Author Picture

বাবুল আহমদ-এর একগুচ্ছ কবিতা

বাবুল আহমদ

আরেক ফাল্গুণে

এ কেমন বর্বরতা!
হিটলার যদি গোলাপ চাষীও হয়ে যায়
অথবা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চার্চের পুরোহিত
তাহলেও বরফ গলবে এন্টারকটিকায়
পাতা ঝরবে শরতের বনে
পাপড়িহীন বৃন্তে লাল পিঁপড়া যাবে বিষের সন্ধানে।
এ কেমন বে-নজীর মাতুব্বরি!
স্বর্গের পাখি এলবাট্রোস্ শরবিদ্ধ আজ
তার নামে শোকগাঁথা হলে নরকের সিঁড়ি ভাঙতেই পারে
কেউ যদি মহররমের মর্সিয়ায় রক্তাক্ত করে নিজের শরীর—
বিলাপ করে জারে জারে,
সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার হতে পারবে না কেন ?
আকাশে থু থু ছড়ালে থু থু বৃষ্টি তো হবেই
সমবেত প্রার্থনায় অলৌকিক কিছু ঘটে গেলে
আমাদের কষ্টের দুইকোল ভাঙবে দীর্ঘশ্বাসে।
একটা নীল খাম দিয়ে গেছে ডাক হরকরা,
তাতে কয়েক ফোটা রক্তের দাগ— কাল গোনে,
আমরা এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি
চিঠির উত্তর লিখব আরেক ফাল্গুনে?

 

গুডস্ ট্রেন

ওটা কোনো যাত্রিবাহি ট্রেন ছিল না, লোকাল গুডস্ ট্রেন
১৮নং ডাউন ট্রেন ছেড়ে যাবার সিটি বাজছে—
৩১নং প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনটি
ইঞ্জিন থেকে একরাশ ক্লান্তি বেরিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া হয়ে আকাশে
১নং প্লাটফর্মে ১৯নং আপট্রেন এসে প্রবেশ করবে
সব রকম প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে, ওটা-ও গুডস্ ট্রেন
এর প্রত্যেকটি বগি প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভাবনায় ভরা
যেমনটি ছিল ১৮ নং ট্রেনের
অনেক স্বপ্ন আর পরিকল্পনা নিয়ে
১নং প্লাটফর্মে প্রবেশ করবে ১৯নং গুডস্ ট্রেন
একই স্টেশনে বিদায়ের জন্য যেমন করুণ অন্তিম সুর
তেমনি নুতনকে বরণ করে নেয়ার জন্যও বরণ ঢালা নিয়ে
খোঁপায় চাপাফুল জড়িয়ে তরুণীরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে
আসা যাওয়ার এই খেলা চলছে সেই প্রভু যীশুর কাল থেকে
যেদিন প্রাচ্য দেশের তিনজন বিখ্যাত পন্ডিত বেথেলহামে
সুগন্ধি আর খাবার নিয়ে এসেছিলেন। ১৮নং ডাউন ট্রেনটি
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে ছেড়ে যাবে, এটি তার শেষ যাত্রা
মহাকালের কৃষ্ণ গহ্বরে। ওটা কোনো যাত্রিবাহি ট্রেন নয়
গুডস্ ট্রেন। মানুষের চাহিদার কথা ভেবে এই ট্রেনে
১২টি বগি ছিল স্বপ্ন আর সম্ভাবনায় ভরা
১২টি বগির আলাদা আলাদা নামও ছিল
তাদের মুখ দেখে চেনা যেত কালের বিবর্তন
একই রকম প্রতিশ্রুতি নিয়ে
১৯ নং ট্রেনটিও আসছে ১২টি বগি আপাতত: পূর্ণ স্বপ্নে।

 

বর্ষামঙ্গল

শ্রাবণে বৃষ্টি হবে,
তুমি আমি বৃষ্টিতে ভিজে শুদ্ধ হব,
এক চাদরের নিচে ধুঁয়ায়িত চায়ের কাপে
আমাদের যুগল চুম্বনে শিহরিত হবে
গড়িয়ে পড়া জলকণা।
শ্রাবণে প্রবল বর্ষণ হবে,
আমরা ডিঙ্গি ভাসাব লাল শাপলার ঝিলে,
আমাদের দেখে বয়স্করা উপহাস করবে,
তরুণরা শিটি বাজাবে,
তাদের চটুল গানে আমাদের গাল রাঙা হয়ে উঠবে,
আমরা বালি হাঁসের মতো ডুব দিতে চাইবো
একমুঠো শাপলার আড়ালে।
শ্রাবণে ভারি বৃষ্টি হবে,
টিনের চালে খৈ ফোটার শব্দ হবে অবিরাম,
তুমি আর আমি কবিতা আওড়াবো চিৎকার করে,
লোকে যা’ই বলুক,
আমরা এভাবেই কাটিয়ে দেব বর্ষাকাল।

 

আত্মাকে মরতে দিও না

মাঝে মাঝে ফোন দিও
আজকাল তো কেউ কারো বাড়ি বেড়াতে আসে না,
সবাই ব্যস্ত।
সময় বড় মূল্যবান,
প্রতিটা মূহুর্ত কত দামী।
মাঝে মাঝে ফোন দিও
ইথারের কণ্ঠধ্বনি রক্তকণিকায়
বিদ্যুত প্রবাহ বাড়ালে বন্ধন শক্ত হবে।
আত্মার আত্মীয়তা এক গভীরতম পুড়া ক্ষতের মত,
সেখানে মাঝে মাঝে সম্পর্কের প্রলেপ না দিলে
ক্যান্সার হতে পারে।
ক্যান্সার মানে নিশ্চিত মৃত্যু,
দুদিন আগে কিম্বা পরে।
মাঝে মাঝে ফোন দিও;
সময়ের অজুহাতে আত্মার মৃত্যু যেন না হয়।
সম্পর্কে বন্ধন দৃঢ় করতে পারে একটা ফোন কল,
আত্মাকে মরতে দিও না।
মাঝে মধ্যে ফোন দিও।

 

এবার মূখ খুলো

মৌনতা তোমাকে আরো বেশি কষ্ট দেবে,
তোমার হৃদয় ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর মতো
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে পৃথিবীর সর্বত্র, যেখানে
বুলেটবিদ্ধ মানুষের মরদেহ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে,
বাতাস তাকে সহ্য করতে পারছে না,
অশ্রুর কাছে পরাজিত হয়ে বৃষ্টি থেমে গেছে।
মৌনতা তোমাকে আরো অনেক বেশি কষ্ট দিবে,
তোমার চিৎকার করা উচিত, আমি বলব না তুমি
চিৎকার করে কাঁদো, কিংবা তোমার কণ্ঠস্বরকে
বজ্রের মত নিক্ষেপ করো- তুমি শুধু চিৎকার করো,
মুক হয়ে থাকা তোমাকে মানায় না।
মানুষ হত্যা কোনো মনুষত্বের কাজ হতে পারে না,
হোক তা শান্তি কিংবা অন্য যেকোনো অজুহাতে।
তুমি শুধু প্রিয়জনের বুকে বুলেট বিদ্ধ হলে কাঁদো,
মানুষের মৃত্যু তোমাকে বিচলিত করে না,
তুমিও তো মানুষ!
পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে,
জ্বরা ও মারীতে প্রতিদিন বিদায় নিচ্ছে প্রিয়জনের
সান্নিধ্য ছেড়ে। তারা তো কোনো দোষ করে নি।
তুমি কি প্যালেস্টাইনিদের দেখে, বসনিয়ানদের দেখে,
লেটিন আমেরিকা, পোল্যান্ড, উজবেকিস্তান,
অথবা কাশ্মিরীদের কস্টের কথা ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছ ?
তুমি ভুল করেছ। তুমি জানোনা
মৌন হয়ে থাকার দিন শেষ, এবার মুখ খুলার পালা।

 

একটি মানচিত্র চাই

যে মানচিত্রে কবিতা ফলে না সেই মানচিত্রের
কোন প্রয়োজন নেই আমার।
কবিতাহীন জীবন পাতাহীন বৃক্ষের মতন,
তাতে যতই জল ঢালো ঋতু পরিবর্তনের ছোঁয়া
তাকে পল্লবিত করবে না।
সে প্রাণহীন পাথর সমান,
প্রেমের স্বর্গীয় অনুভুতি তাকে বিমোহিত করে না,
ফুলের সৌন্দর্য সে উপলব্দি করে না,
রাতের কালো চাদরে তারাদের নকশি কাঁথা
তার চোখে ক্লান্তি নিয়ে আসে।
কবিতাই মানুষের জীবন।
প্রত্যেকটি মানুষ এক একটি কবিতা,
পুরুষের চোখে নারী কবিতা,
নারীর চোখে পুরুষ কবিতা,
পৃথিবীর সমস্ত পবিত্র গ্রন্থে কবিতার রহস্যময়তা,
কবিতাহীন মানচিত্রে অমানবিক আগাছা
পরগাছারা শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত হয়।
যে মানচিত্রে কবিতা নেই সেখানে
জীবনের কোন মানে থাকে না,
কবিতাহীন জীবন মানুষের জীবন হতে পারে না।
যেখানে কবিতা নেই সেখানে নারীর ঘন কুন্তলে
বাতাসের লুকোচুরি থাকে না,
সেখানে মরাল গ্রীবায় হংসমিথুন খেলা করে না
প্রেমিক যুগলে।
আমি কবি, কবিতাই আমার বিশ্ব জয়ের আরাধনা,
কবিতা চাষ করে তার রেণুগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই বাতাসে,
বাতাস পরাগায়ণে উদ্বুদ্ধ করবে, জাগাবে
ভীনদেশি কবির মনে কবিতা চাষের আকাঙ্ক্ষা।
কবিতায় কবিতায় ভরে উঠবে পৃথিবীর মানচিত্র,
কবিরা সংবর্ধিত হবে প্রান্তিক মানুষের অন্তরে।
যে মানচিত্রে কবিতা ফলে না সেই মানচিত্রের
কোন দরকার নেই আমার।
আমি একটি মানচিত্র চাই যেখানে কবিতার চাষ হবে
জীবন এবং মানবতার জয়গানে।

আরো পড়তে পারেন

তরুন ইউসুফের একগুচ্ছ কবিতা

বহ্ন্যুৎসব কত কিছু পুড়ল! গাড়ি পুড়ল বাড়ি পুড়ল দম্ভের দালান পুড়ে ক্ষার জলপাই সবুজ ট্যাংক নামল পুড়ল বই গল্প রূপকথার বেলুন হাতে পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে উড়ে গেল বালক মায়ের আঁচল পুড়ল পুড়ল বুকের কাছের লোক যুবকের বুক পোড়াতে পোড়াতে পুড়ে গেল বন্দুক, থানার সেপাই কারো কারো স্বপ্ন পুড়ল আমিও পোড়ার গন্ধ পাই- আমার পুড়ল….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

বাবা আপনার ব্যর্থ শরীর জানত নিরাময় উড়ে গেছে আসমানে, আপনার মৃত্যু হবে। শেষবেলায় আপনি বড় নিঃস্ব, ঈশ্বরের মত নিদারুন, একমাত্র একা। সেকারনেই আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে ভেন্টোলিন সিরাপ খেতেন, অ্যাসমা’র বড়ি গিলে সারা রাত কাঁশতেন। আপনার কফ গলানো কাঁশির শব্দে কোন কোন রাতে আমাদের কাঁচা ঘুম ছিঁড়ে যেত, আমরা বিরক্ত হতাম। তারপর, আপনার জবুথবু মুখের দিকে….

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ২)

মেয়েটি আর তার চিৎকার সমুদ্রতীরের মেয়েটি, যার একটি পরিবার আছে আর সেই পরিবারটির একটি বাড়িও আছে। বাড়িটির মধ্যে দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। সমুদ্রে একটি যুদ্ধজাহাজ মজার ছলে তীরে হাটাহাটি করতে থাকা লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে: চার, পাঁচ, সাত জন বালির উপর পড়ে যায়। একটি অস্পষ্ট ঐশ্বরিক হাতের সাহায্যে মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য কোন প্রকারে….

error: Content is protected !!