মহুয়ার মুখ
আমার প্রেমিকার মুখ পাকা ধান ক্ষেতের মতো সচ্ছল
প্রতিমার মতন নিখুন তার চোখ ও নাকের গড়ন
যাকে পাঠের পর ধানের শীষের ন্যায় নুয়ে পড়ে মন
মন খারাপের মৌসুমে তার চোখ ও মুখের বীজতলায়
জমাট বাঁধে সদ্য লাঙলে চষা নরম থলথলে কাদা
যেন এখনি চুমু রোপণের সমূহ ছলছল হাতছানি।
তালপাখার বাতাসের মতো ঠাণ্ডা তার বুক!
যেখানে সকল দীর্ঘশ্বাস কলমিফুলের মতো নীলাভ কোমল
শারীলিক ঘ্রাণে শিশুর মতো অবুঝ হয়ে পড়ি
যেন এখনি সব ক্লান্তি তার সবুজ ব্লাউজে মুখথুবড়ে পড়বে।
তার গায়ের রঙ রসালো আপেলের মতন কোমল
যখন অভিমানে সোনালু লতার মতো দোল খায়
রক্তজবা ফুলের মতো তার নাভিতে ঝড়ে পড়ে স্বাদের ঠোঁট
তবু তার বটের পাতার গাঢ় গায়ে ল্যাপ্টানো তুলতুলে মন
শারীলিক ছায়ার আবডালে লুকানো অন্য রহস্যের ইশারা।
মহুয়ার ঠোঁট গমের রুটির মতো সুস্বাদু!
এবং তার কপালে বসানো
পুরুষ মৌমাছিকে ক্ষমা করার মতো উদারতর টিকলে
আর চোখের ভ্রু যেন পানসি নৌকো
এখনি চড়তে না পারলে শিউর স্বর্গ্ন হারানোর আফসোস।
সে মাতৃভূমির ডালে ফুটে আছে ভুঁইচাপা ফুলের মতো
যেন পৃথিবীর অন্য কোনো ভূমির চেয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
রূপালী বাজারবার
সাপুড়ে আসতো দূর থেকে
সে কী মানুষ জমানো খেলা
যাদুকরও আসতো
নানান ফর্দের জামা পরে
তাকে সৎ ভাই মনে হতো আমার।
মানুষকে চমকে দেওয়ার মাস্তানি
কীভাবে যেন আমার ভেতর ঢুকে গেল!
বয়সের বড় কোনো মেয়েকে চোখ মেরে দিতাম
চাচতো, খালাতো বোনকে চুমু
অবাক করার বদলে এভাবে
চুরি-ডাকাতিতে মন পেকে গেল!
বাক্সোর ভেতরে এক থুতথুড়ে বুড়ো
প্রায়ই মজার মজার ছবি দেখাতো
তাকে আমার নকল মনে হতো
এখনো আমার জমানো মানুষ
গমগম করা বাজারবার
আর নিভৃত প্রেমিকার মতো কবিতা
চেপ্টা করে রেখে যায়।
পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধে এতো নেশা
দাদীর জন্য পান-তামাক মাস্ট
বাবা ক্ষেত থেকে পটল তুলতেন
আমি তার পিছু পিছু
মরা বোয়ালমাছটা কাঁধে নিয়ে
ঘর থেকে বাজারের দিকে বেরিয়ে যেতাম
সেই শহরের ধাঁধাঁ লাগা ঘোর
এখনো কী আলো কাঁটার মাছের মতন
আমাকে শিকার করে নিল?
হারিকেনের চিমনি থেকে সন্ধেবেলায়
মা যেন মুছে ফেলছেন পৃথিবীর তাবৎ অন্ধকার
মা আমাকে ডাকছেন
ঘরে আয়..রে বাপ
বই পড়তে বস..
মা জানেন না—
বইয়ের আলোতে
মনের আধার দূর হয় না
আজ কি টিভিতে টিপু সুলতান?
আলিফ লাইলা?
আমাকে মাতাল রাখে রূপালী বাজারবার।
চিরকাল
বীজ হবো বলে
চিরকাল
মেখে রাখি গায়ে মুখে
কাদা
কৃষ্ণের বিরহ
ওগো
বোঝে শুধু রাধা
আমাদের স্বপ্ন
রাত, তারা
সবকিছু শাদা
এ কী খোদা
লাগে ক্ষুধা
ভাতগুলো হায়
স্বপ্নের মতন
সাদা
ধানের কাহন
কৃষিজ্ঞান
রাষ্ট্র বোঝে?
আমাদের পিঠে
সমস্ত অবুঝ
গাঁধা!
সঞ্জীবনী সম্মোহন
ফুলের মতন তোমার জীবন ছিল
অথচ কেন জানি মৌমাছির টইটই বেছে নিলে
কিসের সম্মোহনে?
আমৃত্যু মৌমাছি হতে চাই
পরের জীবনে হবো না ফুল
আমার খুব মধুর লোভ
আমি বেঁচে থাকার মোহে
তোমাকে পান করে যাই।
কিন্তু এ কি জীবন বলো?
বিষের চেয়েও ভয়ংকর
অমর হবো আমি সখা
মহুয়া ফুলের ভেতর
সাপশত্রু
সাপের খাবার চিরকাল ব্যাঙ
তাতে তার অপরাধ কই?
আর ব্যাঙের শত্রু তো সাপ
কিন্তু তাতে কী থেকে গেছে পৃথিবী?
বেঁকে গেছে কারো জীবনের পথ?
প্রাণের স্তর নির্মাণ করা এই মানুষ
নিজেকে দাবি করে শ্রেষ্ট কসাই!
বাসীমুখে
জ্যঁ গদার সিনেমা দেখতে দেখতে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
সাধারণত বাসীমুখে আমি বউকে চুমু খাই
তার জন্মদিন ছিল
রাতভর ছিল বৃষ্টির বাসর
জেগে থাকা পাখির নেশা ছিল মনে
শরীরে ছিল আড়মোড়ানো আলসেমি
সকালে তার মুখে গিয়ে ভর করে বাদামী আদর
হঠাৎ ইউরোপ থেকে আসিফের ফোন
আর্মেনিয়া হারিয়েছে শত সৈন্য
মনে পড়ে বাকু শহরের মিষ্টি জয়নাবের কথা
ততক্ষণে খুলে গিয়েছিল স্ত্রীর বেণী
ঘরে-মনে যুদ্ধ নিয়ে কার কাছে যাবো?
এখন কে বেশি দামি?
প্রেমিকা নাকি বউ?
বিছানায় রোমান্টিক কবিতা
আর মনে উত্তরাধুনিক কোলবালিশ গুজে
বিচ্ছিন্ন জীবনের কথা গুছিয়ে রেখেছি বিরহে
তবু মেঘলা দিনে
আপনার
এমন পরকীয়া কবিতা লেখা মানায় না!
মাটির আঁচল ছোঁবো
মায়ের কথা খুউব… মনে পড়ছে। মাটির কথাও। বাবার মাঠের ধান কেমন আছে? খুব ইচ্ছে করছে তাও জানতে। দাদির তইতইগুলো; সারা দিন কানের কাছে প্যাকপ্যাক করে। নানির হাতের চুড়িদুটো; নানা মরার পর কেমন যেন রংচটা হয়ে গেছে! পীরো চাচা মরলো—মনা কবরে গেল—আলি হাসানের টুকটুকে মেয়েটাও নাকি চলে গেছে জম্মের মতো! কাউকে দেখতে পেলাম না।
মা আমি তোমার কাছে থাকবো—আর মাটির ঘরে শোবো। আমার আর কোনো চাওয়া নেই। আমি কৃষকের ছেলে মা—মাটি জল কাদা ছাড়া কীভাবে বাঁচি?
বাবা; তুমি মন খারাপ করলে নাকি? তুমি মাটিতে বীজ দাও—আমি এসে মমতার মই দিবো।
নাগরিক
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দরজা দুটো
পাশাপাশি বসে দু’জোড়া জুতো।
প্রতিদিন প্রতিরাতে
প্রতিক্ষণ প্রতিপ্রাতে
জুতোরাই গল্প করে—বেশ ভালো আছি!
দুঃখ আছে বুকে তবু মুখে হাসি।
জুতোরা প্রভুরা—করমোশালায়
পা-দের পরিচয় হয়নি;
একই ময়দানে যৌথচোখ—
কখনো হয় না সামনা-সামনি।
ফসলপ্রেমিক আব্বা- এক
ধান চাষ করা লস
তার চেয়ে লাভ চাল কিনে খাওয়া
এ কথা আব্বাকে বলি আমি
আমার নিরিখে তিনি বললেন—
তোমরা শিক্ষিত—অঙ্কে পাকা!
লাভ-লসের হিসাব
সহজে কষতে পারো তাই
আমি তো কৃষক; ফসলপ্রেমিক মন
প্রেমিকা গাভিন ধান ছাড়া
দেহের গোলা কি দিয়ে ভরব বাজান?
ফসলপ্রেমিক আব্বা- দুই
চাষ করে আব্বা শুকনো মাটি ও জল
চারা পেতে বীজ দেন আকাঙ্খার ফল
ধান বুনা শেষ
শালিকে শালিকে ক্ষেত মেতে ওঠে বেশ
সবুজে সবুজে ঘেরা ছোট ছোট মাঠ
আল বাঁধা ভূঁই যেন জলে আঁকা খাট
এই বুঝি মা এলেন, মার নাম শোরা
থালে পান্তাভাত নুন-নারকেল কোরা
খেঁজুর গুড়ের মতো কাঁদা
বাবা চেয়ে চেয়ে দেখেন মা যেন রাধা
সে কাঁদায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে ধান
ভেজানো সুপোরি দিয়ে বাবা খান পান
পৌষে মোষ মাঘে বাঘ ফুলে ফালগুন
চৈত্রের গরম ঠোঁটে বাবা দেন চুন
কীভাবে কাটছে ধান বোশেকের মাস
ফসলের গন্ধ মেখে বাড়ি ফেরে হাঁস
ঘরের চালের ’পর বাঁকা ভুরু চান
আমার গ্রামের নাম বাজান.. বাজান…
পৃথিবী লাগছে পিছু বাঁচান বাঁচান
গ্রামকে শহর নয়, সিটি হোক গ্রাম।