
পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০২)
ছয়
আর যদি খুন না করতাম!
. কিছুই হত না। মানে এখন কিছু হত না। তখন অবশ্যই হত। আঙ্কুরা, হৃদয়া, আয়শা, তন্বী, তাম্বুরি, মোহিনী, শারিকা। এদের লাইভ দেখতাম। তাতেও আমার অসুবিধা ছিল না। আমিইতো সিনেমাগুলির পরিচালক ছিলাম। অসুবিধা ছিল আমার চাহিদা পূরণ না হওয়াতে। আমার চাহিদা ছিল আলাদা বিছানা। হামিদ তা দিতে রাজি ছিল না। হামিদের কথা ছিল বিছানা আলাদা করলে আম্মা মরে যাবে।
. আম্মা মরে গেলে মরে যাক, আমি বলেছিলাম। হামিদ বলল, তা কী করে হয়? আম্মাকে আব্বা তার বিছানা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আম্মা যদি দেখে ছেলেও তার বউকে বিছানা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তা হলে আম্মা মরে যাবে।
. তরী চৌধুরীর জীবন রক্ষা করার জন্য আমাকে হামিদের সাথে ঘুমাতে হবে? হামিদ বলল, কেন, তরী চৌধুরীর জীবনের কী কোনও দাম নাই? সে কইতরি বেগম থেকে তরী চৌধুরী হয়েছে, এই জন্য তার জীবনকে তুচ্ছ মানতে হবে? আর তুমি শিশিরকণা হয়ে জন্মেছো, শিশিরকণাই রয়ে গেছো, শিশিরকণাই থাকবে, এই জন্যই কি শুধু তোমার জীবনের দাম? এটা কেমন কথা, শিশিরকণা? এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
. আমি হামিদের কথার যুক্তি অস্বীকার করতে পারি না। তরী চৌধুরীকে তার স্বামী বিছানা থেকে বের করে দিয়েছে, সে জন্য তরী চৌধুরী শাস্তি পাচ্ছে। তরী চৌধুরীর ছেলে তার নিজের স্ত্রীকে বিছানায় আটকে রেখেছে, সে জন্য আমি শিশিরকণা শাস্তি পাচ্ছি। তরী চৌধুরীর ছেলে যাতে ছেলের বউকে বিছানা থেকে তাড়িয়ে না দেয়, তরী চৌধুরী তা দিনরাত খেয়াল রাখে। যখন তখন সে আমাদের ঘরে ঢোকে। রাতে চার থেকে ছয় বার আমাদের বেডরুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। বারান্দায় মার্বেলের ফ্লোরে চপ্পলের ঘষা দিয়ে উপস্থিতি জানান দেয়। আমি জানি বাতিঘর জ্বলছে। জ্বলবে না কেন? তরী চৌধুরীর চোখে ঘুম নাই বিছানা আলাদা হওয়ার জন্য। আমার চোখে ঘুম নাই এক বিছানায় আমাকে ঠেলে দেয়ার জন্য।
. হামিদ যদি আমাকে আলাদা বিছানায় থাকতে দিত, তাতে তরী চৌধুরী যে মরেই যেত, তা অবশ্য হলফ করে বলা যেত না। তবু তরী চৌধুরী মরে যাক, আমি তা চাইতাম না। কিন্তু তারপরও আমি হামিদকে সহ্য করতে পারতাম না। তবু সহ্য করে গেছি। হয়তো শেষ পর্যন্ত করতাম। কিন্তু হামিদতো জহিরকে পৃথিবী থেকে সরিয়েছে। হামিদ জহিরকে হত্যা না করলে আমি তার জন্য অবশ্যই কিছু একটা করতাম। যদিও হামিদ নিজ হাতে জহিরকে খুন করেছে কি না, আমি তা জানি না। হামিদ তা স্বীকার করেনি। জহিরের হত্যার সাথে হামিদের সংশ্লিষ্টতা ধরা পড়ার পর হামিদ আমার সাথে আর একটা সত্য কথাও বলেনি। অবশ্য ভয়েই বলেনি। তখন থেকে হামিদ সত্য কথা বলা ভুলে গেছে। হামিদ মিথ্যা বলত বলে আমি আরও বেশি চটে যেতাম। ওই সময় এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভাল অফারটা আমিই হামিদকে দিয়েছিলাম। আমাকে তালাক দিতে। আমি বললাম, হামিদ, পাঁচ কোটি টাকা কাবিনের এক টাকাও আমার দরকার নাই। আমি শুধু তালাক চাই।
. হামিদ আমাকে তালাক দিবে না। কারণ এমন খবর পেলে নাকি তার গ্রামে থাকা দাদি ছলেমা বেগম মরে যাবে। আমি বললাম, হামিদ, আমি ছলেমা বেগমকে বাঁচাই, তুমি লাইভ খেলো। আমি সব প্রযোজনা, পরিচালনা ও পরিবেশনা করব। শুধু আমাকে একটা আলাদা খাটের ব্যবস্থা করে দাও, তাও প্রতি রাতে ছয় ঘন্টা করে। আর না ঘুমিয়ে আমি থাকতে পারছি না।
. হামিদ বলে ঘুমের ওষুধ খাও। আমি ঘুমের ওষুধ খাই। হামিদ বলে আমি তোমাকে চাই। আমি দুইটা করে ঘুমের ওষুধ খাই। হামিদকে বলি যা করার তা আমার ঘুমের মধ্যে করে নিয়ো। হামিদ চেষ্টা করে আমি যখন ওষুধ খেয়ে স্বপ্নে থাকি তখন কাজ শেষ করার। আমার হামিদকে লাত্থি মারতে ইচ্ছে করে। ঘুমের বড়ি খেয়ে যে ঘুম হয় তার দংশন জেগে থাকার দংশনের চেয়ে খারাপ। ঘুমের ওষুধ খেলে আমি ঘুমের দেশে না গিয়ে স্বপ্নের দেশে চলে যেতাম। এক এক বার মনে হত আমি হামিদের সাথে একশ বছর কি দুশ বছর ধরে আছি। হামিদ বছরের পর বছর বিরতিহীন ভেতর বার ভেতর বার করে যাচ্ছে। সে যে কী আতঙ্ক। যার সাথে এক দিন থাকতে পারি না, তার সাথে একশ বছর থাকা। যে পাঁচ মিনিট ভেতর বার করলে গলার অর্ধেক কাটা হাস,মুরগি,গরু, ছাগলের জবাই হওয়া থেকে প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ের পাঁচ মিনিটের ছটফটের মতো আমি ছটফট করি, সে আমার দুঃস্বপ্নে বছরের পর বছর ভেতর বার ভেতর বার করে গেলে কেমনটা লাগে। এটা স্বপ্নে ঘটে বলে কষ্ট হয় বহুগুন। তখন আমি চিন্তা করি, আমার বরং জাগরণের শাস্তিই ভাল, ঘুমের বড়ির ঘুম নামের দুঃস্বপ্নের শাস্তি থেকে। জাগরণে আমি সময়মতো হামিদকে ঠেলে সরাতে পারি। দুঃস্বপ্নের মাঝে আমি তা পারি না।
. আমি হামিদকে বলি, তুমি মা আর দাদিকে বাঁচাও। আমি আমাকে বাঁচাই। এসো আমরা লাইভের সংখ্যা বাড়াই। বিনিময়ে আমার সাথে তোমার কিছু করা চলবে না। হামিদ বলে, আমি বরং আর কোনও লাইভই করব না, আমার লাইভের দরকার নাই। তুমি বরং শুধু তোমাকে দাও।
হামিদ আমাকে তালাক দিবে না। কারণ এমন খবর পেলে নাকি তার গ্রামে থাকা দাদি ছলেমা বেগম মরে যাবে। আমি বললাম, হামিদ, আমি ছলেমা বেগমকে বাঁচাই, তুমি লাইভ খেলো। আমি সব প্রযোজনা, পরিচালনা ও পরিবেশনা করব। শুধু আমাকে একটা আলাদা খাটের ব্যবস্থা করে দাও, তাও প্রতি রাতে ছয় ঘন্টা করে। আর না ঘুমিয়ে আমি থাকতে পারছি না
. যদিও হামিদ লাইভে না গেলেও আমার অবস্থার কোনও পরিবর্তন হত না। তবে হামিদ লাইভে যাবে না, ওটা ছিল ওর মিথ্যা কথা। অবশ্য ওই মিথ্যায়ও আমার কিছু এসে যেত না। আমি হামিদকে যতই লাইভ করাই না কেন, হামিদ আমার অগোচরে অতিরিক্ত কিছু লাইভ করত। হামিদ বলত, প্রকাশ্য ও গোপন লাইভ দুইটার দুই রকম মজা। তুমি আমাকে একটার সুযোগ দিচ্ছ, এই জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি অন্যটা ছাড়ব কেন? খানাপিনা, পোশাকআশাকে আর কত টাকা যায়? রাস্তাঘাট নাই যে একটা ভাল গাড়ি চালাব। র্ফেরারা গিয়ে কারখানা থেকে পছন্দ করে একটা ফেরারি এনে কাঁধে করে নিয়ে সেটা আবার র্ফেরারাতে ফেরত দিয়ে এলাম। লাইভই একমাত্র জায়গা যেখানে একটু হাত খুলে খরচ করা যায়। আর খরচই যদি না করি, তা হলে এত টাকা কামাচ্ছি কেন? কবরেতো যাব খালি হাতে। আর আমার হার্টের বাল্বের যে অবস্থা তাতে যত বেশি লাইভ যত তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে পারি তত ভাল। ফুট্টুশ হয়ে গেলে এত টাকার কী হবে? আর তুমিতো আমাকে বাচ্চা নিতেই দিচ্ছ না। তাতে আমারও বেশি আগ্রহ নাই। কারণ বাচ্চা মানেই লাইভে বাগড়া। বেশি বাচ্চা বেশি বাগড়া। আমার জন্য লাইভই ভাল।
. হামিদের আম্মা আর আব্বা বাচ্চার জন্য চাপাচাপি করত। হামিদ তা করত না। এ জন্য আমি হামিদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলাম। তবে আমার বাচ্চা হবে কি হবে না, এ ব্যাপারে আমাকেই সব সাবধানতা অবলম্বন করতে হত। হামিদ কোনও ব্যবস্থায় রাজি ছিল না। কারণ হামিদের পক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ মানেই হামিদের আনন্দের কর্তন। হামিদ বলে, আমি ব্যবস্থা নিতে যাব কেন? দুই একটা যদি হয়েই যায়, সমস্যা কী? এত টাকা কে খাবে? তবে লাইভের বিবেচনাটা সবার আগে, হামিদ বলে। এতে কোনও ছাড় দেয়ার সুযোগ নাই।
. আমি বলি, হামিদ, আমিও জানি, তুমিও জান, তুমি কোনও লাইভই ছাড়তে পারবে না। এসো আমরা তোমার প্রকাশ্য ও গোপন লাইভ দুটারই সংখ্যা বাড়াই। শুধু আমার সাথে তোমার কিছু করা চলবে না। আর কেন তা চলবে না, সে কথাও বেশি জিজ্ঞেস করতে যেয়ো না।
. হামিদ বলে, আমাকে তুমি মেরে ফেলো। হামিদ উড়ে গিয়ে ঠাশ করে ওর আলমারি খোলে। খট করে মাঝের একটা ড্রয়ার খোলে। ডান হাত ড্রয়ারে ঢুকিয়ে হামিদ তার প্রিয় গুলি-ভর্তি-করা রুগার সুপার রেডহক পিস্তলটা বের করে এনে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। আমার হাতের উপর হাত রেখে হামিদ পিস্তলের মুখ তাক করে। পিস্তলের মুখ হামিদ তার বুকে ঠেকায়, আর বলে, গুলি চালাও, আমি গুলি চালাই না, তখন হামিদ আমার দুই হাত নিপুণভাবে ঘুরিয়ে পিস্তলের নল তার মুখে ঢুকায়, গলা পর্যন্ত, লাইভের মতো, আর সহসা আমার দুই হাত ছেড়ে তার দুই হাত দিয়ে ইশারা করে, চালাও গুলি।
. আমি হামিদের মুখ থেকে টেনে বের করে পিস্তলটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারি। হামিদ একটা ছোট বাচ্চার মতো অভিযোগ করে, আলজিহ্বার মতো দেখতে পিস্তলের নিশানা ঠিক করার ফ্রন্ট সাইট হামিদের আলজিহ্বায় খোঁচা দিয়েছে। আমি বলি, সেরে যাবে। কে তোমাকে বলেছে, পিস্তলের নল গলায় ঢুকাতে?
. হামিদ বলে, না হলে তুমি আমাকে মারবে কী করে?
. আমি বলি, হামিদ, আমি খুনাখুনিতে নাই। সহজ সমাধান। আমাকে তালাক দাও। এই দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার তালাক হচ্ছে। এক বার তালাকটা দিয়েই দেখো না, মুক্তির কী আনন্দ। সারা বিশ্বে প্রতি ঘন্টায় লক্ষ লক্ষ তালাক হচ্ছে। তুমি আমাকে তালাক দাও, হামিদ। অথবা আমি তোমাকে তালাক দিই। একেবারে আপসে। দেখো, কোনও খরচ নাই, কোনও অসুবিধা নাই। কেউ জানবে না। দুজনেই আমরা মিটমাট করে ফেলতে পারি।
. হামিদ বলে, পাঁচ কোটি টাকার কাবিন। আমি তোমার ব্যাংকে দশ কোটি টাকা এখনই ঢুকিয়ে দিচ্ছি। সোনালী ব্যাংকে তোমার অ্যাকাউন্ট, তাই না? তোমার চেকবইটা বের করো। একটা ছবি তুলে নিই। কালকেই তোমার অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যাবে। তবে তুমি তালাক চেয়ো না।
. আমি বলি, তা হবে না, হামিদ। আমার টাকার দরকার নাই। আমি শুধু তোমার থেকে স্বাধীন হতে চাই। আমার কোনও টাকা লাগবে না। তোমার লাগলে তুমি বলো। আমার অ্যাপার্টমেন্ট তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।
. হামিদ বলে, টাকার গরম দেখিয়ে তুমি আমার সাথে পারবে, শিশিরকণা?
. আমি বলি, পারব না।
. হামিদ বলে, তা হলে টাকার গরম দেখিয়ো না। বরং তোমার কত লাগবে, তা বলো?
. আমি বলি, তালাক ছাড়া আমি আর কিছু চাই না।
. হামিদ বলে, তালাক হবে না। তুমিতো দেখেছো, আব্বা সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে, কচি কচি মুরগি জবাই করছে, কচি কচি ডাব ফাটাচ্ছে। গত মাসে গেছে রোমানিয়া। এই মাসে নিকারাগুয়া। সামনের মাসে যাবে ইউক্রেইন। চিন্তা করে দেখো। কত হুজ্জতের ব্যাপার। ব্যবসার নামে কচি মুরগির সন্ধানে; কচি ডাবের সন্ধানে; কাস্টমাইজড দুধ, মধু আর ক্ষিরের সন্ধানে। তারপরও আব্বা কিন্তু আম্মাকে তালাক দিচ্ছে না। কারণ তালাক দিলে বাড়ির দারোয়ানরা আমাদের সবার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে; মসজিদের ইমাম বাঁকা চোখে তাকাবে; অন্য চাচারা যারা নতুন নতুন মুরগি জবাই করছে আর নতুন নতুন ডাব ফাটাচ্ছে তারা বাঁকা চোখে তাকাবে; ক্লাবের সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে; এফবিসিসিআই’র বোর্ড সভায়, বিজিএমইএ’র বোর্ড সভায়, বিকেএমইএ’র বোর্ড সভায়, মেট্রোপলিটন চ্যাম্বারের বোর্ড সভায়, সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে; অন্য চাচিরা যারা তাদের স্বামীদের নতুন নতুন মুরগি ধরা আর ডাব ফাটানো মেনে নিয়েছে তারা বাঁকা চোখে তাকাবে; গ্রামের লোক বাঁকা চোখে তাকাবে; শহরের লোক বাঁকা চোখে তাকাবে; সরকারি লোক বাঁকা চোখে তাকাবে; বেসরকারি লোক, এই ধরো ব্যাংকের ম্যানেজার, বাঁকা চোখে তাকাবে; দোকানদাররা বাঁকা চোখে তাকাবে; ড্রাইভাররা বাঁকা চোখে তাকাবে; স্যুটের মাপ নিতে আসা দর্জি বাঁকা চোখে তাকাবে; কারখানার কর্মচারিরা বাঁকা চোখে তাকাবে; চাকরচাকরানিরা বাঁকা চোখে তাকাবে; আরও লজ্জার বিষয় খবরের কাগজে খবরটা পড়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বস্ত্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, এবং অন্যান্য মন্ত্রী যারা আব্বাকে চেনে, আমাকে চেনে, আম্মাকে চেনে, এবং আমাদের পরিচিত এবং পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আরও রাজনৈতিক নেতা, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংসদ, আমলা, তারা সবাই আমাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে; আর যেই সব মাস্তানকে আমরা নিয়মিত চাঁদা দিই ওরাও বাঁকা চোখে তাকাবে; এমনকি যারা বিয়েশাদির ধার ধারে না, জারজ সন্তান পয়দা করে, নিজ ঘরে ব্যভিচারে লিপ্ত আছে, আমাদের সেই বিদেশি বায়াররা বাঁকা চোখে তাকবে; এবং দেশেবিদেশে আমি আর আব্বা যাদের সাথে প্রকাশ্যে ও গোপনে লাইভ করি, তারাও বাঁকা চোখে তাকাবে, এমনকি কেউ কেউ আর ভয়ে লাইভই করতে চাইবে না, আবার কেউ কেউ খালি যায়গা পেয়ে বিয়ে করার জন্য চাপ দিবে, উঁচা পেট দেখিয়ে মামলাও করে দিতে পারে, বিয়ের আশায়, ব্ল্যাকমেইল করে কোটি টাকা আদায়ের আশায়। আমাদের পরিবারে তালাক বলতে কোনও বিষয় নাই। তুমিতো জানো, আম্মা আব্বার পা ধরে বলেছিল, আব্বা সব করুক, শুধু তাকে তালাক না দিক, তালাক না হলে আম্মার কোনও কিছুতে কোনও অসুবিধা নাই। এখন তুমিই বলো, শিশিরকণা, কেন আমি তোমাকে তালাক দিয়ে এতগুলি বিপদ ডেকে আনব? আর ধরো কোনও বিপদ না-ই হল, কিন্তু লজ্জাটা। আব্বা আম্মাকে তালাক দিলে লজ্জায় আম্মা বিষ খাবে। আব্বাও বোধ হয় লজ্জায় বিষ খাবে। এই লজ্জার হাতে পড়ার চেয়ে কবরে চলে যাওয়া উত্তম। বুকের বাল্ব নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমিতো এখনই কবরে যেতে প্রস্তুত নই, শিশিরকণা। আমাদের জীবনে একটা জিনিসই আছে, শিশিরকণা, লজ্জা। আমি যখন নদীর চর দখল করি তখন কেউ লজ্জা দিতে আসে না। যখন ট্যাক্স ফাঁকি দিই তখন কেউ লজ্জা দিতে আসে না। ব্যাংকের লোন সময়মতো না দিলে বরং আমার দাম বাড়ে। সরকারি কর্মচারিগুলিকে যখন কিনি, তখন কী যে আরাম পাই, যদিও শালারা স্যার ডাকিয়ে ছাড়ে, তারপরওতো ওরা বিক্রি হয়, অবশ্য এক বার স্যার ডাকলে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত মাফ হয়ে যায়, তা হলে আমার দশ বার স্যার ডাকতে অসুবিধা কী, আফটার অল ওরাতো ক্রীতদাসই, যে-ই টাকার কাছে বিক্রি হয়, সে-ইতো ক্রীতদাস, তা নয় কি? কিন্তু ওদের কেউতো লজ্জা দিতে আসে না। কিন্তু, তালাক? ও আল্লাহ। সারা পৃথিবী চলে আসবে লজ্জা দিতে। এখন তুমিই বলো, শিশিরকণা, তালাকের নাম মুখে আনা যায় কি না?
. আমি বলি, লজ্জার দাম বেশি না মানুষের জীবনের দাম বেশি?
. হামিদ বলে, অবশ্যই লজ্জার দাম বেশি। লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ গায়ে আগুন ধরায়, ফ্যানের সাথে ঝুলে, পানিতে ডুব দেয়, ছাদ থেকে লাফ দেয়, ঘুমের বড়ি খায়, ছেনি দিয়ে বাচ্চাদের কল্লা ফেলে দেয়, বাচ্চাদের আগে বিষ খাওয়ায় তারপর নিজে বিষ খায়। মানুষ মারা যায়। লজ্জা কি মারা যায়? লজ্জা লাফ দিয়ে নতুন মানুষকে আক্রমণ করে। এখন বলো, কার দাম বেশি, কার ক্ষমতা বেশি? মানুষের জীবনের? না লজ্জার? আর সবচেয়ে বড় দুখের কথা কী, শিশিরকণা, তোমরা এই বিপদগুলি বুঝতেই চাও না। কোথা থেকে যে কী কুশিক্ষা তোমরা পাও, আল্লাহ্ই ভাল বলতে পারবে। আমাদের মতো বান্দার পক্ষে এই জিনিস বোঝা সম্ভব না।
তুমিতো দেখেছো, আব্বা সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে, কচি কচি মুরগি জবাই করছে, কচি কচি ডাব ফাটাচ্ছে। গত মাসে গেছে রোমানিয়া। এই মাসে নিকারাগুয়া। সামনের মাসে যাবে ইউক্রেইন। চিন্তা করে দেখো। কত হুজ্জতের ব্যাপার। ব্যবসার নামে কচি মুরগির সন্ধানে; কচি ডাবের সন্ধানে; কাস্টমাইজড দুধ, মধু আর ক্ষিরের সন্ধানে। তারপরও আব্বা কিন্তু আম্মাকে তালাক দিচ্ছে না। কারণ তালাক দিলে বাড়ির দারোয়ানরা আমাদের সবার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে; মসজিদের ইমাম বাঁকা চোখে তাকাবে; অন্য চাচারা যারা নতুন নতুন মুরগি জবাই করছে আর নতুন নতুন ডাব ফাটাচ্ছে তারা বাঁকা চোখে তাকাবে; ক্লাবের সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে
. আমি বলি, হামিদ, তোমার যুক্তি আর আমার যুক্তি এক জগতের নয়। ভিন্ন ভিন্ন জগতের। এই নিয়ে তোমার সাথে তর্ক করব না। তবু আমার দাবিতে আমি অবিচল, আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই। তুমি আমাকে তালাক দাও, নইলে আমি তোমাকে তালাক দিই।
. হামিদ বলে, আমি কেন তোমাকে তালাক দিব, শিশিরকণা? আমার জীবনেরতো কোনও সমস্যা নাই। সব সমস্যাতো তোমার।
. আমি বলি, আমার কাছে আমার জীবনের দাম বেশি। তোমার কাছে সমাজের দাম বেশি।
. অবশ্যই বেশি, হামিদ বলে। আমার কাছে সবার দাম বেশি। আমার জীবনের, তোমার জীবনের, সমাজের, সব কিছুর। আরও বেশি দাম পিতামাতার জীবনের। তুমি যদি আনন্দ না পাও, আনন্দ পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। বাজারে মেশিনপাতি আছে। খেলনা আছে। বড়ি আছে। কত কী আছে? তুমি এত একরোখা কেন, শিশিরকণা? এসো আনন্দ করি, আনন্দ।
. তুমি সমাজের ভয়ে ভীত, আমি বলি।
. সমাজের ভয়ে কে ভীত নয়, শিশিরকণা, হামিদ বলে। আমার আব্বা, আব্বার বন্ধুরা, যারা সারা পৃথিবীতে কচি মুরগি জবাই করে, কচি ডাব ফাটায়, খাঁটি দুধ আর ঘন মধু খায়, তারা এক জনও কেন তালাকের নাম কখনও মুখে আনে না? ফ্যামিলি ভ্যালুর তোমার কাছে কোনও মূল্য নাই, শিশিরকণা, কোনও মূল্য নাই? এ সব কথা বলতে গিয়ে হামিদের চোখে জল চলে আসে। হামিদ বলে, আমার শ্বশুরের কাছেতো ফ্যামিলি ভ্যালুর মূল্য আছে। তুমি তার মেয়ে। তার কাছ থেকেওতো কিছু শিখতে পারো। উনি ভাল মানুষ, সৎ মানুষ। উঁচু বংশের মানুষ, আমাদের মতো নিচু বংশের মানুষ নয়। উনি কচি মুরগি জবাই করেন না, কচি ডাব ফাটান না, উনি দুধ আর মধুর খনির সন্ধানে নাই। আমাদের তুমি ঘৃণা করো, ভাল কথা, ওনাকেতো ঘৃণা করো না। তুমি ওনার কাছে যাও। ওনার কাছ থেকে পরামর্শ আনো।
. আমি দমে যাই। কারণ হামিদের কথা ঠিক। আমার আব্বারও একই ভ্যালু। শুধু আমার মা কোনও মতে তালাক মেনে নিতে রাজি আছে। আমি আব্বার কাছে যাই। আব্বা জীবনে সেদিন প্রথম তার পরনের গেঞ্জিটা আমার সামনে খোলে। নাভি থেকে গলা পর্যন্ত বুকের ফাটাটা দেখায়। ওপেন হার্ট সার্জারি। আর কয়টা দিন কষ্ট করতে পারি কি না, আব্বা জিজ্ঞেস করে। আব্বা বলে, আবার যদি অ্যাটাক করে, হাসপাতালে যাব না। যাতে এবারেই শেষ হয়ে যায়। তারপর তোমরা তালাক দিয়ো।
. আমার খারাপ লাগে। লোকটার বিরুদ্ধে কোনও ঘুষদুর্নীতির অভিযোগ নাই; সবাই তাকে সম্মান করে; ছোট বেলায় সে আমাকে গোসল করিয়েছে; হাত ধরে হাঁটা শিখিয়েছে; যেখানে আমি হাত দিতে চাইতাম না সেখানে নিজের হাত দিয়ে যত্ম করে আমাকে ধুয়েছে; তার বুকের উপর শুয়ে আমি ঘুমিয়েছি, সে নড়েনি পাছে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়; কারও বাসায় গিয়ে বাথরুম নষ্ট করলে সে নিজে আমাকে পরিষ্কার করতে গিয়ে নিজে অপরিষ্কার হয়েছে, তারপর পরিষ্কার আমিকে বের করে দিয়ে নিজে ওই বাথরুম আর নিজেকে পরিষ্কার করেছে, তারপর ভেজা কাপড়ে বের হয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে যাতে আমার অস্বস্তি দূর হয়ে যায়; কোলের উপর আমার মাথা রেখে সারা রাত আমার গালে হাত দিয়ে বসে থেকেছে আমার দাঁতের ব্যথা ভুলিয়ে রাখতে; হাম হওয়ার পর আমাকে বুকে ধরে রেখেছে, পিঠ চুলকাতে বললে আঙ্গুলের বুক পিঠে বুলিয়েছে, নখ দিয়ে চুলকায়নি, পাছে পিঠ কেটে যায়; নিউমার্কেটের ভিড়ে আমাকে সামনে রেখেছে যাতে স্বপ্নদোষের কবলে পড়া দুষ্ট ছেলেরা আমার পাছায় খোঁচা দিতে না পারে; এক বার রাস্তায় হাঁটার সময় সে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে, পেছন থেকে ঘেউ ঘেউ করে ধেয়ে আসা পাগলা কুত্তা তার পায়ের গুলে দাঁত ঢুকিয়েছে, সে এগারোটা ইঞ্জেকশন নিয়েছে; এর পর রাস্তায় বেরোলে সে আমাকে সামনে রেখেছে, যাতে পাগলা কুত্তা কামড়াতে আসলে তাকে কামড়ায় আর আমি বেঁচে যাই; ধানক্ষেতের আইলের উপর আমাদের দুই ভাইবোনকে কোলে তুলে নিয়েছে, সাপে কাটলে তাকে কাটুক; ভাতে ফুঁ দিয়েছে, চায়ে ফুঁ দিয়েছে, পিঠার পেটের গরম তেলে ফুঁ দিয়েছে, যাতে আমার গাল, গলা, অন্ত্র পুড়ে না যায়।
. আব্বা যখন আমার তালাক মানতে নারাজ তখন আমার এ সব কথা মনে পড়ে। তারপরও আমি হামিদকে সহ্য করতে পারি না। যদিও তালাককে আমিও হামিদের মতো ভয় পেতে থাকি, কারণ সারা পৃথিবী, মানে আমি যেই পৃথিবী চিনি তার সবাই, তালাককে ভয় পায়। মনে হয় তালাক হলে তখন জীবনে নতুন সমস্যা যোগ হবে। কী যে সে সমস্যা, তা জানি না। তবে নিশ্চয়ই এমন কিছু হবে যার কারণে ভূমিকম্পে গোটা ঢাকা শহর ধ্বংস হয়ে যাবে; আকাশে তারায় তারায় সংঘর্ষ হয়ে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হবে; পাহাড় চলে যাবে সমুদ্রে, সমুদ্র চলে আসবে পাহাড়ে; বন্যায় এক কোটি মানুষ মারা যাবে; তালাকের পর সবাই রক্তবমি করবে; সকল গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে যাবে আর পৃথিবীতে কোনও নারী কখনও গর্ভধারণ করতে পারবে না; রাষ্ট্রপতিদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে, তারা একে অন্যের দিকে পারমাণবিক বোমা ছুঁড়বে; সন্ত্রাসীরা চাইবে এই সুযোগে যত বেশি দেশ দখল করে নেয়া যায়; কেয়ামত ঘনিয়ে আসবে; আর সবচেয়ে বড় কথা আমি উলঙ্গ হয়ে যাব; এমন উলঙ্গ হব পৃথিবীর আর কোনও পোশাক আমাকে ঢাকতে পারবে না, না মসলিন, না সাইবেরিয়ার শীতের কোট; আশি স্তর জামা পরলেও আমার শরীরের প্রতিটি লোম, প্রতিটি অন্তরঙ্গ হা করে দর্শনার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকবে, আজীবন; আমি হয়ে যাব ফেরাউনের মমির ঘর কায়রোর জাদুঘরের চেয়ে বিখ্যাত জাদুঘর; আমার সারা জীবন ধরে সারা পৃথিবীর মানুষ আসবে আমাকে উলঙ্গ দেখার জন্য, টিকেট কেটে; আমার দেহ কাফনও ঢাকতে পারবে না, কবরে শোয়ানো আমাকে দেখে শেষবিদায়দানকারিদের কামানগুলি আকাশের দিকে তাক হয়ে যাবে। আমার দাফন হবে অপবিত্র, মানুষের চোখে, ফেরেশতাদের চোখে। আমি কী করে তালাক দিই?
. তারপরও আমি হামিদের কাছে এসে তালাক চাই। হামিদ বলে, তালাক হবে না, শিশিরকণা। তুমি বিকল্প দেখো।
. আমি বিকল্প দেখি, কারণ একটা তালাকের কারণে সূর্যের আলো নিভে যাবে, এই ভয় আমার মধ্যে ঢুকে গেছে। আমি বলি, হামিদ, আমিতো তোমাকে আগেই বিকল্পের কথা বলেছি। আমি তোমার কাছে আলাদা বিছানা চেয়েছি। হামিদ বলে, আম্মা মরে যাবে। হামিদ বলে, তার চেয়ে দাঁড়াও, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি। হামিদ এক শিশা জর্জো আরমানির আকুয়া দি জিয়ো গায়ে ঢেলে বিছানায় আসে। আমি বাথরুমে গিয়ে বমি করি। বমি পরিষ্কার করে আমি সারা রাত বাথরুমের মেঝেতে বসে থাকি ঠাণ্ডা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। হামিদ জর্জো আরমানির আকুয়া দি জিয়ো গায়ে মেখে নাক ডেকে ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে সে আমাকে বাথরুমে পায়। হামিদ বলে, আমার ভাল ঘুম হয়েছে, এখন আমার দরকার। আমি বলি ঠিক আছে, চলো।
. হামিদ আমার উপর রিপ্লেন্স লং লাস্টিং ময়েশ্চারাইজার ঢালে। রিপ্লেন্স লং লাস্টিং ময়েশ্চারাইজার বিছানার চাদরে লং লাস্টিং জলাভূমি সৃষ্টি করে, কিন্তু আমার ভেতর ঢোকে না, কারণ মুখ খোলে না। হামিদ বুঝতে পারে আমার যা অবস্থা তাতে ঠোঁটই খোলার সম্ভবনা নাই, মুখতো দূরের কথা। হামিদের আঙ্গুল যতই চেষ্টা করে ততই ঠোঁট দুটি একে অপরকে আঁকড়ে ধরে, এক জোড়া অনাথ জমজ শিশুর মতো, যারা ধরে নিয়েছে তাদের মা তাদের কোরবানি হওয়ার জন্য অকরুণ পূজারীর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ঠোঁট খুলতে ব্যর্থ হয়ে হামিদ তিন বোতল রিপ্লেন্স লং লাস্টিং ময়েশ্চারাইজার একটা গেলাশে ঢালে। শেষ বোতলটা হামিদ ছুঁড়ে মারে। বলে, গন্ধ নাই। যেইখানে যা দরকার তা পাই না। তোমারও গন্ধ নাই। এই মালেরও গন্ধ নাই।
. আমি মনে মনে বলি, মায়ের পুত, গন্ধের জন্য মায়ের কাছে যা।
. হামিদ বলে, এরপর দেখেশুনে কিনব। দরকার হলে সস্তাটা কিনব। কিন্তু শালার এত টাকা রাখব কই? যদি দামী জিনিস না কিনি এই জীবনের কী মানে? তবে গন্ধ আমার চাই-ই চাই। এরপর আর চার বোতল করে কিনব না, এক কার্টন করে কিনব। শিশিরকণা, তুমি যে ভাবে বাথরুমে রাত কাটাচ্ছ, তাতে আমার আর কী করার আছে?
এ সবের জন্য আমি হামিদকে মারিনি। তবে কীসের জন্য আমি হামিদকে মারলাম? ভাবতে বুক ভেঙ্গে আসে। আর সত্য হল আমি হামিদকে খুন করেছি। হামিদ লাশ হয়ে আমার ভেতর ঢুকেছে
. হামিদ নিজেকে চেপে ধরে গেলাশে ঢুকায়। এক মিনিট হামিদ নিজেকে গেলাশে চুবিয়ে রাখে, যাতে ওর চামড়া রিপ্লেন্স লং লাস্টিং ময়েশ্চারাইজার গিলে মোটা হতে পারে আর আস্তে আস্তে দীর্ঘ সময় আর্দ্রতা রিলিজ করতে পারে, ভোলটারিন ইঞ্জেকশনের মতো। তারপর হামিদ অনেক ঠেলাঠেলি করে। কাজ শুরু করে হামিদ বিরক্ত হয়ে বলে, এই দুইটা দাঁড়ায় না কেন? না দাঁড়াইলে আমি কীভাবে কী করব? ফকিন্নির বাচ্চারা কী উন্নতি করল? বড় বড় বিল্ডিং আর রকেট বানাল। অথচ এগুলির জন্য এখনও কোনও তেল বানাতে পারল না। এর নাম কি উন্নতি?
. হামিদ মাথা ঝাঁকায়, আমি ভাবি ওর মাড়ি থেকে না আবার দাঁত খুলে পড়ে। হামিদ গটগট করে বলে। এটা কীসের উন্নতি?
. আমি বলি, হামিদ মুখ খারাপ কোরো না। রাগ করে কী লাভ? হামিদ কাঁপতে থাকে। আমি হামিদকে তার হার্টের বাল্বের কথা স্মরণ করিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করি। আমি বলি, হামিদ, আমার নিচে চলছে মরিচের ঘষা, আমার মুখ মরুভুমি। তুমি মাথা ঠাণ্ডা করো, আগে ছেপ দাও, তারপর চুনুট পাকাও।
. হামিদ গায়ের জোরে চুনুট পাকায়, বিরক্তিসূচক গোঙ্গানি দেয়, বলে, আমি কেন, বিল এসে চুনুট পাকালেও কিছু হবে না।
. হামিদ মেজাজ খারাপ করে কাজ চালায়।
. আমি হামিদকে সাহায্য করেছি যত দিন জহিরের মৃত্যুতে হামিদের জড়িত থাকার কথা আমি জানতে পারিনি। জহিরের মৃত্যুতে হামিদের হাত খুঁজে পাওয়ার পর আমি হামিদকে না বলা শুরু করি। আমি বলি, হামিদ, তুমি লাইভ বাড়াও। হামিদ লাইভ বাড়ায়। হামিদ বলে পনেরো দিন পর্যন্ত বিরতি দেয়া সম্ভব। এর বেশি না। এর বেশি হলে অটো তালাক হয়ে যাবে। আমি ভিমরি খাই। বাইতুল মোর্কারম, নীলক্ষেত, কাঁটাবন থেকে হাদিসের বই কিনি, কোরান শরিফের অনুবাদ কিনি। ফিকাহ শাস্ত্র, মকসুদুল মোমেনিন কিনি। সব বই ঘাঁটাঘাঁটি করি। হামিদকে কিতাব-আল-তালাক খুলে দেখাই, ছয় মাস। হামিদ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। বলে, এ রকম করলে আমার হার্টের বাল্ব এখনই বসে যাবে। হামিদ মনে করে আমি ওর হার্টের বাল্ব নিয়ে চিন্তিত, আসলেই আমি চিন্তিত, একটা গরিব ছেলে ধনী হয়েছে, শুধু হার্টের বাল্ব নষ্ট হওয়ার জন্য মন মতো হাজার হাজার মুরগি জবাই করার আগে মরে যাবে। এটা ভাবতে আমারও কষ্ট হয়। আমি হামিদকে দ্বিতীয় বিকল্প দেখাই: সুরা বাকারার ২২৬ নম্বর আয়াত। বলি চার মাস পর্যন্ত বিরতি দেয়া সম্ভব। এটা একেবারে কোরানসম্মত। হামিদ বলে, তুমি কোরান হাদিসের কী বোঝ? নামাজ পড়ো না, রোজা রাখো না। আমি বলি, তুমিওতো নামাজ পড়ো না, রোজা রাখো না। হামিদ বলে, সে জন্যইতো আমি তোমাকে কোরান-হাদিস দেখাচ্ছি না। আমি মসজিদের হুজুরকে জিজ্ঞেস করেছি। হুজুর বলেছে প্রতি রাতে। মাসিকের দিনগুলি বাদ দিয়ে। আমি হুজুরকে তিন দিন সময় দিই। হুজুর সব পরীক্ষানিরীক্ষা করে আমাকে বলে সর্বোচ্চ পনেরো দিন, এক সাথে থাকলে। আমার মনে হয় বেটা ভয়ে বলেছে। আমার মনে হয়েছে প্রতিদিন বাধ্যতামূলক। আমি গরিব হলে, সৌদি আরবে থাকলে, অবশ্য ভিন্ন ফতোয়া ছিল।
. আমি হামিদকে বলি, চলো, আমরা আলাদা থাকি।
. হামিদ বলে, আলাদা বিছানাতেই থাকা যাচ্ছে না, কারণ আম্মা মরে যাবে বলে। আলাদা থাকলেতো আমার এই ফকিরের গোষ্ঠীর সবাই মরে যাবে। আর জেহাদে গেলেও ভিন্ন কথা, বা বিদেশে গেলে। আমিতো জেহাদে যাব না। আর বিদেশে গেলেও আমি পনেরো দিনের বেশি থাকব না, কারণ আম্মার হাতের গরুর রেজালা না খেলে আমি মরে যাব। বিদেশে গেলেও আমি পনেরো দিনের মধ্যে ফিরে আসব, নয় আম্মাকে সাথে রাখতে হবে গরুর রেজালা রান্না করার জন্য। আমি এত ঝামেলা করতে পারব না। আমি পনেরো দিনের বিরতিতে রাজি। গুনা হলে হুজুর বেটার হবে। আমার হবে না। আমার মনে হয় আব্বাও হুজুরের কাছে গেছে। নইলে আব্বা কেন পনেরো দিন পর পর আম্মার সাথে ঘষাঘষি করে। আর সেই খুশিতে আম্মা পরের চৌদ্দ দিন লাফায়। আব্বা জানে সেটা না করলে আম্মা তালাক হয়ে যাবে।
. আমি বলি, তালাক হয়ে যাক।
. হামিদ বলে, কী বল এ সব? আমার আব্বার বন্ধুরা পর্যন্ত পনেরো দিন পর উন্মাদের মতো ঘরে ফিরে আসে, স্ত্রীর বিছানায় যায় অটো তালাকা ঠেকানোর জন্য। কে চায় ব্যভিচারের জীবন যাপন করতে। বিয়ে না থাকলে সন্তান হবে জারজ। কে চায় অবৈধ সন্তানের বাপ হতে। চৌদ্দ দিন ধরে তুমিও লাইভ করতে পারো, শিশিরকণা, আমার অনুমতি আছে।
. আমি বলি, লাইভ করলে গুনা হবে না?
. হামিদ বলে, গুনাতো অবশ্যই হবে। আর সে জন্যইতো তওবা করারও ব্যবস্থা আছে। তুমি লাইভ করো। তা হলে আমরা সমানে সমান হব। আর এক সাথে তওবা করব, তাহাজ্জুদের নামাজের পড়ব, কারণ তাহাজ্জুদের পর গুনা মাফ হয়।
. হামিদ পাপেও আছে, তওবাতেও আছে। ও এখন বলবে লাল মরিচ খেলে ক্যান্সার ভাল হয়। এক মিনিট পর বলবে লাল মরিচ খেলে ক্যান্সার হয়।
. দুই রকম কথা হল না, হামিদ? এ কথা বললে হামিদ বলত, আমার কী দোষ, বিজ্ঞানীরাইতো দুই রকম কথা বলেছে।
. এ সবের জন্য আমি হামিদকে মারিনি। তবে কীসের জন্য আমি হামিদকে মারলাম? ভাবতে বুক ভেঙ্গে আসে। আর সত্য হল আমি হামিদকে খুন করেছি। হামিদ লাশ হয়ে আমার ভেতর ঢুকেছে।
ওসিডি‘র প্রকাশিত পর্বগুলো পড়ুন—
ওসিডি (পর্ব-০১)
ওসিডি (পর্ব-০২)
ওসিডি (পর্ব-০৩)
ওসিডি (পর্ব-০৪)
ওসিডি (পর্ব-০৫)
ওসিডি (পর্ব-০৬)
ওসিডি (পর্ব-০৭)