
২০২২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন ফরাসি নারীবাদী সাহিত্যিক অ্যানি এঘ্নো (তাঁর বংশনামের মূল ফরাসি উচ্চারণটা এর কাছাকাছি, Courtesy: Quader Chowdhury )। অ্যানি ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। মুদি দোকানদার পিতা আর মাতার ঘরে। বিশ বছর বয়সে লন্ডনে গিয়ে শিশু পালনের কাজ নেন। ফ্রান্সে ফিরে এসে বিয়ে করেন আর দুই সন্তানের মা হন। এরপর বিয়ে বিচ্ছেদ। তারপর থেকে স্বামীহীন মা হিসাবে সন্তানের লালনপালন, স্কুলের শিক্ষকতা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রিলাভ। আটচল্লিশ বছর বয়সে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এক রুশ কূটনীতিকের সাথে বছর দেড়েকের সম্পর্ক। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে তিনি প্যারিস এ বসবাস করছেন। এ হল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর বিশিষ্ট বইয়ের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস Cleaned Out, A Frozen Woman, A Man’s Place, A Girl’s Story এবং আত্মজীবনীমূলক গদ্য সাহিত্য The Years।
The Years অ্যানির সবচেয়ে নামকরা এবং বেশি বিক্রিত বই যা ২০১৯ সালে ম্যান বুকার প্রাইজ এর জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল। এই বইয়ে ১৯৪০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ হলেও এটা নাম পুরুষে লেখা। অনেকে বলেছেন এটা অনেকের আত্মজীবনী। আবার এটা দীর্ঘ ৬৬ বছরের ফ্রান্সের গল্প। অনেকটা প্রুস্ত এর বিখ্যাত উপন্যাস ইন সার্চ অব লস্ট টাইমস এর প্রতিমূর্তি। যেমন জয়েচ এর ইউলিসিস হল হোমার এর অডিসিয়াস এর প্রতিমূর্তি। প্রুস্ত এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের শব্দ সংখ্যা সাড়ে বারো লাখের বেশি। অ্যানির The Years এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৬। আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাসমূহ নতুন বইতে মোটামুটি এক পৃষ্ঠায় ২৫০ শব্দ স্থাপন করে। তবে পরিধি কোনও বড় বিষয় নয়। The Years এর লেখাগুলি গভীর। বইটি থেকে একটু নমুনা দেখা যাক:
‘১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকাল জুড়ে, ওই নারীর কাছে তাঁর নিজের যৌবনকে মনে হয় এক আলোক-পূর্ণ অসীম মহাজগৎ যার প্রতি কোনা তিনি দখল করে আছেন। তিনি ওই জগতের পুরোটা তাঁর বর্তমানের চোখ দিয়ে আলিঙ্গন করেন অথচ কিছুই তিনি সুনির্দিষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন না। যৌবন তাঁর কাছে অতীত, ব্যাপারটা তাঁকে আঘাত করে। ওই বছর, প্রথম বারের মতো, ‘আমার যাপন করার একটাই জীবন আছে,’ এই কথাটার শোচনীয় অর্থ তিনি আঁকড়ে ধরেন। সম্ভবত ইতিমধ্যে তিনি নিজেকে ‘ঠেলে ধরা দাড়কাক’ সিনেমার বয়স্কা মহিলাটার মতো দেখেন। যে সিনেমা আগের বছর গরমকালে তাঁকে ভেঙ্গে চুরমার করেছে, যে সময় এখন অনেক দূরে, যা এক তাপযুক্ত পরাবাস্তব, যা খরার এক মৌসুম। অসাড় আর বাকরুদ্ধ, গাল অশ্রুতে ডুবানো, তিনি দেয়ালে লাগানো ছবিগুলির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, আর পেছনে সেই গানগুলি বেজে চলে। যে সিনেমাগুলি তিনি দেখতে চান, আর যেগুলি তিনি ইদানিং দেখেছেন, তার সবগুলি তাঁর দেহে একটা উপন্যাসের স্রোত তৈরি করে, যেখানে তিনি নিজের জীবন খোঁজেন- ওয়ান্ডা, একটা সাদামাটা কাহিনী। ওই সিনেমাগুলিকে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ অঙ্কনের আহ্বান জানান।’
অনেক বংলাভাষী ক্ষোভের সাথে কিছু বাংলা সাহিত্যিক এর নাম বলেন আর তাঁদের নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার জন্য আক্ষেপ করেন। বিতর্কের গভীরে গেলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হবে। তবে এ কথাতো বলা যায় যে ওরহান পামুক সাহিত্যে নোবেল পেলে হুমায়ুন আহমেদও তার যোগ্য ছিলেন
১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করা অ্যানি এই প্যারাতে তাঁর চল্লিশ বছর বয়সের কথা বলেন। এই বইতে এর চেয়েও অনেক সুন্দর অসংখ্য প্যারা রয়েছে। সোভিয়েত আমলের শেষ দিকে, ১৯৮৮ সালে, প্যারিসে কর্মরত নিম্ন-পদস্থ এক রাশিয়ান কূটনীতিকের সাথে অ্যানির প্রেম হয়। এই ঘটনা নিয়ে তিনি ১৯৯২ সালে Simple Passion নামে একটা উপন্যাস প্রকাশ করেন। প্রেম চলাকালীন সময় অ্যানি প্রতি বার অভিসারের পর বা অভিসার না হওয়ার পর ডাইরির এন্ট্রির মতো করে তাঁর অনুভূতি লিখে রাখতেন। আর এই ডাইরিটা ২০০০ সালে Getting Lost নামে তিনি প্রকাশ করেন। ডাইরির একটা এন্ট্রি এরূপ:
‘শনিবারটা, প্যারিসে, আমার পেটের মধ্যে টনটন ব্যথা করে। আর মনে হয় আমি নিশ্চিতভাবে ধরা পড়ে গেছি। তারপর, মানবিকভাবে, আমি নিজেকে বলি, অসচেতন মন সে প্রকৃতির গতিপথ প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট নয় যা চল্লিশ পেরোনো এক নারীর মধ্যে থেমে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। আপাতভাবে, এ বয়সে, গর্ভধারণ করার সম্ভাবনা পঁয়তাল্লিশ জনের মধ্যে একটা। তারপরও, আমি এস. এর সম্পর্কে বেশ কমই ভাবি। আর বিস্মিত হই, অস্পষ্টভাবেও, আমি একটা পুরুষের মধ্যে যা চাই তার মূলকথা কি এই যে আমি তার দ্বারা একটা কুকুরীর মতো পরাগায়িত হই আর তারপর তাকে আমার ধারালো দাঁত দেখাই।’
অ্যানি এঘ্নোর বইগুলির ইংরেজি অনুবাদকের নাম অ্যালিসন স্ট্রেয়ার। অ্যালিসন বইগুলির খাঁটি অনুবাদ করেছেন বলে বলা হয়। অ্যালিসনের ইংরেজি থেকে উপরের দুটি প্যারার বাংলা তর্জমাও তা প্রমাণ করে। অ্যানির বাক্য গঠনের মধ্যে ভার্জিনিয়া উলফ এর সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে, কিংবা হেনরি জেমসের। তদূপরি অ্যানির বাক্যগুলিকে বোমার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানে প্রতিটা বাক্যের শব্দসমূহের চেয়ে বাক্যের মানে অনেক বড়। এটা এক জন ভাল সাহিত্যিকের, কিংবা যে কোনও ভাল লেখকের, একটা অপরিহার্য গুণ। অ্যানির সম্পর্কে যে সব কথা লেখা হয়েছে, তার সোজাসাপটা মানে হল তিনি তাঁর লজ্জা বিক্রি করে খাচ্ছেন। তিনি নারী না হলে এ কথা জোর পেত না। কারণ সব বড় লেখকই তাঁর লজ্জা বিক্রি করে খান। এর ব্যতিক্রম হলে বড় লেখক হওয়া কষ্টসাধ্য। যদিও পরিবেশনার ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে কে কী রকম জীবন যাপন করলেন তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কে কেমন লিখলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেলে তা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত হয় বলে আমরা সাধারণভাবে ধারণা করি, অ্যানির লেখা প্রমাণ করে তিনি সেই উৎকর্ষ লাভ করেছেন। অ্যানি দেহ, যৌনতা, গর্ভপাত, তালাক, রোগ-শোক, পরিবারের গোপন কথা ইত্যাদির উপর শিল্প সৃষ্টি করেছেন। তবে জীবনের বিশ্লেষণে তিনি নির্মোহ।
যে বছর বব ডিল্যান সাহিত্যে নোবেল পেলেন সেই বছর American Pastoral উপন্যাস এর লেখক ফিলিপ রথ নাকি জামা কাপড় পরে তাঁর প্রকাশকের অফিসে যাচ্ছিলেন সুইডিশ একাডেমির ফোনের আশায়। সে কল গিয়েছে ডিল্যানের কাছে। ফিলিপ রথও আর বেশি দিন বেঁচে থাকেননি
সুইডিশ একাডেমি বলেছে, ‘সাহস আর বস্তুনিষ্ঠ তীক্ষ্ণতার জন্য যা দিয়ে তিনি ঘটনার মূল উন্মোচন করেন, আর স্মৃতিকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দূরত্ব রক্ষা করা আর সামষ্টিক সংযম বজায় রাখার জন্য’ তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। অ্যানি অনেক জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন বটে তবে কয়েকটা বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েও তা পাননি। যেমন তিনি ম্যান বুকার প্রাইজ এর জন্য মনোনীত হয়েও তা পাননি। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড়টা পেয়ে ইতিহাস হয়েছেন। না পাওয়ার হতাশা যেন কোনও শিল্পীকে কাবু না করে, আমরা তা-ই আশা করব। আমরা আরও চাইব সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের জন্য সাহিত্যিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচকরা বস্তুনিষ্ঠ থাকবেন। তবে পৃথিবীর সব প্রান্তের সাহিত্যিকদের বিবেচনা করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মানের ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দেয়া যেতে পারে। এতে আমরা পৃথিবীর নানান ভাষার ভাল সাহিত্যিকদের চিনতে পারব। তাঁদের বই পড়তে উৎসাহিত হব।
যে বছর বব ডিল্যান সাহিত্যে নোবেল পেলেন সেই বছর American Pastoral উপন্যাস এর লেখক ফিলিপ রথ নাকি জামা কাপড় পরে তাঁর প্রকাশকের অফিসে যাচ্ছিলেন সুইডিশ একাডেমির ফোনের আশায়। সে কল গিয়েছে ডিল্যানের কাছে। ফিলিপ রথও আর বেশি দিন বেঁচে থাকেননি। এটা বলা যাবে না যে গায়ক বব ডিল্যানের লেখা শ’পাঁচেক গানের মধ্যে পঞ্চাশটা ভাল গান নাই। কথা হল সাহিত্য সৃষ্টিতে বৃহত্তর ভূমিকা রেখেছেন এমন কাউকে বাদ দিয়ে যদি অপেক্ষাকৃত কম ভূমিকা রেখেছেন এমন কাউকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, তবে আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিকে অসম্মান করা হয়। সুইডিশ একাডেমি কাজটা বেশ কয়েকবার করেছে বলে অনেক আলোচনায় দেখা যায়।
অনেক বংলাভাষী ক্ষোভের সাথে কিছু বাংলা সাহিত্যিক এর নাম বলেন আর তাঁদের নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার জন্য আক্ষেপ করেন। বিতর্কের গভীরে গেলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হবে। তবে এ কথাতো বলা যায় যে ওরহান পামুক সাহিত্যে নোবেল পেলে হুমায়ুন আহমেদও তার যোগ্য ছিলেন। হুমায়ুন আহমেদতো স্টিফেন কিং কিংবা জে. কে. রওলিং এর চেয়ে বড় লেখক ছিলেন। তবে আমরা বাঙ্গালিরা যেমন করে ক্ষোভ জানাই তেমন করে কি আমাদের নিজেদের দোষটা দেখি? তেত্রিশ কোটি মানুষের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে স্টিফেন কিং এর একটা উপন্যাস বের হওয়ার সাথে সাথে সেটার পাঁচ লাখ কপি বিক্রি হয়। বাংলা ভাষায় নতুন কোনও ভাল উপন্যাস বা কাব্য বা গল্পসঙ্কলন যদি বের হত তবে তার কত কপি বিক্রি হত? এই প্রশ্নের মীমাংসা না করে কোনও বাঙ্গালি নোবেল পুরস্কার পেল না, তা নিয়ে হা-হুতাশ করা মানে সমস্যার মূলে চোখ না দেয়া।
সাধারণভাবে ফরাসি সাহিত্য অনেক উঁচু মানের। অনেক গুরুর জন্ম এ ভাষায়। গি দা মোপাসা, স্তাঁদল, মলিয়েঘ, অনঘে দি বালজাক, ভিক্টঘ উগো, গুস্তাভ ফ্লবেঘ, ইমিল জোলা, বদুলেঘ, আলবেঘ কামু। অ্যানির আগে আরও ১৫ জন ফরাসি ভাষার সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
সময়ের সাথে লেখার ধরন বদলেছে। গুন্টার গ্রাসের পর পৃথিবীব্যাপী সেই মাপের সাহিত্যিক আমার চোখে এখনও পড়েনি। অ্যানি এঘ্নো তাঁর সময়ের ভাল লেখকদের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন লেখনি শক্তি দিয়ে, যার দু’টি নমুনা আমি উপরে দেখালাম। ২০২২ সালের সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হবে না। হলেও তা হালে পানি পাবে না।