Author Picture

রুদেবিশ শেকাবের অবিনশ্বর ভালোবাসা

মেজবাহ উদদীন

বিমূর্ত যে বাস্তবতাকে জীবন নাম দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা, অমর হতে চাওয়ার মধ্যদিয়ে তার অতৃপ্তির শুরু। তারপর সেখানে যোগ হয় সুখী হতে চাওয়ার অসুখ। মানুষের সুখী হতে চাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই, আবার যেন সেটাই দোষের। মনের সুখ, দেহের সুখ, চোখের সুখ; হরেক রকম এই সুখের সন্ধান করতে গিয়ে মানুষ হাজার রকম দুঃখের কাছেই পৌঁছে দেয় নিজেকে। তবে কথাসাহিত্যিক হারুন আল রশিদের ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ উপন্যাসে এই উত্তর খোঁজাই একান্ত উদ্দেশ্য নয়। বরং সেটা আসলে খুঁজতে চায় মানুষকে। মাতৃহীন বালকের অভিমানী মনের ওপর প্রত্যাখান জমে জমে পাথর হয়েছে, আর সেই পাথরের সঙ্গে রুদেবিশ মিলিয়ে চলছেন তার চারপাশকে, ফলে জন্ম নিচ্ছে একের পর এক গল্পের। যা কি না ব্যতিক্রমী একজন মানুষকেই নির্মাণ করেছে।

উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস অতীত-বর্তমান হয়ে এগিয়ে যায় ভবিষ্যতের দিকেও। যা ঘটেছে তা ধোঁয়াশাময়, যা ঘটমান তা অস্বস্তির, অতএব এই বিভ্রম মুক্তির জন্য কাহিনিকে এগিয়ে যেতে হয়, যা ঘটতে পারে সেদিকেও। সময় নদীর পাড় ধরে কাহিনির এই আাস-যাওয়া সেই বোধকে জোরালো করে, মানুষ মূলত একা। তাই তো ভিড়ের মধ্যেও এই একলা মানুষ খুঁজে ফেরে আর-একজন মানুষকে, যে মানুষ হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারে। তাকে ভালোবাসতে পারে। এ-উপন্যাস সেই বিবেচনায় ভালোবাসার কাঙাল মানুষেরই যেন প্রতিধ্বনি। দুই খণ্ডে রচিত উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে রুদেশিব শেকাবের পারিবারিক, সামাজিক ও কৈশোরের ভাবাবেগের চিত্রায়ণ। দ্বিতীয় খণ্ডে লুনাভা মিনির প্রতি রুদেবিশ শেকাবের নিখাদ প্রেমের উষ্ণতায় নিজেকে সেকে নেওয়ার অসম্পূর্ণ অ্যালগরিদম।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র- রুদেবিশ শেকাবের জীবন কোন দেশীয় প্রেক্ষাপটে চিত্রিত হয়েছে? সেখানকার মানুষের জীবনযাপন, ধর্মীয় বিধান কী? এসব প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর জানা না গেলেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়, রুদেবিশ শেকাবের কথায়, ‘আমি যে জায়গায় আছি তাকে আপনারা সমুদ্রের তলদেশ, সুউচ্চ পর্বত চূড়া, বিস্তৃত বালিয়াড়ি, কণ্টকিত জঙ্গল, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, কর্মব্যস্ত শহর, শান্ত পল্লিদেশ, স্বর্গ বা নরক বলে মনে করতে পারেন। তবে সমুদ্রতলদেশ একটি উপযুক্ত পরিবেশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, কারণ আমার পরকালের যাত্রা সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু হয়।’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে পাঠক এদেশের জীবনযাপনের সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাবেন।

রুদেবিশ কেন পারেনি সুখী হতে? শেষ পর্যন্ত সুখ খোঁজার অভিযান কোথায় থামাতে বাধ্য হন রুদেবিশ? সমাজের প্রচলিত মিথ, ধর্মীয় আচার, আধ্যাত্মিকতা পেরিয়ে ব্যতিক্রমী কোন ঘাটের অভিমুখ হয়ে উঠেছিল তার যাত্রপথ! সুখী হওয়ার জন্য জ্যোতিষী ধ্রোনের উপদেশ ছিল, ‘সুখী হতে চাইলে জিব কামড়ে ধরে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করো। যদি তা না পারো, গ্রামে চলে যাও, ভূমি চাষ করো। যদি জমি না থাকে, গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হও। যদি তা-ও না পারো, উপাসনালয়ে যোগ দাও। প্রতিবেশীরা তোমার জন্য খাদ্য নিয়ে আসবে, খাটে তোমার বিছানা পেতে দেবে। তুমি সুখী হবে।’

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবনহারুন আল রশিদ
উপন্যাস । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মূল্য: ৪৫০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017 
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/290130
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

উপন্যাসের শেষ খণ্ডে লুনাভা মিনিকে পরিপূর্ণ রূপে পাওয়ার জেদ পাগলামিতে পরিণত হয়েছিল। তবু ভালোবাসার সুর সব জয় করেও ধর্মের কাছে এসে বাধা পরে ভীরুতায়! ১০০ বছর বাঁচার অভিলাষের বরফখণ্ড পানি হয়ে রুদেবিশ শেকাবের আঙুলের ফাঁক গলে ৩৩ বছরেই বেরিয়ে গেল! কিন্তু আমরা তার ২৩ বছরকেই পাই ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদের কলমের পাশে। রুদেবিশের বাকি ১০টি বছর বা তার মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল তা রহস্য হয়েই থেকে গেল।

জানামতে, সামাজিকতায় মোড়া মানুষ সব থেকে অযত্ন করে তার মনের। তার চাওয়া-পাওয়াকে সে চাপা দেয় আপন দক্ষতায়। অনেকটা যেন, মানুষ তার নিজের ভেতরেই নিজেকে সমাধিস্থ করে রাখে। তার একান্ত কথাগুলো যাতে অশ্রুত থেকে যায়, সে বন্দোবস্ত করে নিজের হাতেই। তবুও কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে মনের দরজাগুলো খুলে গেলে মানুষের রূপ বদলে যায়। লেখক আমাদের যেন মনে করিয়ে দেন, মাপে-মাপে বয়ে চলা এই জীবনের সবটুকুই সত্যি নয়। তাই তো সমাজ ব্যবচ্ছেদের এই উপন্যাস আধুনিক মানুষকে আলো-অন্ধকারে এনে দাঁড় করায়। লেখকের আকাঙ্ক্ষা পাঠক যেন তাঁর লেখার প্রকৃত তাৎপর্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। আর ঠিক সেই কাজটি করতে গেলেই এই ক্রমাগত বদলাতে থাকা বিশ্বে একজন একাকী মানুষের কথন উঠে আসে। যে মানুষ সামাজিক প্রেক্ষিতেই মিলিয়ে দেখছে তার অস্তিত্বকে।

শৈশবের বন্ধুহীন রুদেবিশ শেকাব মানুষের সাথে মিশতে ভুলে গেছে। সব সময় নিজের দুঃখকে বড় করে দেখে, নিজের সুখের সন্ধান করতে করতে বাস্তব জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস তার শেখা হয়ে ওঠেনি। তাই তো তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমার অভিজ্ঞতা বাস্তবে যত বিষাদ, স্মৃতিতে তত মধুর’। লোভ-লালসা-যৌনতার যে মিশ্রণ মানুষের অস্তিত্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে, সেটিতেই লেখক চড়িয়েছেন সমকালের রং।

লুনাভা মিনির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রুদেবিশ শেকাবের ভালোবাসার প্রতি মোহভঙ্গ হয় বলেই মনে হয়। যেখানে আমরা তাকে বলতে দেখি, ‘আমি শপথ করি ভালোবাসার মোহ কেটে ফেলব, আমি অলসতা ত্যাগ করব, বিড়ালের মতো মিউ মিউ জীবন আর যাপন করব না, এবার সিংহের মতো গর্জে উঠবো। আমি মানুষের কষ্টের সাথে মিশে যেতে চাই, বিকেল বেলা শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত খুপড়ির জীবন দেখি। অন্ধ, খঞ্জ, মূক, বধির, ব্যাধিগ্রস্ত, ছিটগ্রস্ত মানুষের সাথে সমব্যথী হওয়ার চেষ্টা করি। প্রেমরোগের তাতে কিছু উপশম হয়। একদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ৩২টি মৃতদেহ দেখে মনে হয় প্রেম আমাকে আর কখনো কষ্ট দিতে পারবে না।’

মৃত্যুকে আমরা প্রতিদিন কত রূপে দেখি, তবু আমরা ভাবি এসব মৃত্যু আমার হবে না। এভাবে মারা যাবে অন্য কেউ। শত বছরের ওপারের কোনো স্টেশনে গিয়ে থামবো আমি। আমাদের এহেন চিন্তায় দেবতার ফিসফাঁস, ‘কেন তুমি প্রতিদিন সকালে ভাবো, আজকের দিন তুমি কোনোভাবে বেঁচে যাবে, যেখানে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষ মারা যাচ্ছে।’

মানুষের পৃথিবী মানচিত্রে বিভাজিত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মতো আরও অনেক কিছুই মানুষের সুখের প্রতিপক্ষ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তবু নশ্বর পৃথিবীর আরও নশ্বর জীবন যে শুধু ভালোবাসা বিতরণ করেও কাটিয়ে দেওয়া যায় ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’র মধ্যদিয়ে ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদ কি প্রকারন্তরে আমাদের সেটাই বলতে চাইলেন?

আরো পড়তে পারেন

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার বাতিঘর

এমনটি হতে পারে এবং হয়েছে সে বিষয়ে বিদগ্ধ লেখক প্রশ্ন তুলেছেন এবং সংশ্লিষ্টদের কাজের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন। দেখুন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার বাতিঘর। আমাদের অস্তিত্ব। সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেভাবে কথা বলা যায় না; মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিংবা পরবর্তীকালে যেসব ষড়যন্ত্র হয়েছে কিংবা এখনও হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলার মানুষের সত্যিকার অভাব রয়েছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সন্তান….

মুক্তিযুদ্ধ : স্বার্থের অভিঘাতে সাম্য বহুদূর

এই বইটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হলেও, একটু ভিন্ন ধরনের। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরোধী ছিলেন; তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন, যে মা তার সন্তানকে যুদ্ধে যেতে বাঁধা দেননি… তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। (বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে) মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগেই। একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্য….

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর

‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ নামে একেএম শামসুদ্দিনের এই প্রবন্ধ সঙ্কলনটির কেন্দ্রস্থলে যে মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে সে-সংবাদটি বইয়ের নামকরণেরই উপস্থিত। লেখক নিজে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। তাঁর আপন দুই ভাই যুদ্ধে গেছেন, ভগ্নিপতি প্রাণ হারিয়েছেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে। যুদ্ধের সময়ে তাঁর বয়স ছিল অল্প, মাত্র ছয়-সাত বছর, নাহলে তিনিও যুদ্ধে যেতেন; সে-মনোভাব সঙ্কলনের প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত। যুদ্ধের সময় তিনি অনেক….

error: Content is protected !!