সূর্য ওঠে। এর আগের বছর হেমন্তের এই সময়ে আমি আমগাছে হলুদ রঙের বোল ফুটতে দেখেছি।  যখন বোল আমে রূপান্তর হচ্ছিল তখন কাঁঠাল গাছে ফুল ফোটে। সাদা-হলুদ কাঁঠাল ফুল। ফুল থেকে মুচি বের হয়। রক্তের প্রকাশ আমার নারীর প্রকাশ এক ধাপ এগিয়ে দেয়। ফুল থেকে ফলের রূপান্তর দেখে দেখে আমি আমার বিকাশ অনুভব করেছি।

.            তার নয় মাস পরের ঘটনা। সে-দিন ভোরে আমি ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। সোনালি আলোয় আমার হাত ডুবে যায়। আমি আমার সীমানার আমগাছ আর কাঁঠালগাছ দেখি। দেখি কাঁঠাল পাতা। বৃষ্টি-ধোয়া কাঁঠাল পাতার রং। সবুজের সবচেয়ে খাঁটি রূপ। নিষ্পাপ কৈশোরের আলোয় ডুবে আমি ভাবছিলাম। এই বিশ্বে মানবী হিসাবে আমার আবির্ভাবের প্রভাব। সেই দিনের অনুভব আজকের পরিণত মস্তিষ্ক দিয়ে প্রকাশ করলে যা দাঁড়ায় তা হল: পৃথিবীতে আমি একটা আধ্যাত্মিক রাজত্ব করব। আমার অনুভব দিয়ে। আমার শরীরকে স্নান করানো বাতাসের ঢেউ পৃথিবীর এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছড়িয়ে যাবে। কামনার বারুদে কখনও আগুন লাগাব না। ওটা যেমন আছে তেমনি থাকবে। পৃথিবীতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা পারমাণবিক বোমাগুলির মতো। আহা, জীবন কত মধুর। রিক্সার টুংটাং শব্দে। হেমন্তের ধানের গন্ধ। আমার দেহের প্রতিটা কোষ দিয়ে আমি শরতের ভোরের রূপ-গন্ধ-স্পর্শ আস্বাদন করি। অথচ তখন সচেতনতা সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। না জেনেই আমি সচেতন, সপ্রতিভ। আসলে শিশুর চেয়ে সপ্রতিভ আর কে আছে। টেলিফোনের ঢ্রিং ঢ্রিং শব্দ আমার নিষ্কলুষ সপ্রিতভতার সুখে বিঘ্ন ঘটায়। আমার স্বপ্নপ্রয়াণ ভেঙ্গে যায়।

.            হ্যালো। আমি আমার আব্বার কণ্ঠ শুনি। তারপর আর কিছু শুনি না। মিনিটখানেক পরে আবার আব্বার কণ্ঠ শুনি। আচ্ছা।

.            আব্বা বারান্দায় এসে আমার ঘাড়ে হাত রাখে, সামান্য ভেজা হাত। ঘামে ভেজা। কিন্তু কেন?

.            “চলো,” আব্বা বলে। “করিমের বাড়ি।”

.            আমার ভাল লাগে। আব্বা আমাকে গুরুত্ব দেয়। আমার ভাই রাশেদ এখনও ছোট। ও শুধু দুধভাত খায়। আর আব্বা আমাকে বাইরে নিয়ে যায়।

.            বৈঠকখানায় ঢুকে আমি মাকে দেখি। সে রাশেদের জন্য দুধ-ভাত-কলা মাখছে। রাশেদ অপলকে মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন শুধু ওই দুধভাতই নয়, ও পৃথিবীর অন্য সব কিছু চায়। ও বসে বসে খাবে আর পৃথিবী ওর চতুর্দিকে জমা থাকবে। আমি আর আব্বা ওদের পেছনে রেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ি।

চাচি একটা অস্ত্র অর্জন করতে চেয়েছিলেন। গর্ভবতী হয়ে। করিম চাচার বুদ্ধির কাছে চাচি সেখানেও হেরে গেছেন। চাচির হাতে সেই অস্ত্র যাতে না যায় এই জন্য করিম চাচা নাকি পৌরাণিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। শুনেছি চাচি চাচাকে অজগর সাপের মতো বেড় দিয়ে ধরতেন। আর সাপের মতোই ফোঁসফোঁস করতেন। চাচা তারপরও দিশাহারা হতেন না। বিপদের জায়গায় অবোধ প্রাণকে তিনি ফেলতেন না। চাচি খামচে চাচার পিঠের মাংস তুলে ফেলতেন। সেটাই বরং চাচা মেনে নিতেন

.            আব্বা নিজে গাড়ি চালায়। গাড়িতে উঠে আমি বুঝতে পারলাম আব্বা কতটা বিচলিত। আব্বাকে কখনও এর আগে ভিড়ের রাস্তায় এত অধৈর্য হতে দেখিনি। ড্রাইভার কখনও ধৈর্য হারালে আব্বা বলত, রাজা মিয়া, আমি কি কখনও তোমাকে পেছন থেকে তাড়া দিয়েছি? না, স্যার, দেন নাই। এ কথা বলে রাজা মিয়া মসৃণভাবে গাড়ি চালাত। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পার হতে দেরি হচ্ছিল। আব্বা স্টিয়ারিং হুইলটার চারদিকে তার মুষ্টি দৃঢ়তর করে। পর পর তিনটা রিক্সার কারণে আমাদের সরকারি ভ্যানটা রাস্তায় যথেষ্ট জায়গা পাচ্ছিল না। কে যেন আব্বাকে চিনে ফেলল। ডিসি সাব গাড়িতে। তারপর সবাই বুঝে ফেলে। মুহূর্তে রিক্সাগুলি যে যে-দিকে পারে সরে যায়। একটা রিক্সা রাস্তা থেকে নেমে ঘাসের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর ফাঁকা রাস্তা। আব্বা এক নিশ্বাসে গাড়ি টেনে করিম চাচার লনে গিয়ে থামে।

.            আমরা লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামি। আর সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে লাল বাড়িটার দোতলায় উঠি। আব্বা বেশ জোরে করিম চাচার ফ্লাটের দরজায় নক করে। একটা মেয়ে আমাদের দরজা খুলে দেন। আমি মেয়েটাকে দেখি। সতেরো কি আঠারো বছরের একটা নাদুসনুদুস সুন্দরী মেয়ে। তিনি পান খাচ্ছেন আর তাঁর গা থেকে আতরের সুগন্ধ বের হচ্ছে। তাকে দেখে আমার বুক হালকা হয়। মানুষের চেহারা আর দেহভঙ্গী থেকে বের হওয়া বাতাস যে শান্তি ছড়াতে পারে সে বিশ্বাস আমার পোক্ত হয়। তবে সে নারীর মুখে কোনও হাসি নাই। আবার চোখে কোনও আতঙ্কও নাই।

.            আব্বা আমাকে টান দেয়। আমি কিছু শব্দ শুনি। অস্বাভাবিক শব্দ। আমি কান পাতি। আমি পেছনে ফেলে আসা মেয়েটার দেয়া শান্তি আর ধরে রাখতে পারি না। বরং অজানা শব্দগুলি আমার বুকে ঢিপঢিপ করে বাজা শুরু করে। আমরা করিম চাচার ফ্লাটের ভিতরের দিকে যাই।

.            মূল বেডরুমের দরজা ঠেলে আমরা ভেতরে ঢুকি। আব্বা বাতাসে ধাক্কা খায়। আমি ধাক্কা খাই আব্বার সাথে। আমি আব্বার ছাটনার কোনা দিয়ে উঁকি দিই। করিম চাচা একটা ধাক্কা খান। কিন্তু চাচির কোনও দিকে তাকানোর মতো অবস্থা নাই। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আমি জানতাম ওই দৃশ্য না দেখে ওখান থেকে ফেরা যাবে না। আমি জোর করে চোখ খুলি।

.            চাচি তাঁর লোহার ধজি দিয়ে চাচাকে পেটাচ্ছেন। চাচির নিশ্বাসের হুতাশ আর চাচার মনুষ্য-পেশিতে ধজির বাড়ির ধেব ধেব আওয়াজ ছাড়া পুরো বাড়িতে আর কোনও শব্দ নাই। মাঝে মাঝে প্রহারের শব্দ তীক্ষ্ণ হয়। তখন আবার আমার চোখ বন্ধ হয়ে যেতে চায়। ধজি চাচার হাঁটুতে বাড়ি দেয়। ঠাশ করে শব্দ হয়। আমি আর আব্বা ঝাঁকুনি খাই।

.            ধজি শব্দটা ফেনীর ভাষা। ধজি দিয়ে চুলার উপর বসানো তরকারি নাড়ানো হয়। বৈয়াম থেকে ধজি দিয়ে লবন তুলে তরকারিতে লবন দেয়া হয়। গ্রামের কোনও মহিলা তরকারিতে লবন কম বা বেশি দিলে তার স্বামী তাকে সংশ্লিষ্ট ধজি দিয়ে পেটায়। আমরা তখন ধজির এই তিনটা ব্যবহার জানতাম। ধজি সাধারণত কাঠের হয়। চাচির ধজি লোহার। আমি চাচার পিঠ দেখি। অন্তত বিশ জায়গায় কাটা। আমি মনে মনে বলি, চাচা আপনি কেন খালি গায়ে মার খেতে গেলেন? এখনতো জুলাই মাসের গরম পড়ছে না, যে গরমে ঘরের মধ্যে অবশ্য কোনও পুরুষই শরীরের উপরের অংশ ঢাকে না। ব্যতিক্রম শুধু আমার আব্বা। আমার আব্বার এমন কোনও গেঞ্জি নাই যা বাহুর অর্ধেক ঢাকে না। করিম চাচার পরনে একটা পাজামা ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি খেয়াল করি আমাদের উপস্থিতিতে করিম চাচার চোখে লেগে থাকা আতঙ্কের প্রলেপ ক্ষীণ হয়ে আসে। সেই চোখজোড়া তিনি আমাদের থেকে সরিয়ে নিয়ে নীরবে ধজির বাড়ি গিলতে থাকেন, যেমন করে কোনও সুবোধ শিশু চোখ নামিয়ে মাথা কামানোর সংবেদনশীলতা হজম করে।

.            ধজির একটা বাড়ি চাচার পাঁজরে পড়ে। চাচা কুঁকড়ে ওঠেন। তিনি ডান দিকে কাত হয়ে যান। অনুনয় করেন, “খাদিজা, রানের উপর মারো।”

.            চাচা তাঁর উরু দুটি চাচির দিকে বাড়িয়ে দেন। তিনি চাচিকে তাঁর রানের দিকে ইশারা করেন। চাচি আমার বা আব্বার উপস্থিতি স্বীকার করছেন না। তিনি এক কদম পিছিয়ে গিয়ে তাঁর কোমরের উপরের অংশ মেঝের সমান্তরালে এনে ডান হাত টেনে চাচার উরুতে দ্বিগুণ জোরে বাড়ি দেন। আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে চাচি কায়দা করে তাঁর ধজি দিয়ে চাচার রান আর গুলে আক্রমণ চালান।

.            “ভাবী, আপনি ওকে মেরে কি এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন?” আব্বা বলে।

.            “না, পারব না।” চাচি খেঁকিয়ে উঠেন। “আর আপনাকে কে বলেছে আমি সমাধান চাই?”

.            চাচি ধজিটা আকাশে ছুঁড়ে মারেন আর নৃত্যশিল্পীর দক্ষতায় লাফ দিয়ে ওটার আগাটা পাকড়াও করেন। উনি নিজের কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে নেন, তারপর ধজির গোড়াটা চাচার ডান চোখে ঠেসে ধরেন। চাচার মাথা কেঁপে ওঠে। শীতল ঘামে আমার জামা ভেজা শুরু হয়। চাচি এক হাতে ধজির গোড়া চাচার চোখে ঠেসতে থাকেন, অন্য হাতে চাচার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা টেনে ধজির দিকে আনেন।

.            আমার মুঠিতে থাকা আমার আব্বার শার্টের পাঁজরের উপর আমার বন্ধন দৃঢ় হয়। মনে হয় চাচার চোখ গলে তরল পদার্থের ফোয়ারা ছুটবে। এর পর আমার ভেতরের প্রত্যঙ্গগুলি শক্ত হতে থাকে। আমি চোখ ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাই, আমার চোখের সামনে মানবরচিত তিনটি চিরস্থায়ী দুঃখের উপমার একটি: চাচা-চাচির বিয়ের ছবি। সবুজ কাতান শাড়ি পড়া চাচি আর সবুজ পাঞ্জাবি পরা চাচার বিয়ের ওই ছবিটা আমার চোখে চিরতরের জন্য গেঁথে যায়, যে ছবি দেখলে যে কারও মনে হবে, বাসরে তাঁরা যে মিলন করবেন, তা চিরকালের, যে শূলে চাচা চাচিকে গেঁথে নেবেন, চাচি ইহকাল আর পরকাল কোনওকালেই সেই শূল থেকে এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে আলগা করতে চাইবেন না, প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবেন; আর চাচা, তিনি যে মধুর বানে ঠোঁট ডুবাবেন, মৃত্যু ছাড়া সেই ভাণ্ড থেকে তাঁর মুখ আলগা করার মতো পৃথিবীতে আর কোনও শক্তি নাই।

.            আমি প্রহসনের রূপকালঙ্কারের দিকে তাকিয়ে চাচার আর্তচিৎকারেরর জন্য অপেক্ষা করি।

.            চাচার আর্তচিৎকার আসে না। আর ওই ছবিটাও দেখতে আমার ভাল লাগছিল না। আব্বা একটু সরে দাঁড়ায়। আমিও আব্বার শার্ট ধরে চাচির ডান দিকে সরে যাই। সেখান থেকে চাচির মুখ দেখা যায়। আমি ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে চাচির দিকে তাকাই। তাকাই চাচার দিকে। দেখি চাচার চোখ তখনও গলেনি। তবে চাচির কাঁপুনি বেড়েছে। মনে হল না, চাচি একটা চোখ গেলে থেমে যাবেন। দুই চোখ হারালে চাচা জনমের মতো অন্ধ হয়ে যাবেন। আমার দুশ্চিন্তা হয়। অন্ধ চাচাকে কে দেখবে? ওই মেয়েটা দেখবে কি, যে আমাদের দরজা খুলে দিয়েছিল? আমি স্পষ্ট দেখতে পাই চাচা হাত-পা ছেড়ে দিয়েছেন। যেন চোখ গলে গেলে গলে যাক। তবু এই যাতনার শেষ হোক। চাচি ধজির আগা চাচার চোখে ঠেসতে থাকেন।

.            “দিলাম, এখনই দিলাম ঢুকিয়ে,” চাচি বলেন। “দেখি, তোরে কে বাঁচায়।”

.            আমি চাচার মুখের দিকে তাকাই। দেখি তাঁর বিকৃত মুখ। চাচা মাথা নাড়াতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কপালটা শক্ত হয়ে আছে। চোখ গলার ধাক্কা সামলানোর জন্য।

.            চাচি কাঁপেন। চাচার নিচের ঠোঁট ঝুলে গেছে। সেটা বেয়ে লালার ধারা গড়িয়ে পড়ছে। গালের পেশিকে কাজে লাগিয়ে বহু কষ্টে চাচা সেই ঠোঁট উপরের দিকে আছাড় দিয়ে কাতর হয়ে বলেন, “স্যার, আমি আল্লাহর আইনে কোনও অপরাধ করিনি।”

.            আমার আব্বা চাচার কথার উত্তর দেয় না। চাচি আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে একটা গালি দেন। গালি দিতে গিয়ে তাঁর চোখ ঘোলা হয়ে যায়। মনে হয় চাচি মূর্ছা যাবেন। আব্বা বুঝি চাচিকে ধরার জন্য প্রস্তুতি নেয়, যদি চাচি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু চাচি মূর্ছাও যান না, মাটিতেও লুটিয়ে পড়েন না। তবে চাচার চোখ থেকে যে তাঁর হাতের ধজি সরে গেছে, তা চাচার খেয়ালে নেই। আমি নিঃশ্বাস ছাড়ি। চাচির গালিতে লাল মরিচের ঝাঁজ। আমি বলছি আমার তেরো বছর বয়সে দেখা ঘটনা। এখন আমার বয়স সাঁইত্রিশ। আজ সকালে আমি আমার মাকে অনেক মন্দ গালি দিয়েছি। তারপরও আমি চাচির সে গালি এখানে উল্লেখ করতে পারছি না। তা উচ্চারণ করলে আল্লাহর আইন আর রাষ্ট্রের আইন, দুই আইনেই অপরাধ হয়।

.            “আমি রাষ্ট্রের আইনে অপরাধ করতে পারি, কিন্তু আল্লাহর আইনে কোনও অপরাধ করিনি,” করিম চাচা বলেন।

.            চাচি তাঁর ধজি দিয়ে করিম চাচার পিঠে চার-পাঁচবার বাড়ি দেন আর একই সাথে মুখ দিয়ে আল্লাহর উপর তাঁর ক্রোধ ঝাড়েন।

.            “একটা ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা করব, ভাবি,” আমার আব্বা বলে।

.            চাচি আব্বার দিকে তাকান। চাচির চোখে রং ফেরে। সে রং লাল। চাচির চোখ দুটি প্রায়ই লাল থাকত। আর তখন মনে হচ্ছিল চাচি এক মাস ঘুমাননি। চাচি তার চোখজোড়া আব্বার চোখে রেখে একটা কথা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে পরিষ্কার জানিয়ে দেন। যার অর্থ হল চাচির সমস্যা সমাধানে আমার আব্বা চাচির দেহের একটা নির্দিষ্ট অংশের একটা চুলও ছেঁড়ার ক্ষমতা রাখেন না। চাচির কথার বিভৎসতায় আমার মনে হল কেউ আমার পায়ের পাতা আর সেন্ডেলের মাঝে দুটি জ্বলন্ত তক্তা বসিয়ে দিল। চাচি যে চুলের কথা বলেছেন তার সম্পর্কে দশ বছর বয়সেও হয়তো আমি তেমন কিছু জানতাম না। অথচ তখন আমি তা নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলেছি। পায়ের পাতার পাশাপাশি আমার কান দুটিও পুড়ে যাচ্ছিল।

.            “পারবেন না, ভাই, পারবেন না। একটাও ছিঁড়তে পারবেন না।”

.            “অবশ্যই পারব,” আমার আব্বা বলে, আহাম্মকের মতো।

.            “কী?” চাচি গলা ফাটান।

.            “একটা কিছু সমাধানতো করতে পারব।”

.            “তা হলে করেন। এখনই সমাধান করেন। করে দেখিয়ে দেন।”

.            চাচি উধাও হয়ে যান আবার মুহূর্তের মধ্যে ফিরেও আসেন। চাচির হাতে চকচকে চাক্কু।

জীবনের শেষের দিকে এসে করিম চাচা ঝামেলায় পড়েন। যে পদ্ধতিতে তিনি স্ত্রীদেরকে নিঃসন্তান রাখতেন, তা নিয়ে নতুন চার স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে থাকে। তাঁরা এক জোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেন অন্তত তাঁদের এক জনকে সন্তান জন্ম দান করতে হবে। স্ত্রীরা এক জোট হয়ে এক জন আর এক জনকে বোন বলে সম্বোধন করেন, বলেন যে কোনও এক জনের একটা পুত্র সন্তান হলেই চলবে, তাঁরা সবাই সেই সন্তানের মা হবেন। তখন, বিশ বছর বিরতির পর, করিম চাচার পিঠে আবার দু-এক ঘা পড়তে থাকে

.            আমি এতক্ষণ কোনওমতে নিজেকে সামলেছিলাম। চাক্কুর রুপালি ধার দেখে মনে হল আমি পড়ে যাব। এর মধ্যে আমি ভেবে ফেলেছি, চাচি শুধু চাচাকে অপমান করে ছেড়ে দিবেন। এখন বুঝলাম আমার সেই ধারণা ভুল ছিল। মনে হল চাচি চাচার চোখ গেলে যথেষ্ট শান্তি পেতেন না। চাক্কু দিয়ে চাচাকে খতম করে তবে তিনি শান্ত হবেন। আব্বা আমাকে আড়াল করে। আমি আব্বার শার্ট ছেড়ে দিয়ে পিঠের পেশি খামচে ধরে নিজেকে সোজা রাখি।

.            “করেন, ভাই, করেন।” চাচি বলেন। “ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা করেন। আপনি আর আপনার মেয়ে,” চাচি দুইটা শব্দ উচ্চারণ করেন। একটা শব্দের লক্ষ করিম চাচার মা, যা চাচি বিশেষণে রূপান্তরিত করে মুখ থেকে ছুঁড়ে মারেন। আমার মাথা যথেষ্ট গরম না হলে ওইসব শব্দ আমি উচ্চারণ করতে পারি না। এখন আমার মাথা ঠাণ্ডা। তাই শব্দ দুইটা উচ্চারণ করতে পারছি না, যদিও তার একটা শব্দ আমি আর আমার মা আজ পরস্পরের উপর যথেচ্ছ বর্ষণ করেছি।

.            “হাত দুইটা ধরেন, ভাই,” চাচি বলেন, “আর আমি চাক্কুটা ব্যবহার করি।”

.            চাচি আসলে ব্যবহার করি, এই কথাটাও বলেনি। অন্য কিছু বলেছিলেন। চাচির উদ্দেশ্য পরিষ্কার। চাচি চাচার শরীরের একটা অঙ্গ সমূলে উৎপাটন করতে চান।

.            “এটাই ন্যায়সঙ্গত সমাধান,” চাচি বলেন। “যতক্ষণ ওটা আছে ততক্ষণ আমার আশা নাই। আর ওইটা না থাকলে এই জানোয়ারকে কেউ পুছবে না। যেমন নাকের ডাক তেমন, বুচ্ছেনতো, কিসের গন্ধ? আপনি থাকবেন এই জানোয়ারের সাথে, আপনি?” চাচি আব্বার দিকে লাফ দেন আর আব্বাকে মনে হয় একটা ঝড় পেছনের দিকে ঠেলে ধরেছে। “আজ আমি সেটা তালের শাসের মতো বের করে আনব,” চাচি বলেন। “আর সেটা রাস্তার কুত্তাকে খাওয়াব। কই, ধরেন!” চাচি আব্বাকে ধমক দেন।

.            আব্বা ধরল না।

.            “ধরছেন না কেন আপনি?”

.            চাচির চিৎকারে আমি কাঁপি, আব্বা কাঁপে, বোধ হয় ক্ষণিকের জন্য পুরো ফেনী শহর কাঁপে। কী যে চাচির অসহায়ত্ব!

.            চাচি চাক্কুটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারেন।

.            “বলছিলাম না, ভাই।” চাচি আব্বাকে আবার তার পশম উৎপাটনের অক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। “আপনি যে পারবেন না, তার প্রমাণ দিলাম, ভাই। দেখলেনতো? আপনি একটুও এগিয়ে এলেন না। না আপনি। না আপনার মেয়ে।”

.            চাচির শেষ কথা ছিল ওটাই: চাচির সমস্যা সমাধানের কোনও চাবিকাঠি আমার আব্বার হাতে নাই। চাচি একটা অস্ত্র অর্জন করতে চেয়েছিলেন। গর্ভবতী হয়ে। করিম চাচার বুদ্ধির কাছে চাচি সেখানেও হেরে গেছেন। চাচির হাতে সেই অস্ত্র যাতে না যায় এই জন্য করিম চাচা নাকি পৌরাণিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। শুনেছি চাচি চাচাকে অজগর সাপের মতো বেড় দিয়ে ধরতেন। আর সাপের মতোই ফোঁসফোঁস করতেন। চাচা তারপরও দিশাহারা হতেন না। বিপদের জায়গায় অবোধ প্রাণকে তিনি ফেলতেন না। চাচি খামচে চাচার পিঠের মাংস তুলে ফেলতেন। সেটাই বরং চাচা মেনে নিতেন। চাচি তখন বুঝে যান রাষ্ট্রের ক্ষমতা কিংবা দৈবের ক্ষমতা, কোনওটাই চাচির সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। রাষ্ট্র, দৈব, চাচি সবাই চাচার স্নায়ুর শক্তির কাছে অসহায়।

.            করিম চাচা চাচির মারকে ততটা ভয় পেতেন না যতটা ভয় পেতেন তিনি চাচির পরিবারকে। চাচির বাবা ছিলেন মুন্সেফ, জ্যাঠা ছিলেন আইজি। করিম চাচার চাকরি যাবার ভয়, জেলে যাবার আতঙ্ক। পুলিশের ডান্ডার বাড়ির চেয়ে চাচির ধজির বাড়িকে চাচা কম বিপজ্জনক হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। চাচি ছিলেন লম্বা, কালো, হালকা, আর তিনি বই পড়তেন। চাচা চাচির উচ্চতা, গঠন, গায়ের রং, বই পড়ার অভ্যাস কোনওটাই সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি ফর্সা, বেঁটে, মাখনের মতো নরম আর টসটসে অল্প বয়সী মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন।

.            সেই মেয়ে, যিনি আমাদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অনেক তথ্য পরে জেনেছি। সাতকানিয়া থানার কোনও এক গ্রামে করিম চাচার বাড়ি। মেয়েটির বাড়িও সেখানে। তিনি এসেছেন করিম চাচার সাথে সংসার করতে। গ্রামে একা থাকলে সুন্দরী মেয়েদের যেসব সমস্যা হয়, মেয়েটা সেসব সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা হত রাতে। সবাই ঘুমিয়ে গেলে গুণ্ডারা তাঁর জানালার বাইরে এসে শিস দিত, জানালার কাঠে ধাক্কা দিত। এই বুঝি জানালা ভেঙ্গে ওরা এক বা একাধিক ঘরে ঢুকে পড়ল। ভয়ে মেয়েটা সারা রাত গুটিসুটি হয়ে থাকতেন। এই আতঙ্ক থেকে বাঁচার জন্য তিনি করিম চাচার দ্বিতীয় স্ত্রী হতে রাজি হয়েছিলেন। আবার করিম চাচার সাথে করা সমঝোতা ভেঙ্গে তিনি করিম চাচার বাড়িতেও চলে এসেছিলেন।

.            ফেরার পথে সে দিন আমি মেয়েটাকে ভাল করে দেখি। মেয়েটা যেমন ছিল তেমনই। তাঁর মধ্যে না ছিল ভয়, না ছিল উচ্ছ্বাস। কিন্তু ওই অবস্থায়ও তাঁর মধ্যে কী যেন একটা জ্যোতি ছিল। শান্তি ছিল। সে ছিল ওসব দুর্লভ মানুষের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা মনের মধ্যে বাস না করে শরীরের মধ্যে বাস করেন। ফলে এঁদের সচেতনতার যেমন বিচ্যুতি ঘটে না, এঁদের সুখেরও কোনও অভাব হয় না, আর এঁদের সুখশান্তি কোনও পরিস্থিতির উপরও নির্ভর করে না, আর এঁরা দুশ্চিন্তায় সময় নষ্ট না করে সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যেমন মেয়েটা করেছিলেন। গুণ্ডায় ভর্তি গ্রাম ছেড়ে দিয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ জায়গা সতীনের বাড়িতে চলে এসেছিলেন।

.            চাচি সেদিনই স্বেচ্ছায় চলে যান। প্রথমে তিনি যান পিতার বাড়ি, পরে আমেরিকায়। সেখানে তিনি মনের মতো মানুষকে বিয়ে করেন। চার পুত্রের জননী হন। সেই সব পুত্রের কেউ সিলিকন ভ্যালিতে চাকরি করে, কেউ নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালায়। চাচি কিছু দিন আগে বিধবা হন এবং এখন তিনি একজন ইউটিউবার, সেলিব্রিটি। রাজনীতিবিদ, আমলা আর ব্যবসায়ীদের চাচি কচুকাটা করেন। চাচি বাংলাদেশে আসলে আমার সাথে দেখা করেন। চাচি করিম চাচার জন্য দুঃখ করেন, কিন্তু নিজের জন্য করেন না, কারণ তিনি শেষ হাসি হেসেছেন। চাচি সমাজের আচারকে গালি দেন, বলেন, শিশিরকণা, সমাজ আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, যার সামনে প্রথম সায়া খুলেছি, তাকে ছাড়লে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ আমার কোথাও কি একটা ফোস্কা পড়েছিল? না পড়েনি। সমাজের কেউ মরেছে? মরেনি। মরলে আমিই মরতাম। করিমের ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে কী যে শান্তি পেয়েছি, তোকে বলে বুঝাতে পারব না।

.            আমি মমতার সাথে চাচির কথা শুনি। আর নিজের কথা ভাবি। চাচি নিজেকে মুক্ত করেছেন। আমি চিরদুঃখে জড়িয়েছি।

 

এগারো

.            আমরা করিম চাচার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরও আব্বা অস্থিরভাবে গাড়ি চালায়। আমরা আমার মায়ের চেম্বারে যাই। ততক্ষণে মা সেখানে চলে এসেছে। আমি সেন্ডেল খুলি, আব্বা তার জুতা খোলে। আমার ডান পাশে কাঠের তৈরি জুতার তাক, তার নয়টা খোপের উপরের দিকের তিনটা খোপ খালি থাকে। আমি আব্বার জুতা আর আমার সেন্ডেল উপরের দুইটা খোপে রাখি। পাশের খোপে মার জুতা। রোগী দেখার বিছানাটার পর্দা সরানো। নার্স রেহানা ওটাতে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে। স্যাভলনের গন্ধ নাকে আসে। মনির নামক ছেলেটা বালতি আর তোয়ালা নিয়ে বের হয়ে যায়। মা এর মধ্যে সাদা হাত মোজা পরে ফেলেছে। মার থুতনিতে আকাশী রঙের মাস্ক ঝুলছে। আমি মা ছাড়া আর কোনও ডাক্তারকে হাত মোজা আর মাস্ক পরে রোগী দেখতে দেখিনি। এ জন্য মার কাছে রোগী বেশি আসে কি না কে জানে?  মা বিলাত থেকে এফসিপিএস পাশ করেছে। সে ওষুধের উপর বিশেষজ্ঞ। এ জন্য সব জায়গায় সে চিকিৎসা করতে পারে। সে আব্বার প্রত্যেক কর্মস্থলে চেম্বার খোলে। রোগী দেখে।

.            সে দিন শুক্রবার ছিল। তখন সাপ্তাহিক ছুটি রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবার করা হয়েছে। মায়ের টেবিলের উল্টা দিকের দুইটা চেয়ারের একটাতে বসে ছিলেন একটা লাল শার্ট আর সাদা টুপি পরা লম্বা লোক আর তার পাশে ধূসর রঙের হাফ-প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা একটা কালো রঙের ছেলে। লোকটার নাম আমিনুর রহমান চৌধুরী। ছেলেটা হামিদুর রহমান চোধুরী। এক জন আমার ভবিষ্যৎ শ্বশুর। এক জন আমার ভবিষ্যৎ স্বামী। আব্বাকে দেখে আমিনুর রহমান চৌধুরী উঠে দাঁড়ান।

.            “স্যার, আন্নে আইচেন্নে। বইয়েন।” আমিনুর রহমান চৌধুরী বলেন।

.            আমি টেবিলটা দেখি। নিখুঁতভাবে তাকে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। প্রতিদিন তা করা হয়। মা ছাড়া মার চেম্বারে কেউ জুতা পরে না। মার চেম্বারে পরার সেন্ডেল চেম্বারেই থাকে। মা কাজ শেষ করলে নার্সের দায়িত্ব হল ওই সেন্ডেলকে জীবানুমুক্ত করে জায়গামতো রেখে দেয়া।

 করিম চাচার মৃত্যু আসতে দেরি হচ্ছিল বলে সেই স্ত্রী অস্থিরতা দেখাতে শুরু করেন। একদিন করিম চাচার দেহ বাড়ির পাশের বিল থেকে উদ্ধার করা হয়। মামলা কোর্টকাচারি ইত্যাদি হয় আর ওই সময় সেই স্ত্রী কিছু দিন জেল খাটেন। তবে চূড়ান্তভাবে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পান। শুনেছি সেই স্ত্রী নাকি এখন করিম চাচার শান্তিনগরের ফ্ল্যাটে উঠেছেন। সাভারের এক চেয়ারম্যানকে বিয়ে করেছেন, যিনি প্রেমের প্রভাবে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন

.            আমিন চাচার পা খালি, হামিদেরও পা খালি। আমিন চাচা ব্যবসা করে জীবনের উন্নতির সংগ্রামে লিপ্ত। আমি হামিদকে দেখি। হামিদ তখন নবম শ্রেণির ছাত্র, বয়সে আমার থেকে তিন কি চার বছরের বড়। তখন আমার আব্বা বা মা কেউ ধারণাও করতে পারেনি এক দিন হামিদের সাথে আমার বিয়ে হবে। তখন আমি এত সুখী একটা কিশোরী ছিলাম যে প্রেম-পরিণয়-বিয়ে সব কিছু আমার কাছে হাস্যকর ছিল। আমি হামিদকে দেখি। ওর গলায় একটা ময়লার দাগ। বেচারা তখনও ভাল করে গোসল করা শেখেনি। আমার মায়া লেগেছিল। মন চাইছিল ওকে গোসল করা শিখিয়ে দিই। কিন্তু আসলে আমি হামিদের সাথে কোনও কথা বলিনি। আর হামিদও লাজুক ছিল। সেও আমার সাথে কোনও কথা বলেনি।

.            আব্বা আর আমিন চাচা করিম চাচার বিপদ নিয়ে আলোচনা করেন। আমিন চাচা বলেন, “স্যার, কী কন। আঁর উরপে ছাডি দেন।”

.            আব্বা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

.            রোগীদের আসা শুরু হলে আমিন চাচা ছেলেকে সাথে নিয়ে বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় আমিন চাচা আব্বাকে বলেন করিম চাচার ব্যাপারে কোনও চিন্তা না করতে। আম্মাকে কাজে রেখে আমি আর আব্বা বাসায় ফিরি। আব্বা জুমার নামাজের জন্য তৈরি হতে গোসলখানায় ঢোকে। আমার কানের লতিতে আগুনের তাপ আর নাই।  অথচ করিম চাচার বাড়িতে তখন মনে হয়েছিল, বাসায় ফিরে আমার দুই কানের উপর বরফ না ঘষলে আমার কান দুটি ঠাণ্ডা হবে না। এখন আমাকে রাশেদের জন্য দুধভাত মাখতে হবে। ঘুরে ফিরে তিন জন পুরুষ আর দুই জন মহিলা বাসায় কাজ করে। কিন্তু রাশেদের জন্য দুধভাত মাখি শুধু আমরা দুজন: আমি আর মা।

.            মা বোনের হাতে দুধ ভাত খাওয়া রাশেদকে কোন ওসিডি সর্বনাশ করেছে তা আমি জানি। হয়তো পুরোপুরি জানি না। হামিদ, রাশেদ, আমাদের চেয়ারম্যান স্যার সবাই একটা কমন ওসিডিতে আক্রান্ত। কিন্তু কেন? কোনও দিন সময় পেলে হয়তো তা ভাবব। আমার চৌহদ্দিতে হামিদের ভূতের কোনও উপস্থিতি এখন আর নাই। হামিদের জন্য আমার মায়া হয়। বেচারা বেঁচে থাকলে কত দুধভাত খেতে পারত। রাশেদ যেমন খেয়ে চলেছে। চেয়ারম্যান স্যার যেমন খেয়ে চলেছেন। করিম চাচাও অনেক দুধভাত খেয়েছেন মর্যাদাহীন মৃত্যুর কাছে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি দুধভাত খেয়েছেন বাহার চাচা। দুধভাত তাঁদের ওসিডির আর এক নাম।

 

বারো

.            আমার দাদা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। চট্টগ্রাম থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন। করিম চাচা আর আব্বা দুজনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সাঁতার না জানা আব্বা পতেঙ্গাতে সাগরের জলে ভেসে যাচ্ছিলেন। করিম চাচা আব্বাকে টেনে কূলে আনেন। যে জীবন এক সেকেন্ড পরে চলে যেত সে জীবন করিম চাচা আব্বাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। করিম চাচাকে আব্বা উপেক্ষা করতে পারত না। করিম চাচা মেধাবী মানুষ ছিলেন। যদিও দুধভাত ছাড়া আর কোনও কাজে তাঁর মেধা তিনি ব্যয় করেননি। আমরা ফেনী ছাড়ার পরও করিম চাচা আমাদের বাড়িতে আসতেন। এমনকি অনেক সময় তিনশ মাইল পথ পাড়ি দিয়েও এসেছেন। প্রথম স্ত্রী চলে যাবার পর করিম চাচা আরও চৌদ্দো কি পনেরোটা বিয়ে করেছেন। তবে তিনি আর কখনও কোনও বড়লোকের ঘরে পা মাড়াননি। গ্রাম থেকে বেছে বেছে তিনি সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করে আনতেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা চিকন ছিল করিম চাচা তাঁদের মধু আর মাখন খাওয়াতেন। বিছানায় করিম চাচার পছন্দ ছিল মোটা উরু আর ছুটন্ত অশ্বারোহীর মতো ঝম্পমান শরীর। করিম চাচা ঘি, মধু, মাখন খাইয়ে তাঁর পছন্দ মতো স্ত্রীদের দেহ গঠন করতেন। তদুপরি তিনি ওই সব স্ত্রীর ভাইদের বিদেশ পাঠাতেন, বোনদের বিয়ের খরচ দিতেন। বোনের স্বামীদের চাকরি দিতেন। ওদের কেউ কাউকে তালাক দিতে চাইলে তা যাতে সহজে তারা করতে পারে, তিনি তার ব্যবস্থা করতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদের পরিবারগুলোর আরও অনেক উপকার করতেন। কিন্তু তিনি ওই স্ত্রীদের কাউকে চার-পাঁচ বছরের বেশি রাখতেন না। শেষ পর্যন্ত চাচার জীবনে চারজন তরুণী স্ত্রী স্থায়ী হন।

.            জীবনের শেষের দিকে এসে করিম চাচা ঝামেলায় পড়েন। যে পদ্ধতিতে তিনি স্ত্রীদেরকে নিঃসন্তান রাখতেন, তা নিয়ে নতুন চার স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে থাকে। তাঁরা এক জোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেন অন্তত তাঁদের এক জনকে সন্তান জন্ম দান করতে হবে। স্ত্রীরা এক জোট হয়ে এক জন আর এক জনকে বোন বলে সম্বোধন করেন, বলেন যে কোনও এক জনের একটা পুত্র সন্তান হলেই চলবে, তাঁরা সবাই সেই সন্তানের মা হবেন। তখন, বিশ বছর বিরতির পর, করিম চাচার পিঠে আবার দু-এক ঘা পড়তে থাকে। এবার আর ধজির নয়, শলার ঝাড়ুর বাড়ি। ওই স্ত্রীরা সাতকানিয়া, মহেশখালি, রাঙ্গুনিয়া ইত্যাদি এলাকার শক্তপোক্ত শলার ঝাড়ু ব্যবহার করে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা সবাই গ্রাম থেকে শলার ঝাড়ু আনিয়ে  রাখতেন। বিবাদ শুরু হওয়ার পর করিম চাচার বাড়িতে শলার আমদানি ও ব্যবহার দুটোই বেড়ে যায়। অবসর জীবনে এসে করিম চাচা আগের মতো সহজে আর তালাক দিতে পারছিলেন না। আর সরকারের নারী ক্ষমতায়নের কর্মসূচীর  বদৌলতে পরের দিকের স্ত্রীদের কেউ কেউ বিএ, কেউ বা এমএ পাশ ছিলেন। এই স্ত্রীদের কারও পরিবারকে করিম চাচা ভয় পেতেন না, ভয় পেতেন শুধু স্ত্রীদেরকে। তাঁদের হইচই আর চেঁচামেচিকে তিনি ভয় পেতেন। স্ত্রীরা ব্যাপারটা বুঝে যান। করিম চাচাকে পেটানোর পাশাপাশি তাঁরা চেঁচানো শুরু করেন, যেন ঝাড়ুর বাড়ি করিম চাচার পিঠে নয়, তাঁদের পিঠে পড়ছে। শুনেছি তাঁরা করিম চাচার চারিদিকে জড়ো হয়ে নাকি একবার করিম চাচার কানের কাছে আর একবার জানালার দিকে ফিরে চেঁচাতেন। করিম চাচা চাইতেন দরকার হলে তাঁর স্ত্রীরা চেঁচিয়ে তাঁর কান ফাটিয়ে দিক, তারপরও কোনও আওয়াজ যেন জানালার বাইরে না যায়। যখন  তাঁরা বুঝলেন করিম চাচার কানের ধৈর্য অসীম তখন তাঁরা তাঁর কান ত্যাগ করে সব চেঁচামেচি জানালার বাইরে পাঠিয়ে দিতেন।

.            লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য করিম চাচা শান্তিনগরে তাঁর সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে সাভারে পাট ক্ষেতের মধ্যে একটা নিরিবিলি বাড়ি তড়িঘড়ি করে বানিয়ে ওটাতে উঠে যান। আগে দাম্পত্য গণ্ডগোলের শব্দ শুনে আসত আসেপাশের বাসার মানুষরা, যাঁরা এক সময় ককটেল ফোটার আওয়াজ শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠত। এখন পাটক্ষেত দ্বারা ঘেরা বাড়িতে আসে চাষীরা, মেম্বাররা, চেয়ারম্যানরা, আর অনেক গুণ্ডাপাণ্ডা, যারা এক সময় ককটেল ফোটাত। করিম চাচার অবস্থা শোচনীয় হয়। আব্বা মরে যাওয়ার পর করিম চাচাকে সাহায্য করার আর কেউ রইল না। এক জন তাঁকে সাহায্য করতে পারতেন, তিনি হলেন আমিন চৌধুরী, আমার প্রয়াত স্বামী হামিদের বাবা। আমি হামিদকে খুন করার পর করিম চাচার পক্ষে আর আমিন চৌধুরীর নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরও শেষ সময়ে করিম চাচা তিন জন স্ত্রীকে তালাক দিতে সমর্থ হন। এক জনকে রাখেন এই শর্তে যে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ওই স্ত্রী তাঁর সাথে থাকবেন। চাচার মবিল চেঞ্জ করার জন্য। চাচা নিজেকে গাড়ির সাথে তুলনা করতেন। মবিল চেঞ্জ না করলে গাড়ি যেমন অচল হয়ে যায়, চাচার বিশ্বাস ছিল তাঁর মবিল চেঞ্জ না করতে পারলে তিনিও অচল হয়ে যাবেন। নিঃসন্তান থাকার শর্তে চাচা ওই মেয়েটাকে তাঁর যাবতীয় স্থাবর এবং অস্থাবর সব সম্পত্তি লিখে দেন।

.            করিম চাচার মৃত্যু আসতে দেরি হচ্ছিল বলে সেই স্ত্রী অস্থিরতা দেখাতে শুরু করেন। একদিন করিম চাচার দেহ বাড়ির পাশের বিল থেকে উদ্ধার করা হয়। মামলা কোর্টকাচারি ইত্যাদি হয় আর ওই সময় সেই স্ত্রী কিছু দিন জেল খাটেন। তবে চূড়ান্তভাবে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পান। শুনেছি সেই স্ত্রী নাকি এখন করিম চাচার শান্তিনগরের ফ্ল্যাটে উঠেছেন। সাভারের এক চেয়ারম্যানকে বিয়ে করেছেন, যিনি প্রেমের প্রভাবে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের একটা ছেলেও হয়েছে। ঢাকা শহরে যেই দিন যে রেস্তোরাঁর উদ্বোধন হয়, ওই দম্পতি সেই দিন সেখানে খানা খান।

.            আব্বার সাথে বাহার চাচার কোনও আন্তরিকতা ছিল না। আর বাহার চাচার ভাগ্য করিম চাচার চেয়ে খারাপ ছিল। তাঁর বিয়ের ঘটনা করিম চাচার অনুরূপ, মার খাওয়ার ঘটনাও অনুরূপ। করিম চাচা ধর্মের কোনও বিধানই মানতেন না। আর বাহার চাচা ঘুষ খাওয়া ছাড়া ধর্মের অন্য অনুশাসনগুলি মেনে চলতেন। বাহার চাচা কখনও জন্মনিরোধের ব্যবস্থা করেননি। বছর দুয়েক আগে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাহার চাচার তেত্রিশ সন্তান-সন্ততি একদিন তাঁর মগবাজারের বাড়িতে এসে হাজির হয়। তারা পিতার চুল ছিঁড়ে, দাঁড়ি টানে, টাকের উপর আঘাত করে, পিঠে ঘুসি দেয়, পাছায় লাত্থি মারে। তারা তাঁকে মারতে মারতে কয়েকটা দাঁত উপড়ে ফেলে আর দুই হাঁটু জখম করে। মাস দুয়েক পরে বমি করতে করতে বাহার চাচা মরে শয়নকক্ষে পড়ে থাকেন। আমি খবরের কাগজে বিষয়টা দেখার পর খোঁজ নিই।

.            আমি অবশ্য প্রথমে তেত্রিশ নম্বরটাকে অতিরঞ্জণ মনে করেছিলাম। পরে শুনলাম মরহুম বাহার চাচার সন্তানের সংখ্যা আরও বেশি। বদলির চাকরি করার সুবাদে বাহার চাচা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাঁর বীজ বুনে গেছেন। ছোট দেশ, অল্প জায়গা, মানুষ বেশি, নারী বেশি, উর্বরতা আরও বেশি। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণি তাদের উত্তরাধিকার থেকে শান্তি আর নিরাপত্তা পায়। বাহার চাচা তাঁর বংশধরদের ভয়ে জীবনের শেষ দশ বছর নাকি ঘুমাতেই পারেননি।

.            তারপর আরও অনেক দাম্পত্যের বিপর্যয় আমি দেখেছি। কিন্তু এর সুরাহা কিসে কেউ বলতে পারে না। এক মাত্র আমাদের চেয়ারম্যান স্যার ছাড়া। তাঁরা কথা হল দাম্পত্যকে বেআইনি ঘোষণা করে তা ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হল এই বিপর্যয় ঠেকানোর এক মাত্র উপায়। স্যার জ্ঞানী মানুষ। তাঁকে বিশ্বাস করার কারণ আছে। কিন্তু স্যারের কথা শুনলে যে সাথে সাথে পৃথিবীতে কেয়ামত নেমে আসবে, তাতো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

 

ওসিডি‘র প্রকাশিত পর্বগুলো পড়ুন—
ওসিডি (পর্ব-০১)
ওসিডি (পর্ব-০২)
ওসিডি (পর্ব-০৩)
ওসিডি (পর্ব-০৪)
ওসিডি (পর্ব-০৫)
ওসিডি (পর্ব-০৬)
ওসিডি (পর্ব-০৭)

আরো পড়তে পারেন

ওসিডি (পর্ব-১০)

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৯) উনিশ আমরা সিঁড়ি বেয়ে বারন্দাতে নামি। ড্যাব করে একটা আওয়াজ হয়। একটা ফুলের টব উল্টে গেছে। প্লাস্টিকের হালকা টব। মাটি আছে ওটার ভেতরে। সোনিয়া বসে গাছটার গোড়া ধরে ওটাকে টেনে তোলে। বারান্দার ছাদের বাইরের দিকের দুই কোনায় দুটি বাল্ব আছে। তাদের ঢাকনাগুলি বেশ পুরনো আর ওদের ওপর অনেক ধুলাও জমেছে। আবছা আলো।….

ওসিডি (পর্ব-০৯)

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৮) এরপর আমার আসল পরীক্ষা শুরু হয়। পাগল এক বালতি পানি আর একটা নতুন তোয়ালে নিয়ে এসে দরজার সামনে বসে যায়। পাগল পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে ফ্লোর মোছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দরজার সামনে আর যাওয়ার উপায় থাকে না। প্রথম ঝগড়াটা হয় আমার চপ্পল-জোড়া নিয়ে। আমার চপ্পল পাগলের মোছা ফ্লোর ময়লা করে। সেই চপ্পল যেই….

ওসিডি (পর্ব-০৮)

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৭) আঠারো শপাত! শপাত! .            কীইইই? আমি লাফ দিয়ে উঠি। সত্যিই কি চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে জুতার বাড়ি? আমি এতক্ষণে চিত হয়ে পড়ে যেতাম, যদি আমি এক যুগ আগের শিশিরকণা হতাম। সেই পতনে আমার মাথা ফাটত। কিন্তু আমি এক যুগ আগের শিশিরকণা নই। শপাত! শপাত! চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে আবার জুতার….

error: Content is protected !!