
চার পঙক্তির ছড়াটি সেকালের তো বটেই, এবং একালের শিশুদেরও মুখস্তই বলা যায় :
ইনি মিনি মাইনি মো
ক্যাচ অ্য টাইগার বাই দ্য টো
ইফ হি হোলার্স লেট হিম গো
ইনি মিনি মাইনি মো
হোলার মানে চিৎকার চেঁচামেচি করা, কিন্তু ইনি মিনি মাইনি মো-ও মানে কি?
হাট্টিমাটিম টিম কিংবা এলাটিং বেলাটিং এর যা মানে ইনি মিনি মাই মো-ও অনেকটা সেরকমই; এর কোনো মানে নেই, কিংবা এর অনেক মানে। পায়ের আঙ্গুল ধরে এক হেঁচকা টান মারলে জাগুয়ারই হোক কি রয়েল বেঙ্গল টাইগার -শিশুটির পায়ের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বেয়ারা বাঘও তো আছে। এসে যদি চেঁচামেচি চিৎকার শুরু করে? হোলার মানেটা তাই। তাহলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে, বাঘ চলে যাক।
ছড়া চর্চা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এ জন্য আমার এই নিবন্ধটি নয়। আমি অন্য কথা বলব। এই ছড়াটির ভিন্ন একটি আমেরিকান ভার্সন আছে, এটিই ছিল বহুল পরিচিত, বহুল পঠিত বহুল শ্রুত বহুল উদ্বৃত। উনবিংশ শতকের পুরোটাতেই ছিল বিংশ শতকেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। একবিংশ শতকে- কিংবা নতুন সহস্রাব্দে এসে সহিংস-স্বরে আবৃত্তি শুরু হয়েছে। হেনরি ক্যারিংটন বোল্টনসহ আরো কেউ কেউ উনবিংশ শতকেই ছড়াটি লিপিবদ্ধ করেছেন :
ইনি মিনি মাইনি মো
ক্যাচ অ্য নিগার বাই দ্য টো
ডেরেক বিকারটোন দেখিয়েছেন ইনি মিনি মাইনি মো শব্দগুলো এসেছে আফ্রিকান দাসদের ব্যবহৃত সাও টোমানিজ উপভাষা থেকে, সেখানে বলা হয় ইনি মিনা মানা মো- তার মানে আমার বোনের বাচ্চারা।
নিগ্রো ধরার মন্ত্রণা ছড়ায় আসার আগেও একই ছন্দে প্রচলিত কিছু ছড়া ছিল, গবেষকরা উদাহরণ দিয়েছেন কিন্তু শুরুটা কোথায় সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি। তবে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস ধরতে হলে কী করতে হবে তারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ছড়ায়- এটা দাসমালিক ও তাদের সন্তানদের ছড়া। দাসরা সব কালো, নিগ্রো, নিগার।
আরো সমকালীন ভাষায় এটাকে বলা যায় এটা বর্ণবাদী ছড়া।
বর্ণবাদ RACISM এর বাংলা অনুবাদ। বর্ণবাদ শব্দটি RACISM এর যত মানে সব ধারণ করে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই লেখাটি বর্ণবাদ কিংবা RACISM এর কোনো তাত্ত্বিক কিংবা লোকপ্রিয় কোন আলোচনা নয়। অভিধান শব্দটিকে কিভাবে ব্যবহার করেছে তা-ই তুলে ধরা হচ্ছে।
র্যাসিজম (রেইসিজম) বলতে যা বোঝায় তা শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হবার হাজার বছর আগেও ছিল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিচার্ড হেনরি প্র্যাট (১৮৪০-১৯২৪)-এর বক্তৃতায় প্রথম র্যাসিজম শব্দটি উচ্চারিত হয় ১৯০২ সালে। তিনি বলেন Association of races and classes is necessary to destroy racism and classism – জাতিবাদ ও শ্রেণীবাদ ধ্বংস করতে দূর করতে চেয়েছেন, আবার বহুল তর্কিত একটি বক্তব্যও মানুষের মুখে মুখে ঘুরেছে- এ কালের ভাষায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল কিল দ্য ইন্ডিয়ান… সেইভ দ্য ম্যান। সম্ভবত এটাই বলতে চেয়েছেন তার ভেতরের আদিবাসী ইন্ডিয়ান সত্ত্বাকে হরণ করে তাকে ভিন্নভাবে আমেরিকান হিসাবে বাঁচিয়ে রাখুন। তিনি আদিবাসীদের জন্য স্কুল ও আবাসিক হোস্টেল স্থাপন করেছেন- লক্ষ্য ইন্ডিয়ান ভাষা ও স্ংস্কৃতি বর্জিত সম্পূর্ণ ভিন্নমানুষ তৈরি করা। তিনি ইন্ডিয়ানদের মূলধারায় সংযুক্ত করতে চেয়েছেন, সফলও হয়েছেন। যারা তাকে মেনে নিয়েছে দারিদ্রমুক্ত হতে তাদের সময় লাগেনি। ইন্ডিয়ানদের প্রকৃত সত্ত্বা বিলোপের অনেকটা দায়ই তাকে বহন করতে হচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে : র্যাসিস্ট।
নিগ্রো ধরার মন্ত্রণা ছড়ায় আসার আগেও একই ছন্দে প্রচলিত কিছু ছড়া ছিল, গবেষকরা উদাহরণ দিয়েছেন কিন্তু শুরুটা কোথায় সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি। তবে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস ধরতে হলে কী করতে হবে তারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ছড়ায়- এটা দাসমালিক ও তাদের সন্তানদের ছড়া। দাসরা সব কালো, নিগ্রো, নিগার
র্যাসিজম শব্দটির সাথে পৃথিবীতে ব্যাপক পরিচিত হয় জার্মানির নাৎসি আমলে। ১৯২০ সমাজ বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক হার্টস একে বলেছেন রেইস হ্যাট্রেড।
২৫ মে ২০২০ আমেরিকার সাদা পুলিশের পায়ের চাপে কালো মানুষের নির্মম মৃত্যুর পর পৃথিবী বর্ণবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। বর্ণবাদকে অভিধানসমূহ সঠিকভাবে উপস্থাপন করছে না এমন একটি অভিযোগ এনে আমেরিকান আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ড্রেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক হওয়া তরুণী কেনেডি মিচাম অভিধান প্রকাশক মেরিয়াম ওয়েরস্টারকে লিখলেন: তাদের অভিধানে র্যাসিজম শব্দের যে সব অর্থ বলা হয়েছে তা অসম্পূর্ণ; ‘পদ্ধতিগত অত্যাচার’-কে এর অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ১০ জুন ২০২০ কেনেডি মিচামের ইমেইল পাবার পর প্রকাশকের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে তার প্রস্তাব অনুযায়ী এটিও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তরুণী বিবিসিকে বলেছেন তার স্কুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে এমন সব বিষয়ে হেনস্তা হতে হয় আপাতদৃষ্টিতে যাকে স্থূলভাবে র্যাসিস্ট বলা যায় না। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তা রয়েছে। পদ্ধতিগতভাবে এই অনাচারটি করা হয়ে থাকে।
একই অপরাধে সাদা মানুষের চেয়ে আড়াইগুণ বেশি সাজা হয় কালো মানুষের। সাদা ও কালোর চাকরির আবেদন করার সমান অধিকার থাকলেও ইন্টারভিউয়ের সময় আফ্রিকান- আমেরিকান নামের অধিকাংশকেই বাদ দেওয়া হয়। গায়ের রঙ সাদা হবার কারণে এমনিতে সাদারা বাড়তি সুবিধে পেয়ে যায়। এই সুবিধাটি প্রতিটি স্তরে স্তরে।
কয়েকটি অভিধান র্যাসিজমের কি উদাহরণ দিচ্ছে দেখা যাক। তার আগে আমরা ধরে নিই অর্থগত দিক দিয়ে বর্ণবাদ যদিও রঙ-এর প্রাধিকারের কথা বলে আমরা ধরে নিচ্ছি র্যাসিজমের অর্থ বর্ণবাদই।
ক্যামব্রিজ অভিধান
১. স্কুলে বর্ণবাদ মোকাবেলার পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষ নিতে যাচ্ছে।
২. প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ এদেশের গভীরে প্রেথিত।
৩. আমি সব ধরণের বর্ণবাদ ঘৃণা করি।
৪. এই আইন কেবল বর্ণবাদ লালন করে।
৫. ইউরোপ ১৯৪০ দশকের পর আর দেখেনি এমন বর্ণবাদের আমরা সাক্ষী হতে যাচ্ছি।
লঙ্গম্যান অভিধান
১. সরকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
২. তিন জন আলজেরিয় কর্মচারিকে চাকুরিচ্যুত করায় কোম্পানির বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ আনা হয়েছে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ ব্রিটিশ সমাজের ভেতরে এতোটাই প্রবেশ করেছে অভিবাসী শ্রমিকদের ঠাঁই হচ্ছে কেবল নিচু সামাজিক মর্যাদার অদক্ষ কাজে।
অক্সেফোর্ড অভিধান
১. গত রাতে বর্ণবাদ বিরোধী গণ প্রতিবাদে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ যোগ দিয়েছে।
২. বর্ণবাদীরা একটি পরিবারকে হেনস্তা করে চলেছে।
সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজকে বিভক্ত (apartheid) করাতে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকায় যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ দশক পর্যন্ত বিরাজমান ছিল তার নাম অ্যাপ্যারথিড। এর মানে বাংলা অভিধানে জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ, পৃথকীকরণ লেখা হয়েছে। সাধারণভাবে একেও বর্ণবাদই বলা হয়েছে। অ্যাপারথিড শব্দটি প্রথম ব্যবহ্নত হয় ১৯৪৭ সালে। ভাষা ও সাহিত্যে দৈনন্দিন ব্যবহারের শব্দগুলোই স্থান পায়। আমাদের শৈশব থেকে শুনে আসা হিপ হিপ হুররে’ যে একটি বর্ণবাদী বিষয় তা কখনো ভেবে দেখেনি। বিজয়ও আনন্দের প্রকাশ ঘটে ‘হিপ হিপ হুররে’-তে। এটি অ্যন্টি-সেমেটিক স্লোগানের মতো। ১৮১৯ সালে জার্মান কনফেডারেশনে ইহুদিদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করার সময় জার্মানরা হিপ হিপ ধ্বনি দিত। পরে তার সাথে যোগ হয় হুররে।
শুধু কালোরাই বর্ণবাদের শিকার হয় এমন নয়, কালো অধ্যুষিত অঞ্চলে সাদারা শিকার হতে পারে। আবার সাদার রাজ্যে সাদাকেও বর্ণবাদী অবিচার সইতে হতে পারে।
আমার বিলেত বাসকালে আমার শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক রিচার্ড কেডিন বুলার্ড একাধিকবার বলেছেন তিনি বর্ণবাদের শিকার।
আমি জিজ্ঞেস করি, আপনার রঙে সাদার কি ঘাটতি আছে?
তিনি বললেন না, আমার বাবার জন্ম ইংল্যান্ডের এসেক্সে হলেও আমার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। বিলেতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ সাদারা দক্ষিণ আফ্রিকার সাদাকে প্রায় কালোই বিবেচনা করে। মুখে বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুন, অন্তরে তারা বর্ণবাদ লালন করেন, নিজের ও সন্তানদের বিয়ের সময় পাত্রপাত্রী নির্বাচনের প্রশ্নে ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা বর্ণবাদী সত্তাটি বেরিয়ে আসে।