
মিলান কুন্ডেরা (জন্ম ১ এপ্রিল ১৯২৯ ব্রনো, চেকোস্লোভাকিয়া [বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রে]— মৃত্যু ১১ জুলাই ২০২৩, প্যারিস, ফ্রান্স)। অতিসম্প্রতি মাত্র দিন কয়েক আগে গত হওয়া বিংশ শতাব্দীর সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন কুন্ডেরা ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং কবি— যার সৃষ্টিসমূহ পৃথিবীর কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দার্শনিক বোধ ও বিদ্রুপের সাথে প্রবলভাবে একচ্ছত্র রাজনৈতিক মতবাদের সমালোচনা করে। যে রাজনীতি, যে শাসক ও শাসন মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাঁর উপন্যাস তাদের এই অরাজকতাকে ঠাট্টার ছলে চপেটাঘাত করে। ফলে, আমাদের সৌভাগ্যই যে, আমরা এমন এক মহান লেখকের সময় পৃথিবীতে ছিলাম, যিনি দ্বিধাহীনভাবে একচেটিয়া ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ কথা বলতে পারতেন। যেমনটা বলেছেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য জোক’ এ। যদিও তা প্রেমের গল্পের বুননে। কিন্তু সে উপন্যাসের ভাষা, বিশ্বাস ও আদর্শিক চেতনা ছিল এমনই শক্তিশালী— একটি দেশের তৎকালীন শাসনব্যবস্থা যার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে, উপন্যাসটি হয় নিষিদ্ধ এবং এর লেখক জীবনের প্রারম্ভেই হন নির্বাসিত। তদুপরি একজন লেখক যদি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন, গতানুগতিক স্থায়ী মতামত ও কর্তৃত্ববাদীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন, তাহলে জীবদ্দশাতেই তিনি এর একটা সুফল ভোগ করতে পারেন। অনায়াসে যেতে পারেন শতাব্দীর শীর্ষ লেখকদের তালিকায় এবং তাদের সৃষ্টিকর্মগুলোও পেতে পারে ক্লাসিকের মর্যাদা।
কাজেই এ এমন এক ধরণের নিকট-উত্তরত্ব— যা একজন লেখকের জীবদ্দশায় অর্জন করা যেতে পারে যদিও, তবে তাঁর সাহিত্যের পরবর্তী জীবনগুলো অনিশ্চিত। কিন্তু একজন লেখক যখন স্থায়ীভাবে লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে চলে যেতে পারেন, পরবর্তীতে ইতিহাস ও সাহিত্যে খুব দ্রুতই তিনি নিজেকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেন। কুন্ডেরা মূলত ছিলেন সাহিত্যের সেই নিভৃত অদম্য যোদ্ধা, যিনি চিরকাল তাঁর সৃষ্টিতেই নিমগ্ন ছিলেন। একটু গল্পের মত বললে, জনারণ্যের অদূরে ঋষির মত এমনভাবেই ধ্যানস্থ হয়েছিলেন যে, কয়েক দশক ধরে একপ্রকার অদৃশ্যই হয়ে ছিলেন প্যারিসে। কয়েক দশক আগে জনজীবন থেকে আড়াল হওয়া এবং আর কখনও একটি সাক্ষাৎকার না দেয়ার শপথের পরও, তিনি ছিলেন বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরে সারা পৃথিবীর তুমুল জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একজন। তার উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটকের বইগুলো পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষার পাঠককূলের হৃদয় ও সেলফ— দুটোরই সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর নোবলে প্রাইজের জন্য তার নাম উঠলেও, এ নিয়ে কখনো তেমন উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। একটি আত্মজীবনি লেখেননি, ছবি তোলা বা জনসম্মুখে তাঁর ব্যপারে ঘটা করে বন্ধুদের কথাবার্তা বলতেও করেছেন বারণ।
মোটকথা, আপন রচনার প্রতিটি দৃষ্টিকোণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং সেগুলোর সম্পাদনা ও অনুবাদেও ছিলেন যারপরনাই নির্মম নির্দয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মে এমন নিখুঁত, অনিন্দ্য এক সূত্র ও নৈতিক আদর্শ ছেড়ে যেতে চেয়েছেন, যেখানে এমনকি একটি কমাও স্বস্থানের বাইরে নেই। অতএব, সাহিত্য সমালোচক ও বিশ্লেষকদের মত মিলান কুন্ডেরা তাঁর দেশ চেকোস্লোভাকিয়ার জন্য সাহিত্যে তাই করেছেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (কলোম্বিয়ান ঔপন্যাসিক, ১৯২৭-২০১৪) ষাটের দশকে ল্যাটিন আমেরিকা এবং আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন (১৯১৮-২০০৮) সত্তরের দশকে রাশিয়ার জন্য যা করেছিলেন। এককথায় পূর্ব ইউরোপকে পশ্চিমা পাঠক জনগণের নজরে এনেছেন তিনি এবং এমন এক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তা সম্পন্ন করেছেন, যা তাদের আবেদনে সর্বজনীন। সত্যের জন্য তাঁর আহবান এবং যে অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা ছাড়া সত্যকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না, সে বিষয়ে তাঁর উপলব্ধি ছিল, ‘সত্যের সন্ধানে আমাদের অবশ্যই মৃত্যুর সাথে মানিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
যে রাজনীতি, যে শাসক ও শাসন মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাঁর উপন্যাস তাদের এই অরাজকতাকে ঠাট্টার ছলে চপেটাঘাত করে। ফলে, আমাদের সৌভাগ্যই যে, আমরা এমন এক মহান লেখকের সময় পৃথিবীতে ছিলাম, যিনি দ্বিধাহীনভাবে একচেটিয়া ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ কথা বলতে পারতেন
ফলে নিজের লেখালেখি এবং উপন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর যে স্পষ্ট চিন্তা ও আদর্শিক মনোভাব ছিল, ১৯৮৩ সালে ক্রিশ্চিয়ান স্যালমনকে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার থেকে তার কিয়দাংশ তুলে ধরা হলো।
: আধুনিক সাহিত্যের অন্য লেখকদের চেয়ে ভিয়েনিজ ঔপন্যাসিক রবার্ট মুসিল (অস্ট্রিয়ান দার্শনিক লেখক, ১৮৮০-১৯৪২) এবং হারম্যন ব্রোচের (১৮৮৬-১৯৫১) কাছাকাছি বোধ করেন বলে দাবি করেছেন আপনি। ব্রোচ ভেবেছিলেন, যেমনটা আপনি মনে করেন যে, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের যুগ শেষ হয়ে এসেছে। পরিবর্তে, যেটিকে তিনি ‘পলিহিস্টোরিক্যাল নভেল’ বা ‘বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বলেছেন, তাতেই বিশ্বাস করতেন।
কুন্ডেরা: মূলত মুসিল এবং ব্রোচ উপন্যাসকে সাঙ্ঘাতিক দায়িত্বের সাথে সাজিয়েছিলেন। তাঁরা এটিকে অনন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সংশ্লেষণ হিসাবে দেখেছিলেন, যেখানে মানুষ এখনও সমগ্র বিশ্বকে প্রশ্ন করতে পারে। তারা নিশ্চিত ছিলেন যে, উপন্যাসের অসাধারণ এক কৃত্রিম শক্তি রয়েছে, যাতে কবিতা, কল্পনা, দর্শন, অশ্লীলতা এবং প্রবন্ধ সবই এক হয়ে যেতে পারে। ব্রোচ তাঁর চিঠিতে এ বিষয়ে কিছু গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন। যাহোক, তা আমার মনে হয় , ‘পলিহিস্টোরিক্যাল নভেল’ শব্দটি ব্যবহার করে তাঁর নিজের উদ্দেশ্যকে অস্পষ্ট করেছেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ব্রোচের স্বদেশী, অ্যাডালবার্ট স্টিফটারের (১৮০৫-১৮৬৮) একটি ক্লাসিক, যিনি ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ডার নাচসোমার’ [Indian Summer]-এ সত্যিই একটি বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক উপন্যাস সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও বর্তমান সময়ে এটি দুষ্পাঠ্য। কেননা, এটি ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, কারুশিল্প, চিত্রকলা এবং স্থাপত্য সম্পর্কে তথ্য দিয়ে পরিপূর্ণ ঠিক, কিন্তু এই বিশাল উন্নত বিশ্বকোষ কার্যত মানুষ এবং তার পরিস্থিতিকে ছেড়ে নিজেই চলে যায়। অবশ্য ব্রোচের ক্ষেত্রে কিন্তু আবার এমনটা নয়। পক্ষান্তরে! তিনি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন ‘যা উপন্যাস নিজেই আবিষ্কার করতে পারে।’ ফলে ব্রোচ যেটিকে ‘উপন্যাসিক জ্ঞান’ বলতে পছন্দ করেছেন তাঁর নির্দিষ্ট বস্তুটি হল অস্তিত্ব। আমার দৃষ্টিতে, ‘বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক’ শব্দটিকে অবশ্যই ‘অস্তিত্বের উপর আলোকপাত করার জন্য প্রতিটি উপায় এবং জ্ঞানের প্রতিটি রূপকে একত্রিত করে’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। তাই হ্যাঁ, আসলেই আমি এই ধরনের একটি পদ্ধতি এবং অভিগমনের কাছাকাছি অনুভব করি।
: Le Nouvel Observateur ম্যাগাজিনে আপনার লেখা একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশের কল্যাণে ফরাসিরা ব্রোচকে পুনরায় আবিষ্কার করতে বাধ্য হয়। তাঁর সম্পর্কে বেশ উচ্চ কথা বলেন আপনি এবং সমালোচনামূলকও। যেমন ঐ প্রবন্ধের শেষে আপনি লিখেছেন, ‘সমস্ত মহান কর্ম (কারণ, কেবল সেগুলো শ্রেষ্ঠ) আংশিকভাবে অসম্পূর্ণ।’
কুন্ডেরা: ব্রোচ আমাদের কাছে একটি অনুপ্রেরণা কেবলমাত্র তিনি যা অর্জন করেছিলেন তার জন্য নয়, বরং তিনি যা উদ্দেশ্য করেছিলেন ও চেয়েছিলেন কিন্তু অর্জন করতে পারেননি, তার জন্যও। ফলে তাঁর কাজের অসম্পূর্ণতাগুলোও আমাদের নতুন ‘আর্ট-ফর্মে’র প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। যেসবের মধ্যে রয়েছে : ১. মৌলিক অপ্রয়োজনীয়তাকে দূরে সরানো (অর্থাৎ, আমাদের অন্তর্গত গঠনাত্মক নির্মলতাকে ক্ষুণ্ন করা ছাড়াই আধুনিক বিশ্বে আমাদের অস্তিত্বের জটিলতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যেভাবে)। ২. উপন্যাসগত মেলবন্ধন ( অর্থাৎ, দর্শন, আখ্যান এবং স্বপ্নকে একক সঙ্গীতে একত্রিত করা)। ৩. বিশেষ উপন্যাসমূলক প্রবন্ধ (অন্য কথায়, পাঠকদের প্রতিষ্ঠিত কোনো বিতর্ক বা বার্তা প্রদানের পরিবর্তে, অনুমানমূলক, কৌতুকপূর্ণ, বা বিদ্রূপাত্মক বিষয়াদি উপন্যাসের প্রবন্ধের মধ্যে সংশ্লেষ বা সমন্বয় ঘটানো।)
: এই তিনটি পয়েন্ট আপনার সমগ্র শৈল্পিক কার্যক্রম ক্যাপচার করে বলে মনে হচ্ছে!
কুন্ডেরা: উপন্যাসকে অস্তিত্বের বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক আলোকসজ্জায় পরিণত করার জন্য আপনাকে উপবৃত্ত বা উহ্যবাক্য পূরণের কৌশল এবং সংক্ষেপনের শিল্প আয়ত্ত করতে হবে। অন্যথায়, আপনি অন্তহীন দৈর্ঘ্যের ফাঁদে পড়ে যাবেন। দেখুন, মুসিলের ‘দ্য ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিজ’ আমার সবচেয়ে প্রিয় দুটি বা তিনটি উপন্যাসের একটি। কিন্তু আমাকে এর বিশাল অসমাপ্ত বিস্তৃতির প্রশংসা করতে বলবেন না দয়া করে! ধরুন, আপনি এত বড় একটি দুর্গকে কল্পনা করছেন, চোখ এক দৃষ্টিপাতে যার সবটা দেখতে পারে না। সেখানে নৃতাত্ত্বিক সীমা আছে— যা লঙ্ঘন করা উচিত নয়, যেমন স্মৃতির সীমা। ফলে, যখন আপনি পড়া শেষ করবেন, তখনও আপনার শুরুটা মনে করতে পারায় সক্ষম হওয়া উচিত। তা না হলে, উপন্যাসটি তার আকৃতি হারায়, এর ‘গঠনাত্মক স্বচ্ছতা’ অস্পষ্ট হয়ে যায়।
: আচ্ছা! একজন ঔপন্যাসিক কেন উপন্যাসে তাঁর দর্শন প্রকাশের অধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইবেন?
কুন্ডেরা: কারণ তাঁর কেউ নেই! লোকেরা প্রায়শই চেখভের (রুশ সাহিত্যিক,১৮৬০-১৯০৪) দর্শন, কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) বা মুসিলের কথা বলে। কিন্তু তাদের লেখায় একটি সুসঙ্গত দর্শন খোঁজার চেষ্টা করুন তো! এমনকি যখন তাঁরা তাঁদের নোটবুকেও আইডিয়াগুলো টুকে রাখে, তখনও সে আইডিয়াগুলো দর্শনের দাবি-দাওয়ার পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন, প্যারাডক্সের সাথে খেলা, আশুরচনা কিংবা তাৎক্ষনিক উদ্ভাবনের সমান। এবং দার্শনিক যারা উপন্যাস লেখেন তাঁরা ছদ্ম ঔপন্যাসিক ছাড়া আর কিছুই নন। যারা তাদের আইডিয়াগুলো চিত্রিত করার জন্য উপন্যাসের রূপটি ব্যবহার করেন শুধু। অতএব, ‘উপন্যাস একা যা আবিস্কার করতে পারে, তা না ভলতেয়ার (ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক, ১৬৯৪-১৭৭৮) না কামু (লেখক, নাট্যকার ও দার্শনিক, ১৯১৩-১৯৬০) তাদের কেউই কখনও আবিষ্কার করতে পারেননি। তবে আমি শুধু একটি ব্যতিক্রমের কথা জানি, আর তা হল ডিডেরটের (ফরাসি দার্শনিক, ১৭১৩-১৭৮৪) ‘জ্যাক লে ফ্যাটালিস্ট।’ কী আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন! এতে উপন্যাসের সীমানা পেরিয়ে গুরুতর দার্শনিক হয়ে ওঠেন কৌতুকপূর্ণ চিন্তাবিদ। এমনকি এ উপন্যাসে একটি গুরুতর বাক্যও নেই, বরং এর সবকিছুই ক্রীড়া। আর এ কারণেই মূলত উপন্যাসটি ফ্রান্সে অত্যন্ত আন্ডাররেটেড। প্রকৃতপক্ষে, জ্যাক লে ফ্যাটালিস্টে ফ্রান্স যা হারিয়েছে এবং পুনরুদ্ধার করতে অস্বীকার করেছে তার সবকিছুই রয়েছে। ফ্রান্সে, চিন্তা বা ধারণাগুলো কাজে উপস্থাপন করা হয়। আর জ্যাক লে ফ্যাটালিস্টকে যেহেতু ধারণার ভাষায় অনুবাদ করা যায় না, তাই এটি ধারণার জন্মভূমিতে বোঝাও যায় না।
কয়েক দশক আগে জনজীবন থেকে আড়াল হওয়া এবং আর কখনও একটি সাক্ষাৎকার না দেয়ার শপথের পরও, তিনি ছিলেন বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরে সারা পৃথিবীর তুমুল জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একজন। তার উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটকের বইগুলো পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষার পাঠককূলের হৃদয় ও সেলফ— দুটোরই সৌন্দর্য বর্ধন করেছে
ফলে, উপরোক্ত এই প্রশ্ন তিনটি থেকে উপন্যাস তথা গদ্য সাহিত্য নিয়ে কুন্ডেরার যে ভাবনা, তার একটা ধারণা আমরা পাই। যেখানে শুরু থেকেই তিনি জনগণের ওপর স্বৈরশাসকদের নিপীড়ন ও অমানবিকতার কথা খুব ভালোভাবেই জেনেছিলেন এবং প্রবলভাবে উপলব্ধিও করেছিলেন। এমনকি তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ‘ম্যান, এ ওয়াইড গার্ডেন’ (১৯৫৩) যখন প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ। যে বইয়ের স্বরভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুতে স্পষ্টতই সোভিয়েত দখলদারিত্বের উল্লেখ। যে দখলদারিত্বের ধারাবাহিকতায় চেকোশ্লোভাকিয়ায়ও লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সকল সৃষ্টিশীল মতাদর্শ দমনের শুরু হয়েছিল। কিন্তু এরপর ১৯৬৭ সালে যখন তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ লেখেন, তারপর ১৯৬৯ সালে ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’ (যেটা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়)— এই দুটি উপন্যাসই তীব্রভাবে তৎকালীন রাজনৈতিক মতবাদকে ব্যঙ্গ করে। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে হন বহিষ্কৃত এবং চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ফ্রান্সে নির্বাসনে চলে যেতে হয়। তবে এরপর তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ (১৯৮৪)— এ-ও কিন্ত ঠিকই তিনি সর্বগ্রাসী রাজনীতি নিয়ে তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েই যাচ্ছিলেন, প্রাগ বসন্ত (প্রাগ বসন্ত ছিল চেকোস্লোভাক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক লিবারেলিজশন এবং গণবিক্ষোভের সময়। ১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল এটি এবং ২১ আগস্ট ১৯৬৮ পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত ছিল। যখন সংস্কারবাদী নেতা আলেকজান্ডার দুবচেক চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির (KSČ) প্রথম সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বেশিরভাগ ওয়ারশ চুক্তির সদস্যরা তাঁর এ সংস্কার দমন করার জন্য দেশটিতে আক্রমণ করেছিল) এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের বর্বরতা সম্বন্ধে নানা অন্বেষণ করেছিলেন। তাই, যদিও আপাতদৃষ্টিতে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তুটি গভীর আন্তরিক শোনাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি উপন্যাসেই কিন্তু কুন্ডেরা কিছুকিছু কৌতুকরসবোধ জাগিয়ে তোলেন। যেগুলো প্রায়শই অতীব তিক্ত ঠিক, তবে আড়ালে থাকা সত্যি এবং প্রলেপ আচ্ছাদিত বাস্তবতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জমাটবদ্ধ করতে সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেসে’ উপন্যাসের কথক নিৎসের (ফ্রেডরিক নিৎসে, জার্মান ভাববাদী দার্শনিক, ১৮৪৪-১৯০০) doctrine of eternal recurrence তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন যে, খুব সম্ভব আমরা বারবার একই জীবন যাপন করি। কিন্তু সেইসাথে তিনি আবার একটি কামোত্তেজক আখ্যানও গড়ে তোলেন, যাতে মনে হয় হালকা মনের যৌনতা আমাদের এই মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে বাঁচতে দেয়। যার ফলে আমরা এখানে এখন জীবিত থাকার লঘুতার জন্য চিরন্তন পুনরাবৃত্তির ওজন বিনিময় করতে পারি। মোটকথা, একদিকে ভালোবাসা, মৃত্যু ও দুঃসহ স্মৃতিকে বয়ে চলার উপলব্ধি এবং অন্যদিকে ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ভারমুক্তির অনুষঙ্গ নিয়ে লেখা এ উপন্যাসটি— নানা দার্শনিক প্রসঙ্গ টেনে এনে পাঠককে এক অভাবনীয় ঘোরের ভেতর আবদ্ধ করে ফেলে। তাই একটু ঘাঁটলেই দেখা যায়, কুন্ডেরার সফল উপন্যাসগুলো রচিত হয়েছে ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে। সেই সব উপন্যাসের বিষয়বস্তু একাধারে যেমন প্রাহাকেন্দ্রিক গৃহকাতরতা, তেমনি তাতে আছে নির্বাসন ও নির্বাসিত জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ। তাই খুব সংক্ষেপে আমরা কথাসাহিত্যের এই মহানায়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান পাঁচটি উপন্যাসের কথা আলোচনা করে এ বিষয়গুলোই জানতে পারি যেমন:
১. The Unbearable Lightness of Being
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, কোনপ্রকার তর্ক ছাড়াই এ মাস্টারপিস উপন্যাসটি কুন্ডেরার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টির একটি। ১৯৬৮ সালে প্রাগের তুমুল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের পটমভূমিতে লেখা এ উপন্যাসটি জীবন সম্বন্ধে টমাস, তেরেজা, সাবিনা এবং ফ্রাঞ্জের যাপনের নানা দিক ও দর্শনের বয়ানের সাথে তাদের সম্পর্ক, আকাক্সক্ষা এবং অস্তিত্বের গুরুত্ব ও প্রভাবহীনতার ধারণাটি অন্বেষণ ও বিশ্লেষণ করে। সেইসাথে এসব চরিত্রের দ্বারা আমাদের পছন্দ এবং আমাদের জীবনে সেসব পছন্দগুলোর কী পরিণতি?— কুন্ডেরা তাঁর দার্শনিক গানের অনুধ্যানের মাধ্যমে নিরন্তর সেগুলোরই পরীক্ষা করেন।
২. The Book of Laughter and Forgetting
কথাসাহিত্য ও ইতিহাসের অপূর্ব সংমিশ্রণ এবং অভূতপূর্ব নির্মাণকুশলে সৃষ্ট এ উপন্যাসে কুন্ডেরা স্মৃতির আখ্যান এবং ব্যক্তি ও সমষ্টিগত পরিচয় গঠনে এর তাৎপর্য অন্বেষণ করেছেন। ফলে দেখা যায়, পরস্পরসংযুক্ত গল্পের বিবিধ চরিত্রের মাধ্যমে পাঠককে তিনি একটি ভ্রমণে নিয়ে যান। যেখানে সেসব চরিত্রের মাঝে একজন নিন্দিত রাজনীতিবিদ ও একজন নির্বাসিত কবিও রয়েছেন। চেকোস্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাথে রয়েছে যাদের বিজড়িত অভিজ্ঞতা।
৩. Immortality
ধ্যানের মত স্নিগ্ধ এ উপন্যাসটি শিল্প, প্রেম ও নশ্বরতা নিয়ে কথোপকথন করে। যেখানে অ্যাগনেস নাম্নী একজন সফল লেখক এবং তার সৌন্দর্য ও প্রতিভা দ্বারা বিমুগ্ধ হওয়া বিভিন্ন পুরুষের সাথে তার মুখোমুখি হওয়ার গল্প বলেন কুন্ডেরা। জীবন ও শিল্পের মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্কটির অন্বেষণ করেন এবং অমরত্বের সন্ধান এবং মানব সম্পর্কের উপর এর প্রভাব সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলেন।
৪. The Joke
যদিও এটি কুন্ডেরার প্রথম উপন্যাস, কিন্তু কী অমিত শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে যে তাঁর আগমন— পুরো পৃথিবী ও বিশ্বসাহিত্য ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশের সাথেসাথেই তা আঁচ করে ফেলেছিল। যেখানে তিনি লুডভিক নামক এমন এক তরুণ শিক্ষার্থীর গল্প বলেন, যার জীবন নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, যখন সে কমিউনিস্ট শাসনকে উপহাস করে একটি পোস্টকার্ড পাঠায়। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে ঠাট্টার ছলে নিরিহ এই কাণ্ডটি কী করে যে তার সমস্ত জীবনই দুর্বিষহ করে তোলে— সে গল্পই আছে এই বইয়ে।
৫. Farewell Waltz
প্রবল এ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসে, কোনো একটি স্পা-তে মিলিত হওয়া চারটি চরিত্রের জীবনের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের অযৌক্তিকতাগুলোকে ভীষণভাবে তিরস্কার করেন কুন্ডেরা। যাতে বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝের সীমানাগুলোকে ঝাপসা করে এমন এক মজাদার আখ্যান তৈরি করেন তিনি, যা ক্রমবর্ধমান যান্ত্রিক সমাজে প্রেম, পরিচয় এবং মানুষের অবস্থার মতো বিষয়গুলোকে স্পর্শ করে।