
এবার শ্রাবণে কবিতার হাঁটুজলে
আষাঢ়ের গান থইথই করে ভাসে,
আসমানীদের ভাঙ্গা ভাতের থালায়
পুঁজিবাজার খলখলিয়ে হাসে।
এবার শ্রাবণে পাহাড়ি বানের জলে
মহেশের গৃহে অভাবের আনাগোনা,
আদালত পাড়ায় সমকাল উল্লাসে
মুক্ত বয়ান আগুনে পুড়ে সোনা।
এবার শ্রাবণে কমলা রোদের তাপে
গণতন্ত্র হয় দাবানলে পুড়ে খাক,
শান্তি মিশন মার খায় ডুবাজলে
মানুষ খুঁজে সাম্যবাদের ফাঁক।
এবার শ্রাবণে তুমি নেই আজ পাশে
নির্জন বুকে চৈত্রের হাহাকার,
ঘোর বর্ষণে কাঁদিছে অলকানন্দা
ঋতুবতী হয় সকল পাপাচার।
এবার শ্রাবণে আকাশে ‘বারুদ-গন্ধ’
কৃষ্ণচূড়ার রঙ হয়েছে কালো,
সুঁই সুতোয় বানিয়ে জলের সেতু
আছি আমি ভীষণভাবে ভালো।
২.
এই শ্রাবণে আমি কিছুতেই থাকবোনা
কাশফুল-কদমের বিপুল সংঘাতে,
এই শ্রাবণে তাই ভিজবোনা জলে আমি
ফুল হয়ে রয়ে যাব তোমার খোঁপাতে।
এই শ্রাবণে আমি উজান স্রোতে ভাসা
ডুবো ডুবো ম্রিয়মান ঋণগ্রস্ত কাঁধ,
বুকের আগুনে পুড়ে খাক হয় চাঁদ তাই
জলের আগুনে দেখি মৃত্যুর ফাঁদ।
গভীর অসুখ পুষে রেখেছি বুকে আমি
ফিকে বিকেলের সব সাজানো হাতলে,
এই শ্রাবণেই ভাঙ্গি আকাশকুসুম যত
ভাতের মাড়ে মাখা হাতুড়ি শাবলে।
এই শ্রাবণের ভাঁজে স্বপ্নের সেতু আমি
আর কিছু থেমে থাকা বিকল সময়,
তুমুল বর্ষণে আজ ‘মুমূর্ষু-কান্না’ তুমি
ঘোলা জলে ভেজা এক স্নিগ্ধ অপচয়।
এই শ্রাবণে আমি অসৎ কাব্যের নদী
প্রখর ক্ষুধায় মাখা অস্পষ্ট গোঙানি,
ভেলায় চড়েচড়ে পাড়ি দেই পথেপথে
প্রয়াণসমুদ্রে আমি তোমার উস্কানি।
এই শ্রাবণের কালে সংসদে থেকো তুমি
ডুবে থাকা জলে যেন ঋতুর সংসার,
এই শ্রাবণে আমি কাঁদলেই কিইবা হবে
নাগরিক রোদে ঢাকা ত্রাণের প্রহার।
মুমূর্ষু স্বদেশের অকাল প্রয়াণে আজ
‘হলুদ-বসন্ত-পাখি’ চিঠি নিয়ে আসে,
নীলরঙ গল্পের বুঝিনা তো ভাষা আমি
এক্কাদোক্কা খেলায় হাভাতে উল্লাসে।
এই শ্রাবণের গৃহে হারবেই বলে জানি
সৈয়দ শামসুল হক খেলারাম খেলে,
আমি শুধু গুনে গুনে কড়ি জমাতেই থাকি
স্বাধীনতা বুঝে নেয় ধার্মিক জেলে।
এই শ্রাবণের বুকে আড়মোড়া ভেঙে ভেঙে
জেগে ওঠে ঘুম থেকে বিষণ্ন খরা,
কার কিইবা এসে যায় শকুন উড়ে এলে
শ্রাবণের জলে ভাসে ‘মৃত্যু ও জরা’।
ভাঙ্গা টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টিতে
টপটপ ঝরে পড়ে অভাবের কণা,
সুবুজ পতাকায় রঙগুলো ম্লান হলে
ফোঁসফোঁস করে ওঠে সাপের ফণা।
এই শ্রাবণের জলে চোখের প্লাবনে ভাসে
বুকের উঠোন আর একমুঠো রোদ,
কবিতার ঘ্রাণ শুধু শুকবেই বলে জানি
কামুক কবি তার হারায়েছে বোধ।
অরণ্যের সংসার সাজাতেসাজাতে ভাবি
আমি যেন ঝমঝম ‘বৃষ্টি-বাসর’,
চালের খোসার ভেতর জমিয়ে রাখি তাই
‘ভোরের আজান’ আর ‘ঘন্টা-কাসর’।
চাঁদের ছায়ায় ডুবে অভাবী চুম্বন আজ
শ্রাবণে মরে গেছে কদমের ফুল,
জোৎস্নার মাতম আর জলের অসুখে তাই
ভীষণ ভালো আছে মোর যত ভুল।
ভালো থেকো ভালো থেকো অভাবী অসুখ
ভালো থেকো শ্রাবণের শোষক প্লাবণ,
ভান করে আছি আমি মহা সুখে তাই
জলের আয়নায় দেখি ‘দুঃখ-কাহন’।
আতসী কাঁচ দিয়ে খুঁজব না আমি আর
বুকের কফিনে রাখা গোপন ঠিকানা,
শ্রাবণ জেনে গেছে জলের মাঝি আমি
জলেজলে ভাসা এক মোহরের দানা।
৩.
পথের শেষে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা
শ্রাবণের মেঘ বৃষ্টি হয়ে এলো,
মেঘমল্লার গান গাইছিলে তুমি
আঁচল ছিল বাতাসে এলোমেলো।
আমি তখন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
ঝাপসা চোখে চেয়ে আছি অনিমেষ,
হঠাৎ দেখি একফালি রোদ্দুর
জলের আগুনে শুকায় তোমার কেশ।
আমি তখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখি
মেঘলা আকাশে কবিতার খুনসুটি,
বুকের ভেতর আড়মোড়া ভাঙ্গে সাপ
আমার তখন তোমাতেই লুটোপুটি।
তুমি এখন শাওনমাখা ভোরে
ভৈরবীতে বাঁধছো নতুন তান,
আমার শ্রাবণ তোমার চুলের ভাঁজে
হারিয়ে যাওয়া বাদল দিনের গান।