
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে ইস্যুটি নিয়ে এখন শীতল, এর ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে । তা হলো স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান। ভারত ও বাংলাদেশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রে একে অপরের অকৃত্রিম বন্ধু, সেই সাথে আরো এক বন্ধু ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে এগিয়ে আসা সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা আজকের রাশিয়া। যে কোনো দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নির্বাচন একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাসের সাথে, একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই নির্বাচনী কার্যক্রম ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই নিবন্ধটির লক্ষ্য নির্বাচনের সময় একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলি এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা।
সম্প্রতি ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খবরাখবর আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ ভিসা নীতিকে ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী শিবিরে। কতিপয় নেতা-নেত্রীর এ বিষয়ে অতিশয় উচ্ছ্বাস খুবই দুর্ভাগ্যজনক, কারণ ১৯৭১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের জন্য কখনোই পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে পাওয়ার উল্লেখযোগ্য কোনো নজির নেই। কাম্বোডিয়ায় গণহত্যা, চিলিতে নির্বাচিত সরকার উৎখাত, ভিয়েতনাম, ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কী করেছে তা কারো অজানা নয় ।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের নেতাকর্মীদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বহুমুখী ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জ হবে। তিনি ৫ জুন গণভবনে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকমীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জ, কারণ বিভিন্ন মহলের ষড়যন্ত্র রয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, যখনই দেশের মানুষের জীবনযাত্রার কিছুটা উন্নতি হয়, তখনই বাংলাদেশে কিছু কুলাঙ্গার আছে, যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং সর্বত্র মিথ্যাচার করে। তিনি বলেন, কিছু মানুষ আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার জন্য বিদেশিদের সামনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে। তিনি আরো বলেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, মুক্তিযুদ্ধের সময় লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও দমন-পীড়নসহ গণহত্যা ও অন্যান্য অপরাধ করেছে এবং এখন তাদের প্রজন্ম নিরলসভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপগ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। (সূত্র: বাসস,৫ জুন, ২০২৩)
বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশের চ্যালেঞ্জ রয়েছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর ওপর আলোকপাত করতে আমাদের নিন্মোক্ত বিষয়গুলো দেখা প্রয়োজন-
রাজনৈতিক মেরুকরণ: বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ জর্জরিত। এই মেরুকরণ প্রায়শই উত্তেজনা, রাস্তায় সহিংসতা এবং গঠনমূলক রাজনৈতিক আলোচনার অভাবের দিকে পরিচালিত করে। এ ধরনের পরিবেশ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুন্ন করে।
একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য, একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা এবং সমর্থন করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অপরিহার্য
নির্বাচনী সহিংসতা: বাংলাদেশে নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতা একটি পুনরাবৃত্তিমূলক চ্যালেঞ্জ। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকদের মধ্যে ভয় ভীতি, হয়রানি ও সংঘর্ষের ঘটনা আগের নির্বাচনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই সহিংসতা শুধু ভোটদান প্রক্রিয়া ব্যাহত করে না বরং ভোটারদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করে, তাদের রাজনৈতিক পছন্দ প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করে। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য জবরদস্তি ও সহিংসতামুক্ত একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা: সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে কমিশনের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাধীনতার অনুভূত অভাব নির্বাচন পরিচালনা সংস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে ক্ষুন্ন করতে পারে এবং প্রক্রিয়াটির ন্যায্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা: বাংলাদেশের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি বিশ্বব্যাপী অঙ্গীকারের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃপক্ষের উপর গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলা, মানবাধিকারকে সম্মান জানাতে এবং সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান খেলার ক্ষেত্র নিশ্চিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের সময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের উপস্থিতি নির্বাচনী জালিয়াতি এবং অনিয়ম রোধ করতে সাহায্য করে, নিশ্চিত করে যে জনগণের ইচ্ছা চূড়ান্ত ফলাফলে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়। অধিকন্তু, তাদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশ ভবিষ্যতে নির্বাচনী সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার জন্য মূল্যবান দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে।
রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করা: আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং শান্তিপূর্ণ আচরণের প্রচারের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে সাহায্য করতে পারে। তাদের নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা একটি মধ্যপন্থী শক্তি হিসাবে কাজ করে, যা রাজনৈতিক অভিনেতাদের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়। এটি, পরিবর্তে, একটি আরও স্থিতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবদান রাখে।
বাংলাদেশে নির্বাচন একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা ও প্রতিপালনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক মেরুকরণ, নির্বাচনী সহিংসতা এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগগুলি হলো মূল বাধা গুলোর মধ্যে একটি যা সমাধান করা দরকার। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালীন রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য, একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা এবং সমর্থন করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অপরিহার্য।