Author Picture

সিদ্ধার্থ হকের পাঁচটি অপ্রেম

সিদ্ধার্থ হক

১.

                     প্রতিবার শিখতে হয়, কেননা সে প্রতিবারই নতুন;
পূর্বের অভিজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা, সার্থকতা, ভুল, শুদ্ধতা, ধ্যান, অস্থিরতা
                                 বেদনা, কোন কাজেই আসেনা;
অদ্ভুত অনিশ্চয়তা পুনরায় ফিরে আসে সমস্ত অস্তিত্বে;
                         মনে হয় জগতের সকলই অজানা;
হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয় এই পৃথিবীর প্রান্ত থেকে প্রান্তে

বুঝতে পারিনা আমি কি করা উচিত; জানা নাই সে কি চায় বা চায় না
আমার অধিকার কতদূর; আদৌ কোন অধিকার আছে কি না
আবার কি শুনতে হবে, “ইউ হ্যাভ নো ক্লেইম”?
মনে হয় সম্পূর্ণ অধিকারহীন আমার শরীর আর মন

হাঁটি আর ভাবি, ভাবি আর আরো আরো হাঁটি; ব্রহ্মাণ্ডের টার অন্ধকার
আমার দুচোখে ভীড় করে; অবনত হতে থাকি আমি
সকল ধারণা, অভ্যাস, জ্ঞান থেকে নিজেকে মুক্ত করবার কঠিন প্রয়োজনীয়তা
                                 অনুভব করি
সব আনলার্ণ করতে হবে তোমাকে এই বলে আনলার্ণ চারদিকে নাচে

বলব কিনা জানিনা তবু ভাবি একদিন বলব তাকে ডেকে… তোমার সাথে
কিছুক্ষণ হাঁটতে চাই আমি পথ থেকে পথে;
                                      শুধু তোমার সঙ্গে হাঁটতে চাই ব্রহ্মাণ্ড ঘিরে
অবিরাম স্পাইরালভাবে বেড়ে উঠতে থাকা রিংরোডে; তারপর ক্লান্ত হয়ে ভাসমান
ফুটপাতে বসে পড়তে চাই; তোমার শাড়ির পাড় আমার হাতের সাথে লাগে;
ঘূর্ণমান রিংরোডে একেই কি স্পর্শ বলে? বলব কখনো তাকে এইসব আমি?

স্বপ্নের জলপানে তৃষ্ণা কখনো মেটেনা, বরং বাড়ে
ঘুমের ভিতরে বসে এই সত্য জানতে পারা যায়
                                          ভয়ানক তৃষ্ণার্ত আমি; ঘুম থেকে উঠতে হবে
                                   আগুনের জলপান করতে হবে হাত হাতে নিয়ে

আমার নির্মম সত্য তোমাকে কিভাবে জানাবো, জানা নাই;
                  হয়ত আমাকে পড়বেনা তুমি কোনোদিন, মধ্যরাতে শুয়ে

 

২.

নিজের অবশ শরীর ভালো লাগে, মৃত নই, জীবিতও নই, স্মৃতি নেই ও আছে
সময় ঘুরছে—এসব শূন্যের মধ্যে সময় লিনিয়ার নয়;
ক্রমশঃ ধ্বংস করে দিয়েছি যেসব, অপ্রেমের বেদনায় সেইসব মনে পড়ে
গোসল সমাপ্ত করে, দেহ মুছে, টাবের ভিতরে, বিছানার উপরে, শূন্যে ভেসে,
নগ্ন হয়ে, নিশ্চুপ বসে থাকা ভাল লাগে; ক্রমান্বয়ে টের পাই
না পেয়ে হারাবার ভয় মানুষের হয়, যখন সে অপ্রেমে ডুবে যায়;
মন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে; কোন যুদ্ধে না নেমেই যুদ্ধে মারা পড়ে গেছে সে;
শুয়ে আসে মাঠের ভিতরে; বাতাস তার মৃত চুল নিয়ে খেলা করে;
                  সরীসৃপ ঢুকে যায় নাক দিয়ে হৃদপিণ্ডের অনেক তলায়;

অপ্রেমের এইসব গভীর বেদনা, বল, তুমি কি জেনেছো? জেনেছো নিশ্চয়ই—
অপ্রেম অবিরাম পুনরাবৃত্ত হয়ে চায়; বারবার, বারবার একই জনের সাথে,
                                  মহাবিশ্বের পথে, মহাজগতের কেন্দ্রে পৌঁছাবার জন্য
যতদিন হাঁটতে হবে ততদিন তোমার অপ্রেম আমি চাই;
তোমাকে জানাই, শোন, না পেয়ে হারাবার ভয় মানুষের শুধু অপ্রেমেই হয়;

যে হাত তোমার সাথে নেই, ছিলনা কখনো, সেই হাত ফুল, যে ফুলের ঘ্রাণ তুমি
কখনো পাওনি; সেই হাত তোমাকে পেঁচিয়ে ধরেছে নরম লোহার লতার মতন;
তাকে আর কোনদিন দেখতে না পাওয়ার ভয়ে প্রায় মৃত নেবুলার মত নিভে যাচ্ছ;
অবিরাম তারাদের জন্ম মৃত্যু হয়; ওদের মৃত্যুর ভয়, জন্মের অপেক্ষা আছে নাকি?

                  ভয় তাহলে কি? আকাঙ্খা ও আশঙ্কা একসাথে;
আনন্দকে পাবার চিন্তার আনন্দ আর তাকে না পাবার চিন্তার বেদনা; সাপলুডু;
তবু অপ্রেম অন্ধকার নয়, খেলা নয়; বরং এক অন্ধকার-আলো,
যদি পারো ভয় থেকে বের হয়ে যেতে,
যদি তার সাথে কিছুদিন হাঁটো, না হেঁটেও হাঁটো, একসাথে,
বিনিময়হীনভাবে ভালবাসো, তাহলেই সূর্যসম নিজেকে পুড়িয়ে তুমি
                ব্যথা ও আনন্দ পাবে ফের, সব তারা যেভাবে পেয়েছে, আজো পায়

 

৩.

                        চেতনা সকল সময় খালি পায়ে হাঁটে-
অপ্রেম চেতনা এক—বহুরাতে একা একা জঙ্গলে ঘোরে, না-পাওয়ার গান করে
তার সাথে পায়ে পায়ে হেঁটে যায় ঋতুহীন ঝরাপাতা, তার গানে গান করে ছায়া
গাছ তাকে নিচু হয়ে দেখে, ডাল নেমে ছুঁয়ে দেয় তার নিরবচ্ছিন্ন শান্ত চুল;

মানুষ লুকায় যত, সে তত উদ্ভাসিত হয়ে খুলে ধরে আপনাকে;
                    মানুষের তথাকথিত লজ্জা কিম্বা ভয় তার নেই
গভীর আনন্দের শান্তি, তার পায়ে পায়ে ফোটে,
                        পদচিহ্নে পড়ে থাকে, জাগে পাতায় পাতায়;
হায় আমি তার থেকে বহু দূরে অন্য এক রাল্মে থাকি
                   চারপাশে বহু কিছু শেষ হয়; কিন্তু সে অফুরন্তই থেকে যায়

বহুরাতে নিজ বুকে হাত দিয়ে রক্ত চিহ্ন টের পাই; অধিকারহীন ভবনের দ্বার
আমার এ বুকের কপাট; আমার শরীর এক দরদালানের অন্ধকারে শুয়ে থাকা
মহাবিশ্ব বিচার করেনা; তবু কোনো এক আদালত, দয়ামায়াহীন জুরিদের দল,
নির্ণয় করে বলে গেছে—আর কোন প্রেম নেই তোমার জন্যে এ জগতে;
আমি তাই মহাজগতের দিকে, অপ্রেমের দিকে চলে গেছি;
                        ভাসমান চলে গেছে লিনিয়ার সময়ের অনেক বাইরে

যতদিন পারি আমি থেকে যাবো বেদনায়; টিকে থাকবার জন্য বেদনা অসীম শক্তিশালী
দূরের রাল্ম থেকে দেখব আমার অপ্রেম হাঁটছে চেতনার মত একা চেতনার সাথে,
                  প্রতি-পদচিহ্নে তার, আনন্দবেদনার দীপ, জ্বলে উঠছে নীরবে, বহুরাতে, সারাদিন

 

৪.

বেদনা তারের উপরে নগ্ন হয়ে বসে আছে অপ্রেমের মত, তবু
মৃত্যুকে জানিনা আমি, তুমিও জানো না; তাকে, কেউই কি জানে?
মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে আসা কারো সাথে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়নি
ঘাসের উপর দিয়ে, ক্লান্ত মরুভূমিতে, সমুদ্রের উপর দিয়ে যেতে যেতে
                        দেখা হয়ে যায়নি কখনো কোন প্রত্যাবর্তনকারীর সাথে

স্বপ্নে হয়েছে দেখা বহুবার মৃতদের সাথে,
কেননা স্বপ্নের সময় মোটেই এই পৃথিবীর ভ্রান্তি নয়,
কিন্তু যারা মৃতুর ওপার থেকে ফিরে, আমার স্বপ্নের মধ্যে,
ক্লান্ত বেদনার মত ঢোকে, তারাও কি মৃত্যুকে জানে?

স্বপ্নে এসে ওরা আমার সাথে, পৃথিবীর মত কথা বলে, প্রাণ বিনিময় করে;
মনে হয় আমার বা ওদের উপরে অপ্রেম বা সময়ের কোন প্রভাব পড়েনি
ভ্রান্তিময় এ জীবনে স্বপ্নকে গাঢ় বাস্তবতার মত লাগে, ওদের জড়িয়ে ধরি,
কিছুক্ষণ বাস্তব থাকে, তারপর চ্যাপ্টা কাগজের মত হয়ে যায় সকলের দেহ
টের পাই, মৃত্যু নিয়ে যে যা বলে তা সবই কল্পনা;
                        ধ্যান করে, না করে, মৃত্যুকে জানা যায় নাকি?

বরং গভীর অপ্রেমের মধ্যে মৃত্যুকে ঝাপ্সা ছায়ার মত ধরা যায় যেন;
মনে হয় ঘুম এক কমা; মৃত্যুর রিহার্সাল;
জেগে ওঠা একটি ফুল-স্টপ পার হয়ে অন্য একটি বেদনার বাক্যে ঢুকে যাওয়া
প্রত্যেকটি দিন এক বিপর্যস্ত, হাঁটু গেড়ে নত হতে থাকা, ক্ষুদ্র বাক্য

বহু স্কাইস্ক্রেপারের মধ্যে পুরাতন দালানের মত বসে আছি
একটি হলুদ ক্রেন আমার চারদিকে ঘোরে; তা সত্ত্বেও, স্ট্রেঞ্জ বেদনায়,
                        গাছ জন্মে আমার শ্যাওলা পড়া ছাদে, সবুজ বাতাসে

 

৫.

                        বিশদ বর্ণনা নেই, সংকুচিত আমি, এই ঈগল ও স্পেস;
অনেক জীবন, প্রতি জীবনের মধ্য দিয়ে, দীর্ঘশ্বাসের মত, ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছে;
চোখের ভিতরে, কপালের উপরে, ডিএনেতে— দীর্ঘদিন, দীর্ঘরাত;
ঘুম পায়; বহু কষ্টে চোখ খুলে থাকি; এরকম দীর্ঘকাল হল;
চলে গেছে বহু কিছু; বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের ঘুমের অক্ষম চেষ্টা
                                                 রয়ে গেছে চোখে

পৃথিবীর মানুষের অনিদ্রার নিপীড়ন আমার দুচোখ;
অনিদ্রা, সে এক নিষ্ঠুর অমরতা;
চক্রাকারে ঘুরছে আকাশ, যেন সে মাতাল এক গোল্ডেন ঈগল;
পথ স্থির নেই; পথ থেকে সরে যাচ্ছে পথ;
সমস্ত সড়ক তাদের মূল উদ্দেশ্য ভুলে
                        টার ও কংক্রিটসহ আমার চোখের নিচে ক্রমশ জমছে

অপ্রেমের হাত থেকে মুক্তি পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম;
কিন্তু দেখলাম আমি, সকল প্রকার খাঁচা গোল হয়ে এগিয়ে আসছে
অনেক পরাজয়ের মধ্যে অপ্রেম ছড়িয়ে পড়ছে ক্যামিক্যাল উইপন হয়ে
ফলে আর অপ্রেম থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ভাবছিনা আমি;

এও ঠিক, অপ্রেমে, জ্ঞানের মত এক সন্নিবিষ্ট ছায়া, এসেছে নিকটে
ওকে ঠেলে সরাবার চেষ্টা আর করছিনা;
বরং দরদালানের মত নীরব হয়েছি, ভাবছি
অনিদ্রার অমরতা থেকে মুক্তির পন্থা কিছু আছে নাকি নেই
পন্থার গুরত্ব আমি আবার নতুনভাবে অনুভব করছি;
অফুরন্ত অপ্রেম— গোল্ডেন ঈগল, ঘুরছে কাঁচের বাইরে,
দূরে কেউ ফোনে কথা বলে, আমার সঙ্গে নয়, অন্য কারো সাথে;

অনিদ্রার অমরতাও একইভাবে মেনে নেব ভাবছি এখন

আরো পড়তে পারেন

তরুন ইউসুফের একগুচ্ছ কবিতা

বহ্ন্যুৎসব কত কিছু পুড়ল! গাড়ি পুড়ল বাড়ি পুড়ল দম্ভের দালান পুড়ে ক্ষার জলপাই সবুজ ট্যাংক নামল পুড়ল বই গল্প রূপকথার বেলুন হাতে পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে উড়ে গেল বালক মায়ের আঁচল পুড়ল পুড়ল বুকের কাছের লোক যুবকের বুক পোড়াতে পোড়াতে পুড়ে গেল বন্দুক, থানার সেপাই কারো কারো স্বপ্ন পুড়ল আমিও পোড়ার গন্ধ পাই- আমার পুড়ল….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

বাবা আপনার ব্যর্থ শরীর জানত নিরাময় উড়ে গেছে আসমানে, আপনার মৃত্যু হবে। শেষবেলায় আপনি বড় নিঃস্ব, ঈশ্বরের মত নিদারুন, একমাত্র একা। সেকারনেই আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে ভেন্টোলিন সিরাপ খেতেন, অ্যাসমা’র বড়ি গিলে সারা রাত কাঁশতেন। আপনার কফ গলানো কাঁশির শব্দে কোন কোন রাতে আমাদের কাঁচা ঘুম ছিঁড়ে যেত, আমরা বিরক্ত হতাম। তারপর, আপনার জবুথবু মুখের দিকে….

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ২)

মেয়েটি আর তার চিৎকার সমুদ্রতীরের মেয়েটি, যার একটি পরিবার আছে আর সেই পরিবারটির একটি বাড়িও আছে। বাড়িটির মধ্যে দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। সমুদ্রে একটি যুদ্ধজাহাজ মজার ছলে তীরে হাটাহাটি করতে থাকা লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে: চার, পাঁচ, সাত জন বালির উপর পড়ে যায়। একটি অস্পষ্ট ঐশ্বরিক হাতের সাহায্যে মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য কোন প্রকারে….

error: Content is protected !!