
উপন্যাসের সূচনায় ‘আমি সুখী হতে পারতাম।’ এক চমক দিয়ে লেখক বইয়ের বিশেষত্ব ঘোষণা করেছেন। নায়কের দুঃখী জীবনের ইঙ্গিত দিয়ে, নামকরণের মতো ব্যতিক্রমী প্রকাশের ইঙ্গিত। উপন্যাসটি আসলে এক মৃত মানুষের বিবৃতি, লেখক দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই তা স্পষ্ট জানিয়েছেন। রুদেবিশ নামক এক স্বপ্নে বাস করা ব্যক্তির কথা বলেছেন, যিনি সবসময় কল্পনায় ঘুরে বেড়াতেন। মাত্র তেত্রিশ বছর জীবনটি তিনি ব্যতিক্রমীভাবেই কাটিয়ে দিলেন। উপন্যাসের নায়কই যে শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন তা কিন্তু নয়, নায়কের বাবা দিওনিশ শেকাব এবং তাদের পরিচালক নাজিফও ছিল অদ্ভুত। শৈশবে মাতৃহারা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রুদেবিশ ছিলেন অনেকটাই অকালপক্ব। পাঁচ বছর বয়সেই ১৫ বছরের বালকের মতো পরিপক্ব হয়ে ওঠেন। নারীবিহীন তাদের ঘরের পরিবেশই তাকে নারীর প্রতি তীব্রভাবে আগ্রহী করে তোলে। বড় হয়ে যদিও সে পিতার মতো হতে চায়, তবুও রুদেবিশ নারীবিহীন জীবনযাপন না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু প্রেম নিয়ে বাবার প্রতারণা রুদেবিশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এ নিয়ে পিতার লুকোচুরি, নাটক তৈরি তাকে চরমভাবে আহত করে। প্রেমের ত্যাগের কারণে বিস্মিত রুদেবিশ বাবার প্রেমিকার রূঢ় আচরণও ক্ষমা করে দিয়েছিল। যেখানে বাবার প্রেমিকা হিসাবে এক রহস্যময় চরিত্র খ্যাপাবুড়ির আর্বিভাব। কৌঁসুলি লেখক শেকাবের শৈশবের নারী লোটাসকে তুলে এনেছেন একেবারে ছাঁকুনির নির্যাস দিয়ে। লোটাসের ভন্ড প্রেমিকের প্রতারণা আর প্রেমিক বন্ধুদের নিয়ে লোটাসকে ভোগ করে ফেলে রেখে যাওয়ার চিত্র এঁকেছেন দারুণ মুনশিয়ানায়। লোটাসের বিয়ে না হওয়ার জন্য পরিবারের পীড়নে বিমর্ষ লোটাসের সঙ্গে শেকাবের সখ্য ছিল গভীর। ব্যর্থ প্রেম, সামাজিক নিপীড়ন ও পারিবারিক যন্ত্রণা লোটাসকে বিষপানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে, এ ঘটনা শেকাবকে দুঃখিত করে তোলে। কিন্তু তারও আগে ঘাস বনের মাঝে সজীব নদী, ভাপে ভেজা দুই পাড় আবিষ্কার করে শেকাব লোটাসের কাছে কৃতজ্ঞ থেকে যায় আজীবন।
লেখকের কল্পনায় গরুচোর লৌহান রুদেবিশের ভাই, তার বাবার অবৈধ প্রেমের ফসল, যার প্রতি কৈশোরিক মমতা, তাকে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল গড়ার ইচ্ছাও তৈরি হয়। এছাড়া লৌহানের সঙ্গে লোটাসের ভন্ড প্রেমিক ও বন্ধুদের খতম করার স্বপ্নও বিস্তৃত হয়েছে।

উপন্যাস । প্রকাশক: সৃজন । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মূল্য: ৪৫০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/290130
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮
উপন্যাসের প্রথম অংশের শেষে পিতা আর খ্যাপাবুড়ির খুনিদের খুন করার মতো ঘটনাও তার জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত। এ ছাড়া নায়কের শৈশব-কৈশোর ছাড়িয়ে দূরদূরান্ত কল্পনায় শুধু নারী ছাড়া আর তেমন কিছু ভাবনায় আসেনি। উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশে লুনাভা মিনির প্রতি রুদেবিশ শেকাবের রোমাঞ্চকর গভীর প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। পাঁচ-ছয়শ বছর বাঁচার আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়। ঘৃণার বন্ধুত্বকে প্রেমের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে অস্থিরতায় চরম ভুল হয়ে যায়।
ভুলের করুণ আখ্যানের চরম পরিণতিতে পাঠকের হৃদয় বিদীর্ণ হয়। দারুণ উপমা আর বিশ্লেষণের দ্বিতীয় অংশটি আলাদা উপন্যাস হতে পারত। নতুন আলো পুরোনো হয়ে নিভু নিভু দ্বীপ জ্বেলে যেতে পারত। ৪০ অধ্যায়ের ১৮২ পৃষ্ঠার ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ এর লেখক হারুন আল রশিদের উপন্যাসটি ট্রাজেডি হলেও, উপন্যাসটিতে রয়েছে গভীর জীবনবোধ, রসবোধ এবং শৈল্পিক কারুকাজ।
উপন্যাসের জগৎটি কাল্পনিক হলেও, আমাদের আশপাশে এরকম অনেক ঘটনা আমরা দেখতে পাই; যার দারুণ এক শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন উপন্যাসিক। যার জাদু পাঠককে নিয়ে যায় উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের শেষে লেখক জীবন উপভোগের আহ্বান জানিয়েছেন, বলেছেন ভালোবাসুন। প্রেম করুন। ‘প্রকৃতি আপনাকে দুঃখ ভোগের জন্য সৃষ্টি করেনি।’
সুখী হওয়ার অনেক উপাদান আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে আছে। অনেক সহজে সুখী হওয়া যায়, বেঁচে থাকা যায়, আনন্দ উপভোগ করা যায়, উপন্যাসের পরতে পরতে লেখক সেই বিষয়টি দেখিয়েছেন। রুদেবিশ শেকাবের মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণ বইয়ের মাঝে লেখক বর্ণনা করেননি। তবে পাঠকের চিন্তার খোরাক তৈরি করে দিয়েছেন।
দীর্ঘ প্রস্তুতির পর, কাল্পনিক জগতের এক জাদুকরী উপন্যাস সৃজন করে পাঠককে মোহাবিষ্ট করার দিকে অগ্রসর হয়েছেন; যা পাঠকের চিন্তার সীমা প্রসারিত করে। লেখকের ভাবনার গভীরতা দিয়ে তিনি বিশ্বসাহিত্যে নিজস্ব ধারার একটি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, মিখাইল লেরমন্তভের—‘আমাদের সময়কার নায়ক’ অথবা নিকোলাই অস্রভোস্কির—‘ইস্পাত’ বা সুনীল/সমরেশ/ শীর্ষেন্দুর উপন্যাসগুলো পড়া শেষে অনেক্ষণ বুঁদ হয়ে বসে থাকতাম। ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’-শেষ করে অনেকদিন পর আবার সে অনুভূতি ফিরে পেলাম।