Author Picture

বৈশ্বিক মোড়কে দেশজ কাহিনীর দ্বৈত আঙ্গিক

গাজী গিয়াস উদ্দিন

সমাজ, সংস্কৃতি, জন্মমৃত্যু, প্রেম, কামনা, অর্থসম্পদের অধিকার ও বিরোধ বিচিত্র মিথস্ক্রিয়ায় শিল্পিত হয় সাহিত্যে। স্মৃতিকথা, অভিজ্ঞতা, উপদেশ, প্রত্যাদেশ প্রকাশে প্রয়াসী হন শিল্পী। এ শিল্প ধারণার আলোকে ব্যতিক্রম একটি উপন্যাস পর্যালোচনায় নিতে চাই।

লেখক কিছু বিশেষ বক্তব্য, দর্শনতত্ত্ব পাঠকের কাছে সরবরাহ করতে উদ্ব্যস্ত। বিষয়বস্তুর অনুসরণে নামকরণ লক্ষণীয়। ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’। আত্মজীবনের সাথে বিশেষ ব্যক্তিজীবন বর্ণনার ভেতর দিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ই এর লক্ষ্য। এতে মানবজীবনের বিচিত্র পরিস্থিতি ও সমস্যার ছায়াপাত ঘটেছে। শোষক ও লুটেরাগোষ্ঠীর দ্বারা বঞ্চিত দু:খী মানুষের দুর্দশার কথা পাঠকের চোখে জীবন্ত করে তুলেছেন। বিবেকবুদ্ধিকে নাড়া দিতে ধর্মদর্শনের অপব্যবহার ও গলদগুলো চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভালোবাসার বন্ধন, শোষণ বঞ্চনা ও কুসংস্কারমুক্ত সুন্দর পৃথিবীর প্রত্যাশা।

রুদেবিশ প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় মজনু- কায়েস বা কৃষ্ণের মতো প্রেমিকবর। ফরহাদ চরিত্রেরই নব আধুনিক রূপ। উপন্যাসটি মূলত আধুনিক প্রেম ও বিরহের। সময়কালের যদিও সুস্পষ্ট উল্লেখ নাই, আমরা ধারণা করে নিতে পারি, এ উপন্যাসের সমাজ ব্যবস্থা ও রীতিনীতি স্বাধীনতার ২০ বছর পরের, আজ থেকে ৩০ বছর আগের। এ উপন্যাসের সার্থক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কাহিনী পাঠককে ভিন্ন এক জগতে, চেনাজানা পরিবেশ সত্ত্বেও, ব্যতিক্রমী ভুবনে নিয়ে যায়। বইয়ের পুরোটা না পড়লে সে সৌরভ মিলবে না।

অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস মানুষের জীবনে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার ধর্মের বহু দর্শন জীবনে ফলেও যায়। রুদেবিশ ও অন্যান্যের ঘটে যাওয়া গল্পে লেখক হারুন আল রশিদ তার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। আখ্যান জুড়ে গঠনগত ও মনন সৃজন মুন্সিয়ানায় তা পরিব্যাপ্ত। বর্ণনার মাধুর্য আর মনস্তাত্বিক বিস্তার কাহিনীর মসৃণতার অভাবের সুস্পষ্ট পরিপূরক। এ উপন্যাসের ভাষাগুণ স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। ভালোবাসা ছাড়া মানুষের জীবনে আর কোনও প্রকৃত সুখ নেই। আর পুরুষের ভালোবাসার আধার নারী। এ পরমা নারী সত্তার কাছেই অবশেষে প্রেমিক পুরুষ রুদেব নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।

স্মৃতিমূলক আত্মজীবনী উপন্যাসাকারে লিখেছেন ২০২২ সালের নোবেল লরিয়েট ফরাসী লেখক এ্যানি এরনো। তার সাহিত্য প্যাটার্নের বিষয় এখানে মনে পড়ে গেল। হারুন আল রশিদের উপন্যাসে প্রকারান্তরে স্মৃতিচারণ থাকলেও এতে ডাইরির প্যাটার্ন নেই। রশিদের এ নভেল ভিন্ন মাত্রার, ভিন্ন স্বাদের।

মানুষের সুখ দেখে বেড়ানো কিশোর দ্রুত সুখী হতে চাওয়ার মাধ্যমে উপন্যাসের বিস্তার। পথপরিক্রমায় নানা ভুল সত্ত্বেও পবিত্র রক্তের দাবিদার রুদেব। বালক বয়সে মানুষের নিষ্ঠুরতা আর অপমানের অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বল্পভাষী এবং পরিচ্ছন্ন থাকার প্রতিজ্ঞা করে সে অগ্রসর হয়। এরপর আমরা পাই অদ্ভুত নায়কের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার বর্ননা এবং জীবন বিশ্লেষণ। এখানে উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি: ‘ঈশ্বর আমার অধ্যবসায় গ্রহণ করেছেন, ফলে পরিশেষে তিনি তাঁর প্রাচুর্য থেকে আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। আমার অভিজ্ঞতা বাস্তবে যত বিষাদ, স্মৃতিতে তত মধুর।… জ্যোতিষী ধ্রোন বলেছিলেন সুখী হতে চাইলে জিব কামড়ে ধরে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করো।’ (পৃষ্ঠা ১৩)

কাহিনীর চরিত্র ভিন্ন জগতের মানুষ। পরজগতের কথায় পরিবেশ বর্ণনা : ‘আমার জগতে মানুষ কলুষতামুক্ত।… এখানে সবাই খালি হাতে আসে। নিয়ে আসে শুধু হৃদয়ের অনুভূতি। পরকালের সামগ্রিক সত্তা অনুভূতি দিয়ে তৈরী।’ (পৃষ্ঠা ১৪)

‘সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, কেয়ামত আসবে মানুষের সন্তান জন্মদানের অনিচ্ছা থেকে, অন্যদিকে দেবদূতের তূর্যনাদ থেকে কেয়ামত সৃষ্টি হবে বলে পাদ্রিরা মূল সত্যে অবিচল থাকেন।… বেশীর ভাগ মানুষ উপসনালয় থেকে বের হয়েই পাপ শুরু করত। আমি বুঝতাম, শাস্তি অনেক পরে হবে বলে তারা পাপ করতে ভয় পেত না।’ ( পৃষ্ঠা ১৫-১৬)

এ উপন্যাসের অলৌকিক রূপ হলো, নায়ক পরজগতে বসে ইহজাগতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেন পৃথিবীবাসীর সাথে। পৃষ্ঠা ১৭ থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করছি : ‘পরবর্তী জীবনে নতুন এক বাসনা নিয়ে আমি অনেক প্রার্থনা করি। আমার ইহকাল ও পরকাল এই বাসনাটি দিয়ে তৈরী। মৃত্যুভয়ের উপর গবেষণা করে আমি জীবন শুরু করি। প্রেমে পড়ার পর সে গবেষণা আঁস্তাকুড়ে চলে যায়। প্রেম আমার জীবনকে চিরতরে বদলে দেয়।’

জাতীয় বহু সংকটের বিষয় লেখক পরিবেশন করেন কাহিনীর অবসরে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রচলিত হওয়ার আগে আমাদের সমাজে বংশ বিস্তারের হিড়িক পড়ে। লেখকের মন্তব্য : ‘ঈশ্বর প্রত্যেক জাতিকে একটি করে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। আমাদের (ধারণা করি বাঙালিদের, যেহেতু উপন্যাসে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নাই) ভাগ্যে পড়ে প্রজনন ক্ষমতা’।

ধর্ম বিশ্বাসের প্রভেদ কতো অনাকাক্সিক্ষত কুসংস্কার ও দুর্মতির জন্ম দেয়, তার গভীর পর্যালোচনা লেখক স্বতন্ত্র তথ্য ভঙ্গিতে পরিবেশন করেন। একপর্যায়ে পিতার বিতর্কিত স্ত্রী খ্যাপাবুড়ি চরিত্র কাহিনীতে নতুন এক রহস্যের সৃষ্টি করে। মাঝবয়সী সুন্দরী এবং পাগলের বেশ ধরা এই নারী ছিল রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবনের প্রথম নারী। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত রুদেবের গোচরে আসে খ্যাপাবুড়ি ও পিতার মিলন। ডামা ডোরির বড় মেয়ে লোটাসের সাথে জড়িয়ে শিশু রুদেবের মনে নারী ধারণার ক্রমবিকাশ ও পরিণতি উপন্যাসের এক উপাদেয় টার্নিং পয়েন্ট।

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন । হারুন আল রশিদ
উপন্যাস । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মূল্য: ৪৫০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/290130
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

কুমারী লোটাস উপকাহিনীতে দেখা যায়, লোটাস পরিবারের বোঝা ও গলগ্রহ। এ যেন বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পের জনম অভাগী ক্ষেন্তি। এখানে রুদেব লোটাসের দু:খের সাথী ও সহমর্মি। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সন্তান লোটাসের স্বপ্নের ‘শখ সিল্কের পোশাক, পরিষ্কার বিছানা, ফুলের বারান্দা, একটা বড় উঠান আর একটা পুকুর।’ লোটাস বিনি তারা নামক প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত। লোটাসের পরিণতির করুণ ছবি আঁকেন লেখক: কীভাবে আমার বন্ধু পাতিলের তলার মতো কালো আর কাঠির মতো পাতলা হয়ে গেল। এটা ছিল উপমার আরেক লোকজ উদাহরণ। এ প্রসঙ্গে পবিত্রগ্রন্থের বর্ননা দিয়ে লেখক বলেন, পবিত্রগ্রন্থের এ বাণী কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, আমি কখনও তা আর অস্বীকার করিনি। শেষতক লোটাসের আব্ধসঢ়;রু হারানোর হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে।

অবশেষে প্রেমে ব্যর্থ অনূঢ়া লোটাস ধর্মীয় পাদ্রী ঘোষিত শেষ কাতারের হীনমন্যতা জয় করে বিষপান করে। লেখকের ভাষায় ‘লোটাস বলে, আমি এখন প্রথম কাতারে চলে এলাম।’ ১৩ বছর বয়সের রুদেব ২২ বছর হবার আগেই কৌতুহল মিটিয়ে ফেলে  লোটাসের সাথে। লেখকের তাত্ত্বিকতা: বহু বছর পরে বহু বই পড়ে জেনেছি ওটা ছিল মূলত শুধু রক্ত প্রবাহের আনন্দ।…

এমন আনন্দ যা অপব্যবহার করলে পরমায়ু কমতে থাকে। অল্প বয়সে সচেতনতা লাভ ঘটে রুদেবের অলৌকিক জীবনে। উপাসনালয়ের আড়ালে ব্যভিচার, গরুচোরের প্রতি গৃহস্থ ও গ্রামবাসীর সমবেদনা, কারণ সে পিতার জারজ সন্তান। লৌহান দৌমত বাংলাদেশী নাম নয়। ৬০ নম্বর পৃষ্ঠায় পরিবেশের চমৎকার যে বর্ণনা আছে তা যে বাংলাদেশের তা লেখক না বললেও পাঠক অনায়াসে বুঝতে পারে। স্কুল সহপাঠী রুনিতা (সারাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে) এবং ইংরেজি স্যারের চরিত্র বর্ণনায় প্রাজ্ঞতার মাঝে একটি উপমা উল্লেখ করি: “তার (রুনিতার) সাদা উরুর দ্যুতি বেলা এগারোটার বৃষ্টিতে চারিদিকে রঙধনুর সৃষ্টি করে।” রুদেবের জীবনে আরো এক প্রেমপ্রার্থীর আবির্ভাব রোজা। অধ্যায় ১৩ তে অভ্যুত্থানে রুদেবের দেশের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ঘটনা, প্রভাবশালী পরিবারে পরিকল্পিতভাবে মেয়ে বিয়ে দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার এবং প্রতিশোধ গ্রহণের কৌশল বর্ণনা, যা রুদেবের দাদার জীবন বৃত্তান্তের অংশ। পিতা দিওনিশ শেকাবের বহু প্রেমবিবাহ, সমাজ ও পারিবারিক বিরোধ কেন্দ্রিক নানান রহস্যময় ঘটনা, একটি চিঠি পিতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তি, পারিবারিক বিপত্তি সত্ত্বেও বারবার নারীর কাছে সমর্পণ। নারীর সুখেই যার আনন্দ।

উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড। তেত্রিশ বছর বয়সে রুদেবের শত্রুদের হাতে মৃত্যু হয়, যা অবশ্য শুধু মার্জিনে বলা হয়েছে। গৃহ শিক্ষকতা জীবনের ছাত্রী লুনাভা মিনি নায়কের সর্বশেষ চির আরাধ্য নারী। লেখকের ভাষায় : ‘সকালে পৃথিবীর আর এক প্রান্ত থেকে সূর্য নয়, লুনাভা মিনি আমার জন্য ঘুম থেকে উঠে’। যে প্রেমিক প্রেয়সীর পায়ের পাতার সৌন্দর্য উপভোগ করেন। নারীর ভালোবাসা নিয়ে প্রেমিকের এত গভীর আত্মবিচার বিস্ময়কর। প্রেমকেন্দ্রিক বিচিত্র ভাবনা, কামনা বাসনার যুক্তিনিষ্ঠ বর্ননা সত্যি ব্যতিক্রম। নারী থেকে প্রাণশক্তির প্রাচুর্য লাভ করেন রুদেব। রাষ্ট্রপতি হওয়া, নোবেল প্রাইজ পাওয়া যার কাছে তুচ্ছ, যিনি চেয়েছেন শুধু নারী প্রেম। গৃহশিক্ষকতার আড়ালে লুনাভা প্রেমে নায়কের হাবুডুবু। অনেক বর্ণনা স্বগতোক্তিমূলক এবং মনস্তাত্ত্বিক।

শেষ পর্যন্ত লুনাভা থেকে কামনার সুখ চরিতার্থ করার ব্যাকুলতায় কাহিনীর ক্লাইমেক্স। তবে রুদেবের লুনাভা মিনিকে জোরপূর্বক ভোগ করার পরিকল্পনা তার সীমাহীন কল্পনার অংশ মাত্র, তার প্রেমপূর্ণ চরিত্র থেকে তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। ধর্মগুলির নাম উল্লেখ না করা হলেও ধারণা করা যায় লুনাভা খৃষ্টান আর রুদেব মুসলিম। আর তাদের প্রেমে সবচেয়ে বড় বাধা ধর্মবিশ্বাস। এ প্রসঙ্গে নারীর ঘোমটা ও সৌন্দর্য প্রকাশের পক্ষ বিপক্ষ বিতর্ক। লুনাভা মিনির মন জয়ের জন্যে নায়কের শতমুখী প্রচেষ্টার বহুমূখী দীর্ঘ দীর্ঘ বর্ণনায় নাটকীয়তা না থাকলে তা একঘেয়েমি সৃষ্টি করত। ৩১ অধ্যায়ে লুনাভার পেছনে মিছে সময় ক্ষেপন অর্থহীন প্রচেষ্টার অতিরেক মনে হয়। তেত্রিশ বছরের ইহকাল সাঙ্গ করে প্রেমিক পরকালে বসে লিখলেন প্রেম জীবনের খতিয়ান। রুদেবিশ শেকাব পাঁড় প্রেমিক। ইহকালে প্রেম না পেলেও পরকালে প্রেমের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছেন। প্রেম ও পরকালে তিনি পরম বিশ্বাসী। তাই অনন্য ব্যতিক্রমী এক ঐতিহাসিক প্রেমের জীবন আমরা প্রত্যক্ষ করি।

এ উপন্যাসের বীজমন্ত্র বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর  ভালোবাসার নায়ক নায়িকারা। ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘কলেরার সময়কার প্রেম Love in the time of cholera’ উপন্যাসের নায়ক ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। প্রতিশ্রুত প্রেমিকা ফার্মিনা দাজাকে পাওয়ার জন্যে তার নিশি জাগরণের ৬২২টি অবৈধ মিলন এবং অসংখ্য অস্থিরমতি অভিযানে মেতে উঠে। অন্যদিকে ফার্মিনা পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে এক বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে এর গুটিকয়েক নিদর্শন রয়েছে। সমালোচকেরা বলেছেন, মার্কেসের এ বইয়ে গা ছমছমে রহস্য ভাব জাগিয়ে তোলার বিলাসিতা, বাস্তবতার নিয়মকে একটা বিশেষ বোধগম্যতার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা, শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত কথিত কালহীন মানবীয় কাহিনী। (এ্যান টাইলার, শিকাগো সান- টাইমস বুক উইক।)

উপন্যাসের শেষাংশে নারী প্রেমের পরিবর্তে রুদেবের দুঃখী বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াবার কমিটমেন্ট আছে। লুনাভার জন্যে জীবন উৎসর্গীকৃত ত্যাগের কাহিনী ছাপিয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চিরদুঃখী ভাগ্যহত ছিন্নমূল মানুষের মানবেতর জীবন পারের জবানবন্দি। বস্তির বাস্তব করুণ চিত্র। একটি সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা এবং প্রেমময় বিশ্ব দেখার বাসনা নিয়ে লেখক কাহিনীর ইতি টেনেছেন। মানসিক টানাপড়েনের প্রাধান্য, মনের গভীরে বিশ্লেষণ, মানব মনের অস্থিরতা প্রকাশ এবং মানসিক জটিলতা, দ্বৈততা ও ব্যাধি পরীক্ষণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ প্রধানত একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারার উপন্যাস। রহস্যময়ী লুনাভা লেখকের ব্যাতিক্রম চরিত্র সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, যোগাযোগ, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, দিনেন্দ্র নাথের তৃতীয় ভুবন, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা এ ধারার উপন্যাস।

হারুন আল রশিদের উপন্যাস রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন মায়া জড়ানো নভেল। বাক্য বিন্যাস, ভাষার লালিত্য, গদ্য উপমার বাহাদুরি অলংকৃত করেছে কাহিনীর দেহ সৌন্দর্য। লুনাভা আর সেসব প্রকরণ সৌন্দর্য একাকার হয়ে গেছে। প্রেম, ধর্ম, প্রাচীন মিথ, স্বৈরাচার, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নির্যাতনের ইতিহাস, নারীবাদ, পারিবারিক ও সামাজিক চড়াই উৎরাইয়ের প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাস পাঠকের কাছে বেশ পরিচিত এবং এটাই এ উপন্যাসের মূল স্পর্ধা।

আরো পড়তে পারেন

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার বাতিঘর

এমনটি হতে পারে এবং হয়েছে সে বিষয়ে বিদগ্ধ লেখক প্রশ্ন তুলেছেন এবং সংশ্লিষ্টদের কাজের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন। দেখুন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার বাতিঘর। আমাদের অস্তিত্ব। সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেভাবে কথা বলা যায় না; মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিংবা পরবর্তীকালে যেসব ষড়যন্ত্র হয়েছে কিংবা এখনও হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলার মানুষের সত্যিকার অভাব রয়েছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সন্তান….

মুক্তিযুদ্ধ : স্বার্থের অভিঘাতে সাম্য বহুদূর

এই বইটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হলেও, একটু ভিন্ন ধরনের। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরোধী ছিলেন; তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন, যে মা তার সন্তানকে যুদ্ধে যেতে বাঁধা দেননি… তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। (বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে) মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগেই। একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্য….

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর

‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ নামে একেএম শামসুদ্দিনের এই প্রবন্ধ সঙ্কলনটির কেন্দ্রস্থলে যে মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে সে-সংবাদটি বইয়ের নামকরণেরই উপস্থিত। লেখক নিজে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। তাঁর আপন দুই ভাই যুদ্ধে গেছেন, ভগ্নিপতি প্রাণ হারিয়েছেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে। যুদ্ধের সময়ে তাঁর বয়স ছিল অল্প, মাত্র ছয়-সাত বছর, নাহলে তিনিও যুদ্ধে যেতেন; সে-মনোভাব সঙ্কলনের প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত। যুদ্ধের সময় তিনি অনেক….

error: Content is protected !!