Author Picture

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ‘ম্যান উইথ গোল্ডেন হার্ট’

মেজবাহ উদদীন

জীবনের যে পিঠে বাস্তবতার ভিড়, ফুটবলের অবস্থান তার বিপরীত পিঠে। রাষ্ট্র, নেতা, মতাদর্শ, রাজনীতি– যে যার মতো চলতে চলতে ফুটবল মাঠে এসে মিলে যায় এক জায়গায়। আর সেই ফুটবলকে শীল্পের মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার লিগেসি যাদের কাঁধে তিনি তাদের একজন। তার পায়ের জাদু আর হার না মানা মানসিকতায় বুঁদ একটা পুরো প্রজন্ম, তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ডস স্যান্টোস আভেইরো, আদুরে নাম সি আর সেভেন।

মেসি-ম্যাজিকে মুগ্ধ বিশ্বে তার নামেও জয়ধ্বনি ওঠে সমান তালে। তার ফুটবলীয় সৌন্দর্যের কাছে দুনিয়া যেনো পঙ্গপাল। তাই তো বিজ্ঞাপনী সংস্থার বড় বড় কর্তারা তার পিছনে টাকা ঢালেন অকৃপন হাতে। রোনালদোর ফুটবলার হওয়ার পেছনে তার বাবা-মার অবদান সবচেয়ে বেশি। পরিবারের খরচ জোগাতে পৌরসভার মালির চাকরির বাইরে স্থানীয় ক্লাব অন্দোরিনহার কিট ম্যানও ছিলেন তার বাবা জোসে। ছোট্ট একটা রুমে রোনালদো চার ভাইবোনের সাথে ঘুমাতেন। সেখানেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতেন ফুটবলটা আকড়ে ধরে। স্বপ্ন দেখার সেই তো শুরু। সেই স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে মাত্র ৭ বছর বয়সে আন্দোরিনহায় যোগ দেন রোনালদো। ১২ বছর বয়সে স্পোর্টিং সিপির তিন দিনের এক ট্রায়ালে যাওয়াটাই তার জীবনের গল্পটা পালটে দেয়। মেদেইরা ছেড়ে লিসবনে স্পোর্টিংয়ের ইয়ুথ একাডেমিতে যোগ দেন ক্রিস্টিয়ানো। ১৪ বছর বয়সেই ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে যাওয়ায় মায়ের সঙ্গে কথা বলে লেখাপড়ায় ইস্তফা দেন। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন থেকেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে পর্তুগালের ক্লাব স্পোর্টিং এফসি-তে সই করেন সি আর সেভেন। আর ২০০৩-০৪ মৌশুমে প্রথম পর্তুগিজ প্লেয়ার হিসেবে ইংল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সই করেন তিনি। কোচ ফার্গুসনের অধিনে এমন কোনও ট্রফি নেই, যেটা তিনি জেতেননি। এরপর সময়ের সাথে পরিণত হয়ে শাসন করেছেন প্রতিপক্ষকে। ক্লাব ও দেশের হয়ে পাঁচ-পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, ইউরো কাপ, নেশনস লিগ, ৫টি ব্যালন ডি-অর, ৪টি গোল্ডেন বুট, ফিফা দ্য বেস্ট সহ নিজের ফুটবল জীবনে জিতেছেন অনেক অনেক কিছু।

ফুটবল ইতিহাসে কিংবদন্তির আগমন প্রতিদিন ঘটেনি। ফুটবল মাঠের আবেদন বৃদ্ধি করা সেই মহানায়কদের দেখার জন্য চোখের অপেক্ষা ছিল দীর্ঘতর। প্রতি যুগে একাধিক কিংবদন্তির দেখা পাওয়া যায়নি। যদিও একই সময়ে কাছাকাছি মানের ছিলেন অনেকেই। তবুও পার্থক্য ছিল-ই। সাধারণভাবে প্রতিপক্ষ, সতীর্থ, নিয়ম, প্রযুক্তির মতো অনেক কারনেই আলাদা প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা করা কঠিন। কিন্তু একই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা করা সহজ হওয়ায় লিয়োনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ফুটবল দুনিয়া। ফুটবলে এই দু’জনের দাপট তুলনা করা যায় টেনিসের রজার ফেদেরার এবং রাফায়েল নাদালের অবিশ্বাস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে। মেসি কিছুটা ফেডেরার ধাঁচের, যিনি ভরসা রাখেন শিল্পের ওপরে। রোনালদো যেনো নাদাল, যার কাছে শিল্প কম, শারীরিক শক্তি বেশি। অথবা, রোনালদো যদি হন সঙ্গিতের রক্ এন রোল, মেসি নিশ্চিতভাবেই ক্লাসিকাল। তাই কেউ যদি বলে শুধু ক্লাসিকাটাই সঙ্গিত অথবা শুধু আধুনিকটাই সঙ্গিত তবে বুঝতে হবে ভুল সুরে আটকে গেছে তার জীবন।
ক্যানভাসটা যখন সবুজ; রোনালদোর কথা তখন আপনার ভুলে গেলে চলবে না। রেকর্ড গড়া যার কাছে নিত্যদিনের ঘটনা। সেই রোনালদো বিশ্বের প্রথম পুরুষ ফুটবলার হিসাবে ২০০তম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ফেললেন। গোলও করলেন সেই ম্যাচে। ২০০৩ সালে জাতিয় দলে অভিষেকের পর থেকে দেশের হয়ে খেলে চলছেন। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম খোদাই করে রাখলেন রোনালদো। আর দেশের জার্সিতে সবথেকে বেশি ম্যাচ খেলার পাশাপাশি সবথেকে বেশি গোল করার রেকর্ডের মালিকও সেই তিনিই।

এক পঞ্জীকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক গোল (৩২) রোনালদোর। চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের (২৯) সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। প্রথম ফুটবলার হিসেবে ম্যাচের প্রতি মিনিটে গোলের রেকর্ড করেছেন সাবেক এই রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড। রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনালদো। লা লিগায় রেকর্ড ৩৩টি হ্যাটট্রিক তার। এতেই লা লিগায় দ্রুততম দেড় শ, দুই শ ও তিন শ গোলের রেকর্ডটি এখনও তার দখলে। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টানা ৬ মৌসুমে কমপক্ষে ৫০ গোল তার। টানা ৭ পঞ্জীকাবর্ষে ৫০ গোল করার রেকর্ডটিও শুধুই রোনালদোর। ইউনাইটেড ও রিয়ালের হয়ে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পথে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এ প্রতিযোগিতায় ১০০ গোল করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট ক্লাবের হয়ে ১০০ গোল করা প্রথম ফুটবলারও তিনি। গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচে গোল করার অনন্য অর্জনটিও শুধুই তার।

রোনালদো মানেই এক অমোঘ ইন্দ্রজাল। পায়ের খেলায় তার মাথাও চলে সমান তালে। তিনি ফুটবলে যোগ করেছেন নিজস্ব ‘স্বরলিপি’। যা দিয়ে তিনি ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে চলছেন বছরের পর বছর। তার খেলায় জয়ের সুতীব্র ক্ষুধা নিয়ে জেগে থাকে হার না মানা গরিমা। তাই তো মেসি-আলোয় ঝলমলে পৃথিবীতে কিছুতেই সরিয়ে রাখা যায় না রোনালদোর গল্প

বয়স এখন ৩৮। এই বয়সে অনেক ফুটবলার অবসর নিয়ে নেন। তবে রোনালদো আরও কিছু দিন দেশের জার্সি পরে মাঠে নামতে চান। আর কতদিন খেলবেন? প্রশ্নের উত্তরে নিজেই বলেছেন, যতদিন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আর কোচ তাকে দলে চাইবেন, ততদিন তিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যাবেন। কারণ তার কাছে জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারাটা বিরাট সম্মানের। এখন ২০২৪ এর ইউরো কাপে তাকে খেলতে দেখা যায় কি না, সেই দিকেই তাকিয়ে আপামর ফুটবলবিশ্ব।

২০২২ বিশ্বকাপ ভাল যায়নি রোনালদোর। গোটা প্রতিযোগিতায় মাত্র একটি গোল করেছেন তিনি। পর্তুগালও প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ গিয়েছে। সেই সাথে ক্লাব ফুটবলেও সময়টা ভাল যায়নি রোনালদোর। বিবাদের জেরে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ছেড়েছেন তিনি। যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে। সেখানে এখন চিরচেনা ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন ছেড়ে আনন্দ ভাগাবভাগি করছেন ডাগআউটে। বয়স বারছে ঠিক-ই তবে গায়ে এখনও লেগে আছে কৈশরের গন্ধ আর জেতার খুধা। টানা ৪১ বছরের ইতিহাসে যে দলটা কখনোই ফাইনালে উঠতে পারেনি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সেই আল নাসর’কে আরব ক্লাব চ্যাম্পিয়নস কাপের শিরোপা এনে দিয়ে যেনো বলতে চাইছেন, মেসিকে নিয়ে তোমরা কথা বল, কিন্তু আমাকে ভুলতে পারবে না।

রোনালদো মানেই এক অমোঘ ইন্দ্রজাল। পায়ের খেলায় তার মাথাও চলে সমান তালে। তিনি ফুটবলে যোগ করেছেন নিজস্ব ‘স্বরলিপি’। যা দিয়ে তিনি ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে চলছেন বছরের পর বছর। তার খেলায় জয়ের সুতীব্র ক্ষুধা নিয়ে জেগে থাকে হার না মানা গরিমা। তাই তো মেসি-আলোয় ঝলমলে পৃথিবীতে কিছুতেই সরিয়ে রাখা যায় না রোনালদোর গল্প।

রোনালদো যত বড় খেলোয়াড় তার থেকে বড় তার হৃদয়, নিপীড়িত অসহায় মানুষের জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের অসহায় মুসলমানরা যখন ঠিকমতো সেহরি ও ইফতার করতে পারছিল না তখন রোনালদো শত ব্যস্ততার মাঝেও তাদের কষ্টের কথা মনে রেখে দের মিলিয়ন ইউরো দান করেছিলেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের বর্বর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়। ২০১২ সালে গাজার শিশুদের পড়াশোনার সাহায্যের জন্য তিনি নিলামে তুলেছিলেন তার ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার। ফুটবল মাঠে যিনি ম্যান উইথ গোল্ডেন হার্ট নামে পরিচিত। শুধু ফিলিস্তিন নয় তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার শিশুদেরও অর্থ সাহায্য দিয়েছেন। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে তিনি সিরিয়ার শরণার্থীদের ৫০০০ ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালি শিশুদের জন্য সেভ দ্য চিলড্রেন এর মাধ্যমে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। বিশ্বের অসংখ্য ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা ব্যায় বহন করেন রোনালদো। সুযোগ পেলেই ফিলিস্তিনি শিশু বা যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ান শিশুদের বুকে জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে দেন তার একটা মানবিক হৃদয় আছে। এবং তার অবস্থান শান্তি আর মানবতার পক্ষে।

অতিরিক্ত মদ খাওয়ার কারনে তার একান্ত কাছের মানুষ বাবা মারা যাওয়ায় তিনি জীবনে কখনো মদ খাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকার দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে রক্ত দেয়া যায় না, এতে করে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাইতো একজন রক্তদাতা রোনালদোর শরীরে অন্যান্য ফুটবলারের মতো উল্কি দেখা যায় না।

কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রোনালদোর নামে আলাদা একটা কোর্স পড়ানো হয়, ওই কোর্সের মূল প্রতিপাদ্য হলো সমাজ সংস্কৃতিতে রোনালদোর প্রভাব। সেখানে তিনি পাঠ্য বইয়ের অংশ কারণ সমাজ সংস্কৃতিতে তার অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ান শিশুদের মধ্যে তিনি যেভাবে আশার সঞ্চার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা মানবতাবাদী রোনালদোরই প্রতিনিধিত্ব করে। মানবতার ফেরিওয়ালা এই রোনালদো পৈশাচিক পৃথিবীর বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী মুখ। এই রোনালদোকে আপনি ভালোবাসতে বাধ্য।

আরো পড়তে পারেন

ক্রিকেটের এপিটাফ

কারো জন্য অংশগ্রহণ-ই বড় কথা। আবার কারো জন্য জয়লাভ-ই শেষ কথা। এই দুই পৃথিবীর ভেতরে দর্শনের যে ফারাক, তাই-ই আজ আমাদের ক্লান্ত করছে। আর আমরা সেই আমাদের ওয়ান ডে ক্রিকেটের চিরপরিচিত রূপকে ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে দেখে আহত, রক্তাক্ত হচ্ছি। খিদের আগুনই তো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে, ছুটিয়ে বেড়ায়। সে পেটের খিদে হোক কিংবা জয়ের খিদে। ক্রিকেটারদের….

ক্রিকেটে আমাদের গন্তব্য কোথায়!

যুবক হতে চলা সকালের গায়ে বার্ধক্যের ক্লান্ত আলো যে হতাশার কথা মনে করিয়ে দেয়। তেমনি হতাশা আর পুরো শরীরে ব্যথা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে এক রোগী। রোগী: ডাক্তার সাহেব আমার সারা শরীরে ব্যথা, যেখানে ধরি সেখানেই ব্যথা। আমাকে এই ব্যথা থেকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব। ডাক্তার: পুরো শরীরে ব্যথা তো অনেক ভয়ের কথা। আচ্ছা….

ক্রিকেট বিশ্বকাপ: দুঃখ-সুখের জামদানি

কাব্য করার এই অবেলায় গোধূলি নেমেছে সুরের বারান্দায়। মনখারাপের মেঘ তাই কয়েক প্রজন্মের আকাশ জুড়ে। সমস্যার সাগরে ডুবে থাকা বাঙালির নাকের ওপর আক্ষরিক অর্থেই নয় হাত পানি। আপাদমস্তক হতাশায় মোড়া বাঙালির জীবনে যেটুকু আলো আসে সেটা ক্রিকেটের জানালা গলেই। বাঙালির একান্ত সেই যায়গাতেও‌ এখন বিভক্তির সুর। ফুটবল বিশ্বকাপে বাঙালি সমর্থকরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে—….

error: Content is protected !!